সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক এর সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং কর্ম
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ০১ নভেম্বর সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক কুড়িগ্রাম শহরের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এ শহরেই তার কৈশোর এবং তারুণ্য অতিক্রান্ত হয়েছে। তার স্কুল জীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম শহরেরই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। প্রাথমিক বিদ্যার পাঠটি সম্পন্ন করবার পর কুড়িগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে তার শিক্ষার পরবর্তী ধাপটি শুরু হয়। এবং সে বিদ্যালয় থেকেই তিনি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে এস এস সি পাশ করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কুড়িগ্রাম কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। দারিদ্র্যের কারণে তার উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের আকাক্সক্ষাটি পূরিত হয় নি। স্কুল জীবন থেকেই তিনি দারিদ্র্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। কিন্তু এই দারিদ্র্য তার লেখালেখির স্পৃহাকে কোনভাবেই প্রভাবিত করতে পারেনি। স্কুল জীবন থেকেই তিনি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখালেখি শুরু করেন। স্কুল জীবন থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত তিনি কুড়িগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। ইতোমধ্যেই তিনি একটি কাব্য-নাটক সহ ১০ টি ( দশটি) নাটক, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, গীত এবং রাজনৈতিক নিবন্ধ রচনা করেন যা বিভিন্ন জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। নাটকগুলি কুড়িগ্রাম এবং কুড়িগ্রামের বাইরেও মঞ্চস্থ হয়েছে। এখনও তিনি অবিরাম লিখে চলেছেন এবং নাটক নিদের্শনার কাজটিতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখবার চেষ্টা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যে শাখায় তিনি লেখেন নি। তিনি ইতিমধ্যে তার একটি সমাজিক উপন্যাস ‘প্রাণহীন প্রতিকৃতি’ এবং একটি সাহিত্য প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘আত্মদার্শনিক প্রেক্ষিতে কবিতার অবস্থান’ ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও তার আরও দু’টি গ্রন্থ ০১. ‘প্রভূগৃহ’ ( ইতিহাসাশ্রিত সামাজিক উপন্যাস) এবং ০২. ‘ আক্রান্ত নীলাচল’ (কাব্য গ্রন্থ)। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি সরকারী এবং স্থানীয় পর্যায়ের বহু সংস্থা থেকে অসংখ্য পূরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। নাট্যকলায় সর্বাঙ্গিন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ জেলা শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা পুরস্কার-২০১৩’ লাভ করেছেন। এ ছাড়া স্থানীয় ঘএঙ-সহ বিভিন্ন সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন তাকে বিপুল সম্মানে সম্মানীত করেছে। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন না করলেও পরোক্ষভাবে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার সদস্য হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্প, ভারতে আশ্রিত শরনার্থীদের ক্যাম্পে যুদ্ধ চলাকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পথ-নাটক অনুষ্ঠিত করে মুক্তিযোদ্ধা এবং শরনার্থীদেরকে সাহস এবং উদ্দীপনা যুগিয়েছেন।
নাটকঃ
০১.অথবা অরিন্দম।
০২.প্রতীক যেও না।
০৩.এ্যাবসেন্ট ফিলোসফি।
০৪. অর্পিতার চোখে জল
০৫.জ্বলন্ত বর্ণমালা।
০৬.সুমনের বোন নেই।
০৭.রক্তাক্ত স্বাক্ষর।
০৮.অতৃপ্ত পিপাসা।
০৯.ডঃ শোভন লাল
কাব্যনাটক-
১০.অলৌকিক লোকালয়
গল্পগ্রন্থ-
১১.নির্বাচিত গল্প।
(Selected Best Rtories)
সাহিত্য প্রবন্ধ গ্রন্থ-
১২.আত্মদার্শনিক প্রেক্ষিতে কবিতার অবস্থান
উপন্যাস-
১৩. প্রাণহীণ প্রতিকৃতি
(OFF ABSOLUTE ANIMATION)
গল্প গ্রন্থ-
১৪. নির্বাচিত গল্প
১ গীত-
১৫. (গানসমূহ)
০২.
এই বিশাল ঘন অরন্যের ঠিক মধ্যবর্তী একটি ব্যাপক এলাকা জুড়ে প্রায় দুই থেকে অড়াই শত পরিবারের বসবাস। ছোটো ছোটো ঝুপরির মতো দু’তিনটে খুব বেশী হলে চারটি করে ঘর নিয়ে এক একটি পরিবারের বসতবাড়ী। বাড়ী গুলির ঘরের প্রায় প্রতিটি চালাই ঢেউ টিন দিয়ে ছাওয়ানো। খড় অথবা গাছের পাতা দিয়ে ছাওয়ানো চালা নেই বললেই চলে। ওদের ঘরের এই চালাগুলি দেখে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একেবারে দীন হীন চালচুলো বিহীন ভিখিরীর মতো হত- দরিদ্র নয় এরা। তবে কেনোটি ঘর চার চালার, কোনোটি দু’চলার আবার কেনোটি মোটে এক চলার। তবে ঘরের দেয়ালগুলি সব পাঁকা বাঁশের বাতা দিয়ে খুবই পোক্ত করে বাধানো। আর এসব বাড়ীর এ ধরনের ঘরগুলিতেই পরিবারের সদস্যদের রাত্রি যাপন সাথে ঘরকন্না অর্থাৎ রান্না বান্না ইত্যাদি। প্রতিটি বাড়ীর সামনেই এক চিলতে করে আঙ্গিনার মতো জায়গা রাখা হয়েছে যাতে বাচ্চারা খেলাধুলা করতে পারে। আর বাড়ীর পাশে রয়েছে বড় বড় আকারের শূকরের খোয়ার। প্রত্যেকটি খোয়াড়ে ন্যূনতম দশ থেকে পচিঁশটি পর্যন্ত শূকরের থাকবার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সব সময়ের জন্যে এত শুকর ওই সব খোয়াড়ে থাকে না। মোটা মোটা বাঁশ দিয়ে তৈরী এ খোয়াড় গুলির উচ্চতা অনেক বেশী এবং খোয়াড় গুলির গাঁথুনী যথেষ্ট পোক্ত। খোয়ার গুলি এমনভাবে তৈরী করা হয় যাতে হিংস্রর কোনো প্রকারের মাংসাশী জীব জন্তু কোনোভাবেই খোয়াড়ে প্রবেশ করে শুকর গুলির কোনো ক্ষতি করতে না পারে। কারণ এই শুকর গুলিই ওদের অর্থ উপার্জনের একমাত্র মৌলিক উপায়। অবশ্য সহযোগী উপায় হিসেবে আরও একটি পন্থা ওরা অবলম্বন করে। কিন্তু সে উপায়ের মাধ্যমে উপার্জনের পরিমাণ একেবারেই সামান্য। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা শুকরের পাল গুলিকে খাওয়ানো উদ্দেশ্যে জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে পড়লে মহিলারা সংসারের অন্যান্য কাজ কর্ম সেরে অবসর সময়ে বাঁশের বাতা, কাঠি এবং পাতলা করে চেঁছে নেয়া তেমাল জাতিয় কিছু তৈরী করে নিয়ে সে গুলি দিয়ে ধুমচি, ডালি, কুলো, মাছ ধরবার বিভিন্ন উপকরণ তৈরী করে। আর সে দ্রব্য গুলি নিয়ে ওরা ওদের পল্লী থেকে তিন কিলোমিটারের মতো দূরের ‘নীল কমল’ নামীয় একটি স্রাত বিহীন নদীর ওপারে সপ্তাহে দু’দিন করে বসা হাটে বিক্রি করে। এই বিক্রয়ের মাধ্যমে ওদের যা উপার্জন হয় তাতে করে বড় জোর ওদের তাড়ি বানাবার টাকায় কিছুটা সাহায্য হয় মাত্র। সংসারের ব্যয় নির্বাহে ওই টাকা কোনো ভূমিকাই রাখে না। কিন্তু ওদের শূকর বিক্রি সারা বছর ধরেই চলতে থাকে। আজ এক এলাকা থেকে কেউ শূকর কিনতে এলে কাল বা পরশু অন্য কোনো এলাকা থেকে শূকর কিনবার লোক আসে। এভাবেই ওদের এ ব্যবসাটি সারা বছর ধরেই চলে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ওদেরই গোত্রের অনেক লোকজন তাদের প্রয়োজনে এখানে এসে ওই শূকর গুলিকে নগদ অর্থে কিনে নিয়ে যায়। এই পল্লীটিতে যে শূকরের প্রজনন হয় সেটি বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করা ওদের সমগোত্রীয়রা খুব ভালো করে জানে। তাই ওদের কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অথবা কোনো বড় আকারের পুজো পার্বনে ওরা শূকর কিনতে এ পল্লীটিতেই আসে। যদিও ওদের নিজেদেরও দু’একটি করে শুকর আছে এবং ওরাও শূকর প্রতিপালন করে তবে সংখ্যায় একেবারেই নগণ্য। এ ধরনের শূকরের খামার তৈরী করতে গেলে একটি স্ফীত আকারের অর্থের প্রয়োজন হয় যেটি হয়তো ওরা সংকুলান করে উঠতে পারে না। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক শূকরকে ওরা যথেষ্ট চড়া দামে বিক্রি করে। ওরা খুবই আমোদ প্রিয় উপজাতি। ওদের যে কোনো বড় ধরনের পারিবারিক অথবা সামাজিক অনষ্ঠানে আপ্যায়নের বিষয়টিও খুব বড় আকারের হয়ে থাকে এবং সে আপ্যায়নের মেনুতে শূকরের মাংসের সাথে দেশী মদের উপস্থিতি এক কথাতেই অনিবার্য। দেশী মদ বিশেষ কোনো কারণে জোটানো সম্ভব না হলে নিজেদের ঘরে বানানো চোলাই মদ অথবা তাড়ি থাকতেই হবে। প্রতি মাসের পূর্ণিমার রাতে ওরা ওদের পল্লীতে নাচ গানের আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানে গানের সঙ্গে যে সব বাদ্য যন্ত্র বাজানো হয় তার সংঝ্যা মাত্র তিনটি। ঢোলক আর খঞ্জনীর সাথে একটি মাঝারি আকারের মাটির হাড়িÑ যেটি তবলা আর ডুগিÑ দু’টির কাজই এক সঙ্গেই করে থাকে। কেউ একজন সে মাটির হাড়িটির মুখটি নিজের পেটের ওপর চেপে ধরে তবলা ডুগির মতো করে বাজাতে থাকে। নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের তারতম্যের সাথে বাজাবার তালেরও তারতম্য ঘটতে থাকে। এ বাজনাটি দিয়ে বাদক ওই ঢোলকের বাজনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঠোকা দিয়ে চলে। এ তিনটির মাধ্যমেই ওরা মূলতঃ সঙ্গীতে সুর তোলে। এ সুরটি ওদের কাছে যথেষ্ট ভালো লাগে তো বটেই বাইরের কেউ শুনলেও বিমোহিত না হয়ে পারে না। অবশ্য মাঝে মাঝে এরা ঢোলকের সাথে আর এক ধরণের দেশী বাদ্যযন্ত্র ‘ খোল’এরও ব্যবহার করে থাকে। সঙ্গীতের এ যন্ত্রগুলি সবই ওরা ওদের নৃত্য এবং সঙ্গীতের আয়োজনে ব্যবহার ক’রে থাকে।
প্রতিদিনের মতো আজকেও উঠোনের মাটিতে দাগ কেটে এই ভর দুপুর বেলাতেই চার পাঁচটি ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে মিলে ওদের মতো করে এক পায়ে অথবা দু’পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলাধুলা করে যাচ্ছে। এই খেলাধুলাটি বাচ্চাদের কাছে যেন প্রতিদিনের র”টিন ওয়ার্ক। তবে আজকে বাচ্চারা খেলাধুলার চাইতে চ্যাচামেচিই করছে বেশী। এই চ্যাচামেচির সূত্র ধরে কিছুক্ষণ পর পর ওদের মধ্যে ঝগড়াও লেগে যাচ্ছে। আবার সে ঝগড়া কোনো এক সময় মারামারিতেও রূপ নিচ্ছে। এ সময় বাড়ীতে কোনো পুর”ষ মানুষ থাকলে যথেষ্ট গালাগাল অথবা ছোটো খাটো পিটুনি দিয়ে ওদের সে মারামারিটিকে তখনকার মতো থামিয়েও দিচ্ছে। আবার যখন কোনও সামান্য বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া বেঁধে যায় তখন তো লঙ্কাকাণ্ড ঘটতে থাকে, কান পাতাই দায় হয়ে পড়ে। দু’জনই এত জোরে চেল্লা চিল্লি করতে থাকে যে কাকে ওরা কি বলছে সেটি ওরা নিজেরাই জানে না। এভাবে কিছুক্ষণ চলবার পর আবার আপনা আপনি নিজেরাই ওরা থেমে যায়। এ পল্লীর এসব ঘটনা ওদের দৈনন্দিন জীবনের একেবারেই বাস্তব এবং স্বাভাবিক চালচিত্র। ঝগড়া থেমে গেলে স্বামীটি দিব্বি ঘরের দাওয়ায় বসে ঘরে বানানো তাড়ি গিলতে শুরু করে। আর তাড়ি গিলতে গিলতে আড়ষ্ট জীভে জড়ানো কন্ঠে শুরু করে বেসুরো গলায় দুর্বোধ্য সব গান গাইতে যে গানের কোনও অর্থই বোঝা যায় না। একটু আগেই যে ওর সাথে ওর স্ত্রীর তুমুল কাণ্ডটি ঘটে গেছে তার ছিটেফোটাও আর মনে থাকে না তখন।
বাচ্চাদের এই হৈ হুল্লোড় আর চ্যাচামেচির দিকে কোনো প্রকার আগ্রহ না দেখিয়ে বাচ্চাদের মায়েরা একটি জার”ল গাছের নীচে এসে বসে পড়ে যে গাছটির নীচে ওরা প্রায় প্রতিদিনই বসে। আজকেও ওরা ওখানেই ছড়ানো ছিটোনোভাবে নিজেদের উপকরণ সমুহ নিয়ে বসে গেছে ওদের নৈমিত্তিক কাজেÑ ডালি, কুলো ইত্যাদি তৈরী করতে। আগামী কাল ‘ নীল কমলের হাঁট’। হাঁটে বেচতে হবে ওসব। আগের হাঁটের কিছু অবশিষ্ট রয়ে গেছে আর আজকের গুলিসহ আগামী কালকের হাঁটের পণ্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। এ গুলি বানাতে বানাতে ওদের মধ্যে টুকিটাকি কথা বার্তা হচ্ছে, হাসাহাসি হচ্ছে আবার মাঝে মাঝে হয়তো একের সাথে অপরের ঝগড়াও লেগে যাচ্ছে। কিন্তু কাজ থেমে থাকছে না। নিজেদের কাজটিকে ওরা ঠিক পরিপাটি করেই করে যাচ্ছে। এই কাজ করতে করতেই বিকেল পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যের আনাগোনা ওরা বুঝতে পারছে। এই বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে শুর” হয়েছে ওদের কাজ গুটোনোর পালা। কাজ গুটোনো শেষ হলে যার যার বাচ্চাকে নিয়ে ওরা যাচ্ছে টিউবওয়েলের পাড়ে ওদেরকে স্নান করাতে। বাচ্চাগুলি খেলাধুলো করতে গিয়ে ধুলোয় লুটোপুটি খেয়ে একেবারে কিম্ভূতকিমাকার আকৃতি ধারণ করেছে। এমনিতেই তো ওদের কারো পরনে হাফ প্যান্ট আছে তো উর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন, কারো গায়ে উর্ধ্বাঙ্গের মাপের চাইতে অধিক দীর্ঘ অথবা হ্রস্ব ছেঁড়া ফাটা শার্ট থাকলেও নির্বাঙ্গের পুরোটিই উদোম আবার কারো শরীরে কোনো কাপড়ই নেই, একেবারেই ল্যাংটো। তার ওপর আবার ধূলোবালি মেখে একাকার। তাই ওদেরকে এখন স্নান করিয়ে পরিচ্ছন্ন করা হবে। এটি মায়েদের দায়িত্ব, বাবাদের নয়। বাচ্চাদেরকে সন্ধ্যেয় স্নান করানো ওদের প্রচলিত রীতি। পরিবারে প্রধানরা এক একটি করে ছোটো বড় শুকর বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও ওই উপার্জনের অর্থ তারা তাড়ি আর মদ গিলতেই উজার করে দেয়। ফলতঃ সংসারের উন্নয়ন তো হয়ই না এমন কি ছেলে মেয়েদের জন্যে প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড়ও কিনে দিতে ওরা ব্যর্থ হয়। নতুন করে ঘরদোর নির্মাণ তো দূরের কথা, পুরোনো ঘর দোর গুলির সংস্কারও করতে পারে না।
এই পল্লীর প্রতিটি পরিবার নিজেদের অর্থ সমন্বিত করে চারটি টিউবওয়েল বসিয়েছে স্থান চিহ্নিত করে। এ চারটি টিউবওয়েল থেকেই ওরা ওদের পারিবারিক পানির প্রয়োজন মিটিয়ে নেয়। কিন্তু টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে কে আগে নেবে আর কে পরে নেবে, এই চারটি টিউবওয়েল স্থাপন করতে কার স্বামী কত টাকা দিয়েছে এসব নিয়ে তুমুল ঝগড়া বেধে যায়। এই ঝগড়া বেধে যাওয়াটি ওদের কাছে চিরাচরিত। ওদের কোনো পুর”ষ এ ঝগড়া ঝাঁটির মধ্যে কখনই প্রবেশ করে না।
এর মধ্যে সন্ধ্যে সমাগত প্রায়। মায়েরা বাচ্চাদেরকে স্নান করিয়ে যার যার ঘরে নিয়ে গিয়ে খেতে দিয়েছে। দুপুরে রান্না করা বাসি ভাত, তরকারী দিয়ে ওরা পেট পুরে খেয়ে নিচ্ছে। খাওয়া শেষ হলেই ওরা ঘুমিয়ে পড়বে। শুকরের পাল চড়ানো পুর”ষদের মধ্যে একমাত্র নারী সদস্য বাসন্তি বালি। ও ওর দু’টি প্রাপ্ত বয়স্ক শুকর আর শুকরীর সাথে ওদের তিনটি ছানা নিয়ে প্রথম ঘরে ফিরেছে। এরপর পরিবারের পুর”ষরা শুকরের পাল নিয়ে এক এক করে ঘরে ফিরতে শুর” করেছে। বাসন্তি বাড়ীতে প্রবেশ করেই শুকরগুলিকে খোয়াড়ে ঢুকিয়ে খোয়াড়ের ভেতর রক্ষিত ওদের খাবারের পাত্রে বাড়ীতে রক্ষিত খাবার দিয়ে আর একটি ভিন্ন পাত্রে পানি ঢেলে পূর্ণ করে খোয়াড়ের দরোজা বন্ধ করে দিয়েছে। আর এ দরোজা বন্ধ করণের সাথে সাথে শুর” হয়েছে শুকর গুলির বিকট আকারের ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ। ওরা খাবারও খাচ্ছে আবার চিৎকারও করছে। এই যে চিৎকার এটি তো সব সময়ের জন্যে থাকেই তার ওপর যোগ হয় কাদায় লেপটানো প্রতিটি শুকরের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা এক প্রকারের অসহ্য উৎকট গন্ধÑ যা সাধারণ মানুষের ঘ্রানেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছুলে গল গল করে বমি করে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। অথচ এদের কাছে এসব কোনো বিষয়ই না। এগুলি তাদের উপলব্ধিতে অনুভূতই হয় না। এর মূল কারণ বোধকরি একটিই যে, ওরা এসবের মধ্যেই ডুবে থাকে দিন রাত। এসবকে ওরা ওদের দৈনন্দিন জীবনের অলঙ্কার হিসেবেই মনে করে।
সবাই যখন যার যার শুকরের পালকে ওদের খোয়াড়ে খাবার, পানি দিয়ে খোয়াড়ের দরোজা বন্ধ করে দিলো তখনই শুরু হলো যেন কুরুক্ষেত্র। অত্যন্ত উচ্চৈস্বরে চিৎকারের সাথে সাথে শুর” হলো ওদের নিজেদের মধ্যে মারামারি। দু’টি শূকর খাবার খাচ্ছে তো আরও তিনটে এসে সে খাবারে বাধা দিচ্ছে। আর ঠিক তখন ওদের কণ্ঠ থেকে ভিন্ন এক প্রকার গোঙ্গানোর মতো শব্দ বেরিয়ে আসতে থাকে। যুদ্ধে লিপ্ত শূকর গুলি রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে তবুও যুদ্ধ থামছে না। এ যেন সেই ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিবো সূচাগ্র মেদিনী’রÑ মতো অবস্থা। কিন্তু যখন যুদ্ধরত শূকর গুলি দেখছে ওদের যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ওদেরই দলের অন্য তিন চারটি শূকর এসে ওদের খাবার গুলি খেতে শুর” করেছে ঠিক তখনই যেন ওদের সম্বিত ঠিক ফিরে আসে। তড়িঘড়ি যুদ্ধ থামিয়ে তখন ওরা সবাই মিলে খাবার খেতে শুর” করে এবং ধীরে ধীরে সবাই শান্ত হয়ে ওঠে। শূকরদের এসব আচরণ এ পল্লীর সব পরিবারের কাছে একেবারে চিরচেনা। এ কারণে এসব নিয়ে ওরা একদম ভাবেই না।
জারুল গাছের নীচে থেকে মহিলারা ওদের কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে গেলে বৃদ্ধ ঠাকুর লাল তাড়ির বোতল হাতে নিয়ে এসে বসেছে সেই জার”ল গাছটির নীচে। বসে কোনো দিকে না তাকিয়ে দিব্বি তাড়ি গিলেই চলেছে। তাড়ির প্রভাবে চক্ষু দু’টি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। কণ্ঠের স্বরও জড়িয়ে আসছে। এ রকমের একটি অবস্থায় ঠাকুর লালের বুঝি মনে পড়ে গেলো বাসন্তি বালির কথা। আর মনে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে জড়ানো কন্ঠে ডাকতে শুর” করে দিলো‘এ লালা মাধব’, দ্বিতীয়বার আরও গলা চড়িয়ে ডাকতে থাকলো ‘ আরে এ লালা মাধব, বাসন্তি কা আওল বা?’ দু’বার শুনবার পর কতকটা যেন বিরক্তির সাথে চেচিয়ে উত্তর দিলো লালা মাধব‘হাঁ নানা, কা ভইল্ বা? ইত্না চিল্লাওয়াত কাঁহে?’ সম্ভবতঃ লালা মাধবের কথা পূরোটা বুঝতে না পেরে আবার চিৎকার ওঠে ঠাকুর লাল‘কা রে লালা মাধব বাসন্তি কা কেয়া ওয়াপস্ নাহি আওল বা? জওয়াব কিঁউ না দে তে রে? ঠিকঠাক জওয়াব তো দে।’ এবার আর বিরক্ত না হয়ে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয় লালা মাধব। কারণ উত্তর না দিলে চিৎকার করতেই থাকবে ঠাকুর লাল ‘হাঁ নানা, বাসন্তি ওয়াপস্ আওল বা। জানোয়ার ভি সব আওল বা। তুহার কে লিয়ে চিন্তাকে কোই কুছ নাহি নানা। তু তাড়ি পিতে রাহ্।’
বৃদ্ধ ঠাকুর লালের সাথে তর”ণ লালা মাধবের সম্পর্ক নানা নাতির তবে আপন রক্তের নয়। ওদেরই গোত্রের ঠাকুর লালের দূর সম্পর্কের এক জ্ঞাতি ভাইয়ের পুত্র লালা মাধব। সেই সূত্রে ঠাকুর লাল লালা মাধবকে নিজের নাতি বলেই মনে করে। লালা মাধব বিবাহিত। কিছুদিন আগে ওর বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বউটির বয়স অনেক কম। এখনও ওদের সন্তানাদি হয় নি। লালা মাধব নিজেই পছন্দ করে ঠাকুর লালের অনুমতিক্রমে ওকে বিয়ে করেছে। বলতে গেলে বিয়েটি এক প্রকার ঠাকুর লালই দিয়েছে। লালা মাধবের বয়স যখন তিন বছর তখনই ওর পিতা মাতা গত হয়েছে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে। সে সময়ে ওদের এলাকায় কলেরা আর বসন্তের আধুনিক কোনো চিকিৎসাই ছিলো না শুধু ঝার ফুক, তুক্ তাক্ আর অশিক্ষিত কিছু গ্রাম্য কবিরাজের হারবাল জাতীয় সামান্য চিকিৎসা ছাড়া। এসব চিকিৎসায় রোগ নিরাময়ের বিপরীতে মৃত্যু ছিলো অবধারিত। লালা মাধবের পিতা, মাতার মৃত্যুর পর ঠাকুর লালই তিন বছর বয়সের লালা মাধবকে ওর কাছে নিয়ে আসে এবং ঠাকুর লালের পরিবারেই ও বড় হতে থাকে।
ঠাকুর লালের স্ত্রী বিয়োগ অনেক আগেই হয়েছে। এখন থাকবার মধ্যে আছে কেবল একমাত্র কন্যা বাসন্তী বালি। মেয়েটি বিধবা। বিয়ের চার বছর পর বাসন্তি একটি কন্যা সন্তানের জন্মদান করে। সেই সন্তানটি দেখতে অপরূপ সুন্দর ছিলো বলে ওর নানা অর্থাৎ ঠাকুর লাল ওর নাম দিয়েছিলো ‘ দুর্গা’। দুর্গার মতোই দুধে-আলতায় গায়ের রং, চোখ দু’টি বড় বড় ঠিক যেন মা দুর্গার চোখ, চিবুকের ঠিক মাঝখানে খুব ছোট্ট একটি দাগের চিহ্ন যে দাগটি শিশুটির চিবুকটিকে দু’ভাগে পৃথক করেছে। বড় হলে যে চিহ্নটি ওর সৌন্দর্যে একটি অসাধারণ মাত্রা যোগ করবে। যে সব মহিলা পুর”ষ শিশুটিকে দেখতে এসেছে তারা সবাই এক বাক্যে সে কথাই বলেছে। মা, বাবা, নানার চোখের মনি হয়ে তরতর করে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে দুর্গা। দুর্গার বয়স যখন দু’বছর তখন ওর বাবা নিজেদের গোত্রীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। এবং দিনে দিনে এই গোত্রীয় কোন্দল গভীর থেকে গভীরতর হতে হতে এক পর্যায়ে এসে ভয়াবহ সংঘর্ষের রূপ ধারণ করে। আর এই সংঘর্ষের একটি স্তরে এসে দুর্গার বাবা প্রতিপক্ষের রাম দা এর পরপর কয়েকটি আঘাতে প্রাণ হারায়। এর পর থেকে বাবার কাছেই থেকে যায় বাসন্তী আর বাসন্তির কন্যা দুর্গা। দুর্গার বয়স এখন তিন বছর। দুর্গার মা বাসন্তিই তখন থেকে পরিবারের রান্না বান্নার কাজ একই সাথে শুকর চড়ানোÑ দু’টিকেই সমানভাবে সামাল দিয়ে চলে। দিনের বেলা দুর্গা শুকর চড়াতে বাইরে বেরিয়ে গেলে নানাই দুর্গাকে সামলে নেয়। ভীষণ ভালোবাসে ঠাকুর লাল নাতনি দুর্গাকে। দুর্গাও যেন নানার শরীরের সাথে প্রায় লেপটে থাকে সারাদিন। দুর্গাকে ¯œ ান করানো, ওকে খাওয়ানো, জামা কাপড় পরিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়াসহ সবকিছুই করে ঠাকুর লাল। শুকর চড়াতে বাইরে বেরিয়ে গেলেও বাসন্তি নিশ্চিত থাকে যে, বাবা তো রয়েছেই, বাবাই দুর্গাকে সামলে নেবে। তাছাড়াও বাসন্তি খুব ভালো করেই জানে যে, বাবার পক্ষেও দুর্গাকে ছাড়া থাকা সম্ভব নয়। বাবার বয়স হয়ে যাবার কারণে বাবাও এক প্রকার ছেলে মানুষের মতো হয়ে গেছে। দুর্গাই এখন হয়েছে বাবার একমাত্র ‘অন্ধের যষ্ঠি’র মতো অবলম্বন।
নানা মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে দুর্গার মা যখন বাড়ীতে থাকে না, শুকর চড়াতে যায়, তখন নাতনিকে কাঁধে নিয়ে বসতি ছেড়ে অরণ্যের কিছুটা ভেতরে চলে যায়। অরণ্যের বিভিন্ন প্রকারের গাছপালা দেখায়, গাছের শাখায় ছোটো ছোটো পাখিরা বসে কিচির মিচির করে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে এসব দেখিয়ে দুর্গাকে বলে ঠাকুর লাল ‘দুর্গা, দেখ্ দেখ্ কিত্নি চিড়িয়া, তু লিবেক্?’ নানার প্রশ্ন শেষ হলে উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠে দুর্গা। ঠিক এ মুহূর্তে দুর্গার গোলাকৃতির মুখোমণ্ডল থেকে এক অপূর্ব সৌন্দর্য়ের বিভা ছড়াতে থাকে। ঠোঁট দু’টিতে রক্তিমাভা ফুটে ওঠে। আধো আধো উচ্চারণে বলে ‘ হাঁ নানা, কিঁউ না লিবেক? তু দে না নানা এক চিড়িয়া কে ছানা। হামরে ঘর মে তুহার জো খোপরি রহল না ওহি চিড়িয়া কে লিয়ে ঘর ভি তো বনল বা। হাম তো উছে খানা খিলাবে, পানি পিলাবে হ্যায় না নানা।’ দুর্গার মুখ থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে যেন কথার ফুলঝুরি ঝরতে থাকে। মোটেই থামতে চায় না। নানাও আর উত্তর না দিয়ে থাকতে পারে না। বলতে শুর” করেÑ ‘ হাঁ হাঁ, সব কুছ তো হোবেক লেকিন চিড়িয়া কে পাকড়নে কে লিয়ে তুঝে তো তুহার মা কি তাড়াহ্ বড়া তো হোতে হোবেক। এক কাম র্ক চল, অব হাম নে তুঝে বৈচি খিলাবে, বহত হি মিঠা। কেয়া, নাহি খাওগে?’
‘হাঁ নানা, খাবেক কিঁউ নাহি? আবভি লে চল্ হামে।’ নিমেষেই পাখির কথা ভুলে গিয়ে এবার বৈচি ফল খাবার লোভ আর সামলাতে পারে না দুর্গা। বারবার নানার মাথায় ছোটো ছোটো হাত দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এই আঘাতের উত্তরে নানা বলে‘আরে বাবা হামে তো দেখ্, হাম তো চল্ হি দিয়া।’ এ কথা শুনবার পর দুর্গা নানার মাথার ওপর ওর হাতের আঘাত করা থামিয়ে দিয়ে ওই হাত দু’টি দিয়েই এবার বড় মমতার সাথে বিলি কাটতে থাকে নানার মাথার চুলে। নানা ওকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বৈচির গাছ খুঁজতে শুর” করে। পেয়েও যায় এক সময়। নানা লক্ষ করে ছোটো আকারের বৈচির গাছের শাখায় কিছুটা লটকনের মতো তবে লটকনের চাইতে একটু বড় মাপের অনেক বৈচি ফল পেঁকে লাল হয়ে রয়েছে। নানা উৎফুল্ল হয়ে দুর্গাকে সেই গাছের দিকে ইঙ্গিত করে বলতে থাকে ‘ আরে এ দুর্গা, উ দেখ্ কিত্নি বৈচি লাল হো কে রহল বা! কেয়া রে, তু দেখত্ নাহি?।’ নানার কথা শেষ হলে দুর্গা নানাকে তাড়া দিয়ে বলে
‘হাঁ নানা দেখত্ রহি। চল্ না জলদি।’ দুর্গার তাড়ায় নানা দ্রুত হাঁটতে শুরু করে বৈচি গাছটির দিকে।
প্রসঙ্গতঃ এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এরা যুগের পর যুগ ধরে এই বাংলায় বসবাস করা এবং বাঙ্গালীদের সাথে মিশে যাবার কারণে বাংলা ভাষাটি ওরা মোটামুটি ভাঙ্গা ভাঙ্গাভাবে রপ্ত করে নিয়েছে। আর এই ভাষাটি সাধারণভাবে রপ্ত করবার ফলে নিজেদের মধ্যে কথা বলবার সময়েও ওরা ভারতের বিশেষ রাজ্যের ভোজপুরি অঞ্চলের ভাষার সাথে বাংলা ভাষাকে মিশিয়ে কথা বলে, ঠিক যেভাবে ওরা বাঙ্গালীদের সাথে কথা বলে। নানা নাতনির কথোপকথনের মধ্যে দিয়েও এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ স্পষ্ট।
নানা অনেকগুলি বৈচি ফল গাছ থেকে পেড়ে দুর্গার কোচড় পূর্ণ করে আবার নাতনিকে কাঁধে নিয়ে বাড়ীতে নিয়ে এলো নানা ঠাকুর লাল। বাড়ীতে প্রবেশ করে নানার কাঁধ থেকে উঠোনে নেমেই হৈ হাঙ্গামা করে সব ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের ডাকতে শুর” করে দিলো। ওর চ্যাচামেচি আর চিৎকার করা ডাক শুনে এক এক করে সব ছোটো বাচ্চারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকলো। যে এর মধ্যেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সে-ও দু’চোখ কচ্লাতে কচ্লাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কারো কারো মা-ও সন্তানের সাথে বেরিয়ে এলো। এমনভাবে দুর্গা চিৎকার করে ওদেরকে ডাকছিলো তাতে মায়েরা রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলো ‘না জানি কোনো বিপদ হয়েছে। তা না হলে দুর্গা এমন চিৎকার করে সব বাচ্চাদের ডাকাডাকি করে পাড়া মাথায় তুলবে কেন?’ কিন্তু যখন সবাই ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তখন দেখলো দুর্গা দার”ণ উৎফুল্ল হয়ে কোলাহল করে ওর কোচড়ে থাকা বৈচি ফলগুলি থেকে একটি দু’টি করে ওর খেলার সাথীদেরকে সানন্দে দিয়ে দিচ্ছে। এই ফলগুলি থেকে কিছু কিছু ওদেরকে দিতে পারাতে ওর যে কী আনন্দ সেটি ওই মুহূর্তে ওকে চাক্ষুস না দেখলে উপলব্ধি করা যায় না। অনর্গল বন্ধুদের সাথে কথা বলে চলেছে। ছোট্ট লক্ষীকে কাছে ডেকে বলছে ‘এ লছমি, আ, ইধার আ, আ। আ নারে বাবা, ইতনা দেড় কিঁউ লাগাওয়াত রে?’ লক্ষীকে ওরা লছমি বলে ডাকে। মেয়েটি কাছে এলে ওকে দু’টি বৈচির পাঁকা ফল হাতে দিয়ে দুর্গা বলে ‘লে, খা, অউর দেখ্ কিতনি মিঠা বা! নানা হামরি কে ই জঙ্গল কি বহত অন্দর মে লিয়ে গেলো অওর পেরোঁ কি ডালমে বয়েঠ্না ওয়ালা অওর ডালছে উড়নে ওয়ালা বহত চিড়িয়াকো ভি দিখাওল বা। উসকে বাদ পেরোঁছে নিকাল কর ই বৈচি হামরেকো খানে কে লিয়ে দিয়ে দিলো। আরে খা না, বহত হি মিঠা বা।’ Ñ ওদেরকে ফলগুলি খাওয়াতে পেরে দুর্গা নিজেই যেন আহ্লাদে আটখানা। খুশি যেন ওর আর ধরে না। এবার সব বাচ্চারা মিলে নানার ঘরে গিয়ে ঘিরে ধরলো নানাকে। নানা কতকটা হকচকিয়ে গেলো। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে ওদেরকে প্রশ্ন করলোÑ ‘কেয়া রে, তু সব বাচ্চা আদমী হামার কাছে কেন আসলি। হাম তো আব তাড়ি পিবেক না!’ নানার কথার উত্তরে ওরা যা বললো তার মর্মকথাটি হলোÑ ওদেরকেও জঙ্গলে নিয়ে যেতে হবে, পাখি দেখাতে হবে আর পাঁকা বৈচি ফল গাছ থেকে পেড়ে দিতে হবে। ওদের সব কথা, সব দাবি শুনে নানা বাধ্য হলো কথা দিতে যে, ওদের সবাইকে নানা একদিন জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যাবে। যদিও ওদেরকে প্রতিশ্রæতি দেবার পর নানা তখনকার মতো বেঁচে গেলো কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই বুঝে নিলো এই একই দাবি নিয়ে ওরা প্রতিদিনই নানার কাছে আসবে। নানা আর কিছু বললো না। বাচ্চারা নানার ঘর থেকে খুশি মন নিয়ে ফিরে গেলো। ওরা চলে যাবার পর ঘরের দাওয়ায় এসে নানা শুরু করলো তাড়ি পান করতে। বোতল থেকে একটু একটু করে তাড়ি গলায় ঢালছে আর দু দিকে মাথা দুলিয়ে নীচু স্বরে কী সব গান গাইছে, মাঝে মাঝে হাতও নাড়ছে। এই মাথা দুলিয়ে আর হাত নেড়ে নেড়ে কি গান যে ও গাইছে একমাত্র ও ছাড়া সে গানের কথা অথবা মর্ম বুঝবার ক্ষমতা আর কারো নেই। তবে এটুকু বোঝা যায় ও খুবই আনন্দের সাথে তাড়ি পানের নেশাটিকে উপভোগ করছে।
সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে অনেক্ষণ। নানার তাড়ি পান শেষ হয়নি বরং কিছুটা বেড়েছে। নানার তাড়ি পান বৃদ্ধির সাথে সাথে রাত্রিও বাড়তে শুর” করেছে ধীরে ধীরে। বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। ফলে ওদের চিৎকার চ্যাচামেচিও থেমে গেছে একেবারেই। মাঝে মাঝে শুকরগুলির কিছু শব্দ আর মহিলাদের রাতের খাবার আয়োজনের টুকিটাকি শব্দ ছাড়া আর কিছুই
------------------------------
নেই বলা যায়। মোটামুটি একটি শুনশান নীরবতার আবহ সৃষ্টি হয়েছে পুরো পল্লীটি জুড়ে। আরও কিছুটা সময় পেরিয়ে যাবার পর বাসন্তি ওদের শোবার ঘরের মেঝেতে একটি মাদুর পেতে সে মাদুরের ওপর ওর বাবার আর নিজের খাবার সাজিয়ে রেখে বাবাকে ডাকতে এলো। তখনও ঠাকুর লাল তাড়ি পান করে চলেছে। ঘর থেকে দাওয়ায় এসে বাবার একটি হাত ধরে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বললো ‘ এ বাপুজি, রাতকে খানা তো তৈয়ার হো গৈল বা। আব তাড়ি ছোড়, চল, খানা খাবেক।’ বলে বাবার হাত থেকে তাড়ির বোতলসহ পাশে পড়ে থাকা আরও একটি খালি বোতল এক হাতে নিয়ে টলায়মান বাবাকে টানতে টানতে ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে কোনো রকমে **** মাদুরের ওপর বসিয়ে দিলো। বোতল দু’টি চৌকির নীচে রেখে নিজেও বাবার পাশে খেতে বসলো। দুর্গাকে অনেক আগেই রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে বাসন্তি। খেতে খেতেই বাবার সাথে সামান্য দু চারটি কথা হলো যেমন প্রতি রাতেই হয়। সব কথার মধ্যে যেটি মুখ্য এবং নিত্যদিনের কথা সেটি হলোÑ বাসন্তি বাবাকে তাড়ি খেতে দেবে না আর বাবার কথা হলো ও তাড়ি না খেলে বাঁচতে পারবে না। এভাবে কথা বলতে বলতেই খাবার শেষ হয়ে গেলে বাসন্তি শোবার আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাল সকালেই আবার শুকর নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। আজ যে রাতের মেয়ের বারণ কালকে আর মনে থাকে না ঠাকুর লালের। দিব্বি তাড়ি পান করতে থাকে। তাড়ি না থাকলে অনাসৃষ্টি কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয় বাড়ীতে। বাধ্য হয়ে বাসন্তিই আবার বাবাকে তাড়ির ব্যবস্থা ক’রে দেয়। আর এভাবেই নিয়ত চলতে থাকে বাবা আর কন্যাকে নিয়ে বাসন্তির সুখের(?) সংসার।
রাত্রি গভীর হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই এ পল্লীর। রাত্রিতে এরা পল্লীটির একাধিক নির্দিষ্ট স্থানে মশাল জালিয়ে রাখে যাতে কোনো প্রকার হিংস্রর জন্তু, জানোয়ার এসে ওদের নিজেদের এবং শুকরগুলির কোনও ক্ষতি করতে না পারে। সাধারণতঃ জন্তু জানোয়াররা আগুন দেখলে ভয় পায়। এ কারণেই এ মশাল জালিয়ে রাখবার ব্যবস্থা। তারপরেও প্রতি রাতে পালা করে দুজন লোক পল্লীটির প্রহরায় নিয়োজিত থাকে। এদের কাজটি হলো প্রহরা চলাকালীন অস্বাভাবিক কোনো কিছু চোখে পড়লেই চিৎকার করে পল্লীর সব মানুষকে জাগিয়ে তুলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আজকেও দু’জন লোক নিয়ম অনুযায়ী প্রহরা দিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে ওদের উপস্থিতি। কিন্তু এই প্রহরা চলবার ভেতর দিয়েই ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একটি তর”ণ ঢুকে পড়েছে পল্লীর ভেতর। মশালের আলোকে আড়াল করে একটি ঘরের দরোজায় দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে খুবই চাপা কণ্ঠে ডাকছে‘এ ফুল্লরী, এ ফুল্লরী দরোয়াজা তো খোল্, এ ফুল্লরী।’হাঁপাতে থাকে তর”ণটি। এবার ঘরের ভেতর থেকে একটি নারী কণ্ঠ বলে ওঠে ‘কৌন? আবে কৌনরে ইতনি রাত কো?’ নারী কন্ঠটি থেমে গেলে তর”ণটি দাঁত চেপে আবার বলে‘আ বে হাম রাম পরসাদুয়া। আব তো দরোয়াজা খোল্। হামরে পিছে বহত বিপদ লাগাওয়াত রে। হামরে কে তু বাচা লে ফুল্লরী, দরোয়াজা খোল্।’অস্থির হয়ে ওঠে রামপ্রসাদ। বারবার করে চরম আতঙ্ক নিয়ে তীক্ষ্ন অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে চারদিক দেখতে থাকে। এর মধ্যে ঘরের দরোজাটি সামান্য ফাঁক করে একজন নারী গলা বাড়িয়ে দেখতে থাকে রাম প্রসাদকে। নারীটি ফুল্লরীর মা। চিনতে পারে রাম প্রসাদকে। চিনবার পর রাম প্রসাদকে প্রশ্ন করে ফুল্লরীর মা‘কেয়া রে, ইত্নি রাত মে তু? কা ভইল্ বা?’ রাম প্রসাদ কোনো উত্তর না দিয়ে দরোজা ঠেলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। ঘরে প্রবেশ করে প্রথমেই এক গ্লাস পানি খেতে চায়। ফুল্লরীর মা পানি এনে দিলে পানি পান করা শেষে ফুল্লরীর মাকে ওর পাশে বসতে বলে রাম প্রসাদ ফুল্লরীর মা ওর পাশে বসে। এরপর রাম প্রসাদ ফিস ফিস করে কিছু কথা বলে ফুল্লরীর মাকে। ওর কথা শুনে আঁতকে ওঠে ফুল্লরীর মা। ওর কণ্ঠ দিয়ে যেন আর শব্দ সরে না। ওদের দু’জনের এই ফিসফিসিয়ে কথা বলার মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে যায় ফুল্লরীর। বিছানা থেকে নেমে এসে মায়ের পাশে বসে ফুল্লরী। মায়ের পাশে বসে ফুল্লরী রাম প্রসাদের সব কথা শুনে মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাম প্রসাদকেও ওর একটি হাত ধরে টেনে তোলে। টেনে তুলে ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে মায়ের বিছানার নীচে থেকে একটি ছোটো টিনের বাক্স বের করে এনে বাক্সটির ভেতর থেকে মায়ের একটি শাড়ী বের করে। মা কিছু বলবার আগেই শাড়ীটিকে ছিঁড়ে দু’ভাগ করে। এর পর শাড়ীটির একটি অংশ রাম প্রসাদকে দিয়ে বলে ‘ই কাপড়া দিয়ে তুহার মাথা অওর মুখ আচ্ছা কর কে ঢেকে লে। ইখানে তুহার থাকা ঠিক নাহি হোবেক। চল্ হামরে সাথ।’ ফুল্লরীর কথা শেষ হলে মা প্রশ্ন করে ফুল্লরীকে ‘ ই-সে কাঁহা লে যাওয়াত রে ফুল্লরী? বাতা তো সহি।’ফুল্লরী উত্তর দেয় ‘তু কুছু চিন্তা না কর রে মা-ই। লওট নে কে বাদ সব হি তো তুহার কে বোলবেক না! পহেলে ই-সে হিফাজত তো করতে হোবেক। চল্ রাম পরসাদ, দেড় না লাগাওল বা।’ আর কথা না বাড়িয়ে মায়ের শাড়ীর খণ্ড দু’টি দিয়ে দু’জনই মাথা মুখ ভালো করে ঢেকে নিয়ে ঘরের বাইরে এসে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে যেভাবে রাম প্রসাদ ফুল্লরীদের ঘরের দরোজায় এসেছিলো ঠিক সেভাবেই প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে খুব দ্রæত হাঁটতে থাকে দু’জনই। ফুল্লরী ওর ডান হাত দিয়ে রাম প্রসাদের একটি হাত ধরে। দু’জনের কেউই আর পেছন ফিরে তাকায় না। মা স্থানুর মতো দরোজায় দাঁড়িয়ে থেকে ওদের চলে যাওয়া অবলোকন করতে থাকে। ফুল্লরীর বাবা নেই। ফুল্লরীই মায়ের একমাত্র সন্তান। সে-ও এভাবে চলে গেলো। যদি আর ফিরতে না পারে, পথে যদি কোনো বিপদ আপদ ঘটে যায়! মোটেই ভেবে পায় না এখন ওর কী করা উচিত।
০৩.
খুব দ্রুত হেঁটে ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই নীল কমল নদীর তীরে পৌঁছে যায়। যে তীরে ওরা পৌঁছায় সে তীরটি নদীটির একটি খুব ছোট্ট খেয়াঘাট। দিনের বেলা ওই ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে সামান্য কিছু মানুষজন নদীটির এপার ওপার করে। রাতের বেলা খেয়া পারাপার বন্ধ থাকে। কারণ রাতে এ খেয়াঘাট দিয়ে কোনো মানুষ নদী পারাপার করে না। প্রকৃত অর্থে এটি নদী নয় একটি দীর্ঘ মাপের বিল মাত্র। প্রশস্ততা এবং গভীরতাও খুব বেশী নয়। গভীরতা স্বল্প হবার করণে পানির নীচে প্রচুর শৈবালের জন্ম বিস্তৃত হওয়ায় এর পানি সব সময়েই সবুজাভ নীল রং-এর হয়ে থাকে। এবং এর পানিতে প্রচুর নীলপদ্ম ফুটে থেকে নদীটির সৌন্দর্য়ে একটি ভিন্ন মাত্রা দান করে। পানির রং আর নীলপদ্ম ফুটবার বিষয়টিকে মাথায় রেখেই বহু বছর আগে স্থানীয় জনগণ এর নাম করণ করেছিলেন ‘ নীলকমল নদী’ হিসেবে। নদী না হয়ে বিল হলেও ‘ নীলকমল’কে নদী বলে ডাকতেই বেশী পছন্দ করে এখানকার লোকজন। নদীটির তীরে রাতের বেলা দু একটি ডিঙ্গি নৌকা বাঁধাই থাকে। ডিঙ্গির বৈঠাটির কিছু অংশ মাটিতে পুঁতে ওই বৈঠার সাথেই দড়ি দিয়ে ডিঙ্গিটিকে বেঁধে রাখে নৌকার মাঝিরা। ওরা জানে রাতের বেলা তীরে বাঁধা ডিঙ্গিকে কেউ ছুঁয়েও দেখবে না। আর সে বিশ্বাসের ওপর ভরসা করেই হারিয়ে যাবার কোনো প্রশ্ন ওদের মনে জন্মায়ই না।
অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে বেঁধে রাখা চারটি ডিঙ্গির মধ্যে মোটামুটি যেটি ওর কাছে ভালো বলে মনে হলো সেই ডিঙ্গিটিকে বৈঠার বাঁধন থেকে মুক্ত করে নিয়ে বৈঠাসহ দু’জনই গিয়ে ডিঙ্গিটির ওপর বসলো। কোনো কথা না বলে ফুল্লরীই বৈঠা দিয়ে ডিঙ্গিটি বাইতে শুর” করলো। রাম প্রসাদ কিছু বলতে চাইলেও ফুল্লরী ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই দাঁড় বাইতে লাগলো। এখন মধ্য-কার্তিক। স্বাভাবিকভাবেই রাত্রিতে কুয়াশার ঘনত্ব বিস্তৃত হচ্ছে একই সাথে শীতের তীব্রতাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। এ বিষয়টিকে গুর”ত্ব দিয়েই ফুল্লরী মায়ের শাড়ীটিকে দ্বিখণ্ডিিত ক’রে চাদরে রূপ দিয়ে দু জনের মাথা, মুখ, কান ভালো করে ঢেকে নিয়েছে। এতে দুটি কাজ হয়েছে এক ঠাণ্ডকে খুব বেশী না হলেও অন্ততঃ কিছুটা রোধ করা গেছে, দুই নিজেদের পরিচিতিটিকেও তাৎক্ষণিক ভাবে যতটুকু করা যায় ততটুকু বোধ করি আড়াল করা সম্ভব হয়েছে।
ডিঙ্গি বাইতে বাইতে ডাঁটাসহ দু’ট নীলপদ্ম তুলে নিলো ফুল্লরী। একটি এগিয়ে দিলো রাম প্রসাদের দিকে। রাম প্রসাদ পুস্পটি নিয়ে নাকের কাছে ধরলো। কোনো কথা বললো না ফুল্লরী। এই সামান্য এতটুকু ছোট্ট একটি ঘটনার ভেতর দিয়ে ফুল্লরীর মনের অবচেতন-আয়নায় ওর আকাক্সক্ষার যে তোলপাড় তার ছবিটি স্পষ্টই উপলব্ধি করা যায়। ফুল্লরী রাম প্রসাদকে ওর প্রাণটিকে সঁপে দিয়ে নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে চায়। রাম প্রসাদের চাওয়াটিকে কিন্তু কোনোভাবেই প্রকাশ করে না রাম প্রসাদ। নদীটির প্রশস্ততা দীর্ঘ না হবার কারণে মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যেই ওরা অপর পাড়ে পৌঁছে গেলো। পৌঁছেই ডিঙ্গিটিকে ওপাড়ের মতো করে মাটিতে বৈঠার কিছু অংশ পুতে দিয়ে বৈঠার সাথে ডিঙ্গিটিকে বেঁধে রেখে নদীর তীর ছেড়ে ওরা দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুর” করলো। এখান থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণে জেলে পল্লী কৈবর্ত ধাম। কৈবর্ত ধামের সবারই পেশা নদীতে জাল দিয়ে স্বাধীনভাবে মাছ ধরা এবং ধৃত মাছ বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে সন্তান সন্ততিকে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। এর ফলে ওদের মননে সব সময়ই একটি স্বাধীনচেতা মনোভার ক্রিয়াশীল থাকে। যে কারণে এ ক্ষেত্রে ওরা কোনো প্রকার বাধা নিষেধের ধার ধারে না। এই কৈবর্ত ধামের আরও তিন কিলোমিটার পূর্ব দিকে সাঁওতাল পল্লী ‘ সেতাব গড়’। ফুল্লরীর লক্ষ সেই সাঁওতাল পল্লী সেতাব গড়ের দিকে। তবে সেতাব গড় যাওয়ার পথে ‘ কৈবর্ত ধাম’ গ্রামটি পার হয়ে যেতে হলেও কৈবর্ত ধামের জেলে সম্প্রদায়ের সাথে ফুল্লরীদের সম্প্রদায়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো যেমন সাঁওতালদের সঙ্গে ওদের সুসম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। ফুল্লরীদের সম্প্রদায়ের অনেকেই নিজেদের পেশা ত্যাগ করে জেলেদের সাথে মিশে গিয়ে মাছ ধরাকেই মূল পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং অনেকেই তাদের স্ত্রী, পরিবার, পরিজনকে নিয়ে জেলে পল্লী কৈবর্ত ধামেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এসব নিয়ে কখনই ওদের মধ্যে কোনো বিবাদ অথবা অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয় নি এবং এখনও হয় না। আর ভবিতব্যের বিষয়টি তো একেবারেই পৃথক। যদিও বর্তমানকে দিয়ে ভবিষ্যতকে মাপা যায় না তবুও কিছুটা ইঙ্গিত হয়তো লাভ করা যায়।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনও সবাই উদার এবং স্বাধীনতা-প্রিয়। নিজেদের সম্প্রদায়ের স্বার্থে, নিজেদের আত্মোন্নয়নের প্রয়োজনে কখনই ওরা কারো সাথে আপোস করে না এতে যদি ওদের জীবনও দিতে হয় ওরা অকাতরে দিয়ে দেয়। এই একটি বিষয় নারী পুর”ষ নির্বিশেষে ওদের সবার চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়া। কারণ জ্ঞানতঃ ওরা কোনো অন্যায় করে না এবং কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। ওদের আত্মবিশ্বাসের ভিতটি খুবই দৃঢ়। ওদের মূল পেশা বিভিন্ন জঙ্গল ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় পাখি ধরা। মাঝে মধ্যে চার পায়ের ছোটো খাটো প্রাণী পেলেও ওরা ধরে নেয়। সেসব প্রাণীর মাংস রান্না ক’রে ওরা নিজেরাই ভক্ষণ করে। সেই সব পাখি বিভিন্ন স্থানে বিক্রী করে ওরা ওদের সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে। বিশাল মুক্ত উদার প্রকৃতির ভেতর রাত দিন বিচরণ ক’রে ক’রে ওরা এক ধরনের স্ফুর্ত প্রশান্তি অনুভব করে। হয়তো এ বিষয়টিই ওদের মানসিকতাকে উদার এবং স্বাধীনতা-প্রিয় করে তুলতে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলে অবিরত। অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও ওরা কখনই উচ্ছৃক্সক্ষলতাকে কোনোমতেই প্রশ্রয় দেয় না। এ সবের পাশাপাশি ওরা দারণভাবে আমোদ-প্রিয়। ওরা নাচ, গান করতে ভালোবাসে। কখনও কখনও ওরা ওদের পল্লীর বাইরে সাধারণ মানুষের মাঝে নাচ, গান করেও অর্থ উপার্জন করে। নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হলেও সাধারণ মানুষ ওদেরকে খুব ভালোবাসে। বিশেষতঃ বাচ্চাদের কাছে তো ওরা খুবই প্রিয়। ওদের বহুবর্ণিল পোশাক আর ওদের কথাবার্তার ধরণ বাচ্চাদেরকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। ওরাও বাচ্চাদেরকে ভালোবাসে, আদর করে। যেহেতু ওরাও তো মানুষ, ওদের ভেতরেও তো মানবিকতা বোধ আছে। স্নেহ, মায়া, মমতা সব কিছুই আছে। ওরা দলবদ্ধ হয়ে গভীর জঙ্গলে গিয়ে ছোটো খাটো জীব জন্তুও শিকার করে থাকে। এ সব শিকারের ক্ষেত্রে ওরা সাধারণতঃ তীর ধনুক ব্যবহার করে এবং তীরের ফলায় ওরা এক ধরনের তীব্র বিষ মাখিয়ে রাখে যাতে ওই তীরের আঘাত প্রাপ্ত কোনো জন্তু আঘাত প্রাপ্তির কয়েক সেকেণ্ডর মধ্যেই ওদের স্নায়ু গুলির স্বকীয়তা হারিয়ে ফে’লে দুর্বল হতে হতে নিস্তেজ হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত হলে ওরা মৃত জন্তুটিকে সংগ্রহ করে। একটি জন্তু শিকার করতে পারলে ওরা খুবই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। নিজেদেরকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে করে। শুধু শিকারের জন্যেই যে ওরা তীর ধনুক ব্যবহার করে তা নয়, নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যেও তীর ধনুককে ওরা প্রধান অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে। যে কারণে প্রায় সব সময়ই ওদের সাথে তীর ধনুক থাকে। বিশেষতঃ বাইরে বেরোবার সময় তো এ অস্ত্র ওদের সাথে রাখা একেবারেই অনিবার্য।
এ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেকেই আবার জীবিকা নির্বাহের জন্যে ছোটো ছোটো পাহাড়ের মাটিতে অথবা প্রচুর উঁচু জমিতে ‘জুম’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। বিশাল বিশাল উঁচু জমিতে ওরা অসংখ্য ছোটো ছোটো গর্ত খনন করে বিভিন্ন প্রকারের শস্যের বীজ এক সঙ্গে বপন করে। নির্ধারিত সময়ের পর সে সব বীজ থেকে অঙ্কুর উদ্গমিত হয়ে চারা গাছের সৃষ্টি হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে চারা গাছগুলি বড় হলে গাছগুলির শীষে শস্য দানা ধারণ করতে থাকে। শস্য দানা পরিপুষ্ট হলে ওরা চারাগুলি কেটে নেয়। এই শস্য দানা ওদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে। সকল জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হলেও ওই সব জমিতে চাষবাসের জন্যে ওদেরকে কোনো খাজনা, ট্যাক্স অথবা টোল প্রদান করতে হয় না। তবে ‘ জুম’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে গেলে ওদেরকে প্রচুর শ্রম বিনিয়োগ করবার সাথে সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে হয়। যার ফলে ওরা ভিন্ন কোনো উপার্জনের পথে যেতে পারে না। এত কষ্ট, এত পরিশ্রম করেই ওরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো জীবন যাপন করে।
ওদের নারীরা বাড়ীতে সব সময়ই হাস, মুরগি, ছাগল ইত্যাদি পালন করে। কেউ কেউ গাভীও পালন করে। সে সব থেকেও ওরা মোটামুটি অর্থ উপার্জন করেÑ যা সংসারের অভাব মেটাতে অনেকটাই সাহায্য করে।
কৈবর্ত ধাম ডিঙ্গিয়ে ওরা দু জন পৌঁছে গেলো সেতাব গড়ের সাঁওতাল পল্লীতে। আসবার পথে সারা পথ জুড়ে ওদের মধ্যে সামান্য দু একটি সাধারণ কথা ছাড়া ভিন্ন প্রসঙ্গে তেমন কোনো কথাই হয় নি। শুধু স্থির লক্ষ্য সেতাব গড়ের সাঁওতাল পল্লী। ফুল্লরীর সমগ্র ভাবনা আবর্তিত একটি মাত্র বিষয়কে ঘিরেÑ রাম প্রসাদকে আগে বাঁচাতে হবে। তখনও ভোরের আলো পরিপূর্ণ রূপে ফুটে ওঠে নি। কুয়াশাচ্ছন্ন চারদিক। সাঁওতাল পল্লী একেবারে নিঝুম, নিস্তব্ধ। এপাশ ওপাশ একবার দেখে নিয়ে ওরা দু’জন সন্তর্পণে প্রবেশ করে পল্লীটির ভেতর। ঘরের বাইরের সব উঠোনগুলি ফাঁকা। বোঝা যায় বাচ্চারাও ঘুম থেকে ওঠে নি এখনও। কোনো ঘরের বাইরের উঠোনে কোনো শিশু অথবা ছেলে-পুলে নেই। বড়রাও নেই। ওরা লক্ষ করে এ পল্লীর প্রায় প্রতিটি ঘরের পাশেই দু একটি করে ছোটো ছোটো মাটির ঢিবিÑ যে মাটিগুলি ওদের ঘরের ভিটি লেপনের জন্যে ব্যবহৃত হয় হয়তো। যেহেতু সব ঘর গুলিই কাঁচা। ঘরের পেছন দিকে লাউ, শীম ইত্যাদির মঞ্চ, মঞ্চের ওপর লাউয়ের ডগা,শীমের লতা বেড়ে উঠে মঞ্চগুলিকে যেন প্রায় ঢেকে দিয়েছে। তবে এখনও ফল ধরে নি। মঞ্চগুলির পাশে দু একটি করে নিম জাতীয় গাছও লাগানো। গাছগুলি বড় হয়েছে। মোটামুটি একটি নৈসর্গিক পরিবেশের আবহ খুবই ভালো লাগলো ফুল্লরীর। এই সাঁওতাল পল্লীটির প্রধানের নাম হীরন নাগ। ওর স্ত্রীর নাম সাগিনা নাগ। হীরন নাগের নির্দেশের বাইরে ওরা কেউ কখনই কিছু করে না। মাঝারি আকৃতির হীরন নাগ পঞ্চাশোর্দ্ধ বয়সের। স্বাস্থ্য মোটামুটি তবে শরীরে এখনও যথেষ্ট শক্তি ধারণ করে যা ওর হাতের পেশী দু’টিকে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। গায়ের রং শ্যামলা। মাথার চুলগুলি সব অর্ধ পাকা এবং ঘাড় পর্যন্ত প্রলম্বিত। হীরন নাগকে ফুল্লরী জানে, হীরন নাগও ফুল্লরীকে চেনে। ওদের মধ্যে জানাশোনা অনেক আগে থেকেই। হীরন নাগ কোন ঘরে থাকে তা-ও জানে ফুল্লরী। আর কিছু না ভেবে হীরন নাগের ঘরের দরোজায় গিয়ে চাপা স্বরে ডাকতে শুর” করলো ফুল্লরী
‘নাগ-জি, এ নাগ-জি, সোকাল তো হো গৈল বা। বাহার নিক্লা, দেখ্ কৌন আওল বা তুহার ঘর মে।’ ফুল্লরীর ডাকের পরেও ঘরের ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো ওরা। দেখতে থাকলো এদিক ওদিক থেকে কেউ আসে কিনা অথবা কারো কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় কিনা। কিছুই পাওয়া গেলো না। এবার দরোজায় মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে আবার ডাকলো ফুল্লরী ‘ নাগ-জি, হাম ফুল্লরী বা। দরওয়াজা তো খোল্।’ এবার ভেতর থেকে ঘুম জড়ানো স্বরে একটি নারী কণ্ঠ ভেসে এলো ‘এতো রাতে ফের কা ভইল্বা রে? তু কোওন আছে বোটেক্?’ নারীটির কন্ঠস্বর শুনে ফুল্লরী বুঝে গেলো হীরন নাগের স্ত্রী সাগিনা নাগ কথা বলছে। উত্তর দিলো ফুল্লরীÑ ‘হাঁ সাগিনা কাকী, আব রাত নাহি রহল বা। সোকাল হোয়ে গেলো, ওঠ্, অন্দর তো আওত্ দে।’ ফুল্লরীর কথায় কাজ হলো এবার। দরোজা খুলে চোখ কচ্লাতে কচ্লাতে ফুল্লরী আর রাম প্রসাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ফুল্লরীকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে আশ্চর্য হয়েই প্রশ্ন করলো ‘আরে বাপ রে! এতো সুভা, সুভা ফুল্লরী তু ইখানে কেনে?’ এ প্রশ্নের পর ফুল্লরীর উত্তর ‘ সব হি বাতাওবে কাকী। আগে তো ঘর লে চল, পানি পিয়া। বহত হি তিয়াস লাগল বা।’ এরপর কাকী ফুল্লরীর এক হাত ধরে ঘরের ভেতর নিতে নিতে ওর স্বামীকে ডাকতে থাকলো ‘ এ নাগ-জি, ওঠ্্, সোকাল হোয়ে গেলো। দেখ্ কোউন আসলো তুহার ঘোরে।’ রাম প্রসাদসহ ফুল্লরী প্রবেশ করলো হীরন নাগের শোবার ঘরে। ওদের কথা বার্তার মধ্যে হীরন নাগও জেগে উঠলো। জেগে উঠেই ফুল্লরীকে দেখে রীতিমত যেন চমকে উঠলো হীরন নাগ। বিশ্বাসই করতে পারছিলো না যে ফুল্লরী ওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। বিছানা থেরক নেমেই সরাসরি ফুল্লরীর সামনে দাঁড়িয়ে ওর মাথাটি নিজের মুখের একেবারে কাছাকাছি এনে দু গালে হাত দু’টি রেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে যেন ফিসফিস ক’রে বললো ‘ কোতো বড়া হোয়ে গেলো হামার ফুল্লরী মা-ই। আরে দেখ্ না সাগিনা, ফুল্লরী কো দেখ্, বহত বড়া হোয়ে গেলো, আরও সুন্দর হোয়ে গেলো। উধার দেখ্ রাম পরসাদুয়া ভি বড়া হোয়ে গেলো। কোতো দিন আগে ওকে দেখেছিলোম হ্যায় না-রে সাগিনা? কোথা কেনে বোলছিস্ না-রে?’ হীরনের কথা শুনবার পর কতকটা যেন অভিমান করেই বললো সাগিনা ‘হাঁ হাঁ ঠিকই তো, তোখন থিকে নিজেই বোক্বোক্ কোরতে কোরতে হামার কানমে তালা লাগিয়ে দিয়ে ইখোন বোলছে কেÑ হামি কোথা বোলছি না? শুন্ ফুল্লরী তুহার কাকাকে বাত শুন্।’ এর মধ্যেই কাকী একটি কাশার গ্লাসে এক গ্লাসে পানি এনে ফুল্লরীর হাতে দিয়ে বললো ‘ই লে, পানি পি-কে তিয়াস নিভা।’ পানির গ্লাসটি হাতে নিয়ে কাকাকে উদ্দেশ্য ক’রে কাকীর অভিমান মেশানো কথাগুলি শুনে খিল খিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে ফুল্লরী। ফুল্লরীর হাসি দেখে এত বড় জীবন-মরন ঝুঁকির মুখে থেকেও না হেসে থাকতে পারে না রাম প্রসাদ। হাসতে হাসতে রাম প্রসাদও কাকীর কথা সমর্থন ক’রে বলে ‘ কাকী তো ঠিকই কহল বা কাকা। আগর তু না থামলে কাকী তো কোথা বোলতে পারবেক লা-ই, হ্যায় না হীরন কাকা!’ রাম প্রসাদের কথা শুনে কতকটা যেন ক্ষোভের সাথেই উচ্চারণ করে হীরন কাকা ‘হাঁ হাঁ তু তো বোলবেকই কাকীকে তরফ, তু কাকীকে এক লম্বর তরফদার হ্যায় না পরসাদজি? কাকা তো কিসিকি পছন্দ হি নাহি। কেয়া, রামজি বেটা, হাম নে ঠিকই বোললোম তো, হ্যায় না?’বিষয়টি ফুল্লরী ওর বুদ্ধির তীক্ষতা দিয়ে নিমেষেই বুঝে নেয়। এখুনিই কাকাকে না থামিয়ে দিলে কাকীর সাথে কাকার ঝগড়ার যুদ্ধ বেধে যাবে। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই ফুল্লরী গিয়ে কাকার বিছানায় ওর পাশে গিয়ে বসে এবং কাকীকে আহবান জানায় ‘ এ কাকী হামরে পাছ্ আওয়াত তো, হামরে পাশ বয়েঠ্, কেয়া নাহি ব্যায়ঠল বা?’ কাকী এসে কাকার পাশে বসে। এক পাশে কাকা, এক পাশে কাকী আর মাঝে ফুল্লরী। এর মধ্যে কাকা উঠতে চায়। উঠবার উপক্রম করতেই ফুল্লরী কাকার একটি হাত টেনে ধরে ‘আরে, উঠল বা কাঁহে?’ ফুল্লরীর প্রশ্নের পর কাকার উত্তর‘কেয়া বাত! পিসাব ভি কোরবেক লাইখে?’কাকার কথা শুনে মুচকি হেসে ফুল্লরী বলেÑ ‘হাঁ হাঁ, যা পিসাব করকে জলদি আওয়াত্। বহত হি বাত চিত রহল বা।’ কাকা প্র¯্রাব করতে বাইরে চলে গেলে এদিক ওদিক দেখে খুবই চাপা স্বরে কাকীর সাথে কথা বলে ফুল্লরী
‘কাকী দেখ্, রাম র্পসাদ কি বহত বিপদ হোয়ে গেলো, একদম জিয়াকে বিপদ। কাকা, তু অওর ইয়ে সারা গাঁওকে সোব্বাইকে সাথে লিয়ে আগে র্পসাদজিকে জান তো বাচাতে হোবেক।’ফুল্লরীর চাপা কন্ঠের কথা শুনে যেন আঁৎকে ওঠে কাকী। ধ’রে নেয় এমন কিছু একটা ঘটেছে যার জন্যে রাম প্রসাদকে এখানে পালিয়ে আসতে হয়েছে। হয়তো নির্ঘাত এমন সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে যা রাম প্রসাদকে একেবারে জীবন মরনের মাঝামাঝি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দার”ণ অস্থিরতার সাথে অনেকটাই উত্তেজনা আর ভীতি মেশানো উৎকন্ঠা নিয়ে ফিস্ফিস্ ক’রে ফুল্লরীকে প্রশ্ন করবার আগে কাকীর চোখ দু’টি স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে অধিক বড় আকার ধারণ করে, চোখের ভ্রু দু’টি ওপরে উঠে গিয়ে কপালের মাঝামাঝিতে গভীর তিনটি ভাঁজের সৃষ্টি করে। প্রশ্ন করে কাকী ‘ হামরে কো তু বাতা তো ফুল্লরী রাম র্পসাদ কেয়া কুনো মানুষকে খুন টুন কোরে নাই তো! হামার তো ইখোন বহত ডর লাগছে, সে রোকম কুছু না হলে র্পসাদজিকে জিয়াকে বিপদ কেনে হোবে রে ফুল্লরী?’ ¬ কাকীর কথা শেষ হলে কাকীকে শান্ত হয়ে বসতে বলে ফুল্লরী। কাকী বিছানায় বসবার পর ফুল্লরীও কাকীর পাশে বসে বলতে শুর” করে ‘শুন্ কাকী.....।’কিন্তু ফুল্লরীকে থামিয়ে দিয়ে রাম প্রসাদই কাকীকে বলতে শুর” করে‘ কাকী হাম রামপরসাদ, তু তো জানত্ হি হ্যায় কে হাম রেল কোম্পানীকে উও ‘ধরমপুর’ ইষ্টিশানমে ‘পাইটমেন’ ( পয়েন্টস্ম্যান) কি কামমে নওক্রী করত্ বা। ইষ্টিশানকি মাষ্টারজিনে ভি হামরেকো বহত দিনোছে বহত্হি বিশওয়াস কোরতে রহল বা। লেকিন মাষ্টারজিনে উন্কা দিল্ছে আংরিজকো পসন্দ কভি নাহি করল বা। হাম ভি মাষ্টারজিকে সাথ এক। হাম ভি কভি নাহি চাহতে কে আংরিজ ফৌজ হামারে ইয়ে জমিনকো উন্কে আপনে তাবেদারি মে লে লে। হামরেকো মাষ্টারজিনে বহত বাত বাতায়া কেমোন কোরে হাম্রে সোবকো একসাথ মিল র্ক হামারে ইয়ে জমিন্ছে আংরিজ সোব জানোয়ার গোরা ফৌজকো হটাওত্ কি লিয়ে চুপ চুপ করকে কাম কোরতে হোবেক। কেমোন কোরে আংরিজ ফৌজকে রাইফেল বান্দুককে গুদাম লুট করকে ওহি রাইফেল, ওহি বান্দুকছে আংরিজ ফৌজকে হামারে ইয়ে মিট্টিছে হটাওয়াত্ কোরতে হোবেক। লেকিন, বাত ইয়ে হ্যায় কি, এতো কুছু সোব একদিন অওর এক রাতমে কভি না হোবেক। সাথ সাথ এক, দশ অওর পচাশ আদমীছেভি না হোবেক। ইস্কে লিয়ে হামরে গাঁও, আশ পাশকে হর গাঁও ওয়ালেকি সাথ বহত দূরোঁ কি গাঁওকে ভি সোব আদমীকে এক কোরতে হোবেক। অন্দর অন্দর ইয়ে কাম বহত পহেলে হি শুরু হো গৈল বা। কাকী, তু তো সোব হি জানত্ হো। হীরন কাকা তো তুঝে সব কুছহি বাতাওয়াত, হ্যায় না?’এই কথা কথাটি বলবার পরই রাম প্রসাদকে থামিয়ে দিয়ে কতকটা ধমকের সাথেই বলে ওঠে ফুল্লরী ‘আরে পরসাদজি, আসলি বাত কাঁহে বাতাওয়াত্ নাহি? টাইম কেয়া বহত হ্যায় হাম্রে পাছ?’ চোখ মুখ, ঠোঁট দাঁত এক করে ক্রোধের মাত্রাটিকে কোনোমতেই সামলাতে না পেরে যথেষ্ঠ ক্রোধ মিশ্রিত স্বরেই যেন কথাগুলি বললো ফুল্লরী। হাতে তো একদমই সময় নেই অথচ এই সঙ্কটজনক মুহূর্তে এসেও দ্রুত কথাগুলি বলতে পারছে না রামপ্রসাদ ফুল্লরীর ক্রোধের মূল উৎসটি এখানেই। এখনও বেঁচে থাকবার জন্যে কতো কিছুই না করতে হবে ওদেরকে এই ছোট্ট সাধারণ কথাটিকেও যেন বুঝতে পারছে না রামপ্রসাদ।
‘আরে বাপরে! ঠিক হ্যায় বাবা, ঠিক হ্যায়, আসলি বাত ম্যায় আভি বাতাওয়াত্ হুঁ।’ফুল্লরীকে আর কথা বলতে না দিয়ে এবার খুব দ্রæত বলতে শুরু করলো রাম প্রসাদ ‘ তো কাকী শুন্, ধরমপুর ইষ্টিশানকে দো লম্বর লাইনকে উপর পূরা দশ বগিমে চার পাঁচশও আংরিজ ফৌজকো লে কর পহেলেছে হি এক ট্রেন খাড়া রহল বা। মাস্টারজিনে হামরেকো চুপ্কে বাতায়া কেয়া ‘ ঝিনিয়া গাঁও ইস্টিশানছে অওর বহত আংরিজ ফৌজকো লে কর আনেওয়ালা ট্রেনকো ভি দো লম্বর লাইনমে হি লাগাতে হোবেক। ইস্কি মতলব ইয়ে হোলো কে, আনেওয়ালা ট্রেন যো হ্যায় উও ধরমপুর ইস্টিশানমে রুকেগি নাহি, সিধা পাস করেগি ধরমপুর ইষ্টিশানকি উপর দে কর বহতহি ইস্পিরিটছে। লেকিন হামরেকো পিলান মাফিক উও ট্রেন ধরমপুর ইষ্টিশানকো পার হোতে পারবেক লাইখে বা। ইস্ লিয়ে কে, আনেওয়ালা উও ট্রেন পহেলেছে হি দো লম্বর লাইনকে উপর খাড়া হুয়া যো ট্রেন রহল্বা উছকে পিছে ওয়ালে ডাব্বেকো এত্তো, এত্তো জোরছে ধাক্কা মারেগি কেয়া দোনো ট্রেন এক সাথ্হি পালাট্ জায়েগি ইস লিয়ে কে আনেওয়ালা ট্রেন কি লাইন দো লম্বর লাইনকে সাথহি লাগা দিয়া হুয়া। অওর ইস্কি ফায়দা ইয়ে হোবেক কি, দোনো ট্রেন কি অন্দর জিতনি আংরেজ ফৌজ রহলবা উসকা আন্দাজ আধা আধিকে জান উও ধাক্কে মারনেকি বাদ কুছ টাইমকি অন্দরমে হি একদম খতম হো যাবেক। অওর বাকী সোবছে অন্দর কুছ কুছ লেংড়া হোয়ে যাবেক, কুছ কুছ আন্ধা হোয়ে যাবেক, কাম কোরতে পারবেক লাইখে। আংরিজ ফৌজকি তাকৎ ভি বহত্হি কমজোর হো যায়েগি বোটেক। ইসি লিয়ে হাম্নে ঝিনিয়া গাঁওছে আনেওয়ালে ট্রেনকি লাইনকে পাইট (পয়েন্ট) দো লম্বর লাইনকে সাথ্ জোড় দিয়া অওর সিগনালকো ভি দো লম্বর লাইনকে কিলিয়ার দেখানেকে লিয়ে ডাউন কর দিয়া। লাইনকো জোড় দেনা, সিগনালকো ডাউন করনা ই সোব কাম করনেকি বাদ হাম অওর মাষ্টারজিনে একসাথ ইস্টিশান ছোড়কে ভাগ আওল্বা।’ কথাগুলি শুনবার পর কাকীর বড় বড় চোখ দু’টি কপালে উঠে যায়। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি মাত্রাধিক বেড়ে যাবার সাথে সাথে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করে কাকী। কাঁপতে কাঁপতেই বলে ‘ তো ইখোন তুহার কেয়া হোবেক রাম পরসাদুয়া অওর ইষ্টিশান মাষ্টারজিকো ভি কেয়া হোবেক?’ কাকীর প্রশ্ন শেষ হবার পর খুব দ্রæত উত্তর দেয় ফুল্লরী‘আরে কাকী ইয়ে সোব লিয়ে বাতচিত করনেকি টাইম তো ইখোন না হলো। তু ইয়ে তো সমঝ্তি কাকী কে পহেলে তো হাম সোবকো বাঁচতে হোবেক, উস্কে বাদ এক সাথ সোব্বাই মিল র্ক বসে ঠিক কোরতে হোবেক কি হাম্রেকো কেয়া করনা চাহিয়ে। হামরে খোদকো বাচানে কি সাথ সাথ ইয়ে মিট্টিকো ভি তো বাচাতে হোবেক।