বাংলা কবিতার কালপরিধির অসীম রেখায় নক্ষত্রপুঞ্জের উদ্ভাসন ঘটেছে যুগে যুগে। আর ওই নক্ষত্রবীথির মর্মতলে কাব্যিক অনুরণন যে সব সময়ই অনুরণিত হয়েছে তেমন নয়। বর্ধিষ্ণু কবিতাঞ্চলের উপত্যকায় কখনও মেঘ কখেনও বৃষ্টি কখনও রৌদ্রাঙ্কিত প্রহর, আবার কখনও রাশি রাশি জ্যোৎ¯œা এক অমোঘ ঐশ্বর্যময়তা ঝরিয়ে ঝরিয়ে বাংলা কবিতাকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি, দিয়েছে অনর্গল আন্তর্জাতিকতা বোধের গভীর অভিস্ফুরণ। আর তারই নিরিখে বিংশ শতাব্দী-উত্তর তিরিশীয় কবিতা এক অনন্য মহিমা মুগ্ধতার আবেশ অবয়বে ধারণ করে একটা সুনির্দিষ্ট প্রান্তরেখা অতিক্রমের অধিকার অর্জন করতে সক্ষমও হয়। তারপর কবিতার প্যাটার্ন, স্ট্রাকচার, ফাউন্ডেশন, এক্সপ্রেশনে যুক্ত হয় ভিন্ন এক মাত্রা, যা আধুনিক কবিতার রূপবদলের কমিটমেন্ট নিয়ে পাঠকের দরবারে উপস্থাপিত হয়। বরীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতা পরবর্তীকালে জীবনান্দনীয় ফর্মেটে উৎসারিত হয়ে দশক বিভাজনে ষাটে এসে থিতু হয়। ইতোমধ্যে কবিতা ধারণ করে নেয় দেশ বিভাগের গভীর ক্ষত। ১৯৪৭-এ পার্টিশনের ছাপ শুধু কবিতায়ই নয়, সমস্ত বাংলা সাহিত্যের ওপর গহীন দাগ এঁকে দেয়। এই দাগের উৎসস্থল হলো দুই বাংলার মানুষের জীবনবোধ। আকণ্ঠ এক যন্ত্রণাকাতরতা নিয়ে দেশ ভাগের অবস্থান মেনে নিয়েই পরবর্তী সময় জীবনের পথ যায় বয়ে দূরান্তের দিগন্ত অভিমুখে। একসময়কার সাহিত্যের রাজধানী কলকাতার সমান্তরালে পঞ্চাশের দশকে ঢাকাও হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালী সংস্কৃতির পাদপীঠ। অস্থির সময় পেরিয়ে এসে ঢাকার সাহিত্যাঙ্গন মধ্য পঞ্চাশে এসে সুস্থির হয়। ততদিনে ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিশাল এক সাহিত্য পরিক্রমা পরিবৃত হয়ে ক্রমশ পরিশ্রুত ধারায় এসে থামে। এরপর নানান রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে এ দেশের সাহিত্য পথ চলেছে। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিতার যে আঙ্গিক, ফর্ম, থিম; সত্তর দশকে এসে সেখানে আশ্রয় লাভ করে স্বাধীনতা-উত্তর এক ভিন্ন মেজাজের পরিবেশ। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের রাজধানী ঢাকা আরও গতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের ঝর্ণায় অভিসিক্ত হয়ে এক নিউ ডাইমেনশনের রিদমে স্পন্দিত হতে থাকে। বিশেষ করে সত্তর দশকে কবিতার মর্মে এক মখমলি আবেগ উড়তে থাকে স্কার্ফের মতো, যার পুরোভাগ জুড়ে বয়ে যায় রোমান্টিসিজমের অতলস্পর্শী ভাবাবেগ। এ রোমান্টিসিজমের ধারায় তৎকালে সমবেত একঝাঁক নবীন কবি তাদের স্বকীয়তা, স্বনিষ্ঠতায় আধুনিক কবিতার গলায় জড়িয়ে দেয় প্রেমাশ্রয়ী উষ্ণতার তারাজ্বলা মাফলার। সত্তর দশকের সময়জুড়ে যে ক’জন কবি প্রেমের কবিতার ক্রিসেস্থিমাম ফুটিয়ে তরুণ পাঠক মহলে গভীর আগ্রহ জাগাতে সক্ষম হন, কবি বাকী বিল্লাহ ওই ক’জনের শীর্ষ সারির কবিদেরই একজন। তার কবিতার ফোয়ারায় সিঞ্চিত আছে এক সুনির্জনতাবোধের মসলিনি মিহিন মূর্ছনা, যা পাঠকের মনকে অনায়াসেই ছুঁয়ে যেতে সমর্থ হয়। তার কবিতার আকাশে জেগে আছে মেঘ-বৃষ্টি-রোদের মণিরত্মরাজি। কুয়াশার কার্নিভালে অযুত-নিযুত শিশিরপুঞ্জের মতোই বাকী বিল্লাহ’র কবিতা ভোরের রৌদ্রে যেন হয়ে ওঠে একেকটি গোল আয়নার স্বচ্ছ বিন্দু। কবি বাকী বিল্লাহ তার প্রতিটি কবিতার ফারকোটেই এঁকেছেন সোনার বোতামজ্বলা দুপুরের বিজন এচিঙ। তার কবিতার ভেতরবাড়ির প্রতিটি স্তবকেই ফুটে আছে সান্ধ্য জ্যোৎস্নার মতো ভেলভেটজ্বলা মায়াবি কার্নেসন এবং তার কবিতা যেন চন্দ্রাতপ রাত্রির উদ্যানে বিভোর ম্যাগনোলিয়া গ্ল্যান্ডিফোরার মতো অহর্নিশ ছড়ায় অমিয় সুবাস। বিকেলের বাইফোকাল ফিকে আলোর অরণ্য ছুঁয়ে বাকী বিল্লাহর কবিতার শব্দপুঞ্জ সি-প্লেনের মতো যায় উড়ে। দূরে মাঠে-মাঠে ঝরা সেগুন আর দেবদারু পাতার প্যামফ্লেটে তার কবিতার করৌঞ্জ থাকে জেগে। বৃষ্টিভেজা এরোড্রামের মতোই বাকী বিল্লাহ’র কবিতার মোজাইকজ্বলা ফ্লোরে প্রকৃতির গুঞ্জরণ এক ঐন্দ্রজালিক অবগাহনে টেনে নেয় পাঠককে। যাদুকরী ওই টান কবি বাকী বিল্লাহ’র কবিতায় কী এক অদ্ভুত সক্ষমতায় ফুটে ওঠে তারই কিছু উৎসারণ দেয়া যাকÑ যা পাঠক নতুনভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সত্তর দশকের কবি বাকী বিল্লাহ্র কবিতার জলপ্রপ্রাতে ভিজিয়ে নিতে পারেন ধূসর ছায়াচ্ছন্ন মন। ‘সবুজ ঝালর দেয়া কার্ডিগানে তোমাকে মানায় ভালো/ তোমাকে মানায় ভালো নীল বকলেস আঁটা হাইহিলে/ অভিজাত বিপণি বিতানের শোরুম থেকে সাদা ফ্রেমে, চশমায় তোমাকে মানায় ভালো/ ঢেউ জাগা বুকের উত্থান থেকে সরে গেলে/ অসতর্ক শাড়ির আঁচল/ তোমাকে দেখায় যেন থিয়েটারে নায়িকার সাজে/ পটিয়সী নঈমা আলমাস’ (তোমার পোশাক/ লাবণ্যে জড়ানো পাপ’) ‘নিজস্ব নিয়মে বেড়ে ওঠো/ প্রতিবাদহীন বিনম্র আচরণে, মুগ্ধ সঙ্গীতে, উৎসবে/ গৃহবাসী আমের মুকুল বেড়ে ওঠে একান্ত সঙ্গীতে/ সোনালি অর্কিডে/ ফুটে আছো ছাদে, দূর কার্নিশে/ অগ্নুৎসবের মুগ্ধ প্রতিমার মতো ফুটে আছো গ্রিন রোডে/ অঙ্গের উচ্ছ্বাসে, উদ্ধত চোখে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে ফুটে আছো লাবণ্যের বিবিধ উপমা নিয়ে।’ (মাজেদা আক্তার/ঐ)।‘ফুল নয়, পাখি নয়, মেঘ কিংবা স্বপ্নচারিণী কোন প্রিয় মুখ/ ভালোবাসা নয়/ শুধু বেদনার গাছপালা, লতা-গুল্মময় অদম্য বিষাদ তরতাজা/ বেড়ে ওঠে শরীরে আমার/ অরণ্যচারী নই, তৃণভুক বৃক্ষ বিলাসীও নই, নম্রনতজানু প্রেম/ বাঁকানো শরীর/ ফুল নয়, পাখি নয়, মেঘ কিংবা স্বপ্নচারিণী কোন প্রিয় মুখ/ ভালোবাসা নয়/ শুধু এক কষ্টের লতা এঁকে বেঁকে সাড়ে পাঁচ ফুট শরীরে জড়ায়’(লাবণ্যে জড়ানো পাপ/ঐ)কবি বাকী বিল্লাহ’র কবিতা থেকে উদ্ধৃত কয়েক পঙ্ক্তি কবিতা পাঠেই পাঠক সহজেই ধারণ করতে পারবেন তার কবিতার আধুনিক বোধ, স্টাইলিশ মনোভঙ্গি, শব্দবিন্যাস, উপমা, উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ আর চিত্রকল্পের নিখুঁত ব্যবহারবিধি। পরাবাস্তববাদী এক অলৌকিক ট্রাস্পেট বাকী বিল্লাহ্’র কবিতাকে দিয়েছে মিহিন সুরের স্পন্দিত মুগ্ধ মায়াজাল। চন্দ্রডোবা ভোরের ব্যালকনিতে কি আজও তার কবিতার নরম পালক ঝরিয়ে যায় না মুখর ফেব্রিকোর মতো শালিকের ডানার পশম! বরফকুচির মতো মার্বেল পাথরে গড়া তার একেকটি কবিতার প্রাসাদবাড়ির লনে, পোর্টিকোতে ধুম বৃষ্টির দিনে এসে পালক ছড়িয়ে নামে লাল, নীল, সাদা পরীর দল। ম্রিয়মাণ গোধূলির অপাঙ্গে থাকে না ফুটে বাকী বিল্লাহ’র কবিতার কানকোর লাল ঝাউবন। মন থাকে পড়ে টেকঅফ্হীন ধুলো ওড়া মাঠের রানওয়ে আর যায় ছুঁয়ে বাদলাঝরা ঘন সন্ধ্যার মেঘশিরিষের চুড়োর প্রপেলার। তার কবিতার একেকটি কেতাদুরস্ত গোলাপ কি আজও বসে নেই বিছিয়ে লাল কল্কে পেড়ে চন্দ্রাহত স্মৃতির রুমাল। ঝিরিঝিরি ইন্টারভেলের পর্দা সরিয়ে কবি বাকী বিল্লাহ্’র কবিতার প্রাঙ্গণে স্বতঃস্ফূর্ত বর্ষণে পাঠকের মন হবে বিসিক্ত, হবে ফুরফুরে আর হাওয়ার রিসিভারে নেমে আসবে বাকী বিল্লাহ্’র কবিতার মেঘভাঙ্গা রোদের মতো কিন্নরি কলস্বর!