পিকাসোর জীবনটাই যেন বিরাট শিল্পকর্ম
পিকাসোর জীবনটাই যেন বিরাট শিল্পকর্ম

যাদের অবদানে সভ্যতার পতাকা আজও মাথা উঁচু করে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। যে সকল মনীষীদের কর্ম প্রচেষ্টার যোগফলে শিল্প-সাহিত্যের চরম উৎকর্ষতার যুগে আমরা আজ বসবাস করছি। যাদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে শিল্প সমঝদার মানুষরা অধীর হয়ে থাকেন। যেকোনো কল্পনাকেই যিনি জীবিত ফুটিয়ে তুলতে পারেন তার নিপুণ হাতের তুলিতে, তিনি আর কেউ নন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো।

স্পেনের ভূমধ্যসাগরীয় দক্ষিণ উপকূলে কাতালান প্রদেশের মালাগা শহরে পিকাসোর জন্ম ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর। বাবা ডন জোস রুইজ ব্লাসকো ছিলেন আর্ট কলেজের শিক্ষক এবং মিউজিয়ামের কিউরেটর। মায়ের নাম মারিয়া পিকাসো লোপেজ। ডন জোস ছেলের নাম রাখলেন পাবলো নেপোমুসেনো ক্রিসপিনয়ানো দ্য লা সান্তিমাসসিমা ত্রিনিদাদ রুইজ পিকাসো। বড় হয়ে শিল্পী নিজের নাম রাখলেন পাবলো পিকাসো। এই নামেই তিনি আজ জগৎবিখ্যাত ।

শিশুবেলা থেকেই ছবির প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল পিকাসোর। তিন বছর বয়সের কালেই শিশু পিকাসো একটা পেনসিল কিম্বা কাঠ-কয়লা পেলে কাগজ অথবা মেঝের উপরই ছবি আঁকতে আরম্ভ করে দিতেন। তবে তার ছবি আঁকার হাতেখড়ি ছিল বাবার কাছেই। ১৪ বছর বয়সে পিকাসো ভর্তি হলেন স্থানীয় আর্ট স্কুলের অধ্যাপক বাবা ডন জোসের স্কুলে।

ছাত্র অবস্থাতেই তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন শিল্প জগতে নতুন ধারার প্রবক্তা ভ্যান গঘ, তুলুস লোত্রেক, পল গ্যগা প্রমুখের প্রকাশবাদকে। দেখলেন তাদের চিত্রকলার বিচিত্র বৈশিষ্ট্য। ১৮৯৭ সালে পিকাসো মাদ্রিদের রয়াল একাডেমিতে ভর্তি হলেন। এই সময়ে কিছু তরুণ শিল্পী ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। সকলকে বিস্মিত করে এখানে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর পুরস্কার পেলেন পিকাসো।

মাদ্রিদের পরিবেশ ভালো না লাগায় বার্সেলোনায় বাবা-মায়ের কাছে ফিরে এলেন তিনি। বাড়িতেই একটি স্টুডিও তৈরি করেন। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন পথে, বস্তিতে, জাহাজঘাটায়, জেলেপাড়ায়, সমুদ্রের কূলে আর পতিতাপল্লিতে। যা দেখতেন তাই আঁকতেন তিনি। পথের ধারে বসে থাকা ভিখারি, গির্জার সন্ন্যাসিনী, কারখানার শ্রমিক, রাস্তার কুকুর, বৃদ্ধা কিংবা যৌবন হারানো পতিতা কেউ বাদ পড়ত না তার তুলির আঁচড় থেকে।

স্পেনের অনুকূলে তখন শিল্পের পরিবেশ ছিল না। তিনি স্থির করলেন লন্ডনে যাবেন। পথে কয়েকদিনের অবস্থান করলেন শিল্পের তীর্থক্ষেত্র প্যারিসে। মুগ্ধ হয়ে পিকাসো অনুভব করলেন স্পেন, ইংল্যান্ড নয়, প্যারিসই হবে তার শিল্প-সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। তিন মাস প্যারিসে থেকে ফিরে এলেন বার্সেলোনায়। আর্থিক কারণে প্যারিসে স্থায়ী হতে না পারলেও পরের চার বছর তিনি কখনো প্যারিস কখনো বার্সেলোনায় কাটিয়েছিলেন। ১৯০০ সালে পিকাসোর প্রথম ছবি একটি কপি হাউসের দৃশ্য প্যারিসে প্রকাশিত হলো। এই প্রদর্শনীতে কোনো ছবি বিক্রি হলো না। 

পিকাসোর কাছে নীল রং ছিল বিষণ্নতা আর বেদনার প্রতীক। ১৯০১ থেকে ১৯০৪ তার শিল্পীজীবনের প্রথম পর্যায়ে সমস্ত ছবিজুড়ে থাকত নীল রং। এই সময়টিকে নাম দেয়া হয়েছে ব্লু পিরিয়ড। ইতোমধ্যে পিকাসোর একটি ছবির প্রদর্শনী হলো মাদ্রিদে। ফিরে এলেন প্যারিসে। ছবিতে নীল রঙের বদলে এবার দেখা গেল গোলাপি রং। যাকে বলা হয়েছে পিংক পিরিয়ড। ১৯০৩ সাল থেকেই তার ছবিতে এলো গাঢ় কালো সীমারেখা।

অল্পদিনের মধ্যে তার ছবি শিল্প সমঝদার মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। যে সময়ে শিল্পীরা আর্থিক কষ্টের মধ্যে সংগ্রাম করে চলেছেন সেই সময়েই ছবির ক্রেতা পেতে লাগলেন পিকাসো। বেশকিছু ছবি বিক্রি হতেই তিনি স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধলেন প্যারিসে। বারবার সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকত্ব দেয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ফরাসি নাগরিক হননি।

১৯০৭ সালে ‘লে ডিময়সেলস দ্য এভিগনন’ ছবিতে পিকাসোর কিউবিজম ধারার প্রথম সূত্রপাত হয়। ১৯০৭ থেকে ১৯১১ তিনি ধারাবাহিকভাবে তার ছবির মধ্যে একটু একটু করে পরিবর্তন নিয়ে আসতে থাকেন। ছবির ভাষা হয়ে ওঠে জটিল থেকে জটিলতর। ছবির থেকে জীবনের স্বাভাবিক প্রকাশ মুছে গিয়ে জন্ম নিলো এক আধুনিক চিত্রশিল্পকলা। এই সময়ের ছবির মধ্যে অন্যতম হলো ফলের ডিশ, গিটার হাতে মহিলা।

পিকাসো এবং ব্রাকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে প্রচারিত হতে আরম্ভ করল কিউবিক চিত্রকলা। একে বলা হতো কিউবিস্ট কলেজ। সেসময় তার যেসব ছবির মূল্য মাত্র ২ থেকে ২০ পাউন্ডের মধ্যে ছিল তা বর্তমানে এক লাখ পাউন্ডের চেয়েও বেশি।

১৯০৪ সালে পিকাসো যখন আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছেন তখন তার জীবনে প্রথম নারী এলো ‘অলিভিয়ের’। ৯ বছর দুজনের মধ্যে ছিল গভীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। বিবাহ না করলেও দুজনেই থাকতেন স্বামী-স্ত্রীর মতো। ১৯১৭ সালে রাশিয়ান একটি ব্যালে দল নৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য এসেছিলেন প্যারিসে। এই দলের প্রধান শিল্পী ওলগা কোকোলভা। পিকাসো আর কোকোলভা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। ওলগাকে বিবাহ করলেন পিকাসো। বিবাহের এক বছর পর পিকাসোর প্রথম পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, পিকাসোর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কবি ‘এ্যাপোনিয়ার’ আহত হয়ে মারা গিয়েছেন। এই সংবাদ যখন পিকাসোর নিকট আসলো তখন তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রতিকৃতি আঁকছিলেন। বন্ধুর মৃত্যুতে এতখানি বিহ্বল হয়ে পড়লেন, সেই ছবি আর সমাপ্ত করেননি এবং এরপর জীবনে কোনোদিন নিজের ছবি আঁকেননি।

বন্ধুর স্মৃতিকে ধরে রাখতে তিনি আঁকলেন `The Three Dancers’ বা তিন নর্তকী। এই ছবিতে ফুটে উঠেছে মানুষের যন্ত্রণার এক তীব্র বিলাপ। ‘মানবিক যন্ত্রণার এই রূপ’ এরপর নানাভাবে দেখা দিয়েছে তার ছবিতে। তিনি দেখিয়েছেন নিপীড়িত মানুষের ওপর শক্তিমানের অত্যাচার আর অত্যাচার পীড়িত মানুষের যন্ত্রণার করুণ প্রতিচ্ছবি। এরই মূর্ত প্রকাশ তার ‘গোয়ের্নিকা’ ছবিটি।

১৯৩৭ সালে স্পেনের অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ ঘোষণার ফলশ্রুতিতে শাসকদের বোমারু বিমান স্পেনের ছোট্ট শহর গোয়েনির্কার ওপর বোমা বর্ষণ করল। এই ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তিনি। স্পেনের সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া সকল খেতাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তিনি তুলে  ধরলেন অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে। তার ছবি গোয়েনির্কা হয়ে উঠল এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ।

১৯২৭ সাল। পিকাসোর জীবনে এলো আরেক নারী। ‘মারি থেরেসা ওয়ালটার’ নামের এই নারী ছিল পিকাসোর ছবির মডেল। এই সম্পর্কের পরিণতিতে ভাঙন ধরল ওলগার সম্পর্কে। অবশেষে চরম ঘৃণার মধ্যেই দুজনের বিচ্ছেদ ঘটে। মারি ছিল অসাধারণ সুন্দরী। পিকাসোর ছবিতে বারবার কামময়ী নারীমূর্তি হিসেবে দেখা গিয়েছে মারিকে। এরই মধ্যে মারির একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। কন্যা সন্তান জন্মাবার পর দুজনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ তখন পিকাসোর সঙ্গী হয়েছে যুগোশ্লাভ ফটোগ্রাফার ডোরা মা।

অর্থ, খ্যাতি, সম্মান, নারীসঙ্গ পিকাসোর জীবনে অপরিমেয়ভাবে এলেও তা কখনো শিল্পসৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায়নি। শিল্প-সাধনার সময় তিনি উত্তীর্ণ হতেন সাধকের স্তরে। কিউবিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সুরিয়ানিজম, ভাস্কর্য, কারুশিল্প, পোশাক-পরিকল্পনা, মঞ্চসজ্জা, পোস্টার, লিথোগ্রাফ’ বইয়ের অলংকরণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির পর শিল্পজগতের ইতিহাসে এমন বহুমুখী প্রতিভা আর জন্ম হয়নি। তার বর্ণাঢ্য জীবনটাই যেন হয়ে ওঠে এক বিচিত্র শিল্পকর্ম।

১৯৭০ সালে পিকাসো তার সারাজীবনের শিল্পকর্ম বার্সেলোনার মিউজিয়ামকে দান করেন। মাতৃভূমির প্রতি এটি ছিল তার শেষ শ্রদ্ধার্ঘ। ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ফ্রান্সের মুগা শহরে বিশ্বনন্দিত শিল্পী পিকাসোর শিল্পজীবনের চির সমাপ্তি ঘটে। আজ জগৎখ্যাত এই কীর্তিমান চিত্রশিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকী। প্রকৃতপক্ষে পিকাসোর জীবনটাই ছিল শিল্পময় এক ক্যানভাস। মৃত্যুতে যার ক্ষয় নেই। তার জয়গান আজ বিশ্বময়।



সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান