শিবনারায়ণ রায় ঢাকায় এসেছিলেন সম্ভবত ১৯৯০ সালের দিকে। তাকে নিয়ে একটিঘরোয়া আড্ডার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই আড্ডায় কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেইউপস্থিত ছিলেন। আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণযোগ্য হয়ে আছে- সেই অনুষ্ঠানে কবিআবদুল মান্নান সৈয়দ এর সহবত দেখে। মনে হচ্ছিল একজন বাধ্যানুগত ছাত্র যেনপরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তার গুরুর বাণী শ্রবণ করছেন; মাঝে মাঝে মান্নান সৈয়দকিছু প্রশ্ন করছিলেন; আর ত্রিকালদর্শীর মতো রায় মহাশয় তার উত্তর দিচ্ছিলেন।
অনেকটা গ্রিক মিথোলোজির তাইরেসিয়াসের মতো। আমার কেবল মনে হচ্ছিল, মান্নানসৈয়দ তার তুলনায় এতটাই কি দীন! কারণ, আমরা তার পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ঔদ্ধত্যেরঅভিমানটুকু জানতাম; শুধু জানতাম না শিবনারায়ণ রায়ের জ্ঞানের বিশালতাটুকু।তখনো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যেই ছিলাম; লেখালেখি করছি বটে, কিন্তুজ্ঞানের সাগরে তখনো নুড়ি কুড়াতে আসার সময় হয়নি। পরে জেনেছি, তার পাণ্ডিত্যআমাদের স্বীকার করা না করার বাইরে তার ঠাঁই।
বার্টেন্ড রাসেল তারপাণ্ডিত্যকে সম্মান করতেন; যদিও শিবনারায়ণকে আমরা জানি একজন রেডিক্যালহিউম্যানিস্ট হিসাবে; ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার সম্পাদক এবং এম.এন রায়ের সুযোগ্যঅনুসারী হিসাবে। তিনি জীবনকে একটি যুক্তিময় সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠা করতেসারাজীবন কাজ করেছেন।
অবশ্য
আমার এ আলোচনা মোটেও শিবনারয়ণকে নিয়ে নয়; বরং সেদিন শিবনারায়ণ রায় বাংলা
কবিতা নিয়ে একটি মন্তব্য করেছিলেন, যাশৈশব-শিক্ষার
মতো আমার ঘাড়ে পাথরের মতো চেপে ছিল; যা অনেক সময় তোতা পাখিরমতো আওড়েছি; কিন্তু বর্তমানে সে বাক্যে আর জোর
পাচ্ছি না; অর্থাৎ তিনিবলেছিলেন, ‘
বাংলাদেশ
একটি বৃহত্তর গ্রাম, সেটি কখনো পুরোপুরি নগরে রূপান্তরহবে
না।
সুতরাং কবিতার বিষয়ের মধ্যে গ্রামীণ প্রাসঙ্গিকতা একটি অপরিহার্যউপাদান হিসাবে থাকবে। আর তার সমর্থনে তিনি বলছিলেন, কবি হিসাবে জসীম উদ্দীনএর মরণ নাই। সেদিক থেকে বন্দে আলী মিয়া, যোতীন্দ্রমোহন বাগচী এবং আলমাহমুদ অনেক বড় মাপের কবি।’ তাদের বড়ত্ব নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তুযে কারণের জন্য তারা কবি হিসাবে বড় বলে তার মনে হয়েছিল; তার উপস্থিতি কিবাংলাদেশের কোথাও এখন অবশিষ্ট আছে? আমি এখানে কোনো দীর্ঘ আলোচনার অবতারণাকরবো না। কেবল আমরা কয়েকটি প্রিয় কবিতার মৃত্যু ঘটেছে- সে কথাটি বলব। একটিবিতর্ক আমরা সর্বদা করে এসেছি, তাহলো কবিতা বিষয়ের নাকি আঙ্গিকের শিল্প।আমরা সে বিতর্কে না গিয়ে বলতে পারি, একটি বাদে আরেকটি হয় না, বিষয় বাদ গেলেঅঙ্গ আত্মাশূণ্য হয়; আর অঙ্গ বাদ দিলে আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ থাকে না।সেদিক থেকে আমরা এতকাল সেইসব কবিতার কথাই আলোচনা করে এসেছি, যেগুলো বিষয় ওরূপ বর্ণনায় আমাদের আকৃষ্ট করেছে।
আমার
শৈশব কেটেছে একটি গ্রামীণপরিবেশে। মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে জেলা শহরে
স্থায়ীভাবে আমাদের পরিবার চলে আসে।কিন্তু গ্রামের সঙ্গে আমার সংযোগ এখনো অক্ষুন্ন আছে। তবে আমি যে গ্রামকেচিনতাম তার অস্তিত্ব আর কোথাও নাই। প্রাত্যহিক একটা যোগাযোগ থাকার কারণেপরিবর্তনের
বিষয়টি হয়তো চট করে ধরা পড়ে না। কিন্তু
আমি যে গ্রামটিকে চিনতামতার একটি
নিখুঁত কাব্যিক রূপায়ন ছিল ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কিংবা ‘কবর’
কবিতায়;
যার
বিষয়-বর্ণনার দিকে এখন খেয়াল করলে খামতি ধরা পড়ে। কবর কবিতাটিনাকি
দীনেশচন্দ্র সেনের এত ভালো লেগেছিল যে কবির ছাত্রাবস্থায় এটি পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই পেয়েছিল। এই
কবিতাটির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনো কথা নেই।ব্যক্তিগতভাবেও কবিতাটির প্রতিটি চরণ আমার মুখস্ত; কিন্তু
এর প্রতিটিঅনুষঙ্গ বিশ বছরের নিচে কোনো বাঙালি
তরুণের পক্ষে বোঝা প্রায় অসম্ভব।সুধীন্দ্রনাথ বা বিষ্ণু দে-র কবিতা কঠিন বলে আমরা এতদিন যে
অভিযোগ করেআসছি; ঠিক এখন তার
উল্টো ফল ফলতে যাচ্ছে।
যেমন ‘কবর’ কবিতার একটি চরণ‘তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দু’হাতে জড়ায়ে ধরি/ তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিতোসারা দিনমান ভরি।’ আমি গ্রামের বহু তরুণকে জিজ্ঞাসা করেছি, যারা কখনোগরুটানা কাঠের লাঙল-জোয়াল দেখেনি।’
এভাবে আমি জসীম উদ্দীনের প্রতিটি কবিতারচিত্রকল্প মিলিয়ে দেখেছি, যার বাস্তবতা প্রায় বিলুপ্ত বলা চলে। ঠিকএকইভাবে আমার আরো দুটি প্রিয় কবিতার কথা বলতে পারি, একটি হলো যোতীন্দ্রমোহনবাগচীর ‘কাজলা দিদি’ অন্যটি আল মাহমুদের ‘খড়ের গম্বুজ’। আমি এই দুটিকবিতার কথা এ জন্য বললাম; অনেককেই বলতে শুনেছি, তাদের দৃষ্টিতে কবিতাগুলোরঅবিনশ্বরতায় আস্থাশীলতা। আমার মনে হয়, এর একটি অন্যতম কারণ, যারা এইকতিাগুলোর টিকে যাওয়ার কথা বলেন, তারা যুগসন্ধিক্ষণের মানুষ। অ্যানালগ ওডিজিটাল দুই যুগেই যারা বসবাস করছেন; যাদের মস্তিস্কে শৈশবে বেড়ে ওঠা জগতটাএখনো সত্য হয়ে আছে। এই তিনটি কবিতার অর্থ কেবল তিনটি নয়, একটি যুগেরকবিতারই আসলে মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে।
এক
হাজার বছর আগের চর্যার কবিতাগুলোওপ্রায় একই
ধরনের বিষয় নিয়ে এতদিন টিকে ছিল। কারণ
সেই কতিাগুলোতে এ অঞ্চলেরমানুষ যে
ধরনের পেশাজীবিতার সঙ্গে জড়িত ছিল; যারা লাঙল চালাত, মাছ ধরত,
নৌকা
বাইত, তুলো ধুনত, মদ চুলাই করত; কিংবা নগরের
প্রান্তে বারবণিতারা পশারসাজাত। এ দৃশ্য তো গত শতাব্দির আশির দশক
পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রএকটি সাধারণত
চিত্র হিসাবে পরিচিত ছিল। তাহলে
হাজার বছরের একটি কাব্যিকপর্বেরই কি
পরিবর্তন হতে যাচ্ছে? কিন্তু এখন প্রশ্ন থাকে, বিষয়
পরিবর্তনহয়ে গেলে কি কবিতার প্রাসঙ্গিকতা
সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়? আমার তো তা-ই মনেহয়। আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি তাহলে দেখব,
ভাষা
আসলে কিভাবে আমাদের ওপরক্রিয়া করে। আমরা জানি ভাষা আমাদের পরিচিত বস্তু ও
ধারণা জগতের ধ্বনিরূপ; ফলে এই ধ্বনি যখন বস্তুর পরিচিত রূপ
হিসাবে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় না তখনভাষা
তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
এখন
একটি প্রশ্ন, মহাকাব্যেরমিথোলজির
অবাস্তব দেবদেবিরা এখনো কিভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এটি খুবসাধারণ
ব্যাপার, কারণ তাদের অবস্থান তো আমাদের চেতনা ও কর্মলোকের উর্ধ্বে,
তাদের
অতিলৌকিক জগত এখনো আমাদের মস্তিস্কে ফ্যান্টাসি তৈরিতে সক্ষম।
শিবনারায়ন
রায় দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার একটি গ্রন্থের নাম ‘নায়কের
মৃত্যু’; গণতান্ত্রয়ানের যুগে যে আমরা সবাই রাজা এই রাজার রাজত্বে সে
কথা তিনিবুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু
টেকনোলোজির আমূল পরিবর্তন বুঝতে এখনো আমাদের আরোকিছুদিন
অপেক্ষা করতে হবে। ততদিনে এই
যুগনির্মাতা আমাদের ভাষা ও কবিতা জগতেমরণ ছোবল
হানবে বলে আশঙ্কা হচ্ছে। আর
টেকনোলোজির যুগের নতুন কবিতা দেখারসুযোগ হয়তো
আমাদের প্রজন্মে হবে না। তবু
আমার শৈশবের কবিতাগুলো বেঁচে থাক।