বেলাল চৌধুরী : জীবনের আশ্চর্য ফুল - খালেদ হোসাইন
বেলাল চৌধুরী : জীবনের আশ্চর্য ফুল - খালেদ হোসাইন

বেলাল চৌধুরীর ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’ বইটির প্রথম লেখায় চোখ বুলাতে না বুলাতেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবি’ কবিতাটির কথা মনে পড়ল। তিনি লিখেছিলেন, ‘কবি, তুমি গদ্যের সভায় যেতে চাও?

যাও।
পা যেন টলে না, চোখে সবকিছুকে তুচ্ছ-করে-দেওয়া
কিছুটা ঔদাস্য যেন থাকে।
যেন লোকে বলে,
সভাস্থলে
আসবার কথা ছিল না কথা,
তবুও সম্রাট এসেছেন।’
আমরা জানি, বেলাল চৌধুরীর গদ্য একেবারেই স্বকীয়। টান টান, প্রাঞ্জল ও বাহুল্য-বর্জিত কিন্তু চিত্তস্পর্শী। বিষয়ভেদে এসব বৈশিষ্ট্যের তারতম্য ঘটে, কিন্তু সব সময়ই প্রাণবন্ত। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই। ধরা যাক বইয়ের প্রথম বা নাম-প্রবন্ধ ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’। শুরুটা হলো মনোলোভন এক মায়াবী ভাষায় : ‘এক আশ্চর্য রূপকথা যেন। রূপকথায় যেমন সময়কালের যাথার্থ্য নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আমাদের এ কাহিনি যাঁদের নিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রধান নায়ক-নায়িকা তাদের ঘর সংসার, পুত্র-কন্যা নিয়ে পরম সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করলেও মূল পালা-অধিকারী এবং প্রধান অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই আজ ইতিহাস আর অন্য যাঁরা এখনও দিনশেষে শেষ পারানির কড়ি গুনছেন তাদের কাছে ব্যাপারটা হবে হারানো দিনের গান বা সোনালি অতীতের এক আশ্চর্য গাথা।’ ভাষার এ মোহন ভঙ্গি বদলাতে শুরু করে পরবর্তী বাক্যেই : ‘গেল শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকটি ছিল বাঙালি জীবনের জন্য এক ঘটনাবহুল বেদনাদায়ক অধ্যায়। বিদায় নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল মতিচ্ছন্ন, জীবনানন্দ ঘরে বাইরের গভীর মর্মযাতনায় দগ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন অঙ্গার হবার অপেক্ষায় ল্যান্সডাউন রোডের গোলকধাঁধায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগের জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে নতুন চরের মতো জেগে উঠেছে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আত্মদান, আত্মোপলব্ধি সব মিলিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়।’ দীর্ঘ হল উদাহরণ, কিন্তু এ ছাড়া বেলাল চৌধুরীর গদ্যের কড়ি-কোমলে যাতায়াতের নজির আর কীভাবেই বা তুলে ধরা যেত?
বেলাল চৌধুরীর প্রবন্ধ মঁতেইনীয়। ব্যক্তিগত প্রবন্ধ এখন অনেক রচিত হয় বাংলা ভাষায়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ব্যক্তির সীমানা ডিঙাতে পারে না। বেলাল চৌধুরীর প্রবন্ধ শুধু ভাষা-বৈশিষ্ট্য নিয়ে নয়, অর্জিত অভিজ্ঞতার অন্তর্গত তাপ ও চাপ, ঘনিষ্ঠ আন্তরিকতা আর বয়ান-কৌশলের নাটকীয়তার কারণে সঙ্গীতে পরিণত হয়। গানটি ফুরিয়ে যায়, রেশ আর ফুরোতেই চায় না। তাঁর গদ্য আবৃত্তিযোগ্য কবিতার মতোই উচ্চারণ করে পাঠ করবার। কিন্তু তাতে গদ্যের দার্ঢ্য কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় না।
সদ্য-উত্তীর্ণ শৈশব থেকেই বেলাল চৌধুরী আমার কাছে এক অনিঃশেষ রহস্য। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে কি আর কাউকে এমন কিংবদন্তি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে? ছেলেবেলায় ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ দেখতে এসে মাঠে ঢোকার আগেই ছোট সাইজের একটা বই কিনে ফেলি ‘কথা’ নামের ছোট্ট কিন্তু দীর্ঘ দোকানটি থেকে, অমিতাভ দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কবিতার পুরুষ’। সেখানে কেবল জীবিত ও পুরুষ কবিদের কবিতাই সংকলিত হয়েছিল। সংকলনটি হারিয়ে গেছে, স্মৃতিটুকু আছে। ও সংকলন থেকেই আমার আমার অন্তরে গভীরভাবে জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন দুজন কবি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর বেলাল চৌধুরী। মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতাটিও ভালো লেগেছিল (প্রথম পঙক্তি মনে পড়ছে : যা ভাবো তা নয়, নদী ঢেউ ঝিলিমিলি নয়’)। শক্তির কবিতাটি ছিল, ‘যখন দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে’ আর বেলাল চৌধুরীর কবিতাটি শরীর নিয়ে। নারীর শরীর। বৈষ্ণব পদাবলি কিছু পড়েছি— ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর’, কিন্তু শরীর নিয়ে বেলাল চৌধুরীর সেই কবিতার মতো কোনো সমকালীন কবিতা তখনও পড়া হয়নি আমার। সেই কুণ্ঠাহীন উচ্চারণ আজও মনে পড়ে। পরে যখন মুখোমুখি হয়েছি, মনে হয়েছে, সে সাহস তাঁকে মানায়। মনে পড়ছে, বেলাল চৌধুরী সম্পর্কে অদ্ভুত সব গল্প শোনা যেত, যা রূপকথাকে হার মানায়। তিনি নাকি আন্দামানে কুমিরের ব্যবসা করেন। কবির সঙ্গে কুমিরের ব্যবসা তেমন যায় না বলে বিস্মিত হতাম, তা নয়, ভয়াল কুমির নিয়ে যে কারবার করে তাঁর সাহসের সীমান্তহীনতাই বিস্ময়ব্যঞ্জক হয়ে উঠত। আর শক্তি-সুনীলের সঙ্গে কত রকম কাণ্ড-কীর্তি! এমন মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায় না।
তখন কাকরাইল মোড়টায় একটা পেট্রল পাম্প ছিল, তার পাশ দিয়ে একটা গলি ধরে বেলাল চৌধুরীর বাসা। সেখানে দেশি-বিদেশি নানা মানুষের জমায়েত। যখন ছাত্র ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের, অনেকবার গিয়েছি সেখানটায়। গল্প করবার বিষয় হতো বিচিত্র, ভঙ্গি অননুকরণীয়। দেশি-বিদেশি কবিদের চেতনা-জগতের খোঁজ-খবর যেমন মিলতো, খাসালতের চিত্রও কিছু উঠে আসতো। এমন মানুষ যখন নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে অবলম্বন করে কিছু লেখেন, তা সঙ্গত কারণেই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে নেয়। না, কোনো তথ্য-তত্ত্ব-যুক্তি বা পাণ্ডিত্য ফলানোর কোনো আয়োজন নেই এখানে, নিজেকে প্রায় নিষ্ক্রান্ত করে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা বা আবহের ভেতর দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। কখনো শ্রদ্ধা-তর্পণ (‘একজন মীজানুর রহমান’ বা, ‘আমাদের গৌরদা, আমার গৌরদা’ বা, ‘রামমোহন ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’), কখনো মূল্যায়নের স্পৃহা (‘পাভেল রহমান : স্বর্ণশিখরস্পর্শী প্রতিভা’ বা, ‘‘সর্বাঙ্গ সম্পন্ন চতুরঙ্গ’), কখনো সমকালীন কোনো প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ (‘বইমেলা নিয়ে যৎসামান্য’ বা ‘নতুন ভাষার সামনে’), কখনো ব্যক্তি-উত্তীর্ণ স্মৃতিকাতরতা (জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’), কখনো মর্মকামড়ানো দার্শনিকতা (মুহূর্তভাষ্য)— দেশি-বিদেশি নানা বিষয় ও প্রসঙ্গ-চূর্ণ ছড়িয়ে আছে দূর আকাশের নক্ষত্রের মতো। মোট প্রবন্ধের সংখ্যা ৩১টি। একেকটি লেখার আকার একেক রকম— স্বর, সুর আর স্বাদও স্বতন্ত্র। পূর্বাপর পাঠ করার পর মনের গভীর থেকে গভীরে যেন একটি বৃক্ষ তার অজস্র শাখামূল চারপাশে চাড়িয়ে দিতে থাকে। এ এক অন্য-রকম অনুভূতি— অভিনব শিহরন।

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান