বকুলমাল ।। হোসনেয়ারা বেগম
আজ
সকাল থেকেই মনটা খুশিখুশি জাহিদের। সেই সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে জাগাতে
জাগাতে মা যখন বললেন --"জলদি কইরা ওঠ বাপজান আইজকা সকাল সকাল কাজে যাওন
লাগবে। মেডামের বাসায় অনেক মেহমান আসবো। ম্যাডামের বাসায় যেদিন মেহমান থাকে
মা সেদিন একটু দেরি করে ঘরে ফিরলেও মিষ্টির প্যাকেটে করে অনেক মজার মজার
খাবার নিয়ে আসে
ওর জন্যই নাকি ম্যডাম দিয়ে দেয় আহা কত ভাল মেডাম মনে মনে আওড়ায় আর মিটমিট হাসে জাহিদ।
সকালে
পান্তাভাতে পিঁয়াজ কাঁচা মরিচ ডলে ছেলের মুখে নলা পুরে দিতে দিতে জাহিদের
মা আয়মন ছেলেকে বলে গেছে -কয়টা ভাত হাঁড়িতে ভিজানো আছে দুপুরে যেন খেয়ে
নেয়। কিন্তু আজ জাহিদের আর ক্ষুধা তৃষ্ণা নেই। একটু পরেই পাশের খুপরির
জামালের সাথে রমনায় যাবে বকুল কুড়াতে। ওর সাথে মালা গেঁথে সাহবাগের
সিগন্যালে বিক্রি করবে। মা সারাদিন কাজ করে এটা ওর ভাললাগে না। দিনে দিনে
মা কেমন রোগাটে হয়ে যাচ্ছে! দেশের বাড়িতে যখন ছিল মা তখন কত সুন্দর ছিল।
জাহিদ চেয়ে চেয়ে দেখত মায়ের উঠোন ঝাড়ু দেওয়া ঘরদোর লেপা। আহা কী সুখের সে
দিনগুলি। গ্রামে কাজের অভাব দেখা দিলে বাপজান কাজের খোঁজে একদিন শহরে চলে
এলে শুরু হয় মা বেটার দুঃখের দিন।দিন যায় মাস যায় বছর ঘুরে গেলেও বাপজান আর
আসে না কোন খোঁজ খবরও পায় না। মা পথের দিকে চেয়ে থাকে আর চোখের জলে ভাসে।
একদিন পাশের বাড়ির হামজা চাচা শহর থেকে এসে খবর দিল তার বাপ শহরে রিক্সা
চালায় ভালই আছে নতুন সংসার পেতে। সেই থেকে মা আর কাঁদে না। একদিন মাও
জাহিদকে নিয়ে পাশের বাড়ির রহিমা চাচির সাথে ঢাকায় চলে আসে। এই খুপরি ঘরে।
ফুটপাতের সাথে খুপরি ঘর জাহিদের প্রথম প্রথম একটুও ভাললাগেনি। গাড়ির শব্ধ
মানুষের চলাচলের শব্ধ। কেমন যেন চারিদিকে হৈচৈ। কেবলই গাছগাছালিতে ঘেরা
নীরব নিঃস্তব্দ নিজের বাড়িটির কথা মনে পড়েছে। খেলার সাথীদের কথা মনে
পড়েছে।নদীতে ঝাপাঝাপি আর ডাঙ্গুটি খেলার কথা মনে হয়েছে। এখন এই ক' মাসে সব
সয়ে গেছে। দু'বেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে। যেদিন হামজা চাচা বাবার খবর এনে
দিয়েছিল সেদিন থেকে মা আর হাসে না ভাবতেই জাহিদের মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে
যায়।
জামালের খুপরির দিকে হনহন করে হেঁটে গিয়ে জামালকে ডাকে---জামাল জামাল।
জামাল খুপরি থেকে সুঁই সুতোর একটা পলিথিন হাতে বেড়িয়ে এসে বলে -- চল পারবি তো!
জামাল
বয়সে জাহিদের চেয়ে বছর তিনেক বড় হবে কিন্তু এসব কাজে সে একেবারেই পাকা।
সিগন্যাল পড়লেই সাহেবদের গড়ির উইন্ড স্ক্রিনে টোকা দেওয়া মালা কেনার জন্য
ম্যাডামদের প্রলুব্ধ করা সর্বোপরি নিজের অসহাত্বের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলা।
সকাল
থেকে ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে বেলা দশটার দিকে জামালের হাত ধরে সাহবাগের
সিগনালে দাঁড়ায় জাহিদ। সিগনাল পড়তেই কাঠির মাথায় ঝুলানো কয়েক গাছা মালা
এগিয়ে দেয় কালো গাড়ির খোলা জানালায়-- মেডাম মালা নিবেন মেডাম মালা?
গাড়ির
জানালায় ভিতরে বসা মার বয়সী মহিলাকে দেখে মায়ের মুখটা মনে পড়ে যায়। বাপজান
হারিয়ে যাবার আগে মাকে মাঝে মাঝে স্নো -ক্রিম পাউডার দিয়ে এমন সাজগোজ করতে
দেখত।তখন মাকে দেখতে ঠিক মায়ের মুখে শোনা পরির দেশের সেই পরির মতই লাগত।
সহসাই সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে গাড়ি চলতে শুরু করে। জামাল একলাফে
আইল্যান্ডের উপরে উঠে জাহিদকে ডাকে - জাহিদ তারাতাড়ি আয় সিগনাল উইঠ্যা
গ্যাছে তারাতাড়ি আয়।
জাহিদ লাফদিয়ে আইল্যান্ডে উঠেও
পা পিছলে পড়ে যায় আর তখনই অতর্কিতে একটি মটরসাইকেল ওকে ধাক্কা দিলে ছিটকে
পড়ে রাস্তার মাঝখানে। কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই সাদা রং এর গাড়ির চাকাটা ওর
পিঠের উপর দিয়ে চলে যায় ড্রাইভার হার্ড ব্রেক করেও শেষ রক্ষা হল না। গাড়ির
তীব্র হর্ণের শব্দের সাথে মায়ের শেষ চিৎকার ভেসে এল জাহদে কানে মা যেন তাকে
ডাকছে---জাহিদ জাহিদ বাপজান!
ছুটে এল ট্রাফিক
সার্জেন্ট। আবারও কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল গাড়ি কিন্তু একেবারেই থেমে গেল
জাহিদের জীবন- গতি। ট্রাফিক ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দিল জাহিদের ক্ষতবিক্ষত
দেহখানি। আর পিচঢালা কালো রাস্তায় পড়ে থাকল রক্তে ভেজা স্বপ্নে মাখা বকুলের
মালাগুলি।