রাজনীতি বিষয়টি জটিল আর বাংলাদেশের রাজনীতি তো সময়ের পরিক্রমায় বেশিই বাঁক নেয়। বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমান সময়ে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যে দেশটির জন্ম হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার স্বপ্ন নিয়ে সেই দেশটি এই মুহূর্তে পরিষ্কারভাবে দুইভাগে বিভক্ত। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বিরাজমান দুইধারার রাজনীতিসহ দেশের সামগ্রিক অবস্থান চমৎকার সহজ বিশ্লেষণের প্রবন্ধের বই ‘বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি’ ।
বইটির লেখক শিক্ষক, বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধকার,রাজনৈতিক বক্তা এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান।
বইটি এ সময়ে তরুণ থেকে শুরু করে সবারই পড়া উচিত বলে আমি মনে করি। তরুণদের বইটি পড়তে বলছি একারণে কারণ তরুণদের সাথে বাংলাদেশ ও এর রাজনীতি, ইতিহাস বিষয়ে আলোচনায় প্রায়শই আমার মনে হয়েছে তাদের বাংলাদেশের ৪৭ বছরের নানান চড়াই উতরাই সর্ম্পকে খুব স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু এদেশের ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য যেমন তরুণদের প্রয়োজন, তেমনি তাদেরও প্রয়োজন বর্তমান ও পেছনের বাংলাদেশকে জানা। তবে সে জানাটা হতে হবে সঠিক ও নিরপেক্ষ। তাহলে তাদের আর বিভ্রান্ত হবার সুযোগ থাকবে না।
এই বইটি পড়লে সর্বোপরি পাঠকেরা বুঝবে তারা কোন পথ বেছে নেবে ভবিষ্যতে। লেখকের ভাষায় ‘ সমৃদ্ধির বাংলাদেশ নাকি জঙ্গিবাদ আর রাজতন্ত্রের বাংলাদেশ ।’ বাঙালির আমেরিকা প্রীতি সর্বজনবিদিত আমেরিকা যেতে পারলে/ নিদেনপক্ষে পোলাপানকে আমেরিকা পাঠাতে পারলে যেন জীবনটা আমাদের পূর্ণ হয়। যেন আমেরিকা কোন দেশ নয়, এ যেন স্বর্গ । সবকিছুই সেখানে নিখুঁত। কিন্তু এই বই থেকে আমরা জানতে পারি ‘জুনিয়র বুশ প্রথমবার নির্বাচনে হারার পর আদালতের হুকুমে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ।’ (পৃষ্ঠা ৪৬,বিস্তারিত পড়ুন)। দেশটি কী রকম বর্ণবাদী ও অমানবিক তা এ বইয়ের ‘সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন ও হালাল নির্বাচনের খোঁজে’ নিবন্ধে লেখক তুলে ধরেছেন।
বিশ্বভারতীতে যে বাংলাদেশ ভবন হয়েছে তা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু তার বিশদ বিবরণ আমরা জানি কি? বইয়ের ‘নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’ নিবন্ধে লেখক বিশদভাবে বাংলাদেশ ভবনের বর্ণনা,তার সৌন্দর্য ও তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। হয়তো এ নিবন্ধ না পড়লে আমাদের কলকাতায় স্থাপিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ সর্ম্পকে অনেক কিছুই অজানা থাকতো।
৭ই মার্চ ১৯৭১ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ এ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য পাগলপারা করেছিলেন তা নিয়েই লেখক লিখেছেন ‘৭ই মার্চ ১৯৭১-নতুন ইতিহাসের যাত্রা শুরু।’ লেখকের ভাষায় ‘এটি একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়ের চালিকাশক্তি ছিল।’
চারপাশের বুদ্ধিজীবীরা যখন দেশের ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকটাই বেশি তুলে ধরতে ব্যস্ত থাকেন সেখানে লেখকের এই বইয়ে আমরা দেখতে পাই দেশের উজ্জ্বল চিত্র। আর কতো নেতিবাচক কথা আমরা এ দেশকে নিয়ে শুনবো? আমরা কি ভুলে যাই আমরা স্বাধীনতার ৪৭ বছর অতিক্রম করেছি? আমরা কি জানিনা পজিটিভ চিন্তাই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
লেখকের ভাষায়‘ বহির্বিশ্বে যে বাংলাদেশি পাসপোর্টের কোন কদর ছিল না দশ
বছর আগে সেই পাসপোর্টে বাঙালিরা এখন ৪২ টি দেশে আগমনী ভিসা নিয়ে বর্তমানে
ভ্রমণ করতে পারে। দশ বছরে দেড় কোটি মানুষের জন্যে দেশের ভিতরে নতুন
কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ টিআইবির দুনীর্তি
সূচকে পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গত দশ বছরে সেই দুর্নাম শুধু ঘোচেইনি
বর্তমানে তার স্থান ১৭তম তে নেমে এসেছে আর এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে
বাংলাদেশের নাম নেই। ” নিবন্ধে লেখক বিস্তারিতভাবে সহজ ভাষায় বাংলাদেশের
নানা সাফল্য তুলে ধরেছে ।
আজ আর বাংলাদেশ কোন তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। আজ
বাংলাদেশের মাটি নরম ভেজা মাটির মত দেবে যাবেনা । বাংলার জমিন এখন শক্ত।
তবে তার পেছনে রয়েছেন কারা ,কারা এই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর, কারা
চায় বাংলাদেশকে পেছনে টানতে–এসব বিষয় সর্ম্পকে যদি আমরা স্বচ্ছ ধারণা নিতে
চাই তবে আমি বলবো বইটি আমাদের প্রত্যেকের পড়া একান্তই আবশ্যক।
বইটি পড়া শুরু করলে শেষ না করে আপনি উঠতে পারবেন না তা আমি নির্দ্বিধায় পাঠকদের বলতে পারি। কারণ সহজ ভাষায় রাজনীতির মত এত জটিল/দুর্বোধ্য বিষয়কে লেখক সাধারণ পাঠকদের জন্যে করেছেন বোধগম্য।
বইটির প্রকাশক কথাপ্রকাশ। ওপার বাংলায় যারা এই বইটি পড়তে আগ্রহী তারা এই প্রকাশনীর কলকাতা শাখাতেও বইটি পাবেন।
বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি সচেতন। চায়ের কাপে তারা রাজনীতির ঝড় তুলবেই।
কিন্তু তা কি জেনে নাকি না জেনে? তবে চলুন বাংলাদেশ ও– এর রাজনীতি, ইতিহাস
জানি সঠিকভাবে। অবশ্যই তা সঠিক বই পড়ে। ‘বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি’
বইটি আপনাদের জানার ইচ্ছাকে উসকে দেবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক প্রফেসর
আবদুল মান্নানের ৩১ টি নিবন্ধের সমন্বয়ে রচিত সুলিখিত এই বইটি লেখার জন্য
অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। বইটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি।
বই : বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি।
লেখক : আবদুল মান্নান।
প্রকাশক : কথাপ্রকাশ।
মূল্য : ২৫০ টাকা।