তৃতীয় অধ্যায়
০৪.
মধ্য রাত্রি অতিক্রান্ত হবার পর ভারতের এলাহাবাদ নামীয় নগরটিতে বসবাসকারী মানুষজনের স্বাভাবিক কোলাহল যখন ধীরে ধীরে স্তিমিত হ’তে হ’তে একসময় একেবারেই শুন শান হয়ে যায় তখন এলাহাবাদ এলাকার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে এবং এলাহাবাদের বাইরের এলাকা থেকেও গ্রামের ভেতর দিয়ে অতি সন্তর্পনে বিভিন্ন মেঠো পথ ধরে যতটা সম্ভব মানুষের দৃষ্টিকে আড়াল করে বিভিন্ন দলিত, মথিত নীচু শ্রেণীর অসংখ্য মানুষ তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে এলাহাবাদের সীমানা পেরিয়ে রাতের ঘন আঁধারের বিঘœ সঙ্কুলতার সকল ভীতি এবং ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করে যত দ্রæত সম্ভব সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকে নিঃশব্দে। লক্ষ্য তাদের একটিই পূর্ববাংলার সীমানা ভেদ করে বাংলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করা। পূর্ববাংলায় প্রবেশ করে ওই বাংলাতেই বসতি স্থাপন করবার অভিপ্রায়ের নেপথ্যে যে বিশ্বাসটি ওদের মননে একটি স্থায়ী স্থান করে নিয়েছে সেটি হলো পূর্ববাংলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে অন্ততঃ এলাহাবাদের মতো ওদের ওপর ব্যক্তি এবং দলগত স্বার্থ চরিতার্থ করবার লক্ষ্যে কৃত্রিমভাবে আরোপিত বর্ণ বৈষম্য, ধর্ম বৈষম্য এবং উচ্চ বর্ণীয় হিন্দু ব্রাহ্ম সমাজের নিপীড়ন নির্যাতন নেই। যদিওবা থেকে থাকে তা-ও খুবই নগণ্য বলেই ওদের ধারণা। এ ধরনের ধারণাটি ওরা পেয়েছে এলাহাবাদের কিছু কিছু অঞ্চলের লোকশ্রæতি থেকে। ধারণাটির সত্যসার কতটুকু অথবা আদৌ আছে কি নেই যদিও সেটি ওদের কাছে স্পষ্ট নয় তথাপি বর্ণবান, বিত্তবান আর প্রবল ক্ষমতাধর মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির অসহনীয় নির্মমতার সাথে নিপীড়ন এবং নির্যাতনের কারণে ওরা বাধ্য হয়েছে ওই লোকশ্রুতিটিকেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে। তারপরেও মূলতঃ দেশান্তরনের নেপথ্যে মৌলিক যে দু’টি কারণ অপরিহার্যভাবে এদের চিন্তাশীলতায় সব সময়ের জন্যে প্রবল আকার নিয়ে ক্রিয়াশীল থেকেছে সে দু’টির একটি হলো ০১. ‘ধর্মান্তরনের স্বাধীনতায় অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ’ ০২. ‘ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন কর্তৃক ওদের সম্পদ এবং নারীদের শ্লীলতাহানী এবং পুরুষদের ওপর নির্মম নির্যাতন।’ শুধু শ্লীলতাহানী আর নির্যাতনই নয় ওদের উপার্জনের পথও রুদ্ধ করে দেয় কোম্পানির সৈন্যরা কিছু কুলীন ব্রাহ্মণকে সাথে নিয়ে যাতে নির্যাতিতরা কোনোভাবেই কোনো ধরনের প্রতিবাদ করতে না পারে। আর এসব করতে গিয়ে অধিকাংশ সময় বিশেষতঃ শ্লীলতাহানীর পর হত্যার ঘটনাও ঘটে থাকে। যার কোনোকালেই কোনো প্রতিকার হয় না। এমন কি প্রতিকার চাইবারও কোনো উপায় ওদের থাকে না। কারণ ওরা জানে প্রতিকার চাইতে গেলে বরং আরও একাধিক নতুন মৃত্যুর দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
উল্লেখিত দু’টি মুখ্য কারণ এবং ওই কারণ-প্রসূত বিষয়গুলিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ওরা এলাহাবাদের সীমানা অতিক্রম করে পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করবার জোটবদ্ধ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তটি গ্রহন করবার পরপরই ঠাকুর লাল ওর শূকরগুলি বিক্রয় করে দিয়েছিলো। এই শূকর বিক্রয়ের টাকা এবং হাতে যে সামান্য জমানো অর্থ ছিলো সেই অর্থ এবং নিতান্তই সামান্য টুকিটাকি কিছু ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সঙ্গে নিয়েই গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকেই ওরা ধারাবাহিকভাবে ওদের নিজ গ্রাম থেকে একের পর এক একটি পরিবার সাথে আরও দু’তিনটে পরিবারকে সমন্বিত করে বাংলার দিকে ধাবিত হতে থাকে। সাধারণ উদ্দেশ্য একটিই সন্তান সন্ততি, পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন ধারনের জন্যে সামান্য এতটুকু শান্তি প্রাপ্তি। এই লক্ষ্যটিকে সামনে রেখেই ওরা আজ গভীর রাতে ওদের নির্দিষ্ট গ্রাম থেকে চারটি পরিবার এক সঙ্গে বেরিয়ে এসে যাত্রা শুরু করেছে পূর্ব বাংলার উদ্দেশ্যে। গ্রামের ঝোঁপ-ঝাড় পরিকীর্ণ অত্যন্ত সরু মেঠোপথ দিয়ে খুব দ্রুত গতিতে এগুবার চেষ্টা করছে সামনের দিকে। কেউ যেন কোনোভাবেই চ্যাচামেচি অথবা কান্নাকাটি না করেÑ এ কথাটি খুব ভালোভাবে ওরা ওদের নারীদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে। ওদের নারীরাও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে ওদের পুরুষদের নির্দেশ। এ রকম একটি দলের সাথে ঠাকুর লালের পরিবারটিও ছিলো। তবে হাঁটতে গিয়ে ঠাকুর লালের পরিবারটি একটু পিছিয়ে পড়েছিলো।
ঠাকুর লালের পরিবারে ছিলো মোট চারজন সদস্য। ঠাকুর লাল নিজে, ওর স্ত্রী, একটি কন্যা বাসন্তি এবং বাসন্তির স্বামী রাম দেব, রাম দেবকে ওরা রাম দেব না ব’লে ‘রাম দেও’- বলেই সচরাচর ডাকতো। তিন বছর আগে বাসন্তির বিয়ে হয়েছে। মাত্র চার মাস আগে বাসন্তি একটি মৃত কন্যা সন্তানের জন্ম দান করে। কিন্তু মৃত সন্তানটি দেখবার পর থেকে বাসন্তি কেমন যেন অসংলগ্ন হ’য়ে পড়ে। মৃত সন্তানটিকে প্রসবের বিষয়টিকে ও মেনে নিতে পারে নি। এটিকে ওর নিজের অনবধানতার কারণেই ঘটেছে ব”লে ও রাতদিন ভাবতে শুরু করে। যদিও মৃত সন্তানটি প্রসবের ক্ষেত্রে বাসন্তির কোনো কিছুই করবার ছিলো না। বিষয়টি ওকে পরিবারের সবাই বুঝিয়েও ছিলো। বিশেষতঃ ওর স্বামী রাম দেব ঘটনাটিকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়ে বাসন্তিকে অনেক সান্ত¦নাও দিয়েছিলো। কিন্তু কোনো সান্ত¦না অথবা সাহস কোনো কিছুতেই আস্থা রাখতে পারে নি বাসন্তি। বারবার নিজেকেই দায়ী করেছে ওই মৃত সন্তানটির প্রসব করবার কারণ হিসেবে। দিনের পর দিন কেমন যেন ধীরে ধীরে মিইয়ে আসছিলো বাসন্তি। *****।
এই মৃত সন্তানটি জন্মানোর নেপথ্যে বাসন্তির বয়সের স্বল্পতাও যে হয়তো একটি কারণ হ’য়ে থাকতে পারে এ কথাটি মোটেই বিশ্বাস করেনি বাসন্তি। ওর ভেতরটি যেন পাখিদের গুঞ্জনবিহীন, দক্ষিণের সমীরন বিহীন, বৃক্ষ শাখার পত্র-পল্লব বিহীন এক বিবর্ন ধুসর মরুভুমি হ’য়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এ নিয়ে ওদের পরিবারের কারুর মধেই কোনো ক্ষোভ অথবা দুঃখবোধ ছিলো না এবং এখনও নেইও। তবে ঠাকুর লালের স্ত্রী মনে মনে চাইতো ওর একটি নাতি অথবা নাতনি আসুক। কিন্তু কখনই কথাটি ও কোনোভাবেই কারুর কাছে প্রকাশ করে নি। আর যদিওবা এলো তা-ও মৃত। তারপরেও বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নিয়েছে ওর মা।
ওদের দলের সবাই যখন অনেকটাই সামনের দিকে এগিয়ে গেছে এবং ওরাও আরও দ্রæত গতিতে এগিয়ে যবার চেষ্টা করছে কিন্তু বাসন্তির শারীরিক দুর্বলতার কারণে দ্রæত এগিয়ে যেতে পারছিলো না। মাঝে মাঝেই থেমে পড়ছিলো পথের মধ্যিখানে। শেষবার যখন বাসন্তি আবার দাঁড়িয়ে পড়লো ঠিক তখনই পথের পাশের ঘন ঝোঁপের ভেতর থেকে একটি সদ্য জন্মিত শিশুর কান্নার মিইয়ে আসা শব্দ ওর শ্রবনে আঘাত করে বসলো। কান্নার শব্দটি বাসন্তিই প্রথম শুনতে পেলো। একবার দু’বার, তিনবার শব্দটি থেমে থেমে আসতেই থাকছে। দাঁড়ানো অবস্থাতেই কান্নাটি যেদিক থেকে আসছে সেদিকে কান পাতবার চেষ্টা করলো। এমনিতেই গভীর রাত্রি, সূর্যোদয়ের আগেই বাংলায় প্রবেশ করতে হবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন অরন্যের ভেতর দিয়ে যেন ওরা হাঁটছে। শিরশিরে বাতাস, সে বাতাসের আঘাত ঝোঁপ ঝাড়, বৃক্ষশাখার সব পত্র পল্লবকে ঘর্ষিত করে পৃথক একটি ত্রাসের সৃষ্টি করছে। আর এই ত্রাসের কারণে একটি অদৃশ্য আতঙ্ক সব সময়ের জন্যেই ওদের মনকে একটি চরম ভীতিসঙ্কুলতায় মুহূর্মুহু কাঁপিয়ে তুলছে। যদি ইংরেজ সৈন্যরা এর মধ্যেই এসে পড়ে অথবা ওদের আজ্ঞাবহ কেউ- তাহলে তো ওদের কপালে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই জুটবে নাÑএটি ওরা খুব ভালো করেই জানে। আর এ রকমের একটি সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে বাসন্তি কিনা দাঁড়িয়ে পড়লো! অত্যন্ত ক্রোধের সাথে খুবই চাপা কণ্ঠে ঠাকুর লাল বাসন্তিকে কতকটা ধমকের সুরেই বললোÑ ‘ কা ভইলবারে বাসন্তিয়া, খাড়া কিঁউ হো গৈলবা?’ব’লে বাসন্তির দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো ঠাকুর লাল। ঠাকুর লাল কাছে এলে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো বাসন্তি ‘ উও ঝোঁপ কি অন্দর কান লাগাকে তো দেখ্ বাপুজীÑ কোই বাচ্চে কি রোনে কি আওয়াজ কা শুনত হো?’বাসন্তির কথাটি শেষ হবার পর সবাই একযোগে নির্দিষ্ট ঝোঁপটির দিকে কান পাতলো। হ্যাঁ, প্রকৃতই একটি মানব শিশু থেমে থেমে ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর রাম দেব আর অপেক্ষা করলো না। শুধু বাসন্তিকে বললোÑ ‘চল্ হামরেকো সাথ।’ দু’জনই পা বাড়ালো সেই বিদ্ঘুটে আঁধারে আবৃত ঘন ঝোঁপের ভেতরের দিকে। ঝোঁপের মাঝামাঝি গিয়ে ওরা ঠিকই দেখতে পেলো কয়েক ঘণ্টা আগেই প্রসূত একটি শিশু চিত হ’য়ে অনবরত কেঁদেই চলেছে। খুব দামী একটি তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো শিশুটির শরীর। দু’গালে দু’হাতে রক্তের দাগ এখনও লেগে রয়েছে। আর মোটেই দেরী করলো না বাসন্তি। শিশুটিকে কোলে তুলে নিলো। কোলে নিয়ে দেখতে পেলো বাচ্চাটি একটি কন্যা শিশু। বাসন্তি ওকে কোলে তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির কান্না আপনা আপনিই থেমে গেলো। কিন্তু হাত পা ছড়ানোটি থামলো না। বাসন্তি বুঝতে পারলো ওর ক্ষিধে পেয়েছে। বাসন্তি মৃত সন্তান করেছে কিন্তু দু’টি স্তনেই যেন দুধের জোয়ারের বান ডেকেছে। এ দুগ্ধ পান করবার কেউ না থাকবার কারণে আপনা আপনি স্তন দু’টি থেকে দুধ ঝ’রে পড়ে ব্লাউজ ভিজিয়ে দিয়েছে প্রতিদিন। মাঝে মাঝে প্রচন্ডভাবে টন্ টন্ করে উঠতো স্তন দু’টি। সহ্য করতে পারতো না বাসন্তি। বাধ্য হ’য়ে নিজের দু’হাত দিয়ে স্তন দু’টিকে টিপে টিপে দুধ বের করে দিতো। এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতো বাসন্তি। চঞ্চল হ’য়ে উঠলো বাসন্তি। ওর স্বামীকে বললো ‘ চল্ রাম দেও, ইয়াহাঁ অওর নেহি। ইসে দুধ পিলানা হ্যায়, দুধ পিলাতে হোবেক। হামরে বুক মে তো বহতহি দুধ হ্যায় ওহি দুধ ইসে পিলাউঙ্গি ম্যায়।’বলেই ঝোঁপের ভেতরেই ওর একটি স্তনের বোটা ঠেসে ধরলো শিশুটির দু’ঠোঁটের মাঝে। শিশুটিও দুধ পান করতে শুরু করলো নিঃশ্বাস বন্ধ করেই যেন। ওদের এবং শিশুটির ভাগ্য ভালো যে, এই সময়ের মধ্যে কোনো কুকুর শৃগাল অথবা অন্য কোনো জীবজন্তু বাচ্চাটির কান্নার শব্দ শোনেনি এবং বাচ্চাটিকে প্রত্যক্ষ করে নি। যদি করতো তাহলে এতক্ষণে বাচ্চাটি ওদের আহার্যে রূপান্তরিত হ’য়ে সাবার হ’য়ে যেতো।
বেরিয়ে এলো দু’জনই। বাচ্চাটিকে পেয়ে বাসন্তি যেন আকাশে জেগে থাকা পূর্ণ চন্দ্রিমাটিকে ওর বুকের ভেতর পেয়ে গেছে। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো উচ্ছাস যেন আর কিছুতেই নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারছে না বাসন্তি। চঞ্চলা হরিনীর মতো যেন অস্থির হয়ে উঠেছে যার প্রমাণ ওর প্রতিটি কথাতেই ঝ’রে পড়ছে। বারবার ক’রে বাচ্চাটির মুখের দিকে পরম আদরে চেয়ে চেয়ে দেখছে। ওর ঠোঁটে নিজের হাতের আঙ্গুলের স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। টানা টানা দীর্ঘ চোখ দু’টির দিকে তাকাচ্ছে। ভ্রণ দু’টি দীর্ঘ চুল না থাকলেও বোঝা যায় প্রশ্বস্ত ভ্রæ’র লক্ষণ ইতিমধ্যেই ফুটে উঠেছে। ঠোঁট দু’টিতে পুরুত্বের ইঙ্গিত এখুনিই যথেষ্ট এবং টিক টিকে লাল বর্ণের লালিমাপূর্ণ। গায়ের রংটি একেবারেই কালো। সহজভাবে যাকে বলা যায় ‘ কুচকুচে কালো।’ তার চাইতেও যেন মনে হয় আরও কালো মাথাভর্তি একরাশ চুল। অথচ শিশুটির গায়ের রংটি নিয়ে বাসন্তির কোনো ক্ষোভ অথবা দুঃখবোধ এতটুকুও নেই। ও জানে সন্তানটি ওর নয় তারপরেও এর মধ্যেই ও শিশুিিটকে একান্তই আপনার ক’রে নিয়েছে। নিজের দু’হাতের মাঝে শিশুটির দু’টি হাত নিয়ে বিস্ময়াভিভূতের মতো কোনো বিরতি না দিয়ে দেখেই চলেছে বাসন্তি শিশুটির হাত দু’টিকে। হাত দু’টি যেন ওর সুনিপুন সুডৌল মৃনাল বাহু। হাতের আঙ্গুলগুলি দীর্ঘ এবং মসৃণ। ওর হাত দু’টি নিয়ে বারবার নিজের গালের সাথে খুবই আলতো ক’রে স্পর্শ নিচ্ছে ওর। একজন নারীর কাছে একটি সন্তান যে কত কামনার, কত স্বপ্নের, কত প্রিয় নিজের সন্তান না হলেও শিশুটির সাথে বাসন্তির আচরণ প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে বিষয়টিকে। ওর বাবা ঠাকুর লালও খুশি হয়েছে খুবই। কন্যার খুশি দেখে বাবাও যেন আবেগে আপ্লুত হ’য়ে পড়েছে। বিয়ে হবার তিন বছর অতিক্রান্ত হবার পর যে সন্তানটি প্রসব করলো বাসন্তি সেটিও মৃত। এটি যে কত বড় মর্মযাতনা বাসন্তির বোঝে ঠাকুর লাল। আর সে প্রেক্ষিতটি বিবেচনা করেই কন্যার সাথে সাথে পিতাও আনন্দে উচ্ছ¡সিত। অন্ততঃ বাসন্তিকে বাঁচাবার একটি অবলম্বন যেন ঈশ্বরই জুটিয়ে দিয়েছেন বাসন্তির কপালে। কাছে এসে বাসন্তিকে বললো ঠাকুর লালÑ‘লে বাসান্তি, আজছে ইয়ে বাচ্চে তুহারকেহি হোবেক। তুঝেহি ইসে বড়া করনা হোগি, ইসকি মাতাজি বন্নে হোগি, লিখ্যাই পড়হাই শিখানা হোগি। তেরিহি দুধ পিল পিলকে ইয়ে বড়া হো যায়েগি। কেয়ারে তু সমঝতি তো হামরেকো বাত?’ কথা শেষ করলো ঠাকুর লাল। কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে রাম দেব ব’লে উঠলোÑ‘হাঁ বাপুজী তুহার বাতহি সহি হ্যায়। হামসব মিল করকে ইয়ে বাচ্চেকে লিয়ে সবকুছ করেঙ্গে।’ রাম দেবের কথা শেষে ঠাকুর লাল ওদেরকে তাড়া দিলো‘চল্ বহতহি দেড় হো গৈলবা। দুস্রে রাস্তেছে হামরেকো বাংলা পহচ্না হোগা।’ শুরু হলো ওদের ভিন্ন পথে পূর্ববাংলার উদ্দেশে যাত্রা। এতক্ষণ বাসন্তির মা কোনো কথাই বলে নি। এবার বাসন্তির কাছে এসে শিশুটিকে নিজের কোলে তুলে নিলো। আদরে আদরে যেন ভরিয়ে দিতে চাইলো শিশুটিকে। ইতিমধ্যেই ওরা চলতে শুরু করেছে। সামনে ঠাকুর লাল। ঠাকুর লালের পেছনে ওরা সবাই। কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর ওই পথটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর একটি সরু পথ যেটি এঁকেবেঁকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সম্মুখের দিকে মিলিয়ে গেছে সে পথটি ধ’রেই এগিয়ে যেতে থাকলো ওরা। যদিও এই পথ দিয়ে ওরা বাংলায় পৌঁছুতে পারবে কিনা জানে না তবুও এগুতে থাকলো। তবে জঙ্গলা এই পথগুলি সম্পর্কে ঠাকুর লালের মোটামুটি একটি ধারনা ছিলো। যেহেতু ওর শূকরগুলিকে খাওয়াবার জন্যে শূকরের পালকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এসব পথেই ওকে আসা যাওয়া করতে হোতো। কখনো কখনো এলাহাবাদের সীমান্ত পর্যন্ত ও পৌঁছে যেতো। এটুকু অস্বচ্ছ বিশ্বাসের ওপর ভরসা করেই ঠাকুর লাল এ পথ ধ’রেই এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। ওদের সামনের দলটি কতদূর এগিয়ে গেছে জানে না ওরা। ভাবলোও না সে বিষয়টি নিয়ে আর। নতুন পথে নতুন ক’রে যেন যাত্রা শুরু হলো ওদের।
০৫.
বহুদূর পথ হেঁটে হেঁটে ভীষণ ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছিলো ওরা। বিশেষ ক’রে বাসন্তি আর ওর মা যেন কিছুতেই আর হাঁটতে পারছিলো না। বারবার পথের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছিলো। বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলো ঠাকুর লাল। আর বুঝতে পেরেই পূবাকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়েছিলো যে, ভোর হবার জন্যে আর খুব বেশী সময় নেই। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আর না এগুবার। সামনে কোথাও লোকজনের বসতি পাওয়া গেলে আজকের শেষ রাতটুকু আর আগামীকালের দিনটিকে সে বসতিতে কোনো রকমে কাটিয়ে দিয়ে সন্ধ্যের পর আবার যাত্রা করবার। কিন্তু এখন প্রয়োজন শুধু কোনো একটি বসতি খুঁজে বের করা। এবং এই বসতিিিট খুঁজে পাওয়া না গেলে ওদের বাংলায় পৌঁছোনো খুবই দুঃসাধ্য হ’য়ে পড়বে ব’লে ঠাকুর লালের আশঙ্কা। এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় হলো যে কোনোভাবে আর যত কষ্ট করেই হোক একটি বসতি খুঁজে বের করা। তাই সবাইকে সাহস যুগিয়ে, সান্তনা দিয়ে আবারও পথ চলতে শুরু করলো ওরা। আসলেই বাসন্তি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, তারপরওে বাবার নির্দেশ মেনে এগুতে থাকলো সামনের দিকে বাবাকে অনুসরণ করে।
বেশ কিছুদূর এগুবার পর হঠাৎ করে রাম দেব যেন কতকটা চিৎকার করে উঠলো “ উ দেখ্ বাপুজী, কুছ্ ঘর দিখায়ি দে রহল বা। উ, উ দেখ্”বলে ডান হাতটি সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ঠাকুর লালকে দেখাবার চেষ্টা করলো কিছুটা যেন কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট একটি বসতির চিহ্নকে। ঠাকুর লালও কয়েক মুহুর্ত দেঝে নিয়েই বুঝতে পারলো আসলেই রাম দেব ঠিকই বলেছে। সবাইকে নির্দেশ দিলো দ্রুত পা চালাতে। বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর ঠাকুর লাল হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। পেছনের দিকে কান পেতে কি যেন শুনবার চেষ্টা করতে থাকলো। মুহুর্তেই বুঝে গেলো কয়েকটি ধাবমান অশ্বখুরের শব্দ যেন ওদের দিকেই ধাবিত হয়ে আসছে। খুবই দ্রæত সবাইকে নির্দেশ দিলো পথের পাশের ঘণ ঝোপের ভেতর আত্মগোপন করতে। সরু পথের দু’ধারেই থেকে থেকে বিস্তৃত ঝোঁপ ঝাড়। পথটি সরু হলেও একটি অশ্ব চলাচলের জন্যে যষ্ঠে। ঠকুর লালের ইঙ্গিত পেয়ে ওরা চারজন দু’জন দু’জন করে দু’টি দলে ভাগ হয়ে দু’টি ঝোঁপের একেবারে গভীরে প্রবেশ করলো। সবারই আতঙ্কে যেন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। শ্বাস নিতেও ওরা যেন ভীতিতে হিম হ’য়ে যাচ্ছে। একমাত্র কিছু ছোটো ছোটো পাখি যেগুলি উদ্ভিদ জাতিয় অসংখ্য ছোটো ছোটো গাছের পাতার অড়ালে রাত্রি যাপন করছিলো সেই পাখিগুলি শুধু বাসন্তিদেরকে প্রবেশ করতে দেখে ছুটোছুটি শুরু করে দিলো। সাথে কিচির মিচির শব্দ তো আছেই। ওদের ওই কিচির মিচিরের যে শব্দ সেটুকু ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
এদিকে অশ্বখুরের শব্দ আরও ঘনিভূত হয়ে ঠাকুর লালদের ঝোপের প্রায় কাছাকাছি চলে এলো। মুহুর্ত কয়েক পরেই ওই অশ্বখুরের শব্দ ওই ঝোপের একেবারে সম্মুখে এসে থেমে গেলো। অর্থাৎ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর দু’জন অশ্বারোহী সৈনিক এখন প্রায় ওদের মুখোমুখি। অনেক দূর থেকেই সৈনিক দু’জন লক্ষ্য করছিলো কয়েকজন লোক ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে এবং এক পর্যায়ে ঝোপের ভেতর আত্ম গোপনও করেছে। সৈনিক দু’জনের কাছে তীব্র শক্তির যে টর্চ ছিলো সেই টর্চের আলোতে ঠাকুর লালদেরকে খুঁজতে শুরু করলো এবং এক সময় পেয়েও গেলো। কিন্তু আশ্চর্য সৈনিক দু’জন ওদেরকে ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে বললো না। শুধু বললো ”তুমহারা সাথ্ অওর যো সব আদমী থা উছে ইঁহা বোলাও।” নির্দেশ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর লাল এক প্রকার কাঁপতে কাঁপতেই পাশের ঝোপে গিয়ে বাসন্তি আর রাম দেবকে ডেকে আনলো। সবাই সারিবদ্ধভাবে সৈনিক দু’জনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকলো। কোনো শব্দই বেরুলো না ওদের কণ্ঠ থেকে। যেন ওরা একেকজন একেকটি পাথরের মূর্তি দন্ডায়মান সৈনিক দুটির সামনে। বাসন্তি শুধু লক্ষ্য করলো অশ্বের পিঠের ওপর উপবিষ্ট দু’জন সৈনিকের একজন সৈনিকের কোলের সামনে তিন চার বছর বয়সের একটি বাচ্চা বসে আছে মাথাটি বামদিকে কাৎ করে। বাসন্তি বাচ্চাটিকে দেখে আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়লো এই ভেবে যে, ওর কোল জুড়ে থাকা সদ্য ভুমিষ্ট কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটিকেও হয়তো ওরা হত্যা করবে। শিশুটিকে বুকের সাথে লেপটে ধরে আরও জড়োসড় হয়ে পড়লো বাসন্তি। অথচ কাউকে কিছু বলবারও উপায় নেই এই মুহুর্তে কেবল পরিণতি দেখবার জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুণে চলা ছাড়া।
এবার সৈনিক দু’জন অশ্বের পিঠ থেকে নেমে এলো মাটিতে। সরাসরি এসে দাঁড়ালো একবারে ঠাকুর লাল পরিবারের মুখোমুখি। সারে বাচ্চাটির একটি হাত ধরে রাখলো একজন সৈনিক। কিছুক্ষণ ঠাকুর লালের সাথে কথা হলো সৈনিক দু’জনের। সৈনিক দু’জন হিন্দিতে কথা বললো ঠাকুুর লালের সাথে। বোঝা গেলো ওরা কোম্পানীর সৈন্য কিন্তু ইংরেজ নয়। রাত্রিকালীন নিয়মিত টহলে বেরিয়েছে ওরা। ওরা ভরতীয় নেটিভ। ভরতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ ধরণের অনেক নেটিভকে ওরা ওদের সোবাহিনীর অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছেÑ যাদের ওপর ওরা বিশ্বাস স্থাপন করতে পাবে বলে নিশ্চিত হতে পেরেছে। ঠাকুর লালের সাথে সব কথা শেষ করে ওদের সাথে থাকা বাচ্চাটিকে একজন সৈনিক ঠাকুর লালের হাতে দিয়ে শুধু বলেছে“ইয়ে বাচ্চে কো বাচাও। ইসকে বাপ অওর মা’কো হত্যিয়া কিয়ে গ্যায়ে। আংরিজ ফৌজ নে ইয়ে কিয়া। বহত কোশিশ করকে অওর ঝোঁকিকে সাথ হাম ইছে বাচায়া ইস্ লিয়ে কে হাম ভি র্ভাতী হ্যায়। হাম নেহি চাহ্তে কি কোই ভারতী কো অংরিজ ফৌজ নে হত্যিয়া করে। লেকিন বদ্নসীবি কি বাত ইয়ে হ্যায় কে খুদ হাম নে ভি উছহি আংরিজ ফৌজকো হি নওকর বন র্ক গোলামী করতে রহে। ছোড়োঁ ইন বাতোঁকো। তুমহে হাম সবকুছহি বাতায়া আব তুম যাও। অওর শুনো হামরে সাথ তুমহারা যো বাতচিত হূয়া কিছিকে কভি নেহি বাতাওগি। ব্যাস্, তুমহারা সাথ হামারা সোবহি বাতেঁ খতম হো চুকে। আব তুম যাও লেকিন ইয়ে মত ভুলনা কে যাঁহা তুম যাওগে ইছে সাত লে যানে হোগা অওর ইছে বড়া করনা অওর লিখ্যায়ি পড়হায়ি তুমেহি শিখানা, তুমহারি কাম হোগি। ইয়ে তুমহারি র্ফজছে যিয়াদা কুছ হোগি। ওয়াক্ত বহতহি কম, হাম চল্তে।”Ñ এ কথাগুলি বলে সৈনিক দু’জন আার দাঁড়ালো না। দ্রুত অশ্ব ছুটিেিয় যে দিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেলো। ওরা চলে যাবার পর ঠাকুর লাল সবাইকে খুবই নীচু কণ্ঠে বললোÑ ” ইয়ে ফৌজ যো থা না ইয়েভি হামরে দেশ কি আজাদী মাংতি। হাম দিলকে আঁখোছে দেখ্ রহলবা রে বাসান্তি, রাম দেব হামারে ইয়ে মিট্টি বহত জলদহি আজাদ হো যায়েগি। অব্ চল্। আগে হাট্: ওয়াক্ত যিয়াদা অওর নেহি হ্যায় হামরে পাছ।”
আবার চলতে শুরু করলো ওরা ওই বসতিটির দিকে লক্ষ্য স্থির করে। চলতে চলতেই ওদের মধ্যে বেশ কিছু কথাবর্তা হলো। এই কথা বার্তার ভেতর দিয়েই বেশ কিছু সময় পর ওরা পৌঁছে গেলো ওই বসতিতে থাকা একটি বাড়ীর উঠানে। তখনও সন্ধ্যে হয় নি। উঠানে দু দিকে দুটি অর্ধ কাটা বাঁশ প্রোথিত করে একটি বড় জালের দু প্রান্তকে ওই বাঁশ দুটির সাথে বেঁধে একজন আধা বয়সী মানুষ ওই জালটিকে মেরামত করছে। সন্ধ্যের আগে আগে এ রকম একটি সময়ে ঠাকুর লালদেরকে আসতে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো লোকটি। জাল মেরামত বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো লোকটি এবং ওদের মুখোমুখি হয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো লোকটি ‘কই থাইক্যা আইতাছো তোমরা? অহনই তো সইন্ধা অইয়্যা যাইবো। যাইবা কুনহানে তোমরা?”লোকটির কথা শেষ হলে ঠাকুর লাল একটু বসতে চাইলো। আসলে এতদূর পথ হেঁটে এসে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। লোকটি ওদের কথা বুঝতে পেরে ওদেরকে কিছু না বরে বাড়ীর ভেতরে চলে গেলো। ওরা দাঁড়িয়েই থেকে নিজেদের মধ্যে নিম্ন স্বরে কথা বলা শুরু করলো। একটু পরেই বাড়ীর ভেতর থেকে একটি পূরোনো মাদুর নিয়ে এসে ওদের সামনে মাটিতে বিছিয়ে মাদুরটির ওপর ওদেরকে বসতে বললো। সবাই বসে পড়লো ওই মাদুরটিতে। মাদুরটিতে বসেই ঠাকুর লাল সব ঘটনা বর্ননা করতে থাকলো লোকটিকে। ঠাকুর লালের সব কথা শুনে লোকটি কিছুটা যেন বিব্রত হলো এবং একটি ভীতির অস্পষ্ট ছায়া ফুটে উঠলো লোকটির চোখে মুখে। এরপর একটু সময় নিয়ে লোকটি বললো”সবই তো বুঝবার পারলাম, ইংরেজ সেপাইদের কতা না অয় বাদই দিলাম কিন্তু আমি তো হিন্দু না, মসলমান; নদীতে মাছ ধইর্যা কোনো মতে জীবন চালাই। তোমরা খাইবা কী? আমার তো তোমাগো খাওয়ানের তাকৎ নাই। তয় তোমাগো থাকনের ব্যবস্থাডি আমি কইর্যা দিবার পারি। দুইডি ঘর তো খালিই পইড়্যা থাকে। রাইতডি মোটামুটি কাটাইবার পারবা। তয়, কাইল ভোর অওনের আগেই তোমাগো চইল্যা যাইতে অইবো।” লোকটির কথা শেষ হলে ঠাকুর লাল বললোÑ“হাঁ হাঁ বাবু, হামলোগ না রহলবানি। আপ কি তকলিফ হো এ্যায়ছে কোই কাম হাম না করলবা বাবু। ছোটা জাত হোনে কে বাদ ভি ইয়ে হাম পূরা সমঝ গৈলবা। ইত্না নীচা লোগ হাম কভি নেহি ভইলবা বাবুজী।”
”আইচ্ছা ঠিক আছে, আহ আমার লগে।”
এরপর ওদেরকে নিয়ে লোকটি বাড়ীর ভেতর প্রবেশ করে এবং ওরা যে ঘরে থাকবে সে ঘর দুটি ওদেরকে দেখিয়ে দেয়। ওরা একটি ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। ঘরটির ভেতর কিছুই নেই শুধু একটি ভাঙ্গা চৌকি ছাড়া। এবার ওরা দ্বিতীয় ঘরটিতে যায়। সে ঘরটিরও একই অবস্থা; প্রথম ঘরটিতে যদিওবা একটি ভাঙ্গা চৌকি ছিলো এ ঘরটিতে তা-ও নেই। আছে শুদু মাছ ধরবার ছোটো বড় কয়েকটি জাল আর ছোটো ছোটো মাছ ধরবার কিছু সরঞ্জমাদি। তিনটি পলোও রয়েছে ঘরটির এক কোনায়। ঘর দুটি দেখে ওরা মোটেও বিস্মিত হলো না। কারণ এ ধরণের ঘরে বসবাস করতে ওরাও অভ্যস্ত। সত্যি কথা বলতে কি, এ ধরনের ঘরেই ওরা বসবাস করে। মাটির মেঝেতে শুয়ে রাত্রি যাপন করা ওদের জন্যে কষ্টকর নয়। সিমেন্ট দিয়ে মোড়ানো পাকা মেঝে ওরা কোথায় পাবে? বরং মনে মনে এই ভেবে ওরা খুশি যে, একজন মুসলমান তার নিজের বাড়ীতে ওদেরকে থাকবার অনুমতি দিয়েছে। আর কাল বিলম্ব না করে ওরা দুটি ঘরেই ওদের নিজেদের সঙ্গে আনা কাঁথা বালিশ মেঝেতে বিছিয়ে ওরা শোবার আয়োজন খুব দ্রæত করে নিয়ে বাড়ীটির মালিককে ডেকে ওর কাছে কিছু খাবার পানি চাইলো। একটি মাটির হাড়িতে করে কিছু পানি আর দুটি মাটির গøাস ওদেরকে দিয়ে গেলো বাড়ীর মালিকটি, কোনো সঙ্কোচই করলো না লোকটি। লোকটি চলে যাবার পর ওরা ওদের পুটলিতে থাকা মুড়ি, চিড়ে, গুর ইত্যাদি সব বের করে রাতের খাবারের পাটটিও চুকিয়ে দিয়ে ওরা যার যার মতো করে দুটি ঘরে চলে গেলো ঘুমোবার জন্যে। কাল খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আবার ওদেরকে বাংলার সীমান্তের উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে। সে ভাবেই ঠাকুর লাল ওদেরকে আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলো।
মধ্য রাত্রি অতিক্রান্ত হবার পর হঠাৎ বাড়ীর মালিকের শ্রবনে যেন শ্রæত হতে থাকলো কয়েকটি ধাবিত অশ্বের ছন্দবদ্ধ পদধ্বনি। ওদেরকে আশ্রয় দেবার পর মালিকটি কিন্তু ঘুমোতে পারে নি। ওর মনের গভীরেও একটি শিরশিরে আতঙ্ক অনবরত কাজ করে যাচ্ছিলো, যে কারণে ও জেগেই ছিলো। অশ্বগুলি ইংরেজ সৈনিকদের এবং অশ্বারোহী কয়েকজন ইংরেজ যা ওদের হাঁকডাক থেকে বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু সৈনিকগুলি কোথাও দাঁড়ালো না। ওই বাড়ীটির পেছনের রাস্তা দিয়ে ওরা অনেক দূরের কোনো লক্ষ্যের দিকে চলে গেলো। বাড়ীর মালিক এটিকে খুব সাধারণভাবে মেনে নিলো না; যখন তখন আবার ওরা ফিরে আসতে পারে। আর তখন আর একটি সমস্যার সৃষ্টি হবে। আর এ কারণেই নিজের ঘর থেকে দ্রæত বেরিয়ে এসে ঠাকুর লাল যে ঘরে ছিলো সেই ঘরের দরোজায় ধীরে ধীরে ধাক্কা দিতে শুরু করলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ঠাকুর লাল কিন্তু ঘুমোলো না। ও জেগেই ছিলো। যেহেতু ওর মনের ভেতরেও একটি সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিলো এবং সন্দেহ থেকে ভীতি। দরোজায় দুবার ধাক্কাবার পর ঠাকুর লাল কথা বললো ”কৌন্।” বাড়ীর মালিক লোকটি খুব চাপা স্বরে বললোÑ “আমি। দরোজাডি খুইল্যা দেও। জরুরী কতা আছে।” এ কথা শুনবার পর নিঃসঙ্কোচে দরোজাটি খুলে দিলো ঠাকুর লাল। ঘরে প্রবেশ করলো লোকটি। ইতিমধ্যে বাসন্তির মা-ও জেগে উঠেছে। যে ছেলেটিকে সৈনিকরা ওদেরকে দিয়ে গিয়েছিলো সে ছেলেটি দিব্বি ঘুমোচ্ছে। ওদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে যে কথাবর্তাগুলি হলো তার মর্মার্থ এই“কিছুক্ষণ আগেই বাড়ীর পেছনের রাস্তা দিয়ে কয়েক জন ইংরেজ অশ্বারোহী সৈন্য পশ্চিম দিকে চলে গেছে। ওরা ফিরে আসবে কিনা জানা নেই তবে ফিরে যে আসবেই না এমনও কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে কোনো মূহুর্তেই আবার ফিরে আসতে পারে। তোমাদেরকে তো ওই পশ্চিম দিকের পথ দিয়েই বাংলা সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে হবে। পথে যদি ওরা একবার তোমাদেরকে দেখতে পায় তাহলে তো তোমরা ওদের হাতে আটকা পড়ে যাবে। তখন পরিণতি কী হতে পারে তা তোমাদের অজানা থাকবার কথা নয়। কেবল পুরুষ মানুষ হলেও তবু কথা ছিলো; তোমাদের সঙ্গে তো নারীও রয়েছে। তার চাইতে বরং এক কাজ করো আজকের দিনটি তোমরা এখানেই থেকেযাও। কালকে ভোরের দিকে না হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে। আমার ছেলেটিও নদীতে, সকালে ফিরে আসবে। ও ফিরে আসলে সবাই মিলে পরামর্শ করে একটা কিছু করা যাবে। সে রকম হলে আমার ছেলেটিও না হয় তোমাদের সঙ্গে যাবে সীমান্ত পর্যন্ত। তোমরাও বুকে একটু সাহস পাবে। তোমাদেরকে কেনো এতগুলি কথা বললাম এরও কারণ আছে। অনেক বছর আগে আমাদেরকেও ঠিক ইংরেজদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তোমাদের মতো করেই আমাদেরকেও নিজ ভিটে বাড়ী ত্যাগ করে এখানে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এখানে যেটি সবচাইতে অধিক মর্মান্তিক সেটি হলো আসবার পথে আমার দু বছরের চরমভাবে অসুস্থ পুত্র সন্তানটিকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। পথের মাঝেই আমার কোলে ওর মৃত্যু হয়েছে। আমি কিছুই করতে পারিনি। এমন কি ওর সৎকারটিও আমি করতে পারি নি। পেছনে ইংরেজ সৈন্যের তাড়া, আমাদের সবার প্রাণই প্রায় ওষ্ঠাগত। বাধ্য হয়ে মৃত সন্তানটিকে পথের একপার্শে রেখে আমাদেরকে এখানে আসতে হয়েছে নিজেদের ধুকপুকে জীবনটিকে হাতের মুঠোয় করে। পরবর্তীতে সন্তানটির কী হয়েছে আমরা জানি না। হযতো কুকুর শৃগালের অথবা ভিন্ন কোনো জীব জন্তুর আহারে পরিনত হয়েছে। আর এই একটি মাত্র কারণেই আমি আমার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোমাদেরকে আমার বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছি। ভেবেছি এতে যদি আমার সন্তানটির আত্মা এতটুকু হলেও শান্তি পায়! তোমরা নীচু জাতের বলে আমি তোমাদেরকে ঘৃণা করি নি। শেষ বিচারে তোমরাও তো মানুষই, অন্য কিছু তো নও। জাত দিয়ে বিচার করে কি মানুষ হওয়া যায়? যাক, আমি আমার কথাগুলি বললাম-Ñ এখন তোমরা ভেবে দেখো কি করবে।” কথাগুলি বাড়ীর মালিকটি ওর আঞ্চলিক ভাষাতেই বলেছিলো। আমি সবাইকে বোঝাবার স্বার্থে চলিত বাংলায় বর্ননা করলাম। লোকটি কথাগুলি শেষ করে ওদের ঘরে আর থাকলো না। চলে গেলো নিজের ঘরে।
লোকটি চলে যাবার পর ঠাকুর লাল সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসলো। সবাই গৃহকর্থার কথাকেই সমর্থন করলো। কেউই আর আজকের ভোরে যাত্রা করতে চাইলো না। বিশেষ করে বাসন্তি তো নয়ই। বাসন্তির কোলে নিশ্চিন্ত মনে বাসন্তির স্তন পান করে চলেছ্ এই সামান্য কিছু সময়ের সধ্যেই শিশুটি যনে বাসন্তির একেবারে নিজের সন্তান হয়ে গিয়েছে। দুগ্ধ দানরত অবস্থাতেই সন্তানটির গালে চুমু দিযেছে বাসন্তি নিজেই জানে না। ঠাকুর লাল সবই লক্ষ্য করেছে এবং মনে মনে খুশিতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছে। শুধুই ভেবেছে বাসন্তি অন্ততঃ বেঁচে থাকবার একটি অবলম্বন পেয়েছে। মৃত সন্তানটিকে প্রসব করবার পর এই সন্তানটিকে না পেলে বাসন্তিকেই হয়তো বাঁচানো যেতো না। এই বিষয়টি এখন অদৃশ্য মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ঠাকুর লালের মনে একটি বড় মাপের সান্তনা হয়ে দেখা দিয়েছে যা নিজেকে প্রবোধ দেবার মতো একটি যথাযথ উপাদান হিসেবেই গ্রহন করেছে ঠাকুর লাল। ঠাকুর লালের চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো দু গাল বেয়ে। ডান হাতের কব্জির উলটোদিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো ঠাকুর লাল। এর মধ্যেই ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেখেছে আজকে াার এখান থেকে যাওয়া হবে না। জেনে শুনে এতবড় ঝুঁকি নেয়া মোটেই ঠিক হবে না। সিদ্থান্তটি সবাইকে জানিয়ে দিলো ঠাকুর লাল। কেউ কোনো প্রশ্ন না তুলে সিদ্ধান্তটি মেনে নিলো। যার যার মতো করে সবাই আবার শুয়ে পড়লো বিছানায়। বিছানায় শুয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো বটে কিন্তু ঘুমোতে পারলো না শুধু ঠাকুর লাল। শুয়ে বসে জেগেই কাটিয়ে দিলো রাতের অবশিষ্ট অংশটুকু। ভোর পর্যন্ত ইংরেজ সৈন্যরা আর ফিরে এলো না।