আমাদের বঙ্গভূমিতে প্রথাগত নাট্যচর্চার শুরু ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজদের
পৃষ্ঠপোষকতায়। এরপর কলকাতা হয়ে ঢাকায় এই আধুনিক নাট্যধারার সূত্রপাত হয়।
আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম সফল অর্জন হচ্ছে মঞ্চনাটক। শুধু অর্থ উপার্জন
ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ পেশাদারি নিয়ে নাট্যচর্চা বেগবান হয় ঢাকায় এবং ক্রমে
ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। নাট্যরীতি নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে, অসাধারণ সব
নাটক নির্মিত হচ্ছে, বিশ্বমানের নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী ও
নাট্যব্যক্তিত্বের জন্ম হচ্ছে এবং সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাট্যচর্চা
প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের
নেতৃত্ব আমাদের অতীব গর্বের বিষয়।
তবে আমরা আমাদের নাট্যচর্চার জন্য
প্রায়শই মুখাপেক্ষী হই পাশ্চাত্য নাট্যধারার। এ মুখাপেক্ষিতা মোটেও
নিন্দনীয় নয়, কারণ আমরা উন্নত ও প্রতিষ্ঠিত নাট্য সংস্কৃতিতে অবগাহন করে
নিজেদের সমৃদ্ধ করছি। শুধু পরিতাপের বিষয়, আমরা ভুলে যাই নিজেদের সংস্কৃতির
কথা, অবহেলা করি এ জনপদের নাট্যচিন্তাকে। আমাদের যাত্রা, পুঁথিপাঠ,
পালাগান ইত্যাদির ভেতর যে উন্নত ও আধুনিক নাট্যভাবনা কাজ করে, তা কদাচিৎ
আমরা বিশ্লেষণ করি, কখনো প্রয়োগ করি না। অথচ এ নাট্যধারার চর্চা ও প্রসার
আমাদের বিশ্ব নাট্যশিল্পে আরও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারত।
পাশ্চাত্য
নাট্যধারার রয়েছে প্রধান দুটি শাখা, প্রসেনিয়াম ও এপিক। এর মধ্যে ব্রেশটের
এপিক থিয়েটার হচ্ছে সর্বাধুনিক নাট্যরীতি। প্রসেনিয়াম থিয়েটারে অভিনয়ের
মাধ্যমে মঞ্চে একটি কল্পনার জগৎ এবং দর্শকদের মধ্যে একটি বিভ্রম তৈরি করা
হয়। অন্যদিকে এপিক থিয়েটারের মূলনীতি হলো অভিনয় দ্বারা কখনো দর্শককে
মোহাবিষ্ট করা যাবে না। কারণ মোহাবিষ্ট হলে দর্শক আনন্দ পাবে ঠিক, কিন্তু
নাটক শেষে ফিরে যাওয়ার সময় নাটকের মূল বক্তব্য ভুলে যাবে। তাই দর্শকদের বরং
প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে, মঞ্চে যা দেখছেন তা শুধু অভিনয়,
আসল ঘটনা ঘটছে আপনার জীবনে ও চারপাশে।
নাটকের মঞ্চে সুখ–দুঃখের ঘটনায়
দর্শক আন্দোলিত না হয়ে বরং নিজের বোধকে জাগ্রত করবে। নাট্য প্রয়োগের মূল
লক্ষ্য দর্শকদের অনুভূতিকে খোঁচা দিয়ে তাদের সচেতন করে তোলা। এ নাট্যভাবনার
একটি বড় উপাদান হচ্ছে সঙ বা সূত্রধর চরিত্র, যে চলমান অভিনয়কে মাঝে মধ্যেই
ভেঙে দিয়ে নাট্যকারের বক্তব্য ও বিশ্লেষণ সরাসরি দর্শকের সামনে তুলে ধরে।
নাটকের ঘটনা, চরিত্রায়ণ, মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা—সব মিলিয়েই দর্শককে প্রতি
মুহূর্তে সজাগ ও সচেতন রাখে।
এবার আসি আমাদের যাত্রাভিনয় প্রসঙ্গে। অবাক
বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, আধুনিক নাট্যরীতির এত উপকরণ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে
উপেক্ষিত হয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্পটি এবং এর মতো আমাদের
অন্যান্য মৌলিক শিল্প। প্রথমেই যাত্রার মঞ্চের কথা বলি। এখানে মঞ্চ বলতে
শুধু একটি উঁচু পাটাতন, যার চারপাশে কিংবা মাঝে কোনো স্থাপনা নেই। অধিকাংশ
সময় খালি মঞ্চেই অভিনয় চলে। কখনো চেয়ার বা এরূপ একান্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ এনে
দৃশ্য নির্মিত হয়, আবার দৃশ্য শেষে তা দর্শকদের সামনেই ভেঙে নিয়ে যাওয়া
হয়। দর্শক বসে মঞ্চের সামনে তিন পাশে, যেন পুরো মঞ্চটি তাদের হাতের মুঠোয়,
ইচ্ছে করলেই ছুঁয়ে দেখা যায়। প্রচলিত মঞ্চে তিন দিক ঢাকা থাকে, ফলে মঞ্চকে
এক অলীক জগতের মনে হয়। যাত্রায় যন্ত্রীদল রয়েছে যারা বসে মঞ্চের এক পাশে
দর্শকের সামনে। এখানে বসেই প্রতিটি দৃশ্যের আবহ সংগীত প্রয়োগ করছে। প্রচলিত
মঞ্চে যেখানে দর্শক জানতে পারে না কোথায় শব্দ তৈরি হচ্ছে কিংবা কোথা থেকে
আলো আসছে, সেখানে যাত্রায় কোনো লুকোচুরির সুযোগ নেই। অভিনয় শিল্পীদের
প্রবেশ ও প্রস্থানও ঘটছে দর্শকদের সামনে খোলা আলোয়। দর্শক দেখছে, একজন
অভিনেতা হেঁটে বা দৌড়ে আসছেন, মঞ্চে প্রবেশ করেই চরিত্রের ভেতর ঢুকে
যাচ্ছেন। যেমন দর্শক এক সম্রাটের গাম্ভীর্য ও পৌরুষ দেখে বিমোহিত হচ্ছে।
আবার পর মুহূর্তেই দেখছে যে, সম্রাট চরিত্র থেকে বেরিয়ে ওই অভিনেতা সাধারণ
মানুষের মত মঞ্চ ত্যাগ করছেন। কিংবা সেনাপতি, যে মঞ্চে যুদ্ধ করতে করতে
নিহত হলো, দৃশ্য শেষে দর্শকের সামনেই উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নিচ্ছেন।
দর্শক অভিনয় যেমন উপভোগ করছে, তেমনি অভিনয়ের পেছনের দিকগুলো দেখে
মুগ্ধ হচ্ছে। আর এপিক থিয়েটারের মূলনীতির সঙ্গে মিলিয়ে বলা যায়, দর্শক
অভিনয় দ্বারা কখনো বিভ্রান্ত হচ্ছে না, বরং প্রতি মুহূর্তে সচেতন থাকছে। আর
অভিনয় শিল্পীদের যোগ্যতা এখানেই, কত দ্রুত কত দক্ষতার সঙ্গে তাঁরা ব্যক্তি
থেকে নাটকের চরিত্রে রূপান্তরিত হতে পারেন। দর্শকদের সচেতন রাখার জন্য আরও
একটি উপাদান রয়েছে যাত্রায়, তা হলো বিবেক চরিত্র। অভিনয়ের মাঝে মাঝে বিবেক
প্রবেশ করে এবং সাধারণত গানের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য বা ঘটনার সূত্র তুলে
ধরে। এ যেন এপিক থিয়েটারের সেই সঙ বা সূত্রধর, যার রূপ ধরে নাট্যকার নিজেই
মঞ্চে উঠছেন দর্শকের সঙ্গে কথা বলতে।
যাত্রা আমাদের জনপদের মৌলিক লোকজ
শিল্প। অথচ কী অসাধারণ নাট্য বৈশিষ্ট্য! এত আধুনিক নাট্যরীতির উপকরণ থাকা
সত্ত্বেও সভ্য নাগরিক সমাজে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যাত্রা আশ্রয় নিয়েছে গ্রামে।
সস্তা রূপকথা, ঐতিহাসিক কল্পকাহিনী ও অশালীন নৃত্য নির্ভর হয়ে পড়েছে
অস্তিত্বের তাগিদে। যারা যাত্রাভিনয় করছে, তাদের নেই কোনো শিক্ষা, তারা
পায়নি কোনো প্রশিক্ষণ। খোলা মাঠে খালি গলায় অভিনয় করতে হয় বলে চিৎকার করে
বিশেষ ঢঙে টেনে টেনে কথা বলার এক অভিনয়রীতি রপ্ত করেছে তারা। আধুনিক শব্দ
ব্যবস্থা ও অভিনয় প্রশিক্ষণ এতে যোগ হলে যাত্রা হতে পারে এক উন্নতমানের
অভিনয়শিল্প। আধুনিক নাট্যরীতির জন্য বাইরে না দৌড়ে আমরা যাত্রাশিল্প নিয়ে
গবেষণা করতে পারি। এর নাট্য বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী এক নাট্যধারার
প্রবর্তন করতে পারি। বিশ্বের বুকে গর্ব ভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর এ
উপাদানকে আমরা কি করে উপেক্ষা করি?
অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল, যুক্তরাষ্ট্র । সূত্র: প্রথম আলো ।