বাংলা কবিতার সরলতা ও দুর্বোধ্যতা
কর্মজীবনে ব্যস্ততার কাঁধে বহন করে আমরা ছিটকে গেছি গ্রাম থেকে শহরের
বিভিন্ন নাম না জানা অলিগলিতে, যন্ত্রমানবদের জীবন নকল করতে শিখেছি সে
কবেই। আজিজ থেকে সুপার মার্কেটে তারপর উত্তরায় অভিমুখে আমাদের যাত্রা
অব্যাহত, আমরা ঘুরছি, ঘুরছে সভ্যতা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একদল
সাহিত্যবোদ্ধা সুরে সুরে উচ্চকণ্ঠে ফলাও করে কবি জীবনানন্দ সেই বিখ্যাত
বাণী ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ বলে বেড়াচ্ছেন। আমি নিজেই এটার পক্ষে
সাফাই গাই! গাইবই না বা কেন? সব স্রোতের বিপরীতে অবস্থান নেয়াটাই
যুক্তিযুক্ত নয় ।
তবুও বলতে পারি, ছিটকে পড়া মানেই হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা এমনও নয়। সবাই যার যার কর্মকে জড়িয়ে ধরে ছিটকে পড়লেও, সাহিত্যবাজদের আড্ডা চলে আগের নিয়মেই বাংলা সাহিত্যের নেশাকে কেন্দ্র করেই। আমার লেখা প্রবন্ধগুলো নাকি অনেক কর্কশ ভাষায় লেখা হয়! এটা অনেক সাহিত্যবোদ্ধার কাছে শুনেছি, শুনছি এবং তা পাঠ করে অনেকেই আমার উপর ঝড় হাওয়ার মতোই ক্ষোভে-দুঃখে গালি বর্ষণ করতে চায়! এই চাওয়াটা আমার কাছে অস্বাভাবিক কিছুই না, এই চাওয়াটাই আমার কাছে আশীর্বাদ। মহাকাব্য লিখলেই কালের সাক্ষী হবে এটা ভাবা নিতান্তই বোকামি। দেশবিখ্যাত কবি হেলাল হাফিজ দু’লাইনের কবিতা অনেক লিখেছেন এবং বলাবাহুল্য সেগুলো কালের সাক্ষী হয়েও গেছে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বিখ্যাত একটি কবিতা-ওড়না। ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।’
সাহিত্যবোদ্ধা উদ্ধৃতি হতে জানা যায়, বাংলা কবিতার উৎপত্তি হয়েছিল মূলত পালি এবং প্রাকৃত সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতি থেকে। এটি বৈদিক ধর্মীয় ধর্মানুষ্ঠান এবং বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্মের রীতিনীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এর পরস্পরবিরোধী ছিল। তবে আধুনিক বাংলার সংস্কৃত ভাষাভাষীর ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য নামে পরিচিত। সাহিত্যবোদ্ধাদের মতবাদে, আনুমানিক খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে বাঙলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত ঘটে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাংলা সাহিত্য দুটি ধারায় আস্তে আস্তে বিভক্ত হয়ে পড়ে; কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ও ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের সাহিত্য। বর্তমানে আমরা যে বাংলা সাহিত্য দেখছি বা পাঠ করছি তা এতদিনে বিশ্বের দরবারে অন্যতম একটি সাহিত্যধারা হিসেবে সমাদিত। জাতিসত্তার কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা দুই দেশের বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট্য বিচার করতে গিয়ে বলেছেন: ‘আসলে বাংলাদেশের কবিতা মানেই এই সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রসংবলিত এক উম্মাতাল বাণীভুবন। পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা কবিতার সাথে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার মৌলিক পার্থক্য এখানেই। বাংলা কবিতার রোমান্টিসিজম ও রিয়েলিজমের দ্বন্দ্বকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন অনেকেই।’ এ দুইয়ের সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন: ‘আপাত বিরোধমুখর কিন্তু আখেরে সমান্তরাল। পাশাপাশি চলে, চলছে এবং সম্ভাবত চলবেই।’ বর্তমান কবিতার ধর্ম, মিথ, প্রকৃতি ও ইন্দীয়সহ আবহমান বাংলার লোকজ ও ধূবদ রোমান্টিজম জেঁকে বসেছে। এখন আধুনিক বাংলা কবিতা কালের দিক থেকে যেমন রবীন্দ্র পরবর্তী, তেমনটি গুণের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত বলে শনাক্ত করা হচ্ছে। এই কবিতা কে আমরা নগরকেন্দ্রিক, যান্ত্রিক সভ্যতার ধারা তীব্রভাবে প্রভাবিত, প্রচলিত বাকপ্রতিমার পরিহারে স্বতন্ত্র এবং প্রাত্যহিক চর্চার উৎসকেন্দ্রিক। সাহিত্যবোদ্ধাদের চিন্তাধারায়; সেই তিরিশ থেকে চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা কবিতার গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বসাহিত্যেও জটিল প্রেক্ষাপটে বাংলা কবিতা নিজেকে স্থাপন করতে গিয়ে একটি একটি বিশুদ্ধ কাব্যবোধের জš§ দিয়েছে। বাংলা কবিতার বয়স হাজার বছরেরও অধিক। চর্যাপদ থেকে শুরু করে কত যে আঁকাবাঁকা পথে হেঁটেছে এই বাংলা কবিতা, কত রূপে নিজেকে সাজাতে সক্ষম হয়েছে নিজের ক্ষমতায় তার উদ্ধৃতি বা ব্যাখ্যা দেয়ার চিন্তাশক্তি আমার নেই। আধুনিকতার মূল নির্যাস হলো মহাকালের সমালোচনা, বর্তমান সময় গভীর তাৎপর্যময় সময়। তবুও প্রশ্ন উঠে আসে, বাংলা কবিতা কি এখনো আগের মতো কবিতাই রয়ে গেছে? আর চিত্রকলা চিত্রকলাই? তবে টেড হিউজ বা টমাস হিনি, আলেকজেন্ডারের মতো কবিতা রচনা করেন না, শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ লেখেন না বিহারীলালের মতো, জয়নুল আবেদীন, সুলতান বা কিবরিয়া আকেননি রুবেনসের মতন। অর্থাৎ শিল্পী বা কবির দৃষ্টিভঙ্গিতে পরির্বতন এসেছে মাত্র। ঠিক তেমনিভাবে সমসাময়িক কবিদের কাব্যভাবনায় নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে, যুক্ত হয়েছে অভিনব বৈশিষ্ট্য।
আমি যদি এভাবে প্রশ্ন করি একজন কবিকে; বলুন তো কেমন যাচ্ছে বাংলা কবিতার দিনক্ষণ? বর্তমান সময়ে যে বাংলা কবিতাগুলো লেখা হচ্ছে সেগুলো আদৌ কবিতা কিনা? বর্তমান বাংলা কবিতার গতি পথটা কোন দিকে? গদ্যকবিতা নাকি ছন্দকবিতা কোনটাকে প্রাধান্য দিয়া হচ্ছে বা দিচ্ছেন? জানি এসব প্রশ্ন, মূলত প্রশ্নই থেকে যাবে। তাই তো- তরুণ কবিদের উদ্দেশে সোনালি কাবিনের কবি আল মাহমুদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: নতুন কবিদের ছন্দে কবিতা লেখার অনুরোধ রইলো, তার মতে, সবাইকে একটা কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার , যারা ছন্দ জানে না, তারা কবি নয়।
কিন্তু সমসাময়িক বাংলা কবিতাগুলো যেন ঝোঁকে পড়েছে ছন্দহীনতার প্রতি। যা তরুণ অনেক কবিই কবির এসব কথাকে দূষিত বাতাসের সাথে উড়িয়ে দিয়ে গর্ব করে বলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ‘ছন্দ জানিনে কিন্তু কবিতা লিখতে জানি।’ এ ঝোঁকের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ আবার বলেছেন প্রচলিত সকল ছন্দই সাধুভাষার। কবিতা কথ্যভাষায় যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে তার সাথে তাল মেলাতে পারেনি ছন্দ। কিন্তু বাংলা কবিতা এখন অগ্রসরমান আর বিশ্বকবিতার দরবারে বহমান অপরাপর সঙ্গে নীল হতে আগ্রহী। বাংলা কবিতার বিরুদ্ধে যেমন পুরনো অনেক অভিযোগই রয়েছে, যেমন একটি অভিযোগ; জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতা। দুর্বোধ্যতার জালে বাংলা কবিতা তার আসল রূপ হারিয়ে ফেলছে নাতো? বর্তমান কবিমহল পাঠকের রুচিকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছে না ! তাই তো বাংলা অভিধান ঘেঁটেঘুঁটে নেড়েচেড়ে সব দুর্লব শব্দচাবি দিয়ে যে কবিতার শরীর সাজানো হচ্ছে! মানে মেয়েলি ভাষায় সেটাকে বলা যেতে পারে ত্বকের বা অবয়বের ফাউন্ডেশন মারা। এ ক্ষেত্রে কবি পাবলো নেরুদার মুখে ঝাল খেয়ে নবীন অনেক কবিই মুখে ফেনা তুলে বলেন: কবিতা কোনো সময়ই নাকি স্থিতিশীল ছিল না, কবিতা জলস্রোতের মতো। কিন্তু নতুন কবিদের কাব্যদর্শন আরো অবোধ্য। অগোছালো, অসম্পূর্ণ, অর্থহীন, গাম্ভীর কবিতার গঠনশৈলী অন্যের কাছে মানে সাধারণ পাঠকের কাছে; যা ব্যক্তিগতভাবে অমূল্য সৃষ্টি বলেই গর্বে পা ফেলছেন না মাটিতে। কিন্তু তা অনেক প্রবীণ বা সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে খামখেয়ালি ছাড়া আর কিছুই না। কুকুর যেমন জন্মে অতঃপর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। কিন্তু কেউ আর তার কথা মনে রাখে না বা রাখার প্রয়োজনবোধ করেন না, ঠিক তেমনটি তাদের মানে কিছু তরুণদের লেখা, যেগুলো কোনোদিন বা কখনো কালের সাক্ষী হবার ক্ষমতা রাখে না। বাংলা কবিতায় এখন সার্বিক বিবেচনায় বাজছে ব্যক্তি নয় সমষ্টির স্বর, একীভূত সমষ্টির ভাষা। তবুও অনেকের কবিতায় উঠে আসছে তীব্র জীবনবোধ। বাংলা কবিতায় এতসব ঘোরলাগা চিত্রায়নের পরেও জাতিসত্তার কবি নুরুল হুদা তার কাব্যিক চোখে দেখতে পাচ্ছেন আলোর ফুলকি। তাইতো সমসাময়িক কবিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন: লিরিকের তাপর্যপূর্ণ নবনিরীক্ষার পাশাপাশি গদ্যবয়ান, প্রতীকময়তা, কোলাজ, আত্মগামিতা ও বহুস্বরপ্রবণতা নব্বইয়ের পর শূন্য দশকের কবিতায় তাৎপর্যপূর্ণ বাঁকবদলের সূচনা করেছে।
তবুও বলতে পারি, ছিটকে পড়া মানেই হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা এমনও নয়। সবাই যার যার কর্মকে জড়িয়ে ধরে ছিটকে পড়লেও, সাহিত্যবাজদের আড্ডা চলে আগের নিয়মেই বাংলা সাহিত্যের নেশাকে কেন্দ্র করেই। আমার লেখা প্রবন্ধগুলো নাকি অনেক কর্কশ ভাষায় লেখা হয়! এটা অনেক সাহিত্যবোদ্ধার কাছে শুনেছি, শুনছি এবং তা পাঠ করে অনেকেই আমার উপর ঝড় হাওয়ার মতোই ক্ষোভে-দুঃখে গালি বর্ষণ করতে চায়! এই চাওয়াটা আমার কাছে অস্বাভাবিক কিছুই না, এই চাওয়াটাই আমার কাছে আশীর্বাদ। মহাকাব্য লিখলেই কালের সাক্ষী হবে এটা ভাবা নিতান্তই বোকামি। দেশবিখ্যাত কবি হেলাল হাফিজ দু’লাইনের কবিতা অনেক লিখেছেন এবং বলাবাহুল্য সেগুলো কালের সাক্ষী হয়েও গেছে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বিখ্যাত একটি কবিতা-ওড়না। ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।’
সাহিত্যবোদ্ধা উদ্ধৃতি হতে জানা যায়, বাংলা কবিতার উৎপত্তি হয়েছিল মূলত পালি এবং প্রাকৃত সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতি থেকে। এটি বৈদিক ধর্মীয় ধর্মানুষ্ঠান এবং বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্মের রীতিনীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এর পরস্পরবিরোধী ছিল। তবে আধুনিক বাংলার সংস্কৃত ভাষাভাষীর ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য নামে পরিচিত। সাহিত্যবোদ্ধাদের মতবাদে, আনুমানিক খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে বাঙলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত ঘটে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাংলা সাহিত্য দুটি ধারায় আস্তে আস্তে বিভক্ত হয়ে পড়ে; কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ও ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের সাহিত্য। বর্তমানে আমরা যে বাংলা সাহিত্য দেখছি বা পাঠ করছি তা এতদিনে বিশ্বের দরবারে অন্যতম একটি সাহিত্যধারা হিসেবে সমাদিত। জাতিসত্তার কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা দুই দেশের বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট্য বিচার করতে গিয়ে বলেছেন: ‘আসলে বাংলাদেশের কবিতা মানেই এই সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রসংবলিত এক উম্মাতাল বাণীভুবন। পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা কবিতার সাথে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার মৌলিক পার্থক্য এখানেই। বাংলা কবিতার রোমান্টিসিজম ও রিয়েলিজমের দ্বন্দ্বকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন অনেকেই।’ এ দুইয়ের সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন: ‘আপাত বিরোধমুখর কিন্তু আখেরে সমান্তরাল। পাশাপাশি চলে, চলছে এবং সম্ভাবত চলবেই।’ বর্তমান কবিতার ধর্ম, মিথ, প্রকৃতি ও ইন্দীয়সহ আবহমান বাংলার লোকজ ও ধূবদ রোমান্টিজম জেঁকে বসেছে। এখন আধুনিক বাংলা কবিতা কালের দিক থেকে যেমন রবীন্দ্র পরবর্তী, তেমনটি গুণের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত বলে শনাক্ত করা হচ্ছে। এই কবিতা কে আমরা নগরকেন্দ্রিক, যান্ত্রিক সভ্যতার ধারা তীব্রভাবে প্রভাবিত, প্রচলিত বাকপ্রতিমার পরিহারে স্বতন্ত্র এবং প্রাত্যহিক চর্চার উৎসকেন্দ্রিক। সাহিত্যবোদ্ধাদের চিন্তাধারায়; সেই তিরিশ থেকে চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা কবিতার গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বসাহিত্যেও জটিল প্রেক্ষাপটে বাংলা কবিতা নিজেকে স্থাপন করতে গিয়ে একটি একটি বিশুদ্ধ কাব্যবোধের জš§ দিয়েছে। বাংলা কবিতার বয়স হাজার বছরেরও অধিক। চর্যাপদ থেকে শুরু করে কত যে আঁকাবাঁকা পথে হেঁটেছে এই বাংলা কবিতা, কত রূপে নিজেকে সাজাতে সক্ষম হয়েছে নিজের ক্ষমতায় তার উদ্ধৃতি বা ব্যাখ্যা দেয়ার চিন্তাশক্তি আমার নেই। আধুনিকতার মূল নির্যাস হলো মহাকালের সমালোচনা, বর্তমান সময় গভীর তাৎপর্যময় সময়। তবুও প্রশ্ন উঠে আসে, বাংলা কবিতা কি এখনো আগের মতো কবিতাই রয়ে গেছে? আর চিত্রকলা চিত্রকলাই? তবে টেড হিউজ বা টমাস হিনি, আলেকজেন্ডারের মতো কবিতা রচনা করেন না, শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ লেখেন না বিহারীলালের মতো, জয়নুল আবেদীন, সুলতান বা কিবরিয়া আকেননি রুবেনসের মতন। অর্থাৎ শিল্পী বা কবির দৃষ্টিভঙ্গিতে পরির্বতন এসেছে মাত্র। ঠিক তেমনিভাবে সমসাময়িক কবিদের কাব্যভাবনায় নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে, যুক্ত হয়েছে অভিনব বৈশিষ্ট্য।
আমি যদি এভাবে প্রশ্ন করি একজন কবিকে; বলুন তো কেমন যাচ্ছে বাংলা কবিতার দিনক্ষণ? বর্তমান সময়ে যে বাংলা কবিতাগুলো লেখা হচ্ছে সেগুলো আদৌ কবিতা কিনা? বর্তমান বাংলা কবিতার গতি পথটা কোন দিকে? গদ্যকবিতা নাকি ছন্দকবিতা কোনটাকে প্রাধান্য দিয়া হচ্ছে বা দিচ্ছেন? জানি এসব প্রশ্ন, মূলত প্রশ্নই থেকে যাবে। তাই তো- তরুণ কবিদের উদ্দেশে সোনালি কাবিনের কবি আল মাহমুদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: নতুন কবিদের ছন্দে কবিতা লেখার অনুরোধ রইলো, তার মতে, সবাইকে একটা কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার , যারা ছন্দ জানে না, তারা কবি নয়।
কিন্তু সমসাময়িক বাংলা কবিতাগুলো যেন ঝোঁকে পড়েছে ছন্দহীনতার প্রতি। যা তরুণ অনেক কবিই কবির এসব কথাকে দূষিত বাতাসের সাথে উড়িয়ে দিয়ে গর্ব করে বলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ‘ছন্দ জানিনে কিন্তু কবিতা লিখতে জানি।’ এ ঝোঁকের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ আবার বলেছেন প্রচলিত সকল ছন্দই সাধুভাষার। কবিতা কথ্যভাষায় যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে তার সাথে তাল মেলাতে পারেনি ছন্দ। কিন্তু বাংলা কবিতা এখন অগ্রসরমান আর বিশ্বকবিতার দরবারে বহমান অপরাপর সঙ্গে নীল হতে আগ্রহী। বাংলা কবিতার বিরুদ্ধে যেমন পুরনো অনেক অভিযোগই রয়েছে, যেমন একটি অভিযোগ; জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতা। দুর্বোধ্যতার জালে বাংলা কবিতা তার আসল রূপ হারিয়ে ফেলছে নাতো? বর্তমান কবিমহল পাঠকের রুচিকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছে না ! তাই তো বাংলা অভিধান ঘেঁটেঘুঁটে নেড়েচেড়ে সব দুর্লব শব্দচাবি দিয়ে যে কবিতার শরীর সাজানো হচ্ছে! মানে মেয়েলি ভাষায় সেটাকে বলা যেতে পারে ত্বকের বা অবয়বের ফাউন্ডেশন মারা। এ ক্ষেত্রে কবি পাবলো নেরুদার মুখে ঝাল খেয়ে নবীন অনেক কবিই মুখে ফেনা তুলে বলেন: কবিতা কোনো সময়ই নাকি স্থিতিশীল ছিল না, কবিতা জলস্রোতের মতো। কিন্তু নতুন কবিদের কাব্যদর্শন আরো অবোধ্য। অগোছালো, অসম্পূর্ণ, অর্থহীন, গাম্ভীর কবিতার গঠনশৈলী অন্যের কাছে মানে সাধারণ পাঠকের কাছে; যা ব্যক্তিগতভাবে অমূল্য সৃষ্টি বলেই গর্বে পা ফেলছেন না মাটিতে। কিন্তু তা অনেক প্রবীণ বা সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে খামখেয়ালি ছাড়া আর কিছুই না। কুকুর যেমন জন্মে অতঃপর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। কিন্তু কেউ আর তার কথা মনে রাখে না বা রাখার প্রয়োজনবোধ করেন না, ঠিক তেমনটি তাদের মানে কিছু তরুণদের লেখা, যেগুলো কোনোদিন বা কখনো কালের সাক্ষী হবার ক্ষমতা রাখে না। বাংলা কবিতায় এখন সার্বিক বিবেচনায় বাজছে ব্যক্তি নয় সমষ্টির স্বর, একীভূত সমষ্টির ভাষা। তবুও অনেকের কবিতায় উঠে আসছে তীব্র জীবনবোধ। বাংলা কবিতায় এতসব ঘোরলাগা চিত্রায়নের পরেও জাতিসত্তার কবি নুরুল হুদা তার কাব্যিক চোখে দেখতে পাচ্ছেন আলোর ফুলকি। তাইতো সমসাময়িক কবিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন: লিরিকের তাপর্যপূর্ণ নবনিরীক্ষার পাশাপাশি গদ্যবয়ান, প্রতীকময়তা, কোলাজ, আত্মগামিতা ও বহুস্বরপ্রবণতা নব্বইয়ের পর শূন্য দশকের কবিতায় তাৎপর্যপূর্ণ বাঁকবদলের সূচনা করেছে।