ফ্ল্যায়ার ময়েস্ট রিলেশন.... - শৌনক দত্ত
গল্পকার : শৌনক দত্ত
বাড়ীতে আজকাল বিশ্বস্ত লোক পাওয়া আজ বেশ দুস্কর।
নিধি
একটা মাল্টিমিডিয়া কোম্পানীতে বেশ বড় পোস্টে আছে।সকালে বেরোয় ফিরতে ফিরতে
আটটা নয়টা বাজে।শৌভনিকও নামী সি.এ, বছরের অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে
থাকে।তাদের ছেলে টিনটিন বাড়ীতে থাকে একা একা তাই বিশ্বস্ত মানুষ না পেলে
বাড়ীতে রাখতে বেশ চিন্তা হয়।আগে যে মেয়েটা থাকতো সে নিধির মামার গ্রামের
মেয়ে।মেয়েটা কাজে যেমন টিপটপ ছিলো,টিনটিনের সাথেও তার বেশ বন্ধুত্ব
ছিলো।গতমাসেই মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়েছে,তাই নিধি আর শৌভনিকের চিন্তা
বেড়েছে।নিধির কলিগ মেধা সেদিন অফিসে কথাটা শুনে বললেন নিধি বাড়ীতে একটা
পুরুষ হোম মেকার রাখবি।আমার বাড়ীতে যে মাসি কাজ করে তার বর,গতকালই
বলছিলো।শুনেছি গাড়িও চালাতে পারে,তোর ড্রাইভার পারপাসটাও সার্ভ হয়ে যাবে।
-পুরুষ মানুষ!হোম মেকার ধুর আনিজি হবে।
-আনিজির কি আছে।রেস্টোরেন্টে,আমাদের অফিসে পুরুষদের তুই অর্ডার করছিস না?
-তা করছি,কিন্তু বাড়ীতে সারা দিন একটা পুরুষ মানুষ রান্না করবে,আমায় হেল্প করবে কেমন লাগে না।
-নিধি,ডোন্ট বি সিলি,নিয়ে দেখ তোর পারপাস সার্ভ না হলে বাদ দিয়ে দিবি।
-শৌভনিকের সাথে দেখি কথা বলে।
১.
মেধা
সব যোগাযোগ করে দিলো।রবিবার সকালে লোকটি এলো। শৌভনিক তখন বাড়ী নেই।জরুরী
কি কাজে হঠাৎ তাকে অফিস ছুটতে হয়েছে। ড্রইংরুমে লোকটিকে বসতে বলে নিধি
কিচেনে এসে চা করে নিয়ে গিয়ে দেখলো টিনটিন লোকটির পাশে বসে গল্প
করছে,টিনটিনের হাতে একটি ফাইভ স্টার।নিধির চাউনি লোকটি বুঝতে পারলো।
-কিছু মনে করবেন না বৌদি চকলেটটা আমিই দিয়েছি টিনটিন বাবু কিছুতেই নিতে চাইছিলো না।
-নিধি নিজেকে সামলে একটু হাসে,কি দরকার ছিলো এসব আনবার।আপনার নামটাই তো জানলাম না।
-পিতৃপ্রদত্ত নাম প্রিয়াংশু,তবে লোকে ডাকে বল্টু দা।আপনি ও আপনারাও বল্টু ই ডাকবেন।
-হাতের আড়ালে নিধি একটু হাসলো,ঠিক আছে বল্টু দা –ই না হয় ডাকবো কিন্তু আজ যে বাড়ীতে দাদা নেই তাই পাকা কোন কথা যে দিতে পারছিনা।
-বৌদি,কিছু যদি মনে না করেন আমি কাল সকাল থেকে লেগে পড়ি।টাকা কড়ি যা দেবেন তা দেবেন।
-তা বুঝলাম কিন্তু দাদা-র মতামত ছাড়া আমি কি করে ফাইনাল কথা কি করে বলি।আপনি রান্না কি সব পড়েন।
-হ্যাঁ বৌদি,আমিষ,নিরামিষ সব পারি,গাড়িও চালাতে পারি।
-গাড়ি
চালাতে পারেন শুনেছি মেধার কাছে,কিন্তু আমার মাথায় একটা কথা ঢুকছে না
শোনার পর থেকেই।গাড়ী চালাতে পারেন যখন গাড়ী না চালিয়েও তো রোজগার করতে
পারতেন?বাড়ী বাড়ী কাজ তো শুনেছি আপনার স্ত্রী ই করেন।
-কোচবিহার
থেকে কলকাতায় এসে তাই তো করতাম,দুজনের ওইটুকু রোজগারে সংসার আর চলছে
না।আজকাল তো প্রায় সবারই নিজের গাড়ি আছে।ভাড়া গাড়িতে তেমন রোজগার থাকে না
মালিকের টাকা দিয়ে।তাছাড়া কয়েকমাস একজনের বাড়ীতে গাড়ি চালিয়েছি,যা বেতন
তাতে সংসার সেভাবে চলে না।তাই আর কি,তা বৌদি কাল থেকে আসবো?
টিনটিন বেশ লাফিয়ে উঠলো,হ্যাঁ কাকা তুমি কাল থেকেই এসো আমি তোমায় পাজল শিখিয়ে দেবো।
-টিনটিন,দাদা আমি আপনাকে পরে জানাই আপনার দাদার সাথে কথা বলে।
কুচকানো টেরিকটের প্যান্ট আর রংচটা গেঞ্জিটা টান দিয়ে লোকটি মাথা নেড়ে উঠে গেলেন।
২.
শৌভনিক সব শুনলো মন দিয়ে।কোচবিহার থেকে এসেছে কলকাতায়।
-তাই তো বললো।
-নামটা কিন্তু বেশ বল্টু।
-আমিও
হেসে ফেলেছিলাম।নিজেকে সামলেছি অনেক কষ্টে,তবে ভাল একটা নাম আছে উনার
বলেছিলেনও এখন মনে করতে পারছিনা।তা ওনাকে কি রাখবো?টিনটিনের সাথে তো বেশ
মিলে গেছেন এইটুকু সময়েই,তোমার ছেলে তো কালই আসতে হবে জেদ করেছে,আমি পরে
জানাবো বলে দিয়েছি।
-রাখো তবে।কোচবিহারের মানুষ।
-তোমার বাড়ীর এলাকার লোক বলে রাখতে বলছো নাকি?
-না
তা নয়,তোমার মুখে সব শুনে মনে হলো লোকটা মন্দ হয়ত হবে না।তাছাড়া তোমার
ড্রাইভারটাও তো বলছে বেতন বাড়াতে হবে,ওকে ছেড়ে দিয়ে দুটি পারপাস যদি সার্ভ
হয় আমাদের বেতন না হয় বাড়িয়ে দিলে লোকটার।মন্দ কি?
৩.
শৌভনিকের
বেড়ে ওঠা কোচবিহারে।বাবা ব্যাংকে চাকরি করতেন,সে ছিলো বাবার ন্যাওটা তাই
বাবার সঙ্গে স্কুটারে যাবার জেদে একটি বছর তাকে পড়তে হয়েছিলো ব্যাংকের
পাশেই চিলাখানা হাইস্কুলে।শহরের স্কুল ছেড়ে গ্রামে পড়তে এসেছে এমন ছাত্র
তখন গ্রামে কেউ দেখেনি।তার উপর সরলমানুষগুলোর ম্যানেজার বাবুর ছেলে শৌভনিক
ছিল খুব দর্শনীয়।শিক্ষকরা আলাদা নজর দিতো,স্কুলের ছোট বড় ছাত্ররাও বেশ সমীহ
করতো।
নিধি টিনটিন ঘুমিয়ে পড়েছে।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে
সিগারেটে টান দিতে দিতে শৌভনিক কে আজ বহুবছর পর ঘিরে ধরেছে ছেড়ে আসা রঙীন
শৈশব।তার মনে পড়ে যায় স্কুলের কেউ খুব একটা না ঘেঁষলেও একটা ছেলে ছিলো যে
তাকে রোজ ফুল এনে দিতো,টিফিনে বাদাম দিতো।যদিও টিফিনের সময়টা শৌভনিক
ব্যাংকে চলে যেতো বাবার কাছে,কখনো কখনো স্কুলের পাশে নিত্যানন্দ
আশ্রমে।আশ্রমের সেবায়েত রোজ তার জন্য প্রসাদ তুলে রাখতো।সেই ছেলেটি ছিলো
তার নিত্যসঙ্গী।কয়েকদিনের মধ্যেই স্কুলে সবাই ওকে ক্ষ্যাপাতো,টিপ্পনি কেটে
বলতো কি রে রামচন্দ্রের হনুমান।ও কিছুই বলতো না।শৌভনিককে সে কোন কোনদিন
ছুটির পরে নিয়ে যেত টালি বানানো কি করে বানায় দেখাতে।কালচিনি নদীতে,সেখান
থেকে তরমুজের সময় তরমুজ তুলে খাওয়াতো।সিগারেট শেষ হয়ে আসে,ফিল্টারটা
এস্ট্রেতে চেপে ধরে শৌভনিক সেই বন্ধুটার নাম মনে করার খুব চেষ্টা
করলো।কিছুতেই মনে করতে পারছেনা।সব মনে পড়ছে নামটা কিছুতেই মনে করতে
পারছেনা।একটা অস্থিরতা ঘিরে ধরছে।তার এটাও মনে পড়ছে চিলাখানা থেকে এসে যখন
সে জেনকিন্সে চান্স পেলো,চিলাখানা স্কুলে শেষবারের মত সে গিয়েছিলো স্যার ও
ছাত্রদের কাছে বিদায় নিতে।সেদিন সেই ছেলেটা খুব কেঁদেছিলো,বাবার স্কুটারের
পিছে দৌড়ে দৌড়ে ভেলাকোপা পর্যন্ত এসেছিলো।বাবা অনেক বুঝিয়ে তাকে বলেছিলো যা
ফিরে যা ওকে আমি মাঝে মাঝে নিয়ে আসবো তুই কোচবিহার গেলে দেখা করে আসবি।তিন
কিলোমিটার পথ সে কি করে ফিরে গেছিলো কে জানে।বছর দুয়েক শৌভনিকের জন্মদিনে
সে তার বাগানের ফুল পাঠাতো বাবার কলিগদের দিয়ে।শৌভনিক আর কোনদিন চিলাখানায়
যায়নি তার বাবাও দুমাস পরে বদলি হয়ে কোচবিহার শহরে চলে এসেছিলো।শৌভনিকও
ভুলে গেছিলো তাকে শহরের বন্ধুদের ছায়ায় ছায়ায়।আজ এতবছর পর তার নামটাও মনে
করতে না পেরে তার খুব কষ্ট ও লজ্জা হলো।আরেকটা সিগারেট জ্বালালো শৌভনিক।সব
কয়জন বন্ধুর নাম মনে করার চেষ্টা করলো এবং আশ্চর্য হলো জেনকিন্স থেকে
পুরোনো কলিগদের নামও তার সব মনে আছে কেবলিএকটি নামই তার স্মৃতির কোথাও নেই।
৪.
বল্টুদা
কাজে জয়েন করেছে।যদিও শৌভনিকের সাথে তার আজও দেখা হয়নি।ক্লোজিং থাকার দরুন
শৌভনিক একমাস ধরে অফিস বের হয় সাতটায় ফেরে দশটা সাড়ে দশটায়।বল্টুদা আসে
আটটায় আর ফিরে যায় রাত নয়টায়।তবে টিনটিন এবং নিধি বল্টুদার প্রশংসায়
পঞ্চমুখ।শৌভনিককে অফিস থেকে ফিরে রোজ প্রথমে টিনটিন তার পর নিধির কাছে
শুনতে হয় বল্টুদার কথা।বল্টুদার রান্নার হাতটা অসাধারণ এটা শৌভনিকও মানে।এত
বাহারী খাবার মায়ের মৃত্যুর পর যে খাওয়া হয়নি রোজ খেতে খেতে শৌভনিক মনে
মনে প্রশংসা করে কিন্তু কখনো নিধিকে বলে না।
-জানো,আজ
কি হয়েছে।গাড়িটায় কি একটা হযেছিলো গ্যারেজে দশ হাজার চাইলো,বল্টুদা
বললো,বৌদি গ্যারেজে দিতে হবে না বাড়ী গিয়ে আমি দেখছি।অবাক কি কান্ড জানো
বল্টু দা দুইহাজার টাকার কি একটা পার্স এনে ঠিক করে দিলো।
-বা,গ্যারেজের
টাকাও বাঁচিয়ে দিচ্ছো।তোমার তো সোনায় সোহাগা।টিনটিন তার ঘর থেকে দৌড়ে এলো
বাবালি জানো কাকু আমায় বলেছে আমায় অনেক ফুলের গাছ এনে দেবে।কি মজা হবে বলো
ওরা আমার বন্ধু হবে আমি ওদের সাথে খেলবো জল দেবো কথা বলবো।আর কাকা বলেছে
যেদিন গাছ গুলো আমার বন্ধু হয়ে উঠবে তখন ওরা ফুল দেবে।
-শোনো,না কাল তো ওর সেলারি দিতে হবে,কিছুই তো বলে না।কত দেবো?
শৌভনিক
বেসিনে হাত ধুয়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো টিনটিন বলে উঠলো,আমার টাকা আছে না
আমি দিয়ে দেবো কাকা কে একশ টাকা।একটা হাসি ছড়িয়ে পড়লো ঘরময়।
৫.
বল্টুদা,আমি
আর টিনটিন তিনদিনের জন্য একটু বাবার বাড়ী যাবো তুমি এই তিনদিন এগারটার
দিকে যদি বাড়ী ফেরো খুব বেশি অসুবিধা হবে কি?তোমার দাদা দশটায় ফিরে খেয়ে
নিলে তুমি চলে যেও।
-ঠিক আছে বৌদি আমি দাদা খেলে পরেই না হয় যাবো।
-তোমার দাদা কিন্তু ঠান্ডা খাবার একদম খেতে চায় না,তাই ও ফিরলে খাবারগুলো মাইক্রোওয়েবে গরম করে দিও।
-আচ্ছা বৌদি।
-আর একটা কথা দাদা বলতে লজ্জাই করছে তোমার দাদার বিছানাটা গুছিয়ে ওষুধের বাক্সটা মনে করে দিও নয়ত ওষুধ খাবেনা তোমার দাদা।
পরেরদিন
দশটায় বল্টুদা নিধিকে এয়ারপোর্টে পৌঁচ্ছে দিয়ে এলো।রান্না শেষ করে সে
টিভিতে সিনেমা দেখলো,টিনটিন নেই এই সময়টা সে টিনটিনের সাথে কাটায় তাই খুব
ফাঁকা লাগছিলো তার।মনটা হুহু করছে।যদিও তখনো সে জানে আরো মন হুহু করা মন
খারাপ তার জন্য অপেক্ষা করছে ঘড়ির কাটায়।
৬.
দরজায়
যখন বেল বাজলো তখন দশটা বেজে সাত।বল্টু দা দরজাটা খুলে দিলো, শৌভনিক ঘরে
ঢুকলো,আপনিই সেই বল্টু দা,উফ টিনটিনের কাছে রোজ আপনার এত গল্প শুনি অথচ এই
প্রথম আপনাকে দেখলাম যদিও গল্প শুনে শুনে আমি আরো আগেই দেখে ফেলেছি।দাদা
একগ্লাস চিল ওয়াটার দিন না প্লীজ।
নিধির বলে যাওয়া কথামত সব শেষ করে বল্টু দা বলো-দাদা,আমি এবার যাই।
-যাবেন,বলেই ঘড়ি দেখে শৌভনিক।এখন তো সাড়ে এগারোটা বাজে।আপনি কোথায় যাবেন।
-সাউথ কলনি।
-সাউথ কলনি!এখন তো কিছুই পাবেন না যাবেন কি করে?
-কিছু একটা পেয়ে যাবো,না পেলে হেঁটে চলে যাবো।
-কি বলেন পাগল নাকি,চলুন আমি দিয়ে আসচ্ছি বলেই টেবিলে রাখা চাবিটা ছুঁড়ে দেয় শৌভনিক।
-থাক না দাদা,আমি ঠিক চলে যাবো,তাছাড়া আপনি এতটা চালিয়ে এসেছেন,আবার...
-বৌদির গাড়ী তো খুব ভাল চালান শুনেছি আজ আমায় চালিয়ে নিয়ে যান,আমিও দেখি আপনি কেমন চালান ফেরার সময় আমি ঠিক চালিয়ে চলে আসবো।
৭.
শৌভনিক
বল্টুদা কে নামিয়ে ফিরে যাবার পর,গলি পথটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বল্টু দা
বস্তির ফাঁকে দেখলো পূর্ণিমার চাঁদ গলে গলে পড়ছে,শৌভনিকও কোচবিহারের ছেলে
কথায় কথায় শৌভনিক আসার পথে বললো,এটা শোনার পর বল্টুর মনে অজানা এক ভাললাগা
ঘিরে ধরেছে।কতদিন কোচবিহার যাওয়া হয়না,তার হাতে লাগানো নারকেল গাছটা
নিশ্চয় ফল দিচ্ছে,পুকুরটা কি আছে আজো নাকি পটলা সেটা বুজিয়ে ঘর করে
ফেলেছে।জলের দরে সব বিক্রি করে দিতে হয়েছিলো।একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের খুব
গভীরে চেপে রেখে,ঘরের কাছে এসে টিনের দরজায় শব্দ করতেই ঘরের ভেতর থেকে
আওয়াজ এলো-কে?
-দূর্গা,খোলো।
টিমটিম বাল্ব জ্বলে উঠলো।তারপর ঘসটে ঘসটে খুলে গেলো দরজা।
-বল্টু ভিতরে ঢুকে অসুস্থ ছেলের ঘুমন্ত মুখে হাত রেখে আদর করলো।
-এত রাত হলো যে আজ, হেঁটে এলে নাকি?
-না,দাদা গাড়িতে নামাইয়া দিয়ে গ্যাছে।
-ডাক্তার তো সব ওষুধ বদলে দিয়েছেন।একটা ট্যাবলেটের দাম বাহান্ন টাকার।
-এনেছো?
-হ্যাঁ,সব ওষুধ চারটে করে নিয়ে এসেছি।ডাক্তারতো আগামীকাল তোমারে অবশ্যই যেতে বলেছে।
-কাল!কি করে যাবো,দাদা তো বাড়ীতে একা,বৌদি তিনদিন বাপের বাড়ী গেছে আমায় সব দায়িত্ব দিয়ে এমন অবস্থায় কাল কিরে যাই বলো তো?
৮.
সকালে
বল্টুদা এলো না।শৌভনিক ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে গেলো।কাজের চাপে সারা
সকাল বল্টুদার কথা বেমালুম ভুলে গেলো সে।লাঞ্চে নিধির কল পেয়ে তার মনে হলো
বল্টুদা আজ আসেনি।নিধি বাড়ীতেও নাকি কল করেছিলো কেউ কল ধরেনি।নিধির কথায়
একরাশ চিন্তা আর আশংকা ঝরে পড়ছিলো। কলটা কেটে শৌভনিক মনে মনে ঠিক করলো
সন্ধ্যায় বাসায় কল করে যদি দেখে বল্টুদা আসেনি তবে ফেরার পথে একবার
বল্টুদার বস্তিতে ঘুরে যাবে।নিধির কল আবার বেজে ওঠলো।
-এই
শোনো,মেধা কে কল করেছিলাম বল্টুদার বৌ তো আজ মেধার ফ্ল্যাটেও
যায়নি।ব্যাপারটা কিন্তু বেশ গোলমেলে লাগছে।তুমি যা ভুলো মনের মানুষ লকারের
চাবি সঙ্গে এনেছো তো?শৌভনিক পকেট হাতড়ে উত্তর দেয় হ্যাঁ তা তো এনেছি কিন্তু
ব্যাংক থেকে কাল যে টাকাটা তুলেছিলাম সেটা বিছানায় রেখেছিলাম সেটা বোধ করি
লকারে ঢুকাইনি।
-কি বলছো,সে তো অনেক টাকা।তুমি এখনই বাড়ী যাও।
-এখন কি করে যাবো তিনটায় আমার বোর্ড মিটিং।তুমি টেনশন করো না আমি সব ম্যানেজ করে নেবো।
মিটিং
শেষ করে বের হতে হতে শৌভনিকের নয়টা বেজে গেলো।মিটিংয়ের চাপে বল্টুদার কথা
বেমালুম ভুলে গেছিলো শৌভনিক।বাড়ী ফিরে মনে পড়লো বল্টুদার কথা।দরজা খুলে
বিছানার পাশে টাকা নেই,পকেট থেকে লকারের চাবি বের করে লকার খুলে দেখলো না
টাকাগুলো সে লকারেই রেখেছিলো।
৯.
পরেরদিন ভোরে শৌভনিক তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি,কলিং বেলের আওয়াজ।ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুললো শৌভনিক।অচেনা একটা লোক দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।
-নমস্কার,আপনিই কি শৌভনিক বাবু?
-হ্যাঁ,কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
-আমাকে প্রিয়াংশু পাঠিয়েছে।
-প্রিয়াংশুটা কে?
-প্রিয়াংশু মানে বল্টু আর কি।
-হ্যাঁ বলুন,
-প্রিয়াংশুর
ছেলেটা বড্ড অসুস্থ,হার্টে একটা বড় অপরেশান লাগবে,ওরা হাসপাতালে
আছে,আপনারা হয়ত খুব চিন্তা করছেন তাই আমায় পাঠালো জানাতে,আর সঙ্গে এই
ছোকরাকে দিয়ে পাঠিয়েছে,শৌভনিক লোকটির পাশে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে এতক্ষণ
খেয়ালই করেনি,বলার পরে একপলক দেখলো, দশটায় নাকি বৌদি ফিরবেন।ছেলেটা ভাল
গাড়ি চালায় ও গিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বৌদি কে নিয়ে আসতে পারবে। তাই সঙ্গে দিয়ে
দিলো আর কি।
শৌভনিক কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না।হাই তুলতে তুলতে বললো,এয়ারপোর্ট আমি যাবো সমস্যা নেই।কোন হাসপাতালে আছেন ওরা?
-সরকারী হাসপাতালে।
-আপনি অনুগ্রহ করে বল্টু দাকে বলবেন যেন এক ফাঁকে বাড়ীতে আসে আজ।
-আচ্ছা,প্রিয়াংশু কে গিয়ে আমি বলবো,তা হলে ছেলেটিকে কি নিয়ে যাবো?
-হ্যাঁ নিয়ে যান।
১০.
এয়ারপোর্ট
থেকে বেরিয়েই টিনটিন বাবালি বলে জড়িয়ে ধরলো শৌভনিক কে।জানো,মেধা সকালে কল
করেছিলো।টিনটিনকে কোলে তুলে নিতে নিতে নিধির দিকে তাকালো শৌভনিক,বল্টুদার
বৌটি তো ওর ফ্ল্যাটেই কাজ করে আজ সকালে গিয়ে নাকি বলেছে ওর ছেলে অসুস্থ
হাসপাতালে ভর্তি কি একটা অপারেশন করাতে হবে।মেধার কাছে নাকি দুইলাখ টাকা
চেয়েছে।ভাবো একবার এতটাকা নিয়ে মাসের মায়না থেকে কাটাবে বলছে,বল্টুদা তোমায়
কি কিছু বললো?
-না,কিছু বলেনি প্রিয়াংশু
নামটা
উচ্চারণ করেই কেমন যেন থমকে গেলো শৌভনিক।কোথায় যেন ডুবে গেলো।নিধি অনর্গল
বলেই যাচ্ছে,এগুলো এদের চাল,খোঁজ করে দেখো কোন অসুখ বিসুখ নেই কেবল টাকা
হাতানোর ধান্দা।দেখবে বল্টুদাও ঠিক এসে বলবে তাকেও লাখ দুয়েক টাকা
দাও।যত্তসব ধান্দাবাজ,আরে বাবা নিজের পেট পালতে পারিস না যখন ছেলেপেলের
জন্ম দিতে যাস কেন,যদি দিবিই তার ভবিষ্যত গুছাবিনা।
শৌভনিকের
খুব ইচ্ছে করছিলো বলে আরে বাল অসুখ বিসুখ তো হতেই পারে তাই বলে এত লেকচার
দেবার কি হলো।কিন্তু বললো নিধি সবাই ধান্দাবাজ হয় না।সত্যিই বোধ হয় জটিল
কিছু।
-বাবালি ধান্দাবাজ কি?
১১.
বল্টু
এলো না।বল্টু দাদার যে প্রিয়াংশু বলে একটা নাম আছে লোকটা না এলে জানাই
হোতো না শৌভনিকের।সন্ধ্যার দিকে শৌভনিক গাড়ি নিয়ে সরকারী হাসপাতালে যাবে
বলে বের হলো।নিধিকে কিচ্ছুটি বললো না।গাড়িটা সিগন্যালে দাঁড়ালো।ফুটপাথে
দাঁড়িয়ে থাকা একটা বৃদ্ধ লোকটার চোখে চোখ পড়তেই,শৌভনিক আঁতকে উঠলো এই চোখ
তার বড় চেনা।কোথায় দেখেছে,ভাবতে ভাবতেই সিগ্যনাল ছেড়ে দিলো।একটা পার্কিং
লটে গাড়িটা থামিয়ে শৌভনিক গাড়ি থেকে নেমে দৌঁড়ে এলো সেই জায়গাটায় যেখানে
বৃদ্ধ মানুষটা দাঁড়িয়ে ছিলো।লোকটা নেই। এদিক সেদিক তাকিয়ে শৌভনিক দেখলো
লোকটা রাস্তা পার হয়ে ওপাশের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।শৌভনিক
সিগন্যাল না মেনেই পাগলের মতো ছুটে রাস্তা পার হয়ে বৃদ্ধর সামনে গিয়ে একটা
প্রনাম করলো।বৃদ্ধ বেশ বিব্রত হয়ে তাকালেন।মাস্টার মশাই আপনি এখানে?
কালিপদ স্যার চিলাখানা স্কুলে যার ভয়ে ছাত্ররা যে কত প্যান্ট ভিজিয়ে তার
হিসেব নেই।ইরেজিতে ডক্টরেট করে তিনি আরো অনেক বড় কিছু করতে পারতেন কিন্তু
গ্রাম কে ভালবেসে এই স্কুলেই কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন।সবাই বলতো কালিপদ
স্যারের ডিকসেনারী মুখস্হ ছিলো।ছিলো ইংরেজিতে অগাধ জ্ঞান।শৌভনিকের ইংরেজির
ভিতটা উনার হাতেই গড়া।বিয়ে থা করেননি।বই আর ছাত্র-ছাত্রীদের কাটিয়ে দিলেন
এই জীবন।এখন একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন,বয়সের ভাড়ে নুজ্য তবু বিনা পয়সায়
বৃদ্ধাশ্রমের পাশের গরীব ছেলেদের ইংরেজি পড়ান।
-তোমাকে তো বাবা চিনলাম না।
-মাস্টার মশাই আমি শৌভনিক মিত্র।
-শৌভনিক মিত্র!কিছু মনে করো না বয়স আশি হতে চললো,আজকাল আর সব আর মনে থাকে না।
-মাস্টার মশাই আমি চিলাখানায় একবছর পড়েছিলাম,তারপর জেনকিন্সে চান্স পেয়ে চলে গেলাম।
-কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলেন কালিপদ বাবু,তারপর বললেন ও তুমি ম্যানেজার মিত্রবাবুর ছেলে।বাবা এখন কি কর।
-মাস্টার মশাই আমি জিনদাল গ্রুপে সি.এ পোস্টে আছি।
-বাঃবাঃ তোমাদের মত ছাত্রদের জন্য গর্ব হয়,মনে হয় জীবনে কিছু মানুষ রেখে যেতে পারলাম।
-তা মাস্টার মশাই আপনি এখানে কেন?
-সামনের রাস্তাটা পার হয়ে যে গলিটা আছে সেখানেই আমি থাকি।
-ও তাই এখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন বুঝি?
-না
বাবা ওখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে আমি সেখানেই থাকি।কাল বের হয়ে এসেছিলাম ঐ
ওষুধের দোকানটায়।ওখানে মাঝে মাঝে এসে আড্ডাও দেই আবার ঐযে দেখছো বারান্দাটা
ওখানে কয়েকটা পথ শিশুকে ইরেজি পড়াই,এতদিনের অভ্যাস ছাড়তেই পারিনা,আশ্রম
থেকে মানা করে আমি মানি না।তাই সপ্তাহে দুসপ্তাহে চলে আসি।কাল বসে আছি হঠাৎ
দেখি উদভ্রান্তের মতো একটা কি ওষুধ খুঁজতে এসেছে প্রিয়াংশু,প্রিয়াংশুর
সাথে তোমার যোগাযোগ আছে নিশ্চয়।শৌভনিকের মুখের দিকে তাকিয়ে কালিপদ স্যার কি
বুঝলেন কে জানে,মনে নেই তোমার প্রিয়াংশুর কথা।স্কুলে সবাই যাকে বলতো
শৌভনিক ভক্ত হনুমান।মনে পড়েছে।তার ছেলেটির কি যেন এক কঠিন রোগ,বলেছিলো এখন
মনে করতে পারছি না।যাই হোক অনেক টাকার দরকার।চিলাখানার জমিজামা সব তো আগেই
বিক্রি করে এসেছিলো তাতেও কুলায়নি আরো লাগে।আমি আগামীকাল ওকে আসতে
বলেছি,আমার জমানো কিছু টাকা আছে সেগুলো আর কোন কাজে লাগবে সেই টাকাটাই
দোকানে দিয়ে এলাম কাল এলে যেন দিয়ে দেয় বলে রেখে এলাম।তুমি এদিকেই থাকো
বুঝি বাবা,রাত হলো আমার যে যেতে হবে,সময় পেলে এসো একদিন কথা হবে।শৌভনিক
কেবল মাথা নাড়লো মুখ দিয়ে কোন কথা ওর বের হলো না।
১২.
পরের
দিনও অফিস গেলো না শৌভনিক।সকালে বেরিয়ে সরকারী হাসপাতালে গেলো।ডাক্তারদের
সাথে কথা বললো।বল্টু আর দূর্গার হাতে অপরাশনের টাকাটা দিয়ে বললো আমার
একবন্ধুই অপারেশনটা করবে চিন্তা নেই কোন।দূর্গা আর বল্টু সিক্ত নয়নে
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করতে বললো বাকী সবটা জীবন কাজ করে টাকাটা তারা মিটিয়ে
দেবে।শৌভনিক ফিরেই আসছিলো ঘুরে গিয়ে বল্টুর হাতটা চেপে ধরলো।বাড়ীতে আর কাজ
করতে যেও না,দূর্গাকেও পাঠিও না কোথায়।আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি দুজনে মিলে
একটা ব্যবসা করো।আর যখনই দরকার পড়বে আমায় ডাকতে সংকোচ করো না।শৌভনিক
হাঁটতে থাকে গাড়ির দিকে পেছনে একটা ভেজা ছায়া পাশে পাশে হাঁটতে থাকে
চিলাখানা স্কুলের সেই দুপুরের মতো......