বুমেরাং । মনোজিৎ কুমার দাস
ছোটবেলা থেকে বন্ধু ছিলাম আমরা দুটিতে। আমরা একই পাড়ায় মানুষ, একই পাড়ার স্কুলে লেখাপড়া। পুরনো ঢাকার এক সময়ের বনেদী পরিবারে আমাদের দু’জনেরই জন্ম। যদিও প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা কালের প্রথম দিকে আমরা একে অপরকে চিনতাম না। ও পড়তো ওদের বাসার কাছের সরকারী মডেল প্রাইমারি স্কুলে, আর আমি পড়তাম আমাদের বাসার কাছের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। আমাদের পাড়ার নবারুণ সঙ্ঘের সঙ্গীতানুষ্ঠানে গিয়ে ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমরা তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। পুরনো ঢাকার চক বাজারে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ওর বাবা। আমার বাবা মতিঝিলের বড়সড় ফার্মের বড় চাকুরে।
ক্লাস সিক্স থেকে একই স্কুলে পড়তে পড়তে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। আমাদের পাড়াটা বেশ বড়সড়। গার্ল্স স্কুলটা আমাদেরই পাড়ায়। স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজলে আমরা একই সঙ্গে স্কুল থেকে বের হয়ে আমি আগে বাড়ি পৌঁছাতাম। আর আমাদের বাড়ি পেরিয়ে কলেজটাকে পাশে রেখে ও কালীবাড়ির সামনে দিয়ে নিজের বাড়ি যেত। স্কুলে যাবার সময় ও আমাদের গেটের বাইরে থেকে আমার নাম ধরে ডাক দিত। ডাক শুনে আমি বুঝতে পারতাম, পামেলা ছাড়া অন্য আর কেউ নয়। সেই ক্লাস থেকেই পামেলার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
যেদিন সাড়ে নয়টা বেজে পৌনে দশটায় ঘড়ির কাটা ছুঁইছুঁই করতো, সেদিন আমি বুঝতাম পামেলা আজ স্কুল কামাই করছে। সে সময় তো হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না, তবে আমাদের বাসায় বাবা চাকুরীর সূত্রে একটা ল্যাণ্ডফোন ছিল। আমি ভাবতাম, ওরা এত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও ওদের বাসায় একটা ফোন নেই কেন! ও না এলে কেন যেন শূন্য শূন্য মনে হতো। অপেক্ষা করে করে এক সময় আমি স্কুলের দিকে পা বাড়াতাম। একদিন দেরি করে স্কুলে পৌঁছানোয় ন্যাশনাল অ্যান্থেমে উপস্থিত না হতে পারায় বড় আপার বকুনি খেয়েও আমি কিন্তু পামেলার অপেক্ষায় না থেকে পারতাম না।
শরীর স্বাস্থ্যে পামেলাকে আমার চেয়ে বড়সড় দেখাতো। ও বেশ সুন্দরী, চোখদুটো টানাটানা, ডাগর নয়না বললে ভুল বলা হয় না। নাকটা টিকালো, কথা কলার সময় ওর গোলাপী গালে টোল পড়ে, ঠোঁট দুটো প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। নজর কাড়ার মতো সুন্দরী যাকে বলে। আমিও কিন্তু কম সুন্দরী ছিলাম না। তবে আমরা পাশাপাশি দাঁড়ালে ওর মুখের প্রতি নজর পড়তো প্রথমে।
দু’ক্লাস পাশ দিয়ে আমরা ক্লাস এইটে উঠলাম। ক্লাস সেভেনে উঠার মাঝামাঝি থেকেই আমাদের শরীর স্বাস্থ্যে বদল ঘটতে থাকে, আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। ক্লাস এইটের মাঝামাঝি সময়ে পামেলা আমার চেয়ে শরীর স্বাস্থ্য চেহারায় আরো সুন্দরী হয়ে উঠলো। সেই থেকেই ওকে দেখে আমি মুগ্ধ হতে থাকি। আমি নিজেই যেন আমার প্রিয় বান্ধবীটির প্রেমে পড়ে যাই। এক সময় আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারলাম, একদিন ওকে না দেখলে আমার মনটা যেন শূন্য শূন্য লাগে। গাহর্স্থ্য বিজ্ঞানের টিচার তানিয়া আপা তাঁর ক্লাসে বয়:সন্ধিক্ষণের চ্যাপটার বুঝাতে গিয়ে বয়:সন্ধিক্ষণের তের চৌদ্দ বছরের মেয়েদের শরীর স্বাস্থ্য ও মন বদলে যাওয়ার কথা সুন্দরভাবে ব্যাখা করার পর আমার জ্ঞানচক্ষু যেন খুলে গেল। তিনি বললেন- ছেলেমেয়েরা এ বয়স থেকেই সুন্দরের আরাধনা শুরু করে। আমি মনে মনে ভাবলাম, পামেলা সুন্দরী তাই আমি ওকে এত ভালবাসি, ও আমারই মতো একটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও।
দুটো বছর গড়িয়ে গেল। আমরা ক্লাস নাইন থেকে ক্লাস টেনে উঠলাম। পামেলা আমার চেয়ে ভাল রেজাল্ট করলো। আমার রেজাল্ট পামেলার চেয়ে খারাপ হওয়া সত্বেও আমি মোটেই অখুশি নই। ওকে ঈর্ষা করা আমার ধাতে সয় না, কারণ, আমি যে ওকে সত্যি সত্যি ভালবাসি।
আমাদের পাড়ার বারোয়ারি কালীপুজোর রাতে পামেলার সাজগোজ দেখে আমি তো অবাক! আমাদের স্কুলে মাসের শেষ বৃহস্পতিবারে ক্লাসের ইউনিফর্ম বহির্ভূত পোশাক পরে আসার নিয়ম চালু ছিল। এক বৃহস্পতিবারে পামেলার পরনের পোশাক দেখে গীতাঞ্জলী ম্যাডাম তো পামেলার উপর রেগে আগুন হয়ে বললেন – পামেলা, ইউনিফর্ম্ ছাড়া অন্য পোশাক পরার অর্থ শালীনতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া নয় কিন্তু! খবরদার এমন পোশাক পরে আর কোনও দিন স্কুলে আসবে না, পামেলা।
স্কুল থেকেফেরার পথে পামেলা আমাকে যা বলল, তা শুনে আমার পিলে যেন চমকে উঠলো। বলে কী! আমার মনের মধ্যে কৌতূহল মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। আমি একটু ভেবে নিয়ে ওকে বললাম –তোর জন্যে আমি সব কিছুই করতে পারি এ বিশ্বাসটা তোর নেই দেখছি!
পামেলা হাসি হাসি মুখে বললো – আমি জানি তুই আমাকে...
আমি ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম – অবশ্যই তোর সুখের জন্যে যা যা করার তাই করবো। তবে ছেলেটি কে?
- ছেলেটিকে তুই চিনিস না। তবে আমি তার সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দেব।
আমি আগ্রহ সহকারে বললাম- ঠিক আছে।
পামেলা ছেলেটির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। ছেলেটির নাম সুশোভন। আসলেই দেখতে অপূর্ব। আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তের লক্ষ্মীবাজারের কাছাকাছি ওদের বাসা। একটা বিদেশী ফার্মের আইটি সেক্টরে ছেলেটি কাজ করে। আমাদের বাসার কাছাকাছি ওর বাসা হওয়ায় ছেলেটির সঙ্গে আমার হরহামেশাই দেখা হলেও সে কিন্তু আমার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পামেলা বিষয়টা আমার কাছ থেকে শুনে বেশ সময় ধরে কী যেন ভেবে বলল – তোকে দিয়েই কাজ হবে!
তারপর থেকে আমি পামেলার কাছ থেকে একটা দায়িত্ব পেলাম। দায়িত্বটা হল পামেলা ও সুশোভন নামের তার প্রেমিকের মধ্যে চিঠি আদান প্রদানের বাহক হওয়া। মোবাইল ফোনের যুগ না হওয়ায় কয়েকদিন পর থেকে আমি পামেলা ও তার প্রেমিকের মধ্যে প্রেমপত্র আদান প্রদানের ডাক পিয়ন হলাম।
তারপর থেকে সুশোভনের সঙ্গে আমার দেখা ঘন ঘনই হতে লাগলো। আমার পক্ষে একটা যুবক ছেলের সঙ্গে ঘন ঘন দেখা করা সহজ নয় এটা না বললেই নয়। পামেলার উপকার করার উদ্দেশে আমাকে একটা বুদ্ধি খাটাতে হল। সেটার কথাই বলি।
ছেলেটি ভাল গিটার বাজায়, খেলাধুলো করতে ভালবাসে। আমিও গিটার বাজাতে ভালবাসতাম, স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গিটার বাজিয়ে আমি দু’বার পুরস্কারও পেয়েছি। আমার বড়মামা কানাডা থেকে আসবার সময় আমাকে একটা কম্পিউটার এনে দেন। তখন আমাদের এখানে কম্পিউটার হাতেগোণা কয়েকজনেরই ছিল। আমাদের বাসা থেকে একটু দূরে লক্ষ্মীবাজারের কলেজ মোড়ের গলির মাথার সাইবার কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিতে যেতামে। আমি সহজ ভাবেই ভাবলাম, পামেলা ও সুশোভনের চিঠি আদানপ্রদানে সপ্তাহের ওই দিনটাকে আমি কাজে লাগাতে পারি। শুধুমাত্র আমার একান্ত বন্ধু পামেলাকে খুশি করাই আমার এক মাত্র উদ্দেশ্য। তাছাড়া প্রথম দিকে আমার আর কোন মতলব ছিল।
সুশোভনের সাথে সপ্তাহে একদিন মিলিত হয়ে পামেলার ও তার চিঠি আদান প্রদান করতে লাগলাম। আমাদের কমন ইন্টারেস্ট গিটার বাজনা, তাই ওই বিষয়ে সুশোভনের সঙ্গে একটুআধটু আলাপসালাপ মাঝেমধ্যে হতে থাকে। দিনে দিনে ছেলেটির সঙ্গে যে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, তা তখনো আমি ভালভাবে বুঝতে পারিনি। পামেলা ও আমি স্কুল ফাইনাল এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করছি। আমার ক্লাস না থাকায় আমি এর মধ্যেই সাধারণ প্রোগ্রাম শেষ করে এক্সেল প্রোগ্রাম শিখছিলাম সপ্তাহে দু’দিন। ফলে পামেলার প্রেমিক সুশোভনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আগের চেয়ে আরো বেশি হতে থাকল।
আমাদের রেজাল্ট বের হলো। আমরা দু’জনেই ভাল রেজাল্ট করলাম। আমরা একই কলেজে ভর্তি হলাম। এর মাঝে আমার বাবার সিলেটে বদলীর অর্ডার এলো। ঢাকা ছাড়ার আগে টের পেলাম অজান্তেই ছেলেটিকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। ঢাকা ছাড়ার দিন এগিয়ে এলো। আমি ভাবলাম, ভালই হলো। বান্ধবীর প্রেমিককে নিজের করে পাবার জন্যে রেশারেশি করার অর্থ হয় না। পামেলা ছেলেটির সঙ্গে চোখের সামনে প্রেম করবে সেটা ভাবতেও কষ্ট লাগতো ঢাকায় থাকলে।
বিধাতার মনে কী ছিল কে জানে! বছর খানেক পরে একদিন পামেলা টেলিফোন বুথ থেকে আমাদের ফোনে জানালো যে সুশোভন এক বছরের ট্রেনিং এ সিলেটে গেছে। আমি আমার বান্ধবীর ফোন পেয়ে মনের অজান্তেই আনন্দিত হলাম। সে আমাকে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বললো- তুই ওকে হেল্প করিস কিন্তু। ও তো ওখানকার কোন কিছু চেনে না।
ছেলেটি আমাদের ঠিকানা খুঁজে আমার সঙ্গে দেখা করলো। তারপর থেকে সুশোভনের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই আমার দেখা সাক্ষাৎ ঘটতে লাগলো।
একদিন সুশোভন আমাকে বললো যে ট্রেনিংটা শেষ হলে সে একটা প্রোমোশন পাবে, আর তখন সে পামেলাকে বিয়ে করতে পারবে। ওর কথা শুনে আমার মনে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। আমি মনস্থ করলাম, যে করেই হোক পামেলার সঙ্গে তার বিয়েটা ভেঙে দিতে হবে। সুশোভন জানে না আমি তাকে ভালোবাসি। আমি ভাবলাম, সুশোভনকে না পেলে আমি মরে যাব! আমি মনে মনে প্ল্যান কষতে শুরু করলাম। সুশোভনের মনটা আমার দিকে যে করেই হোক ফেরাতে হবে।
পামেলা আমাকে চিঠি লিখে জানালো সে সুশোভনের পথ চেয়ে বসে আছে, অন্যদিকে বাড়ি থেকে তার বিয়ের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। ট্রেনিং সেন্টারের ঠিকানায় চিঠি দিলে তা ওর হাতে নাও পড়তে পারে। আমার ঠিকানায় মুখবন্ধ খামে ও তার প্রেমিক সুশোভনকে চিঠি পাঠিয়ে আমাকে অনুরোধ করলো, আমি যেন চিঠিটা ওকে দিয়ে দেই।
তারপর থেকে একই ভাবে আমার ঠিকানায় মুখবন্ধ খামে সুশোভনকে চিঠি পাঠাতে লাগলো। আমি ওর চিঠি প্রথম প্রথম সুশোভনের হাতে দিতে ভুল করতাম না। তারপর যখন আমি জানতে পারলাম ওর বাবা মা পামেলার বিয়ে অন্যত্র দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, সে কোন রকমে বিয়েটা ঠেকিয়ে রেখেছে, তখন আমার মাথায় একটা কুমতলব এলো। আমি ভাবলাম – এটাই সুযোগ! তখন থেকে পামেলার পাঠানো চিঠি সুশোভনকে দেওয়া বন্ধ করে দিলাম।
সুশোভনকে পামেলার চিঠি বিলি করা থেকে বিরত থাকার মাস খানেক পরে একদিন সুশোভন আমাকে জিজ্ঞেস করলো তার বান্ধবী কেন তাকে চিঠি দিচ্ছে না? পামেলার বাড়িতে টেলিফোন থাকলে সে টেলিফোন করে দেখার চেষ্টা করতো।
ওর দুশ্চিন্তার কথা শুনে আমি তওকে বললাম – আমিও তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ও তো টেলিফোন বুথ থেকেও আমাকে ফোন করতে পারতো। ওদের টেলিফোন থাকলে খোঁজ নিয়ে দেখা যেত।
সুশোভন মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করে ওর মনোকষ্টের কথা জানাতে থাকলো। আমি ভাবলাম, এটাই সময় ওকে আমার দিকে কাছে টানার। সুশোভনের মনোকষ্ট দিন দিন বেড়ে যেতে থাকলো। আমি ভাবলাম, ইচ্ছে করলে ও ঢাকায় গিয়ে পামেলার খোঁজ নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু ও পামেলাদের বাড়িতে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারলো না।পামেলা ওর খোঁজ নেওয়ার জন্যে আগে কয়েকবার টেলিফোন বুথ থেকে আমাকে ফোন করেছিলো। কিছুদিন পরে পামেলার ফোন এলো, ও জিজ্ঞেস করলো – কী রে! কী ব্যাপার সুশোভন তো আমাকে অনেকদিন চিঠি দেয় না। ও কেন আমাকে চিঠি দিচ্ছে না বুঝছি না।
আমি ফোনের এপ্রান্ত থেকে অম্লানবদনে বলে দিলাম – কী জানি! ও তো আমার সঙ্গেও বেশ ক’দিন দেখা করে না। তবে শুনেছি এখানে নাকি ও একজন বান্ধবী জুটিয়ে নিয়েছে।
আমার কথা শুনে পামেলা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো- এখন তা হলে আমি কী করবো? বাড়ি থেকে বের হতে পারলে আমি তোদের ওখানে ছুটে যেতাম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই।
আমি পামেলার কথা শুনে মনে স্বস্তি পেলাম। ভাবলাম, এখন দেখবো তুই কিভাবে সুশোভনকে পাস!
আমার মাথায় জেদ চেপে গেল। আমি ভাবলাম এবার দেখি সুশোভন আমার না হয়ে যায় কোথায়? সুশোভনের সঙ্গে পামেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পামেলা ফোন করে আমাকে জানালো – ওর বিয়ে পাকাপকি ভাবে ঠিক হয়ে গেছে। সুশোভন যেন অবিলম্বে ঢাকায় এসে ওর সঙ্গে দেখা করে।
আমি সুশোভনকে এ খবরটি জানালাম না। সুশোভন ঢাকায় যাওয়ার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠলে আমি তাকে বললাম – পামেলা হয়তো বাড়িতে কড়াকড়ির মধ্যে আছে। এখন ওর সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়াই উচিত। কয়েকদিন পরেই যাওয়াই ভাল। দিশেহারা অবস্থায় সুশোভন আমার কথা মেনে নিল।
সুশোভন ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়ায় পামেলা খুবই মর্মাহত হলো। সুশোভনের প্রতি প্রচণ্ড অভিমানে ও বাবা মায়ের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে করতে রাজি হলো। ছেলেটি কানাডা প্রবাসী। বিয়ের পর পরই তাকে কানাডায় নিয়ে যাবে। পামেলা ওই ছেলের সঙ্গে বিয়েতে সম্মতি দেওযার পর থেকে পামেলার কানাডা যাওয়ার পাসপোর্ট্ ভিসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তার হবু বর।
ফোন করে পামেলা আমাকে সব কিছুই জানালো। আমি কিন্তু এ খবর সুশোভনকে জানালাম না। বিয়ের পর পামেলা আমাকে ফোন করে জানালো তার পাসপোর্ট্ ভিসা রেড়ি হতে মাস খানেক লাগবে। আমি পামেলার ফোন পেয়ে আশ্বস্ত হলাম। সুশোভনের ঢাকা যাওয়া মাস খানেক ঠেকিয়ে রাখতে পারলে আমার লুকোচুরির কথা সুশোভন জানতে পারবে না। যে কোন ভাবেই হোক পামেলাকে কানাডা যাওয়ার আগে কোনক্রমেই ওকে ঢাকায় যেতে দেওয়া যাবে না। পামেলা ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সুশোভন ঢাকায় গেলে সে পামেলাকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে আমার কাছেই ফিরে আসবে। বাস্তবে কিন্তু তা হলো না। মাস দেড়েক পরে সুশোভন ঢাকায় গিয়ে আর ফিরে এলো না।
পরে আমি জানতে পারলাম, সুশোভন ঢাকায় গিয়ে চাকরি ছেড়ে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। আমার সঙ্গে তার আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। আমার বান্ধবী পামেলা ও সুশোভন কেউ আসল সত্যটা আজও জানে না। শুনেছি পামেলা কানাডায় স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছে। অপরদিকে, সুশোভন স্কলারশিপ নিয়ে নিউইয়র্কে, সে নাকি মার্কিনী মহিলাকে বিয়ে করে ওখানেই সংসার পেতেছে। হায়! আমার ছোঁড়া তীর বুমেরাং হয়ে আমাকেই আঘাত করায় আমি এখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত!
ছোটবেলা থেকে বন্ধু ছিলাম আমরা দুটিতে। আমরা একই পাড়ায় মানুষ, একই পাড়ার স্কুলে লেখাপড়া। পুরনো ঢাকার এক সময়ের বনেদী পরিবারে আমাদের দু’জনেরই জন্ম। যদিও প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা কালের প্রথম দিকে আমরা একে অপরকে চিনতাম না। ও পড়তো ওদের বাসার কাছের সরকারী মডেল প্রাইমারি স্কুলে, আর আমি পড়তাম আমাদের বাসার কাছের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। আমাদের পাড়ার নবারুণ সঙ্ঘের সঙ্গীতানুষ্ঠানে গিয়ে ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমরা তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। পুরনো ঢাকার চক বাজারে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ওর বাবা। আমার বাবা মতিঝিলের বড়সড় ফার্মের বড় চাকুরে।
ক্লাস সিক্স থেকে একই স্কুলে পড়তে পড়তে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। আমাদের পাড়াটা বেশ বড়সড়। গার্ল্স স্কুলটা আমাদেরই পাড়ায়। স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজলে আমরা একই সঙ্গে স্কুল থেকে বের হয়ে আমি আগে বাড়ি পৌঁছাতাম। আর আমাদের বাড়ি পেরিয়ে কলেজটাকে পাশে রেখে ও কালীবাড়ির সামনে দিয়ে নিজের বাড়ি যেত। স্কুলে যাবার সময় ও আমাদের গেটের বাইরে থেকে আমার নাম ধরে ডাক দিত। ডাক শুনে আমি বুঝতে পারতাম, পামেলা ছাড়া অন্য আর কেউ নয়। সেই ক্লাস থেকেই পামেলার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
যেদিন সাড়ে নয়টা বেজে পৌনে দশটায় ঘড়ির কাটা ছুঁইছুঁই করতো, সেদিন আমি বুঝতাম পামেলা আজ স্কুল কামাই করছে। সে সময় তো হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না, তবে আমাদের বাসায় বাবা চাকুরীর সূত্রে একটা ল্যাণ্ডফোন ছিল। আমি ভাবতাম, ওরা এত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও ওদের বাসায় একটা ফোন নেই কেন! ও না এলে কেন যেন শূন্য শূন্য মনে হতো। অপেক্ষা করে করে এক সময় আমি স্কুলের দিকে পা বাড়াতাম। একদিন দেরি করে স্কুলে পৌঁছানোয় ন্যাশনাল অ্যান্থেমে উপস্থিত না হতে পারায় বড় আপার বকুনি খেয়েও আমি কিন্তু পামেলার অপেক্ষায় না থেকে পারতাম না।
শরীর স্বাস্থ্যে পামেলাকে আমার চেয়ে বড়সড় দেখাতো। ও বেশ সুন্দরী, চোখদুটো টানাটানা, ডাগর নয়না বললে ভুল বলা হয় না। নাকটা টিকালো, কথা কলার সময় ওর গোলাপী গালে টোল পড়ে, ঠোঁট দুটো প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। নজর কাড়ার মতো সুন্দরী যাকে বলে। আমিও কিন্তু কম সুন্দরী ছিলাম না। তবে আমরা পাশাপাশি দাঁড়ালে ওর মুখের প্রতি নজর পড়তো প্রথমে।
দু’ক্লাস পাশ দিয়ে আমরা ক্লাস এইটে উঠলাম। ক্লাস সেভেনে উঠার মাঝামাঝি থেকেই আমাদের শরীর স্বাস্থ্যে বদল ঘটতে থাকে, আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। ক্লাস এইটের মাঝামাঝি সময়ে পামেলা আমার চেয়ে শরীর স্বাস্থ্য চেহারায় আরো সুন্দরী হয়ে উঠলো। সেই থেকেই ওকে দেখে আমি মুগ্ধ হতে থাকি। আমি নিজেই যেন আমার প্রিয় বান্ধবীটির প্রেমে পড়ে যাই। এক সময় আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারলাম, একদিন ওকে না দেখলে আমার মনটা যেন শূন্য শূন্য লাগে। গাহর্স্থ্য বিজ্ঞানের টিচার তানিয়া আপা তাঁর ক্লাসে বয়:সন্ধিক্ষণের চ্যাপটার বুঝাতে গিয়ে বয়:সন্ধিক্ষণের তের চৌদ্দ বছরের মেয়েদের শরীর স্বাস্থ্য ও মন বদলে যাওয়ার কথা সুন্দরভাবে ব্যাখা করার পর আমার জ্ঞানচক্ষু যেন খুলে গেল। তিনি বললেন- ছেলেমেয়েরা এ বয়স থেকেই সুন্দরের আরাধনা শুরু করে। আমি মনে মনে ভাবলাম, পামেলা সুন্দরী তাই আমি ওকে এত ভালবাসি, ও আমারই মতো একটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও।
দুটো বছর গড়িয়ে গেল। আমরা ক্লাস নাইন থেকে ক্লাস টেনে উঠলাম। পামেলা আমার চেয়ে ভাল রেজাল্ট করলো। আমার রেজাল্ট পামেলার চেয়ে খারাপ হওয়া সত্বেও আমি মোটেই অখুশি নই। ওকে ঈর্ষা করা আমার ধাতে সয় না, কারণ, আমি যে ওকে সত্যি সত্যি ভালবাসি।
আমাদের পাড়ার বারোয়ারি কালীপুজোর রাতে পামেলার সাজগোজ দেখে আমি তো অবাক! আমাদের স্কুলে মাসের শেষ বৃহস্পতিবারে ক্লাসের ইউনিফর্ম বহির্ভূত পোশাক পরে আসার নিয়ম চালু ছিল। এক বৃহস্পতিবারে পামেলার পরনের পোশাক দেখে গীতাঞ্জলী ম্যাডাম তো পামেলার উপর রেগে আগুন হয়ে বললেন – পামেলা, ইউনিফর্ম্ ছাড়া অন্য পোশাক পরার অর্থ শালীনতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া নয় কিন্তু! খবরদার এমন পোশাক পরে আর কোনও দিন স্কুলে আসবে না, পামেলা।
স্কুল থেকেফেরার পথে পামেলা আমাকে যা বলল, তা শুনে আমার পিলে যেন চমকে উঠলো। বলে কী! আমার মনের মধ্যে কৌতূহল মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। আমি একটু ভেবে নিয়ে ওকে বললাম –তোর জন্যে আমি সব কিছুই করতে পারি এ বিশ্বাসটা তোর নেই দেখছি!
পামেলা হাসি হাসি মুখে বললো – আমি জানি তুই আমাকে...
আমি ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম – অবশ্যই তোর সুখের জন্যে যা যা করার তাই করবো। তবে ছেলেটি কে?
- ছেলেটিকে তুই চিনিস না। তবে আমি তার সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দেব।
আমি আগ্রহ সহকারে বললাম- ঠিক আছে।
পামেলা ছেলেটির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। ছেলেটির নাম সুশোভন। আসলেই দেখতে অপূর্ব। আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তের লক্ষ্মীবাজারের কাছাকাছি ওদের বাসা। একটা বিদেশী ফার্মের আইটি সেক্টরে ছেলেটি কাজ করে। আমাদের বাসার কাছাকাছি ওর বাসা হওয়ায় ছেলেটির সঙ্গে আমার হরহামেশাই দেখা হলেও সে কিন্তু আমার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পামেলা বিষয়টা আমার কাছ থেকে শুনে বেশ সময় ধরে কী যেন ভেবে বলল – তোকে দিয়েই কাজ হবে!
তারপর থেকে আমি পামেলার কাছ থেকে একটা দায়িত্ব পেলাম। দায়িত্বটা হল পামেলা ও সুশোভন নামের তার প্রেমিকের মধ্যে চিঠি আদান প্রদানের বাহক হওয়া। মোবাইল ফোনের যুগ না হওয়ায় কয়েকদিন পর থেকে আমি পামেলা ও তার প্রেমিকের মধ্যে প্রেমপত্র আদান প্রদানের ডাক পিয়ন হলাম।
তারপর থেকে সুশোভনের সঙ্গে আমার দেখা ঘন ঘনই হতে লাগলো। আমার পক্ষে একটা যুবক ছেলের সঙ্গে ঘন ঘন দেখা করা সহজ নয় এটা না বললেই নয়। পামেলার উপকার করার উদ্দেশে আমাকে একটা বুদ্ধি খাটাতে হল। সেটার কথাই বলি।
ছেলেটি ভাল গিটার বাজায়, খেলাধুলো করতে ভালবাসে। আমিও গিটার বাজাতে ভালবাসতাম, স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গিটার বাজিয়ে আমি দু’বার পুরস্কারও পেয়েছি। আমার বড়মামা কানাডা থেকে আসবার সময় আমাকে একটা কম্পিউটার এনে দেন। তখন আমাদের এখানে কম্পিউটার হাতেগোণা কয়েকজনেরই ছিল। আমাদের বাসা থেকে একটু দূরে লক্ষ্মীবাজারের কলেজ মোড়ের গলির মাথার সাইবার কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিতে যেতামে। আমি সহজ ভাবেই ভাবলাম, পামেলা ও সুশোভনের চিঠি আদানপ্রদানে সপ্তাহের ওই দিনটাকে আমি কাজে লাগাতে পারি। শুধুমাত্র আমার একান্ত বন্ধু পামেলাকে খুশি করাই আমার এক মাত্র উদ্দেশ্য। তাছাড়া প্রথম দিকে আমার আর কোন মতলব ছিল।
সুশোভনের সাথে সপ্তাহে একদিন মিলিত হয়ে পামেলার ও তার চিঠি আদান প্রদান করতে লাগলাম। আমাদের কমন ইন্টারেস্ট গিটার বাজনা, তাই ওই বিষয়ে সুশোভনের সঙ্গে একটুআধটু আলাপসালাপ মাঝেমধ্যে হতে থাকে। দিনে দিনে ছেলেটির সঙ্গে যে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, তা তখনো আমি ভালভাবে বুঝতে পারিনি। পামেলা ও আমি স্কুল ফাইনাল এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করছি। আমার ক্লাস না থাকায় আমি এর মধ্যেই সাধারণ প্রোগ্রাম শেষ করে এক্সেল প্রোগ্রাম শিখছিলাম সপ্তাহে দু’দিন। ফলে পামেলার প্রেমিক সুশোভনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আগের চেয়ে আরো বেশি হতে থাকল।
আমাদের রেজাল্ট বের হলো। আমরা দু’জনেই ভাল রেজাল্ট করলাম। আমরা একই কলেজে ভর্তি হলাম। এর মাঝে আমার বাবার সিলেটে বদলীর অর্ডার এলো। ঢাকা ছাড়ার আগে টের পেলাম অজান্তেই ছেলেটিকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। ঢাকা ছাড়ার দিন এগিয়ে এলো। আমি ভাবলাম, ভালই হলো। বান্ধবীর প্রেমিককে নিজের করে পাবার জন্যে রেশারেশি করার অর্থ হয় না। পামেলা ছেলেটির সঙ্গে চোখের সামনে প্রেম করবে সেটা ভাবতেও কষ্ট লাগতো ঢাকায় থাকলে।
বিধাতার মনে কী ছিল কে জানে! বছর খানেক পরে একদিন পামেলা টেলিফোন বুথ থেকে আমাদের ফোনে জানালো যে সুশোভন এক বছরের ট্রেনিং এ সিলেটে গেছে। আমি আমার বান্ধবীর ফোন পেয়ে মনের অজান্তেই আনন্দিত হলাম। সে আমাকে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বললো- তুই ওকে হেল্প করিস কিন্তু। ও তো ওখানকার কোন কিছু চেনে না।
ছেলেটি আমাদের ঠিকানা খুঁজে আমার সঙ্গে দেখা করলো। তারপর থেকে সুশোভনের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই আমার দেখা সাক্ষাৎ ঘটতে লাগলো।
একদিন সুশোভন আমাকে বললো যে ট্রেনিংটা শেষ হলে সে একটা প্রোমোশন পাবে, আর তখন সে পামেলাকে বিয়ে করতে পারবে। ওর কথা শুনে আমার মনে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। আমি মনস্থ করলাম, যে করেই হোক পামেলার সঙ্গে তার বিয়েটা ভেঙে দিতে হবে। সুশোভন জানে না আমি তাকে ভালোবাসি। আমি ভাবলাম, সুশোভনকে না পেলে আমি মরে যাব! আমি মনে মনে প্ল্যান কষতে শুরু করলাম। সুশোভনের মনটা আমার দিকে যে করেই হোক ফেরাতে হবে।
পামেলা আমাকে চিঠি লিখে জানালো সে সুশোভনের পথ চেয়ে বসে আছে, অন্যদিকে বাড়ি থেকে তার বিয়ের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। ট্রেনিং সেন্টারের ঠিকানায় চিঠি দিলে তা ওর হাতে নাও পড়তে পারে। আমার ঠিকানায় মুখবন্ধ খামে ও তার প্রেমিক সুশোভনকে চিঠি পাঠিয়ে আমাকে অনুরোধ করলো, আমি যেন চিঠিটা ওকে দিয়ে দেই।
তারপর থেকে একই ভাবে আমার ঠিকানায় মুখবন্ধ খামে সুশোভনকে চিঠি পাঠাতে লাগলো। আমি ওর চিঠি প্রথম প্রথম সুশোভনের হাতে দিতে ভুল করতাম না। তারপর যখন আমি জানতে পারলাম ওর বাবা মা পামেলার বিয়ে অন্যত্র দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, সে কোন রকমে বিয়েটা ঠেকিয়ে রেখেছে, তখন আমার মাথায় একটা কুমতলব এলো। আমি ভাবলাম – এটাই সুযোগ! তখন থেকে পামেলার পাঠানো চিঠি সুশোভনকে দেওয়া বন্ধ করে দিলাম।
সুশোভনকে পামেলার চিঠি বিলি করা থেকে বিরত থাকার মাস খানেক পরে একদিন সুশোভন আমাকে জিজ্ঞেস করলো তার বান্ধবী কেন তাকে চিঠি দিচ্ছে না? পামেলার বাড়িতে টেলিফোন থাকলে সে টেলিফোন করে দেখার চেষ্টা করতো।
ওর দুশ্চিন্তার কথা শুনে আমি তওকে বললাম – আমিও তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ও তো টেলিফোন বুথ থেকেও আমাকে ফোন করতে পারতো। ওদের টেলিফোন থাকলে খোঁজ নিয়ে দেখা যেত।
সুশোভন মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করে ওর মনোকষ্টের কথা জানাতে থাকলো। আমি ভাবলাম, এটাই সময় ওকে আমার দিকে কাছে টানার। সুশোভনের মনোকষ্ট দিন দিন বেড়ে যেতে থাকলো। আমি ভাবলাম, ইচ্ছে করলে ও ঢাকায় গিয়ে পামেলার খোঁজ নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু ও পামেলাদের বাড়িতে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারলো না।পামেলা ওর খোঁজ নেওয়ার জন্যে আগে কয়েকবার টেলিফোন বুথ থেকে আমাকে ফোন করেছিলো। কিছুদিন পরে পামেলার ফোন এলো, ও জিজ্ঞেস করলো – কী রে! কী ব্যাপার সুশোভন তো আমাকে অনেকদিন চিঠি দেয় না। ও কেন আমাকে চিঠি দিচ্ছে না বুঝছি না।
আমি ফোনের এপ্রান্ত থেকে অম্লানবদনে বলে দিলাম – কী জানি! ও তো আমার সঙ্গেও বেশ ক’দিন দেখা করে না। তবে শুনেছি এখানে নাকি ও একজন বান্ধবী জুটিয়ে নিয়েছে।
আমার কথা শুনে পামেলা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো- এখন তা হলে আমি কী করবো? বাড়ি থেকে বের হতে পারলে আমি তোদের ওখানে ছুটে যেতাম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই।
আমি পামেলার কথা শুনে মনে স্বস্তি পেলাম। ভাবলাম, এখন দেখবো তুই কিভাবে সুশোভনকে পাস!
আমার মাথায় জেদ চেপে গেল। আমি ভাবলাম এবার দেখি সুশোভন আমার না হয়ে যায় কোথায়? সুশোভনের সঙ্গে পামেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পামেলা ফোন করে আমাকে জানালো – ওর বিয়ে পাকাপকি ভাবে ঠিক হয়ে গেছে। সুশোভন যেন অবিলম্বে ঢাকায় এসে ওর সঙ্গে দেখা করে।
আমি সুশোভনকে এ খবরটি জানালাম না। সুশোভন ঢাকায় যাওয়ার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠলে আমি তাকে বললাম – পামেলা হয়তো বাড়িতে কড়াকড়ির মধ্যে আছে। এখন ওর সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়াই উচিত। কয়েকদিন পরেই যাওয়াই ভাল। দিশেহারা অবস্থায় সুশোভন আমার কথা মেনে নিল।
সুশোভন ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়ায় পামেলা খুবই মর্মাহত হলো। সুশোভনের প্রতি প্রচণ্ড অভিমানে ও বাবা মায়ের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে করতে রাজি হলো। ছেলেটি কানাডা প্রবাসী। বিয়ের পর পরই তাকে কানাডায় নিয়ে যাবে। পামেলা ওই ছেলের সঙ্গে বিয়েতে সম্মতি দেওযার পর থেকে পামেলার কানাডা যাওয়ার পাসপোর্ট্ ভিসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তার হবু বর।
ফোন করে পামেলা আমাকে সব কিছুই জানালো। আমি কিন্তু এ খবর সুশোভনকে জানালাম না। বিয়ের পর পামেলা আমাকে ফোন করে জানালো তার পাসপোর্ট্ ভিসা রেড়ি হতে মাস খানেক লাগবে। আমি পামেলার ফোন পেয়ে আশ্বস্ত হলাম। সুশোভনের ঢাকা যাওয়া মাস খানেক ঠেকিয়ে রাখতে পারলে আমার লুকোচুরির কথা সুশোভন জানতে পারবে না। যে কোন ভাবেই হোক পামেলাকে কানাডা যাওয়ার আগে কোনক্রমেই ওকে ঢাকায় যেতে দেওয়া যাবে না। পামেলা ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সুশোভন ঢাকায় গেলে সে পামেলাকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে আমার কাছেই ফিরে আসবে। বাস্তবে কিন্তু তা হলো না। মাস দেড়েক পরে সুশোভন ঢাকায় গিয়ে আর ফিরে এলো না।
পরে আমি জানতে পারলাম, সুশোভন ঢাকায় গিয়ে চাকরি ছেড়ে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। আমার সঙ্গে তার আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। আমার বান্ধবী পামেলা ও সুশোভন কেউ আসল সত্যটা আজও জানে না। শুনেছি পামেলা কানাডায় স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছে। অপরদিকে, সুশোভন স্কলারশিপ নিয়ে নিউইয়র্কে, সে নাকি মার্কিনী মহিলাকে বিয়ে করে ওখানেই সংসার পেতেছে। হায়! আমার ছোঁড়া তীর বুমেরাং হয়ে আমাকেই আঘাত করায় আমি এখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত!