ফরিদা ইয়াসমিন সুমি'র গুচ্ছকবিতা
উজানে যাব
-
বহুটাকাল ভাটির ভাটিতে,
উজানে যাব, কিছুটা সময়।
কোথাও একচোট বৃষ্টি হয়ে এলে
নতুন পানির আনাগোনায় সঙ্গী হব
রঙবদলের সাক্ষী হব পানির স্রোতের।
মিহিন ঢেউয়ে বিলি কেটে
মোহনার টানে সিথান জুড়ে
পানিতে, হাওয়ার গোপন প্রেমের সাক্ষী হবো।
বহুটাকাল ভাটির ভাটিতে,
এবার যাব উজান-ঘাটিতে।
রোদ
-
জলজ্যান্ত
মাঘমাসের ভেজা কুয়াশার ভেতর থেকে প্রকাণ্ড রোদের ভূমিষ্ঠ হওয়া দেখতে দেখতে
মনে হলো- মানুষ একসময় গুহাবাসী ছিল; শরীরে, মনে নিভৃত অন্ধকার আর নির্জন
ছায়া নিয়ে ঘুরত। এমন বেহিসেবি রোদের প্রাচুর্য বোধ হয় ছুঁতো না ওদের।
পৃথিবীতে তখনও এমন ডাকাতে রোদের প্লাবন ছিল। লুট হয়ে যেত সব আর্দ্রতার
সংশয়। ছিল অঙ্কুরোদগমের নিশ্চিত সম্ভাবনা। ঝিলিমিলি হাতছানি। তবু যাপিত
জীবন ছিল গুহাকে ঘিরে। দুঃসাধ্য ছিল ভয়,শঙ্কা,আতঙ্কের মতো আদিমতম অনুভূতির
বাইরে যাওয়া, আঁধারের সীমানা পেরিয়ে চকচকে ঝাঁ রোদ্দুরে ঝাঁপ দেয়া! মানুষের
কাছে পৃথিবীর বয়স বেড়েই চলে। একাকী আয়নায় নিরাভরণ শরীর দেখবার কালে জানা
হয়ে যায়, অন্ধকারের ছায়াই একমাত্র সত্য নয়। রোজই প্রচুর রোদ প্রসব করে
চলেছে পৃথিবী। গুহাবাসী নয় গৃহবাসী হতে হয় নেশা ধরানো রোদের ঝিলিক শরীরে ও
মননে মেখে!
কর্ণফুলী আর তুমি
-
কর্ণফুলী আর তোমাকে আলাদা ভাবি না-
বুকে পোরা একইরকম সমুদ্রিত হবার স্বপ্ন
পদ্মার মতো মিঠে নয়, নোনাজলে বয়ে চলা
নিটোল মোহনার জঙ্ঘায় সুখের সঙ্গম।
কর্ণফুলীর গায়ে হাত বুলিয়ে তফাত পাই নি-
তেমনই খরস্রোতা পাহাড়ি-ঢলের মতো
নির্জনতা পেরিয়ে নুড়ি-কাঁকরে ব্যস্ত মুখরতা
তেমনই ছোটো ছোটো অজস্র ঢেউয়ের নেশায়
প্রকাণ্ড তৃপ্তিতে বেলাভূমি পৌঁছে যাওয়া!
কর্ণফুলী আর তুমি একই আমার কাছে
পাহাড়ি মেয়ের কানের দুল
আর
ভেতরে ফোটা প্রেমের ফুল
নিয়ে
বয়ে চলেছ দু'জনই!
চোখের নাভি
-
চোখের নাভি এবং
মস্তিষ্কের ক্রিয়া-কেন্দ্র ভিন্নদিকে সরাতে,
কুশলী হয়ে, চতুরতা দেখিয়ে
প্রায়ই বলি,বারবার বলি-
'রোজই প্রেমে পড়ি'
ভাবখানাও দেখাই সেইরকম
যেন বা সত্যি সত্যিই
রোজই প্রেমে পড়ি!
চোখে ধুলো দিতে এরচে' উৎকৃষ্ট
আর ঝুঁকিহীন নৈপুণ্য জানা নেই।
যে যা বলে বলুক, যে যা ভাবে ভাবুক
তুমি অন্তত জেনো,
কথাটি পুরোপুরি সত্য
প্রেমে পড়বার অভ্যাসটি নির্ভুল
রোজই পড়ি তা-ও প্রায় অকপট
তবে ব্যক্তিটি একজনই
দ্বিধাহীন, অকুণ্ঠ,
ব্যক্তিটি শুধু তুমিই
মনখোলা, মুক্ত!
দীর্ঘবাক্যে কথা বলতে চাই
-
সংক্ষেপে কথা বলার কাল ফুরোলে জানিও-
দীর্ঘবাক্যে কথা বলতে চাই,
তোমার সাথে বকবক করি বলে ভেবো না, বাচাল।
কারো সাথেই দীর্ঘক্ষণ দীর্ঘকথা বলি না আমি,
তোমার কাছে এলেই তর সইতে না-চাওয়া
রাজ্যের কথারা এসে মুখিয়ে থাকে,
নতুবা বেশি কথা বলা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।
ভালোবাসি-
একা থাকতে,
রাত জাগতে,
নির্জনতার ভাষা বুঝতে-
তোমার কাছে গেলেই বুঝি
কতো কথা রয়ে গেছে বাকি!
সংক্ষেপে কথা বলার কাল ফুরোলে ডাক দিও- দীর্ঘবাক্যে কথা বলতে চাই।
নিশ্চিত ফিরবে
-
নিশ্চিত ফিরবে চেনাগলিতে
যার প্রতিটি পদক্ষেপ তোমার চেনা,
ইট, সুড়কি, বালির বিস্তারও জানা।
গলির ওপরকার একচিলতে নীলাকাশ
পাক খেয়ে উড়ে যাওয়া খয়েরী শঙচিল,
নিঃসন্দেহে তুমি ফিরবে এদের কাছে।
দেখা দিবে বলে দাঁড়ের ওপর
মাছ-ঠোঁটে বসে আছে মাছরাঙা!
চটকদার সেজেছে পঙক্তিমালা
নবযৌবনা যেন বা!
না-ফিরে থাকতেই পারবে না
সন্দেহাতীতভাবেই ফিরবে তুমি।