একটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ।
অন্তরক্লিষ্ট যাতনা শেষ পর্যন্ত সিন্ধান্তে আসবার পথে মানসিক দ্বৈরথের পরম্পর চৈতন্যের বিলোড়নে বিকৃত, বিক্ষিপ্ত ও চূর্ণিত হয়েই হয়তো পরিণতিতে অশ্লীলতায় কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। অবশ্য সংগে এ কথাও স্বীকার্য যে, যে যাতনা , যন্ত্রণা অন্তরকে তীব্র ক্লিষ্টতার মধ্যে দিয়ে চূড়ান্ত সিন্ধান্ত উম্মুখতাকে অপ্রকাশিত ভাবে গ্রাহ্য করে চলে সে যন্ত্রণা অথবা যাতনাই ভিন্নভাবে অন্তরকে অন্তর সচেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এ অন্তর চেতনা যখন আবার প্রকারান্তরে হৃদয় বিকীর্ণকারী যন্ত্রণার কাছে সমর্পিত চিত্তে বিজিতের মত করুণা প্রার্থনা করে তখন স্বাভাবিক ভাবেই ঐ অন্তর চেতনা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণতার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে পারে না-অথবা সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সে চেতনার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব-পূর্ণতা গ্রাহ্য হবার অপেক্ষা রাখে না। ফলতঃ ঐ চেতনা, যন্ত্রণার দহনে বিখন্ডিত হয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে সিন্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার অকাল মৃত্যু ( অপমৃত্যু ও অস্বাভাবিক নয়)। যদি বলা যায় এ অকাল অথবা অপমৃত্যুজনিত চৈতন্য ধ্বংসের মূল কারণ অন্য কোথাও- অর্থাৎ সোজা কথায় যদি বলা যায়-ইন্দ্রিয়পরায়নতা, তবে সম্ভবতঃ ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা হবে না। কেননা যন্ত্রণা কখনই এবং কোনক্রমেই ইন্দ্রিয় বিমুখ তো নয়ই উপরন্ত ইন্দ্রিয়কে আশ্রয় করেই কখনও কখনও সেই ইন্দ্রিয় অতিক্রমনকারী স্বপ্নাচারী এক দূর স্পর্শী স্পর্ধিত নিয়ন্ত্রণবিহীন উপলদ্ধি বরং। যে উপলব্ধি অনুমতি হয় মাত্রাধিক দগ্ধতার মত, বয়ে নিয়ে যায় চিত্তকে অবলীলাক্রমেই অনায়ত্ব অসংখ্য আকাক্সক্ষা দুর্বার জলোচ্ছ¡াসের উচ্ছৃখলতায়। এবং সেদিকে থেকে তখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয় যখন ঐ উচ্ছৃংখলতা ইন্দ্রিয়ের সমর্থন পুষ্ট এবং তুষ্ট থেকেও ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অবস্থান করে ইন্দ্রিয় কে আরো দুরন্ত থেকে দুরন্ত করে তুলবার প্রয়াস পায়। এবং যখনই ইন্দ্রিয় তার ঐ দুরন্ত স্বত্বাকে চিত্তের সীমাহীন মুক্ততায় নিজস্ব প্রভাবের আলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় ঠিক তখনই চিত্তের সচেতনতা অর্থাৎ অন্তর চেতনাও তার স্বতন্ত্র, স্বকীয়তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। হয়তো বা নিজের অলক্ষ্যেই। এবং এভাবেই যখন একের পর এক, মুহুর্তের পর মুহুর্ত ধরে চিত্ত এবং ইন্দ্রিয়ের মধ্যে পরস্পর বিরোধী সমরসুলভ ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়ে যায় তখন আপনা আপনি চিত্তের চৈতন্য ইন্দ্রিয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এবং ইন্দ্রিয় আশ্রয় খোঁজে দৈহিক রিপুর অভ্যন্তরে। যা উত্যক্ত করে দৈহিক রিপুর সমস্ত নিশ্চেতন নিম্পৃহতাকে। যেহেতু ইন্দ্রিয়াচ্ছন্ন বেষ্টনির শক্তি সাধারণভাবে ক্ষেত্র এবং সময় বিশেষে চিত্ত চৈতন্যের শক্তির চাইতে অনেক বেশি শক্তিবান ও সকর্মক। সেই হেতু মানসিক দ্বৈরথের প্রশ্নও অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য। কেননা চিরন্তণ মানস কামনায় ( কল্পনা) ও দেহজ বাসনা ঐ ইন্দ্রিয় প্রবণ প্রবৃত্তির বিপ্রতীপ দু’প্রাপ্ত সীমার সুপ্রতিষ্ঠিত অধিবাসী। প্রসঙ্গতঃ এক অধিবাসী যখন তার প্রতিপক্ষের ধৃষ্টতা বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই অপর পক্ষও চঞ্চল হয়ে উঠে। এবং এ দুয়ের আত্মঘাতি সংঘর্ষের ফলাফল যা দাঁড়ায় তাই মানসিক দ্বৈরথ। (এতে বিজিত চিত্তের সকরুন আত্মা বিলাপই সবচাইতে বেশি করে প্রকটিত হবার অপেক্ষা রাখে সম্ভবত) যদি না রাখে তবে তা অবশ্যই হবে ব্যতিক্রম এবং সে ক্ষেত্রে চিত্ত চৈতন্য হবে সাধারণ। কিন্তু প্রশ্ন শুধুমাত্র মানসী দ্বৈরথের শেষ ফলশ্রæতই কি অশ্লীলতার জন্ম দেয় ? সম্ভবত আংশিকভাবে-না। দ্বৈরথকে উপেক্ষা করেও অশ্লীলতার জন্ম সম্ভব হয়ে পারে যদি চির সবুজ অনুভূতির হতাশাগ্রস্থ চেহারা সুস্থ রুচিবোধের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এ রুচি বোধ মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ আবার ঐ ইন্দ্রিয়প্রবণতাও হতে পারে, কিন্তু, তাকে স্বীকার না করেও বলা যাবে হতাশাক্লিষ্ট ইন্দ্রিয় বহির্ভূত অনুভূতির শরীর কখনই রুচি সুস্থ্যতার অবলম্বন নয়। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়কে গ্রাহ্য না করেও নিতান্তই চিত্ত চেতনার দূর্বলতা থেকেও হতে পারে যে দূর্বলতার মৌলিক কারণ হবে সামাজিক প্রতিবেশের অনির্ণেয় বিশৃঙ্খলতা, উচ্ছৃখলতা প্রভৃতির বাঁধনহীন স্বকীয়তা। সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে হৃদয় চূড়ান্ত সিন্ধান্ত গ্রহণের জন্যে চেষ্টিত হবে দগ্ধতার উষ্ণ বৃত্তের তপ্ততা থেকে নিস্কৃতি পাবার জন্যেই। কিন্তু যে বৃত্তকে লংঘণ করে সুস্থ সিন্ধান্ত গ্রহণের জন্যে চিত্ত প্রস্তুতি গ্রহণে প্রবৃত্ত হবে, দেখা যায় তা অনেক আগেই চিত্ত অর্পিত হয়ে গেছে ঐ সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতা বেদীমূলে। ফলে যন্ত্রণা আরো প্রকটিত হবে, চিন্তার মৃত্যু ঘটবে, রুচি বিকৃততায় পর্যবসিত হবে। আর বিকৃত রুচির উৎপ্লবন অনিবার্য ভাবে সম্ভব করে তুলবে অবিনাশী অশ্লীলতার বাস্তবতাকে এবং এ অশ্লীলতা যা সহজে ইঙ্গিত করবে ইন্দ্রিয়প্রবণতাকে। এখন পাশপাশি আর একটা প্রশ্ন ইন্দ্রিয়াশ্রিত অশ্লীলতার বাস্তবতাকে এবং অথবা সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতাজনিত অশ্লীলতা প্রকৃত অর্থে সাধারণভাবে শুধু অশালীন অশ্লীলতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে সুকুমার সৌন্দর্য্যে বিকশিত হতে পারে কিনা ? এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ঃ
(১) “সাহিত্যের ক্ষেত্রে নারীর দেহ লালিমা এবং নর ও নারীর উভয়ের দৈহিক আকর্ষণের বর্ণনা........... সাধারণভাবে সাহিত্যে অশ্লীলতা বোধের জন্ম..........।” (২) “দেহের বর্ণনা থাকলেই যে সাহিত্যে অশ্লীলতা সৃষ্টি হলো এমন কথা বলা যায় না। লোক চক্ষুর অন্তরালে যে জিনিস লুক্কায়িত তাকে প্রকাশ করতে সাহিত্যিকের মন যতই উদার হোক না কেন গোপন জিনিষের মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে সঙ্গে ¯্রষ্টার শিল্পবোধটিও থাকা দরকার।”
(৩) “সাহিত্যের ক্ষেত্রে অশ্লীলতা তখনই সমর্থনযোগ্য যখন তা শিল্পদক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়।”
(৪) “দেহের বর্ণনা তখনই কুৎসিত হয়, দেহ সম্পর্কে যখন শিল্পী মনের সম্ভ্রমবোধ থাকে না।”
(৫) “দেহ সম্ভোগের নিরষ্কুশ বর্ণনার মধ্যেও কবি আশ্চর্য্য কলাকুশলতার মাধ্যমে......প্রেমের অপরূপ ছবি........উপহার দিয়েছেন।”
কিন্তু রুচিরই যখন মৃত্যু ঘটে রুচিই যখন বিকৃত হয়ে যায় তখন শালীনতাবোধ, সৌন্দর্যবোধ এবং শিল্পবোধ-এসবের স্বার্থক মূল্যায়ন সম্ভব হয় কি? সোজা কথায় এবং সহজ অর্থে হয়তো হয় না। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধানে অনুমতি হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে রুচি বিকৃতির অন্তরালেও সুস্থ্য শিল্পবোধের উন্মোষ থাকতে পারে। হয়তো তা প্রকাশের ক্ষমতায় বীর্যবান হবে না। হয়তো নিশ্চল জড়তার মত বিকৃত রুচির কুৎসিততাকেই সমর্থন করে যাবে অসহায়ের মতো । কিন্তু যদি সে নিশ্চল জড় শিল্পবোধকে রুচি বিকৃতি পরিধি ছাড়িয়ে মুক্তি দেয়া যায় জীবনের সর্বস্তরে তবেই চিত্ত চৈতন্য হবে স্বার্থক, পূর্ণাঙ্গ এবং ব্যতিক্রম। যাকে কিছু আগেই আমরা অসাধারণ বলে গ্রাহ্য করে নিয়েছি। এবং এই অসাধারণ চৈতন্য মুক্তির বলিষ্ঠ প্রয়াস লক্ষ্যিত হয় ‘ বিদ্যাপতি ’ র প্রায় সব কাব্য সম্ভারেই। বিদ্যাপতির কাব্যে অপ্রতিহত গতিতেই অশ্লীলতা এসেছে, স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠান করেছে, সবশেষে হৃদয় কে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পরিপ্লুত করেছে অপূর্ব এক তাত্তি¡কতার মধ্যে দিয়ে অদ্ভূত এক সুখের স্পর্শকতর আনন্দ দিয়ে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে তার রুচি বিকৃতির নিয়ন্ত্রণ ছিন্ন করে সুপ্ত চৈতন্যাশ্রিত শিল্পবোধের অত্যুগ্র প্রবৃত্তির বার বার বিকাশোন্মুখ উন্মাদনার নিশ্চিত তাগিদে। এবং এ জন্যেই তার কাব্য পুরোপুরি অশ্লীলতা আশ্রয়ী হলেও নিছক সাধারণ অশালীন অশ্লীলতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। বর্ণনায় দৈহিক উত্তেজনাকে হয়ত সাময়িকভাবে প্রকটিত করেছে আবার সাথে সাথেই শিল্প সৌন্দর্য্যে মন্ডিত হয়ে আত্মহারা হবার যোগ্যতা প্রমাণও করেছে। প্রেম চিরন্তন, প্রেম অবিনশ্বর, প্রেম নিরঞ্জন। এই নিরঞ্জন প্রেমে বিশ্বাসী থেকেই বিদ্যাপতি তার সৃষ্টির তত্ত¡ উদঘাটন করেছেন। প্রেমে অশ্লীলতা অস্বাভাবিক নয় বরং স্বাভাবিক যদি অশ্লীলতা প্রেম বহির্ভূত না হয়। এ প্রসঙ্গে কত গুলো সারহীন প্রচলমান উক্তি অথবা কথা স্মতর্ব্য। পবিত্র প্রেম কে কামোত্তজনা দিয়ে কলুষিত করার অর্থই প্রেমের অকাল এবং অপমৃত্যু ঘটানো কিন্তু প্রশ্ন কামোত্তজনার মধ্যে কি প্রেম সন্দেহ নেই। এবং এ ইতিবাচক উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তির অবতারণা করলে বর্তমান আধুনিক কাব্য সাহিত্যেরই যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে ঃ
(১) মাটির শরীরে তার ছিল যে -পিপাসা
আর সেই ব্যথা ছিল - সেই ঠোঁট, চুল
সেই চোখ - সেই হাত আর সে আঙ্গুল
রক্ত আর মাংসের স্পর্শ সুখভরা -
সেই দেহ একদিন পৃথিবীর ঘ্রাণের পসরা
পেয়েছিল, আর তার ধানীসুরা করেছিল পান
একদিন শুনেছে সে জল আর ফসলের গান,
দেখেছে যে ওই নীল আকাশের ছবি
মানুষ নারীর সুখ- পুরুষ -স্ত্রীর দেহ সবি
যার হাত ছুঁয়ে আজো উষ্ণ হয়ে আছে -
ফিরিয়া আসিবে সেকি তাহাদের কাছে !
প্রণয়ীর মতো ভালবেসে
খুঁজিবে কি এসে
একখানা দেহ শুধু।’
Ñ(জীবনানন্দ দাশ)
এখানে প্রেম বিচিত্র ব্যঞ্জনায় প্রতিভাসিত। এবং সাধারণ অর্থে অনিয়ন্ত্রিত অশ্লীলতা বোধের ইঙ্গিতও দুর্লক্ষ্যে নয়। কিন্তু তবুও এ অশ্লীলতা নিছক নোংরামীকে আশ্রয় করে একেবারে কুৎসিত হয়ে যায়নি- বক্তব্যহীনও হয়ে পড়েনি, বরং অপূর্ব শিল্প প্রলেপন অর্ন্তরস্পর্শী এক মধুর আবেদনের সৃষ্টি করেছে। অথচ এখানে কামোত্তেজনাও এসেছে, ইন্দ্রিয় প্রবণতাও দৈহিক উত্তেজনাকে উত্যক্ত করেছে। কিন্তু এত কিছু করবার পরেও সৃষ্টি তার সৌন্দর্য্য বোধ থেকে এতটুকু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি।
‘যা কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর
সে-সবের মাঝে যেন তব হরষন
অনুভব করিয়াছি! ছুঁয়েছি অধর
তিলোত্তমা, তিলে তিলে
তোমারে যে করেছি চুম্বন
প্রতি তরুনীর ঠোঁটে!
যে কেহ প্রিয়ারে তার চুমিয়াছে ঘুম ভাঙ্গা রাতে
রাত্রি জাগা তন্দ্রা-লাগা ঘুম পাওয়া প্রাতে,
সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা,
তরুলতা, পশুপাখী, সকলের কামনার সাথে
আমার কামনা জাগে,Ñ আমি রহি বিশ্ব-কামনাতে!
বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি!
সকলের সাথে আমিÑ সকলের প্রেমে মোর গতি!
যেদিন ¯্রােষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম
সেইদিন ¯্রােষ্টা সাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম
আমি কাম, তুমি হলে রতি,
তরুন তরুনী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি!’
Ñকাজী নজরুল ইসলাম।
শুধু নজরুলের নয় রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, মোহিত লাল মজুমদার , বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের সৃষ্টিতে প্রেম আবির্ভূত হয়েছে বিচিত্র গতি আর অপরূপ রূপের মঙ্গল মূর্তি নিয়ে এবং বলা বাহুল্য তাদের প্রেমেও উত্তেজনা অলক্ষ্যিত ছিল না। বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশ প্রেমকে যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা অতুলনীয়।
০১.
‘শুধু চোখে চোখে চেয়ে থাকার
ঊুকের তলায় জড়িয়ে রাখার
ঊ্যাকুল কাঁপন নীরব কেঁদে কইবে কি তার ব্যাথা!’
০২.
‘কভু কি কথা সে কইতে গিয়ে হঠাৎ যাবে থেমে,
অভিমানে চারটি চোখেই আসবে বাদল নেমে!
কত চুমুর তুষ্ণায় কাঁপবে অধর, উঠবে কপোল ঘেমে!
হেথা পূরবে নাকো ভালোবাসার আশা অভিমানী,
তাই দলবে বলে কলজেখানা রইনু পথে পাতি।’
সহজেই অনুমেয় জীবনানন্দ দাশ জীবনকেই যেন উদঘাটন করেছেন প্রেমের পরিপূর্ণ নিটোল সবোবরের নিরুপম লাবণ্য থেকে। আর এ লাবণ্যের সাথে তিনি যেন একান্ত হয়ে গেছেন, জীবনের সব ক্ষোভ দুঃখ, হতাশা, ক্লান্তিকে অস্বীকার করেও। রক্ত মাংসরে স্পর্শভরা সুখ এ আপ্লুত হয়ে তিনি যেন সমর্পিত হয়ে গিয়েছিলেন ¯িœগ্ধ প্রেমের কাছে। অথচ এর মধ্যে ও কি উত্তেজনা আসেনি ?
০১. ***
পার যদি এসো শব্দবিহীন পায়;
চোখ টিপে ধো’রো হঠাৎ পিছন থেকে
আকাশে চুলের গন্ধটি দিও পাতি,
এনো সচকিত কাকনের রিনিরিন
এনো মধুর স্বপ্ন ঘন রাতি,
আনিও ঘন আলস্য ঘন দিন।
তোমাতে আমাতে মিলিত নিবিড় একা,
স্থির আনন্দে মৌন মাধুরী ধারা,
মুগ্ধ প্রহর ভরিয়া তোমারে দেখা,
তব করতল মোর করতলে হারা \
Ñরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০২.
রক্ত মাঝে মদ্যফেনা, সেথা মীন কেতনের উড়িছে কেতন,
শিরায়, শিরায় শত সরীসৃপ তোলে শিহরণ,
লোলুপ লালসা করে অন্য মনে রসনা লেহন
তবু আমি অমৃতাভিলাষী!
অমৃতের অন্বেষণে ভালবাসি, শুধু ভালবাসি
ভালবাসি - আর কিছু নয় (বুদ্ধদেব বসু)
সোনালী আপেল, তুমি কেন আছ? চুমু খাওয়া হাসি কৌটায়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁট বাতাস রাঙ্গাবে?
ঠান্ডা, আঁটো, কঠিন........ বৈকুণ্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়?
তৃপ্তির পায়েও দেখে আরও বাকী, এবং ফুরোলো
থামেনা পুলক পুষ্টি উপকার
কিন্তু শুধু কি এই?
Ñবুদ্ধদেব বসু।
এসেছিল। সন্দেহ নেই। তবে জীবনানন্দে যেভাবে এসেছে রবীন্দনাথেও ঠিক সেভাবেই এসেছে তবে অনেকটা যেন সংযত হয়ে। অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশ উত্তেজনাকে সংগোপন করেছেন পাশাপাশি প্রশ্রয়ও দিয়েছেন অবশ্যই কতকটা বিক্ষিপ্ত ভাবে এবং একটা অযাচিত ও চকিত তাৎক্ষণিক স্পর্শের মতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় হয়েছে এর বিপরীত-
০১.
বীনা ফেলে দিয়ে এসো, মানস সুন্দরী,
দুটি রিক্ত হস্ত শুধু আলিংগনে ভরি
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও-মৃনাল পরশে
রোমাঞ্চ অঙ্কুরি উঠে মর্মাহত হরষে
কল্পিত চঞ্চল বক্ষ চক্ষু ছলছল
মুগ্ধ তনু মরি হায় অন্তরে কেবল
অঁেঙ্গর সীমান্ত প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে,
এখনি ইন্দ্রিয়বদ্ধ যেন টুটে, টুটে।
Ñরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০২.
গিয়েছে নীরব হয়ে, কী আনন্দ সুধা
অধরের প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা
না মিটায়ে গিয়াছে শুকায়ে। এই শান্তি
এই মধুরতা দিক সৌম্য ¤øান ক্লান্তি
জীবনের দুঃখ দৈন্য অতৃপ্তির পর
করুন কোমল আভা গভীর সুন্দর।।
Ñরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কল্পনায় যে মানস-প্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করেছেন তাকে তিনি স্বাগত আহবান জানিয়েছেন সর্ব প্রস্তুুতিপর্ব সমাপ্তির পর। অর্থাৎ তিনি আহবান জানাবার জন্য তৈরি হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই তার প্রিয়ার চিত্র অঙ্কনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। যার ফলে তিনি উত্তেজনাকে বিসর্জন দিতে না পারলেও তার কল্পনা নির্ধারিত পথ ধরেই উত্তেজনা এসেছে তার প্রেমিক চিত্তের সৌন্দর্য্যমন্ডিত পবিত্রতাকে লঙ্ঘন না করবার প্রতিশ্রæতি নিয়েই। অবশ্য জীবনানন্দে যে এ প্রতিশ্রæতির অভাব লক্ষিত তাও নয় শুধু জীবনানন্দ যেখানে উত্তেজনার বিচূর্ণিত, বিখন্ডিত টুকরো গুলোকে সংস্থাপন করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে সেখানে রবীন্দ্রনাথ তার সম্পূর্ণ ঘনিভূত চেহারাকেই স্বীকৃতি দিয়ে আহŸান জানিয়েছেন অবলীলাক্রমে। এবং এ জন্যে বিশেষ কতগুলো ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথ হয়েও রবীন্দ্রনাথ থেকে বিচ্ছিন্ন অনায়াসেই। শুধু এ কারণই যথেষ্ট নয়, আরও আছে। আমি ইচ্ছে করেই প্রয়োজন ক্রমে এই একটি মাত্র কারণকেই বেছে নিলাম। বরং বলা যায় বুদ্ধদেব বসুর সৃষ্টি পদ্ধতির একটা অস্পষ্ট কুয়াশার প্রচ্ছন্নতা যেন অচৈতন্য কোন মুহুর্তের অবসরে জড়িয়ে গেছে জীবনানন্দের সৃষ্টি-শরীরে।
বুদ্ধদেব বসুরÑ
‘সোনালী আপেল তুমি কেন আছ? চুমু খাওয়া হাসির কৌটায়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁট বাতাস রাঙ্গাবে?
ঠান্ডা, আঁটো, কঠিন ....... বৈকুন্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়?
তৃপ্তির পায়েও দেখে আরও বাকী, এবং ফুরোলে
থামেনা পূলক পুষ্টি উপকার
কিন্তু শুধু কি এই?’
Ñবুদ্ধদেব বসু।
বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃত কবিতার নি¤েœাক্ত পঙ্তিগুলিÑ
‘সোনালী আপেল তুমি কেন আছ? চুমু খাওয়া হাসির কৌটায়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁট বাতাস রাঙ্গাবে?।’
‘অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়?’
এগুলো যেন জীবনানন্দেরÑ
‘সেই ব্যথা ছিল সেই ঠোঁট, চুল ......
‘সেই দেহ একদিন পৃথিবীর ঘ্রানের পসরা পেয়েছিল
........মানুষ নারীর মুখÑ-পুরুষ- স্ত্রীর দেহ সবি।’
যেন জীবনানন্দকেই ইঙ্গিত করেছে অতি সহজে। কিন্তু এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সাথে কিছুটা সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায় মোহিতলাল মজুমদারের কিছু কর্মেরÑ
১. পাতি ফুল শেজ বসিব দুজনে কথা না বলি
চিবুক ধরিয়া তুলিব আনন-কুসুম কলি।
সে রূপ নেহারি, আঁখি অনিমেষ
প্রদীপ জ্বালায়ে হবে রাতি শেষ।
ভুলে যাব গান, ফুলের মধুও ভুলিবে অলি
শুধু চেয়ে রব কথা না বলি’।
‘বধূরে আমার দেখিনি এখনও, শুনেছি তার-
অপরূপ রূপ-চোখের চাহনি চমৎকার!
আর কত দেরি গোধূলী-লগন?
শুধু সেই চেলি উজলি তুলিবে অন্ধকার
সেই আঁখি তারা চমৎকার।’ -মোহিতলাল মজুমদার
২. পরেছে বসন-বুঝি লাল চেলি, ডালীম ফুলী?
দুরু-দুরু হিয়া-মনিহার তাই উঠিছে দুলি’।
এয়োরা যখন পঙ্খ বাজায়
বধু চমকিয়া ইতি-উতি চায়,
আকুল করবী রুক্ষ-ভুখু চুল পড়িছে খুলি-
হিয়া দুরু দুরু উঠিছে দুলি।
কত নিশি দিন কাটানু স্বপনে- সেই সে মুখ
দেখিনি কখনও, তবু সে আমার ভরেছে বুক
প্রানের বিজনে ঝরিয়াছে ফুল-
ফুটিয়াছে নীপ-বরষা আষাঢ়ে ভরসা সুখ
সে সুখ আমার ভরেছে বুক।’
Ñমোহিতলাল মজুমদার
এখানে রবীন্দ্রনাথেরÑ “বীনা ফেলে দিয়ে এসো, মানস সুন্দরী দুটি রিক্ত হস্ত শুধু আলিংগনে ভরি.....।” নিতান্ত, সাধারণ ভাবেই মনে করিয়ে দেয় মোহিতলাল মজুমদারের “পাতি ফুল-শেজ বসিব দুজনে কথা না বলি, চিবুক ধরিয়া তুলিব আনন-কুসুম কলি” এ রকম ভাব প্রকাশকে। অবশ্য বর্তমান আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য এ নয় যে, কে কাকে প্রভাবিত করেছেন অথবা কার সৃষ্টিতে কে কত বেশি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। শুধু মৌল বিষয়কে সিদ্ধ করবো প্রয়াসেই এত কিছু অবতারণা করা হলো। এবং এসব থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত তাদের স্ব স্ব কাব্য সৃষ্টিতে উত্তেজনা ( অশ্লীলতা) অবশ্যই এসেছে, তবে তা মূল সৃষ্টিকে কখনই কলুষিত এবং বিভ্রান্ত করতে পারেনি। এবং না পারার নেপথ্য ভূমিকায় শুধু একটি মাত্র কারণই সব সময় সক্রিয় থেকেছে তাদের চিত্ত চৈতন্য- ইন্দ্রিয় প্রবণতাকে ছাড়িয়েও যা তাদেরকে ব্যক্তিক্রম চিহ্নিত করার পথকে প্রশ্বস্ত করে দিতে সক্ষম হয়েছে। অন্যভাবে প্রজ্বলন্ত ইন্দ্রিয় প্রবণতার কাছে তাদের চিত্ত কোন ক্রমেই এবং কখনই সমর্পিত হয়নি। প্রমাণ হিসেবে খুব ছোট একটি দৃষ্টান্তের অবতারণা করা যেতে পারে
“প্রান্ত ছেয়ে আছে আ¤্র বনরাজি ঝলক দেয় তাতে পক্কফল,
বর্নে চিক্কন বেনীর মত তুমি আরুঢ় হলে সেই শৃঙ্গে
দৃশ্য হবে যেন ধরার স্তনতট, অমর মিথুন ভোগ,
গর্ভ সূচনায় মধ্যে কালো আর প্রাস্তে পান্ডুর ছড়ানো।”
Ñ মেঘদূতঃ অনুবাদ ঃ বুদ্ধদেব বসু।
লক্ষণীয় এর মধ্যে শিল্প চেতনা আছে, হৃদয়ানুভূতি আছে অথচ এত কিছু থেকেও শুধু একটি মাত্র বস্তুর অভাব যেন সব কিছু থাকাকেই ¤ø ান করে দিয়েছি- যা আংশিকভাবে সুস্থ রুচিবোধ। পূর্ণাঙ্গ চিত্ত-চৈতন্য যেন ইন্দ্রিয় প্রবণতাকে অস্বীকার করে ইন্দ্রিয়ের উর্ধে উঠে নিজের জন্য স্থান করে নিতে পারেনি। কেননা শুধু নারীর উলঙ্গ নগ্নতাই উত্তেজিত লালসাকে উদ্ধতা করেছে- সৌন্দর্যের আবরণ দিয়ে নগ্নতাকে করে লালসাকে সংযত করে পারেনি। ফলে অশ্লীলতাই মুখ্য হয়ে পড়েছে বক্তব্যকে খর্বিত করে। বিদ্যাপতি কাব্যের বৈশিষ্ট্য এখানেই। তার কাব্য কখনই বক্তব্যকে ছাড়িয়ে নিছক অশ্লীলতা সর্বস্বরতায় রূপ লাভ করেনি। তিনি নারী দেহের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ ছিলেন, প্রকাশ করেছেন এবং প্রকাশ করতে গিয়ে তার চোখের সামনে নারী দেহের সম্পূর্ণ গোপনীয়তার শিল্পমন্ডিত সৌন্দর্য অকপটেই লাবণ্যময় হয়ে উঠেছেÑ
১. অপরূপ পেখলু রামা
কনকলতা অবলম্বনে ঊমল
হরিনীহীন হিমধামা।
নয়ন নলিনী দউ অঞ্জনে রঞ্জই
ভাঙ- বিভঙ্গিঁ বিলাস
চকিত চকোর জোড় বিধি বান্ধিল
কেবল কাজর পাশ।
গিরি বর ওরুয়া পয়োধর পরশিত
গীম গজমোতি হারা।
কাম কম্বুভরি কনয়া শম্ভুপরি
তাবত সুরধনী ধারা।।
২.
ভূজভয়ে কনক মৃনাল পঙ্কে রহু,
করভয়ে কিসলয় কাঁপে
বিদ্যাপতি কহ বাত বাত ঐছন
কহব মদন পরতাপে\
সুধা মুখি কো বিহি নিরমিল বালা
অপরূপ রূপ মনভব মঙ্গল
ত্রিভুবন বিজয়ী মালা\
সুন্দর বদন চারু অরু লোচন
কাজরে রঞ্জিত ভেলা
কনক কমল মাঝে কাল ভূজঙ্গিঁনী
শ্রীযুত খঞ্জন খেলা\
নাভি বিবর সঞে লোম লতাবলি
ভুজগী নিশ্বাস পিয়াসা।
নাসা-যগপতি- চঞু ভরম ভয়ে
কুচ গিরি সান্ধি নিবাসা \
তিন বানে মদন জিতল তিন ভুবন
অবধি রহল দউ বানে।
বিধি বড় দারুন বধিতে রসিক জন
সোঁপল তোহার নয়ানে
ভনয়ে বিদ্যাপতি শুন সব যুবতি
ইহ রস রূপ যো জানে \ বিদ্যাপতি
উদ্ধৃত চরণগুলোর মধ্যে বিদ্যাপতির এক বিস্ময়কর সবুজ হৃদয়ের অতলান্ত প্রাণনার ইঙ্গিত স্পর্শিত। বর্ণনা যেন নীর সমুদ্রের বক্ষ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসা উজ্জ্বল ঝিনুকাশ্রিত মুক্তোর মত নিটল উৎফুল্ল অশ্রæবিন্দু। বক্তব্য সুগঠিত। বিক্ষিপ্ত নয়। সব মিলিয়ে বক্তব্যের ভাবগভীরতা যেন অন্তরের অতি কাছাকাছি অনুভূত এক মিষ্টি গুঞ্জরনের মত হৃদয়-জ্বালানোর সুখময়তা। যেখানে দেহের সৌন্দর্য তুলনীয় স্বকোমল কল্পলতার সাথে, মুখশ্রী লাবণ্য নিস্পাপ চন্দ্রের সাথে। সেখানে ভুজঙ্গ-নেত্রের ইঙ্গিত ইন্দ্রিয়কে উন্মাদনায় বিভ্রান্ত করলেও চরম উদ্ধত প্রকাশের পথে হৃদয়ানুভূত বক্তব্য- সৌন্দর্য্যরে প্রলেপন রীতিমত প্রতিবন্ধক স্বরূপ।
০১.
‘দিনে দিনে পয়োধর ভৈগেল পীন।
বাঢ়ল নিতম্ব মাঝ ভেল ক্ষীন\
অবহি মদন বাঢ়ায়ল দীঠ\
শৈশব সকলি চমরি দিল পীঠ।।
পহিল বদরী কুচ পুন নবরঙ্গঁ।
দিনে দিনে বাঢ়য়ে, পীড়য়ে অনঙ্গ।।
সো পুন ভৈগেল বীজক পোর।
অব কুচ বাঢ়ল শ্রীফল জোর\
মাধব পেখনু রমনী সন্ধান।
ঝাটহি ভেইনু করত সিনান\
তনু শুক বসন তনী হিয় লাগি।
সো পুরুখ দেখত তাকর ভাগি\
উরহি বিলোলিত চাঁচর কেশ।
চামরে ঝাঁপাল জনু কনক মহেশ\
ভনয়ে বিদ্যাপতি শুনহ মুরারি।
সুপুরুখ বিলসই সো বরনারী\
০২.
ক্ষনে ক্ষনে নয়ন কোনে অনুসরই।
ক্ষনে ক্ষনে বসন ধুলী তনু ভরই।।
ক্ষনে ক্ষনে দশন ছটাছট হাস।
ক্ষনে ক্ষনে অধর আগে করুবাস\
চৌঙবি চলয়ে ক্ষনে, ক্ষনে চলু মন্দ।
মনমথ পাঠ পহিল অনুবন্ধ\
হৃদয়জ মুকুলি হেরি থোর থোর।
ক্ষনে আঁচর দেই ক্ষনে হোয় ভোর\
বালা শৈশব তারুণ ভেট।
লখই না পারিয়ে জ্যেঠ কনেঠ\
বিদ্যাপতি কহে শুন বর কাম।
তরুনিম শৈশব চিহ্নই না জান \’
- বিদ্যাপতি।
এখানে বিদ্যাপতির রূপ বিশ্লেষণ, রূপ পর্যবেক্ষণ এবং সে রূপের চিত্রকল্প অংকন অদ্ভুত, অপূর্ব। তার কাব্যের নায়িকা অর্থাৎ রাধা যখন শৈশব থেকে যৌবনের পথে দ্রæতগামী তখন তার দেহ সূসুমা ক্রমান্বয়িকভাবে যেমন বিবর্তন-উন্মুখ ঠিক তাকেই অবিকল তেমনি রেখে কবি তাকে বিদ্ধৃত করেছেন তার কবিতায় একান্ত নিজস্ব কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে। তিনি কল্পনা করেছেন রাধার স্তন যুগল কৈশোর পর্যায়ে স্বাভাবিক প্রস্ফুটনমুখ ঠিক পুস্পের মত। এবং ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশেষ লেবুর মত ( নারঙ্গঁ) এবং সময়ের আরও কিছু ব্যবধানে রীতিমতো পাতি লেবুর ( বীজক পোর) আকারে। দ্বিতীয়তঃ বর্ণিত হয়েছে মদন অর্থাৎ কৃষ্ণ যখন নিকুঞ্জ থেকে ¯œ ানরতা রাধার দেহ-লালিমা, রাধার নরম শরীরে জলে ভেজা শাড়ীর আঁচল জড়ানো এবং হৃদয়ে এক অনুপম সুস্মিতা-মাখা রূপ প্রত্যক্ষ করে তখন কবি বিমুগ্ধ হয়ে আপনা আপনি কৃষ্ণের দৃষ্টিকে আত্মস্থ করে মন্তব্য করেছেন¬ ‘যে পুরুষ ও রূপ দেখে বা দেখতে পায় তার ভাগ্য’। এখানেও লক্ষ্যণীয় ইন্দ্রিয়ের ভেতরে ও বাইরে সাড়া জাগবার মতো যে কোন উপাদানেরই অভাব লক্ষিত নয়। অর্থাৎ তবুও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া কলাপ সংযত নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানে একটা কথা বলা অপ্রাসংগিক হবে না বোধকরিÑ সম্ভবত বিদ্যাপতির যে কবিতাটিকে কেন্দ্র করে এত কিছু আলোচনা করা হলো সে কবিতাটিই আবার ‘ পদামৃত সমুদ্রের’- পাঠ অনুযায়ী অন্যরকমÑ
দিনে দিনে উন্নত পয়োধর পীন।
বাঢ়ল নিতম্ব মাঝ ভেল ক্ষীন\
অবকে মদন বাঢ়াওল দীঠ।
শৈশব সকলি চমকি দিল পীঠ\
শৈশব ছোড়ল শশি মুখি দেহ।
যত দেই- তেজল ত্রিবলী তিন রেহ।
এবে ভেল যৌবন বঙ্কিম দীঠ।
উপজল লাজ হাস ভেল মীঠ\
দিনে দিনে অনঙ্গঁ আগোরল অঙ্গঁ।
দলপতি পরাভবে সৈনক অঙ্গঁ\
তাকর আগে তুয়া পর সঙ্গঁ।
বুঝি করব মৈছে নহ কাজ ভঙ্গঁ\
সুকবি বিদ্যাপতি কহ পুনঃ তোয়।
রাধা রতন মৈছে তুয়া হোয় \
এবং ‘গীত চিন্তামনির’- এর পাঠ অনুযায়ী আবারÑ
শশিমুখি ছোড়ল শৈশব দেহে।
ক্ষত দেহ তেজল ত্রিবলী তিন রেহে\
অব যৌবন ভেল বঙ্কিম দিঠ।
উপজল লাজ হাস ভেল মিঠ\
.................................
বিদ্যাপতি কহে করু অবধান।
বালা অঙ্গেঁ লাগল পাঁচবান\
এভাবে প্রতিভাসিত হয়েছে। একই কবিতার মধ্যে এ রকম বৈসাদৃশ্য লক্ষিত হবার মূল কারণ সম্ভবতঃ ( ব্যক্তিগত ধারণা, কেননা বক্ষমান আলোচনার প্রয়োজনে মূখ্যভাবে যে গ্রন্থের সাহায্য নেয়া হয়েছে (‘বিদ্যাপতি-শ্রী কালি প্রসন্ন শর্মা’) তার মধ্যে গ্রন্থকার এই বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে বিশদভাবে কিছুই আলোচনা করেন নি)।
মূল পাান্ডুলিপির দূর্বোধ্যতা (কেননা তার পান্ডুলিপি মিথিলা ভাষায় রচিত) এবং সে কারণেই ধারণা নির্ভরিত হয়ে পান্ডুলিপির বিকৃতি। অবশ্য এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্নের সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে Ñ বক্ষমান আলোচিত কবিতাই যে বিকৃত নয় তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? এ প্রসঙ্গে আমি শ্রদ্ধেয় আব্দুল হাইকে স্মরণ করবো যিনি বক্ষমান আলোচিত কবিতাটি মূল বিদ্যাপতি-সৃষ্ট বলে সমর্থন করেছেন। এবং তিনি তার ‘বিদ্যাপতি কাব্য পাঠ’ প্রবন্ধে বিদ্যাপতি কাব্যের টুকরো টুকরো যেসব উদ্ধৃতি দিয়েছেন আমি নিজেও তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তিনি উদ্ধৃত করেছেনÑ
০১.
আওল যৌবন শৈশব গেল।
চরন চপল লতা লোচন নেল।।
করু দুহু লোচন দুতক কাজ।
হাস সোপত ভেল উপজল লাজ
অব অনুখন দেই আঁচরে হাত।
সগন বচন কহু নত কয় মাথ।।
কটিক গৌরব পাওল নিতম্ব।
চলইতে সহচরী কর অবিলম্ব।।
Ñ বিদ্যাপতি ।
০২. শৈশব যৌবন দুহ মিলি গেল।
শ্রবনক পথ দুহু লোচন নেল।।---
মুকুর লই অব কবত সিঙ্গার ।
সখী পুছই কইছে সুরত বিহার ।।
নিরজনে উরজ হেরই কত বেরি।
হুসইত আপন পয়োধর হেরি।।
পহিল বদরী সম পুন নবরঙ্গ।
দিনে দিনে অনঙ্গঁ অগোরল অঙ্গঁ।।
Ñবিদ্যাপতি।
এবং শুধু তিনিই নন শ্রী কালী প্রসন্ন শর্মা এবং ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহও এসব উদ্ধৃত কবিতাকে নিঃশঙ্ক চিত্তে স্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রকৃতই বিদ্যাপতির সৃষ্টি বলে। তাই ‘পদামৃত সমুদ্র’-অথবা ‘ গীত চিন্তামনি” এর পাঠ মূল কবিতার বিকৃতি বলে গৃহীত হবার অপেক্ষা রাখতে পারে না। ফলতঃ পদামৃত পাঠ ও গীত চিন্তামনি এর পাঠ পক্ষপাত মুক্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই বিসর্জিত হলো। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এখানে উল্লেখ্য যে , প্রকৃত প্রস্তাবে বিদ্যাপতি বাংলা ভাষার কবি ছিলেন কিনা? তার সমগ্র রচনাবলী নিরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার রচিত
১.ভূপরিক্রমা ২. কৃর্তিলতা ৩.পুরুষ পরীক্ষা ৪.কীর্তি পরীক্ষা ৫.লিখনাবলী ৬. শৈব সর্বস্ব ৭. গঙ্গা বাক্যাবলী ৮. দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী এসব গ্রন্থের মধ্যে অধিকাংশই মীথিলা ভাষায় রচিত। দু’একটি সংস্কৃতিতে।
এখন প্রশ্ন তার সমগ্র কবি কর্মই যদি মিথিলা ও সংস্কৃতাশ্রিত হয় তবে তিনি কিভাবে বাংলায় প্রথম মৌলিক কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন? এ প্রশ্ন নিয়ে আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বেও বহুবিধ আলোচনা হয়েছে। এবং এ আলোচনার সূত্র ধরেই তদানিন্তন ‘ বঙ্গ দর্শন ’- পত্রিকার মাধ্যমে জনৈক রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যয় তার নিজস্ব যুক্তি নির্ভর মতামত ব্যক্ত করেছেন ঃ
‘বিদ্যাপতি মৈথিল কবি হলেও তাহাকে বাংলা বলা অন্যায় নহে। বল্লাল সেন বাংলাদেশকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেন; তন্মধ্যে মীথিলা একভাগ। বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষণ সেনের অব্দে বিদ্যাপতির সময়ে মিথিলায় প্রচলিত ছিল, এখনও প্রচলিত আছে। লক্ষণ সেন বিজয়ী বাঙ্গালী রাজা হইলেও বাঙ্গালীরা লক্ষণ-সংবৎ ভুলিয়া গিয়াছে; কিন্তু মৈথিল পন্ডিতেরা তাহা ভুলেন নাই। বাঙ্গালার স্বাধীন রাজ্য-স্মারক লক্ষণ-সংবৎ বল্লাল সেনের যে বিভাগে অদ্যাপি প্রচলিত আছে, সে বিভাগকে বাঙ্গালার অংশ ও তন্নিবাসী দিগকে বাঙ্গালী বলিতে কেন সঙ্কুচিত হইবে? এতদ্ব্যাতিরিক্ত বিদ্যাপতির হৃদয় বাঙ্গালী হৃদয়। তিনি যে রসের রসিক সে রস তিনি বাঙ্গালী জয়দেবের নিকট হইতে পাইয়াছিলেন এবং সে রস চৈতন্যদেব এবং তদুক্তদিগের সময়ে মূর্তিমান হইয়া বাঙ্গালা প্লাবিত করিয়াছিল। সুতরাং বিদ্যাপতির কবিতা কুসুম সাদরে বঙ্গ কাব্যোদানে গৃহীত হইয়াছে, ইহা অস্বাভাবিক নহে।’ এবং গৌড় অপভ্রংশ থেকেই যদি প্রাচীন বাংলা ভাষার রেখাচিত্র অঙ্কিত হয়ে থাকে তবে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের এ সিদ্ধান্তকে মেনে নেবার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তির অবকাশ থাকবে । কেননা বল্লাল সেন যে বঙ্গ দেশকে ( গৌড়) পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছিলেন তা স্বীকৃত কথা এবং যথার্থই সত্য। এবং ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সিদ্ধান্তকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রাচীন ভারতীয় আর্য্য অপভ্রংশ অর্থাৎ গৌড় থেকেই বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি, যার মধ্যে বাংলা এবং মীথিলাও অন্তরিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পূর্ণ চিত্রটিকেই আমি এখানে উদ্ধৃত করছিঃ
প্রাচীন ভারতীয় আর্য্য(গৌড়) অপভ্রংশ
নব্য ভারতীয় আর্য্য ভাষা
মাগধী বা বিহারী ওড়িয়া বঙ্গ কামরূপী
মৈথিলী মগহী ভোজপুড়িয়া বাঙ্গালা আসামী
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা এবং নব্য ভারতীয় থেকেই পর্যায়ক্রমে বিভক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত মৈথিলী ও বাঙ্গালা ( বাংলা) পর্যন্ত উত্তরণ। তাহলে স্থির সিদ্ধান্ত যে, মৈথিলী বাংলা থেকে স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন হলেও তার চরিত্রে বাংলার স্পর্শ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সে সময় অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে এ রকম যুক্তিকে বিশ্বাস করতে চান নি। পরবর্তীতে কেউ কেউ চেয়েছেন, সবাই চান নি। যেমন চাননি প্রাচীন বৌদ্ধ গানের ভাষার প্রশ্নে
আচার্য হর প্রসাদ শাস্ত্রী বৌদ্ধ গানের ভাষার সামগ্রিক চরিত্র বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেনÑ “এ বাংলা ছাড়া আর কিছুই নয়।” কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক
০১.
এক সে শুন্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই।
চী অন বাকলত বারুনী বান্ধই।। ধ্রæ।।
সহজে থির করি বারুনী সান্ধ।
জে অজরামর হোই দিঢ় কান্ধ।। ধ্রæ।।
দশমি দুআরত চিহ্ন দেখিআ।
আইল গরাহক আপণে বহিআ।। ধ্রæ।।
চউশঠী ঘড়িয়ে দেউ পসারা।
পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা।। ধ্রæ।।
এক খড়–লী সরুঅ নাল।
ভনন্তি বিরুআ থির করি চাল।। ধ্রæ।।
০২.
দুটি দুহি পীঢ়া ধরন ন জাই।
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাই।।
আঙ্গঁন ঘরপন সুন ভো বিআতী।
কানেট চোরে নিল অধরাতী।। ধ্রæ
সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগই।
কানেট চোরে নিল কা গই মাগই।। ধ্রæ।।
দিবসহি বহূড়ী কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই।। ধ্রæ।।
অইসনী চর্য্যা কুক্কুরীপা এ গাইল।
কোড়ি মাঝে একু হিঅহি সমাইল।। ধ্রæ।।
০৩.
তিয়ড্ডা চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী
কমল কুলিশ ঘান্টে করহু বিআলী ।। ধ্রæ ।।
জোইনি তঁঁই বিণু খনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কমল রস পীবমি \ ধ্রæ ।।
খেপহুঁ জোইনি লেপন জাই।
মনিমূলে বহিআ ওড়িআনে সমাই।। ধ্রæ।।
সাসু ঘরে ঘালি কোঞ্চা তাল।
চান্দসুজ বেণি পাখা ফাল।। ধ্রæ।।
ভনই গুন্ডরী আম্ হে কুন্দুরে বীরা।
নরঅ নারী মঝেঁ ঊভিল চীবা ।। ধ্রæ।।
০৪.
কাহেরে ঘিনি মেলি অছহু কীস।
বেঢ়িল হাক পড়ই চৌদীস ।। ধ্রæ।।
অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়ই ভসুকু অহেরী ।। ধ্রæ।।
তিণ ন ছবুই হরিণা পিবই না পাণী ।
হরিনা হরিনির নিলঅ ন জাণী ।। ধ্রæ ।।
হরিণী বোলই হরিনা সুন হরিণা তো।
এ বণ ছাড়ী হোহু ভান্তো ।। ধ্রæ ।।
তরঙ্গতেঁ হরিণার খুন ন দীসই।
ভুসকু ভণই মুঢ়া- হিঅহি পইসই ।। ধ্রæ।।
০৫.
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল।। ধ্রæ।।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পূছিঅ জাণ।। ধ্রæ।।
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই।। ধ্রæ।।
এড়িঅউ ছান্দ বান্ধ করণ কপটের আস।
গূনু পথে ভিড়ি লাহু রে পাস।। ধ্রæ।।
ভণই লুই আমহে ঝাণে দীঠা।
ধমণ চবণ বেণি পিন্ডী বইঠা।। ধ্রæ।।
এ বৌদ্ধ গানগুলোকে শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রাচীন বাংলা বলে স্বীকার করেছেন। এখন যদি ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সিদ্ধান্তকে সিদ্ধ বলে গ্রহণ করা যায় ( অবশ্যই গ্রহণের নেপথ্যে যুক্তিও যথেষ্ট আছে) তবে বিজয় চন্দ্র মজুমদার এবং সমগোত্রীয় ব্যক্তিবর্গ যারা বৌদ্ধ গানের ভাষাকে ‘ কৃত্রিম মিশ্রিত ভাষা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন তাদের সিদ্ধান্ত ন্যায়তঃই ভ্রমাত্মক বলে প্রমাণিত হবে। ছোট্ট একটি চরণ বিশ্লেষণ করা যাকÑ
‘কা আ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল। ’
বিজয় চন্দ্র মজুমদার ‘ বি’ এবং ‘ পৈঠা’ শব্দদ্বয়কে হিন্দি বলেছেন কিন্তু ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাকে আদিম প্রাকৃত ‘অপি’ এবং ‘প্রবিষ্ট’ থেকে উদ্ভুত জ্ঞানে বিবেচনা ও বিচার করেছেন। এবং তার এ বিবেচনা সমর্থিত হয়েছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘চর্য্যাচর্য্য বিনিশ্চিয়’-গ্রন্থ এবং ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যে। তেমনিÑ
“দুলি দুহি পীঢ়া ধরন না জাই
রুখের তেন্তলী কুম্ভীরে খাই।।”
Ñএ দুটি এবং অন্যান্য চরণগুলো থেকেই প্রমাণিত হয়েছে যে, বৌদ্ধগানের ভাষা অন্য কোন কৃত্রিম মিশ্রিত ভাষা থেকে ব্যুৎপন্ন নয় বরং বর্তমান বাংলা ভাষারই অতি প্রাচীন রূপ। যেমনÑ ‘রুখের তেন্তলী’- তেন্তলী অর্থে বর্তমান আধুনিক যুগের তেতুল এবং ‘রুখের’ অর্থে বৃক্ষের এবং এসব প্রাচীন বাংলা শব্দ এখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবিকৃত অবস্থাতেই প্রচলিত আছে। ( ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্মতর্ব্য) এবং ‘চলহু’, ‘ জোইনী ’ প্রভৃতি এসব শব্দের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই প্রাচীন বৌদ্ধ গানের ভাষা সম্পর্কেও যেমন বিতর্কের অভাব ছিল না ঠিক তেমনি বিদ্যাপতি ব্যবহৃত তার কাব্যের ভাষা সম্পর্কেও সন্দেহের অবকাশ তিরোহিত ছিল না।
এ সব বিবেচনা করে এখন পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। পূর্বেই স্বীকৃত হয়েছে মৈথীলি স্বতন্ত্র ভাষা হলেও বাংলার চরিত্র্য-লক্ষণ তাতে অস্বাভাবিক নয়। এবং সে সূত্র ধরেই বিদ্যাপতি বাংলার প্রথম মৌলিক কবি এতে কোন সন্দেহ থাকবার কথা নয়। বস্তুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজ্রুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ কবিবৃন্দ বক্ষমান আলোচনায় উল্লেখিত হয়েছেন ঠিক একই কারণে। কেননা বিদ্যাপতির রূপ সৌন্দর্য-উন্মুখ মননকে তারা কেউই অস্বীকার করতে পারেননি। যদি বলা যায় তাদের প্রেম নির্ভর কবি কর্মের মূল প্রেরণা বাংলার আদি কবি বিদ্যাপতি থেকে প্রাপ্ত তবে অন্যায় হবে কি? বোধ করি না। যেহেতু যে রুচি বিকৃতির উর্দ্ধে বিদ্যাপতির চিত্ত চৈতন্য অবিরামভাবে কাজ করেছে তার সুন্দর তৃষিত অন্তরকে সক্রিয় করে তুলতে Ñ ঠিক তাই একই ভাবে কাজ করেছে আলোচিত কবিবর্গের অন্তরায়নেও। শুধু ব্যতিক্রম এসেছে পদ্ধতিগত প্রশ্নে কিছুটা। বিদ্যাপতি সুন্দরের কবি। নিস্কলঙ্ক প্রেমের কবি। এ আখ্যায়িতরই বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন অনেকেই সে সময়। যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন তারা কোনক্রমেই মানতে চাননি যে দেহের নগ্নতার মধ্যেও, উলঙ্গতার মধ্যে শিল্প মাধুর্য থাকতে পারে অথবা আছে, দেহের অকপট প্রকাশভঙ্গিতেও ¯ িœগ্ধ সুন্দরতা আছে অথবা থাকতে পারে। আর অন্তর মথিত চৈতন্যের স্পর্শে সে সুন্দরতা আরো তুলনামূলকভাবে অতি-সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হতে পারে। যখন তারা
০১.
না যানি প্রেম রস নাহি রতি রঙ্গ ।
কেমনে মিলবে ধ্বনি সুপুরুখ সঙ্গঁ\
তোহারি বচনে যদি করব পিরীত।।
হাম শিশু মতি তাহে অপযশ ভীত।।
সখি হে হাম অব কী বলবো তোয় ।
তা সঞে রভস কহ বহু নাহি হোয়।।
সো বর নাগর নব অনুরাগ ।
পাঁচ শরে মদন মনোরথ জাগ।।
দরশে আলিঙ্গঁন দেখব সই ।
জীউ নিকসব যব রাখব কই ?
বিদ্যাপতি কহু মিছাই তরাস।
শুনহ ঐছে নহ তাক বিলাস \
Ñবিদ্যাপতি
০২. পরিহর এ সখি তোহে পরনাম ।
হাম নাহি যাওব সো পিয়া ধাম ।।
বচন চাতুরি হাম কুছু নাহি জান ।
ইঙ্গিত না বুঝিয়ে না জানিয়ে মান ।।
সহচরি মেলি বনায়ত বেশ ।
বান্ধিতে না জানিয়ে আপন কেশ ।।
কভু নাহি শুনিয়ে সুরত কি বাত ।
কৈছনে মিলব মাধব সাথ। ।
সো বর নাগর রসিক সুজান ।
হাম অবলা অতি অলপ গেয়ান \
বিদ্যাপতি কহ কি বলব তোয় ।
অরকে মিলন সমুচিত হোয়।।
বিদ্যাপতি।
বিদ্যাপতির উদ্ধৃত কবিতাগুলির মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন তখন ঐ কবিতাগুলোর মধ্যে একমাত্র অশ্লীলতার নোংরা অপরিচ্ছন্নতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। সহজেই মন্তব্য করে বসেন ‘নিতান্তই অশ্রাব্য ও অপাঠ্য’ বলে। অথচ বিশ্লেষণ করেন না তাদের এ নিতান্ত অশ্রাব্য এবং অপাঠ্য মন্তব্যের মূল সংজ্ঞাটি কী? তারা ‘ রতিরঙ্গ, প্রেমরস, সুপুরুখ সঙ্গ ’Ñ প্রভৃতি শব্দের মধ্যে কামগন্ধের ইঙ্গিত পান। অথচ মূল বক্তব্যের সৌন্দর্যকে স্বীকার করতে চান না। এদের মধ্যে শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার সরকার এবং শ্রীযুক্ত শারদাচরণ মিত্র আবার শ্রী কালীপ্রসন্ন শর্মার মতে ইতিমধ্যেই বেশ (তৎকালে) সুলেখক, সুপন্ডিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং বিদ্যাবুদ্ধি, প্রতিভাবলে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি এ সবের অধিকারী হয়েছেন।
বিদ্যাপতির সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হলে, বিদ্যাপতি কাব্যের সমগ্র নিগুঢ় মমার্থ উদ্ধার এবং উপলদ্ধি করতে পারলে এ কথা নিশ্চিত যে , অক্ষয়কুমার সরকার এবং শারদাচরণ মিত্রের মতো বিকৃত মানসিকতার উন্নাসিকতা যত বিস্তৃত আকারেই প্রকটিত হোক না কেন বিদ্যাপতি তার সত্য মূল্যে প্রতিষ্ঠিত সিংহাসন থেকে কখনই এবং কোনভাবেই বিচ্যুত হয়ে পড়বেন না। কেননা প্রকৃত অর্থেই তিনি বিরাট ব্যক্তিত্ব, স্বতন্ত্র সত্তা এবং তার উত্তর পুরুষদের জন্য অবিনাশী অনুপ্রেরণার উৎস এবং ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনের পথ নির্দেশক। আমি তার কাব্য থেকে আরো গভীর এবং সবুজ মননশীলতার পরিচয়বাহী কিছু কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছি- যে কবিতাগুলি তার বিরুদ্ধে উচ্চারিত নিন্দাবাদের মৃত্যুতুল্য হবেÑ
কহ কহ সখি নিকুঞ্জ মন্দিরে
আজু কি হোয়াল ধন্দ !
চপলে ঝাঁপল জনু জলধর
নীল উৎপল চন্দ ।।
ফনী মনিবর উগরে নিরখি
শিখিনী আনত গেল।
সুমেরু উপরে সুর তরঙ্গিঁনী
কেবলও তরল ভেল \
কিঙ্কিনি কঙ্কনও করু কলরব
নুপুর অধিক তাহে ।
সুকাম নটনে তু বিযতিক হু
ঐছন সকলে মোহে\
না কর গোপনে, নিজ পরিজনে
ইহ বুঝি অনুমান।
বিদ্যাপতি কৃত কৃপায়ে তাহারি
কো ন জান ইহ গান ।।
Ñ বিদ্যাপতি।
বিগলিত চিকুর মিলিত মুখমন্ডল
চাঁদে বেঢ়ল ঘন মালা ।
মনিময় কুন্ডল, শ্রবনে দুলিত ভেল
ঘামে তিলক বহি গেলা ।।
সুন্দরি তুয়া মুখ মঁঙ্গল দাতা ।
রতি বিপ্রীত সমরে যদি রাখ বি
কি করব হরি হর ধাতা \
কিঙ্কিনি কিনি কিনি কঙ্কনও ক্কন ক্কন ,
কলরব নূপুর বাজে।
নিজ মদে মদনও পরাভব মানল
জয় জয় ডিন্ডিম বাজে।।
তলে এক জখন সঘন রব ঘরইতে
হোয়ল সৈনক ভঁঙ্গ।
বিদ্যাপতি ও রস গাহক
যামুনে মিললে গঙ্গঁ তরঙ্গঁ ।।
বিদ্যাপতি।
এ কবিতা দুটির উপস্থাপনা ও সুঠাম দেহ, বক্তব্যের উৎকর্ষতা এত বেশি প্রজ্বলন্ত যে তারা তার বিরুদ্ধে অহরহ নিন্দাবানী উচ্চারণ করেন তাদের অন্তরকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে অদ্ভুত এক সুখ স্পর্শের বিহবলতা অতি সামান্য ক্ষণের জন্য হলেও নির্লিপ্ততার এক প্রচ্ছন্নতায় আচ্ছন্ন করে ফেলবে অনায়াসেই। যেখানেÑ ‘সখী বল বল নিকুঞ্জ মন্দিরে বিদ্যুৎ জলধরকে কি চন্দ্র নিলোৎপলকে আচ্ছন্ন করিয়াছে আজি এই বিষম সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে। ‘ যেখানে যমুনাকে কৃষ্ণ ও গঙ্গাতরঙ্গকে রাধার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ( যেন যমুনায় গঙ্গার তরঙ্গ মিলিয়াছে) সেখানে বিদ্যাপতির চরম দূরদৃষ্টি শক্তি ও তী² আত্মবিশ্লেষণের ক্ষমতা এক কথায় স্বীকার্য এবং গ্র্হ্যা। এবং এ ক্ষমতার অধিকারী বলেই বিদ্যাপতি ইন্দ্রিয় সমর্পিত নন, রুচি বিকৃত নন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম নন। তিনি কবি সুন্দরের, কবি নিষ্পাপ প্রেমের, সর্বোপরি চিত্তচৈতন্যের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের উন্মাদনাকে অগ্রাহ্য এবং বিসর্জন দিয়েই । আর তার কাব্য Ñ এক কথায় যা রক্তের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুন্দরের অগ্নিশিখা যে সুন্দরে অশ্লীলতা ¤ ্রয়িমান, ¤øান, লজ্জিত।
এখন নিঃসন্দেহে বলা যায়Ñ বিদ্যাপতিই বাংলা ভাষার প্রথম কবি এবং নিটোল প্রেমের কবি। তাঁর কাব্যে অশ্লীলতার প্রশ উত্থাপন অবান্তর। এবং যিনি তাঁর কাব্য সম্ভারের ভেতর দিয়ে তাঁর উত্তরপুরুষদের জন্যে অনাগত অনন্ত কালের সীমাহীন অনুপ্রেরণার উৎস হয়েই বেঁচে থাকবেন। তিনি ব্যতিক্রম অবশ্যই তাঁর সমগ্র কাব্য সৃষ্টিতে।