কি ওটা ?
পোকা না পাখি, পাখি না পোকা !
ভাবতে না ভাবতেই আচানক দানবিক গতিতে কিছু একটা ভক করে পেটে বিঁধল ।
শিরদাঁড়া ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেল ধাতব কিছু । চলন্ত সাইকেল থেকে
মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ল জুয়েল । সাইকেলের নিচ থেকে একটা পা বের করে হাঁটু
গেড়ে বসল ।
রক্তের সরু একটা প্রবাহ পেট থেকে নিচে গড়াতে থাকে । ধবধবে সাদা লুঙ্গিতে রক্ত লাগতে দেখে উদ্বেগ হয় তার ।
ওহ্ রে, নয়া লুঙ্গিখান নষ্ট হয়ে গেইল ।
অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করতে করতে গলগলিয়ে ফিনকি দিয়ে প্রবাহমান রক্তের স্রোত
হাত দিয়ে আটকাতে চায় । লুঙ্গিটা নতুন । তারচেয়ে বড়কথা হল ওটা শ্বশুর বাড়ি
থেকে উপহার পাওয়া ।
তাতে সুফিয়ার ছোঁয়া রয়েছে । কিশোনগঞ্জ বাজার থেকে তার চাচা শ্বশুর লুঙ্গিটা কিনে দেন ।
সুফিয়া তা রগড়ে রগড়ে ধুয়ে ভাতের মাড় দিয়ে রোদে মেলে দেয় । গ্রামীণ চেকের সাদা লুঙ্গিখানা এখনো ধবধবে খসখসে ।
এবার তার চোখ পড়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে থাকা চটের ব্যাগটার ওপর । হ্যাপির জন্য প্লাস্টিকের বতলে নানু বাড়ি থেক দেয়া দুধ পড়ে যাচ্ছে ।
নাগর নদীর পিপাসিত বালুয়াড়ি চো চো শব্দে শুষে নিচ্ছে চুইয়ে পড়া দুধ ।
জুয়েলের মাঘায় ঝিম ধরে । আশৈশবের চেনা নাগর নদী, গম খেতে, অতি যত্নের সাইকেলখানা চোখে ঝাপসা দেখায় ।
এখন আর ওসব কিছুই দেখছে না সে । তার চোখে জ্বলজ্বল করে ভেসে আসে সুফিয়ার
মুখচ্ছবি । সরু চিবুক, চিকন ঠোঁট, সলাজ চোখ আর তার কয়লাকালো চুলের খোপা ।
প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটুকু থেকে স্থিরচিত্র পিছনের দিকে মোড় নেয় । রিমোট
চেপে যেন কেউ পিছিয়ে দেখতে চায় চলচ্চিত্রের মিস করা কোন সিন ।
ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্তঘেষাঁ গ্রাম জগদল । জগদল থেকে
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলি স্পষ্ট দেখা যায় । ঐ তো নাগর নদী । নদী পার হয়ে
বাংলাদেশিদের ফসলের মাঠ । তারপরেই বিএসএফদের চা বাগান । নো ম্যানস ল্যান্ড
। কাঁটার বেড়া ডিঙোলেই ইন্ডিয়া । বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের চাক্ষুষ্মান এ
গ্রামগুলোর মধ্যে কোন ফারাক নেই । শুধু ঐ নির্দয় ধারালো কাঁটাতারের
বেড়াটুকু ছাড়া ।
সাযুজ্যে, প্রাকৃতিক পরিবেশে, চলনে-বলনে কোন তফাত চোখে পড়ে না তেমন ।
জগদল গ্রামের ছেলে জুয়েল । পড়ালেখা ঠেলেঠুলে ফাইভ পর্যন্ত । গাঁ'য়ের বাজারে তার একটা ছোট্ট ঘুন্টিঘর ।
চা,পান, বিড়ি, শ্যাম্পু আর ফ্রিজে কোমল পানীয়, আইসক্রিম । এই ঘুন্টি দোকন
থেকে যা আয় হয় তাতেই বেশ কেটে যায় । তাছাড়া ধানিজমিও আছে বিঘা পাঁচেক । তা
থেকে বছরের খাওয়ার চালটা অন্তত জুটে যায় ।
তার মাতৃভূমি বাংলাদেশে হলেও শ্বশুর বাড়ি ইন্ডিয়ায় । গ্রামের নাম বিতনী । খুব নাটকীয় ভাবেই তাদের বিয়ে হয় । আর প্রথম সাক্ষাতটাও ছিল অন্যরকম, আচানক ।
প্রতি পহেলা বৈশাখে ভারত-বাংলাদেশ মিলন মেলা বসে । সীমান্তের
কাঁটাতারে এপার-ওপার বাংলার আত্নীয় স্বজনরা দেখা করে । কথা বলে ।
কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ছুড়াছুঁড়ি করে কাপড়, খাবার, চিঠি আদান-প্রদান করে ।
পাঁচ বছর আগে এমন এক মিলন মেলায় জুয়েল দোকান দেয় খেতের আইলে । চৈত্রের
দাবদাহে আগত মানুষেরা পানির জন্য ছটফট করে ।
ঘুন্টিঘর থেকে আনা কোক, মিনারেল, আইসক্রিম মুহূর্তে বিক্রি হয়ে যায় । তার
স্টকে যা ছিল সব বেচা শেষ । আনন্দে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে সে মানুষের
কারবার দেখে ।
নিকট আত্নীয়, রক্তের আত্নীয়, আত্নার আত্নীয়রা মিলন মেলার সময়টুকু অপলক নয়নে চেয়ে থাকে ভাব বিনিময় করে ।
সারা বছর এদিনের জন্য তাদের অপেক্ষার অন্ত থাকে না ।
অনেকদিন পর চোখাচোখি হতেই কান্নাকাটির দমক জাগে । মাঝেমাঝে হাহাকার করে ওঠে কেউ কেউ ।
ছাতা মাথায় সে ঘুরে ঘুরে দেখে ।
আর অবাক হয়ে ।
প্রতিবছরের এই একই দৃশ্য তার কাছে নতুনতর লাগে ।
তার চোখ পড়ে থুত্থুরে বুড়ি ও তার পাশে বসে থাকা এক কিশোরীর ওপর ।
আকুলিবিকুলি করে ওঠে তার মন ।
দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধান চারার মৃদল দোল লাগে তার হৃদয়পটে ।
লাভ এ্যট ফার্স্ট সাইট !
তা কি বনেদীপনা দেখে হয় ?
তার মন উতলা হয়ে ওঠে । তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়
আমের মুকুল আর বাতাবিলেবুর ফুলের সুবাসে একাকার হয়ে যে মোহন সুবাস সৃষ্টি করে তার গন্ধ পায় ।
কিন্তু বুড়ির আর কিশোরীর দৃষ্টি বড়ই উদাস । কারণ তার বাংলাদেশি আত্নীয় এখনো যে এলো না ।
ও বুড়ি মা, এমন করে কি দেখছেন তে ?
কাঁটাতারের ওপাশে বসে থাকা বুড়ি উঠে দাঁড়ায় ।
আর কহিস না বাও, নেকমরদের হাটে মোর ছুটু বহিনের মায়াডার বেহা হইচে ।
তিনডায় আসপার কথা, এলাও কোন পাত্তা নাই !
তারপর অনেককথা হয় বুড়ির সাথে । জমে ওঠে খেঁজুরে আলাপ ।
মেলা ভাঙে । সবাই ফিরে যায় ।
দিন গড়াতে থাকে । ঘুন্টিঘরে বসে বাংলা ছায়াছবির গান শোনে আর সুফিয়ার মুখ মনে করার চেষ্টা করে ।
দোকানে চা খেতে খেতে একদিন সুজনের কাছে মনের আকুতি জানায় । সুজন ডাকসাইটে
ছেলে । সীমান্তে চোরাকারবারির সাথে জড়িত । লাইনম্যান, বিজিবি, বিএসএফ
সবার সাথে ওর দহরম মহরম সম্পর্ক । সে ব্ল্যাকদার সুজন নামে সমধিক পরিচিত ।
এমনকি
পশ্চিম দিনাজপুরের অনেক জায়গা তার চেনাজানা আছে ।
সে আশ্বস্ত করে জুয়লকে ।
ঠিকানাটা তার কাছে দিয়ে খোঁজ খবর নিতে বলে । সুফিয়ার খালাতো বোনের
বাংলাদেশে বিয়ে হয়েছে । নাম আয়েশা । তাদের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায় না তাকে
। সপরিবারে ঢাকায় । সে এখন গার্মেন্টস শ্রমিক ।
দোকানের চায়ের কাপে স্টিলের চামচ দিয়ে চিনি মিশাতে মিশাতে পড়শি দেশের ষোড়শী তন্বীর কল্পনায় মোহিত হয় । চেহারাটা ছায়াময় হয়ে ওঠে ।
উদাস করা ভাবালুতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে দিনমান ।
এক ভাতঘুমের দুপুরে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে জুয়েলের ফোনে ।
: হ্যালো জুয়েল । মুই সুজন কহচুঁ ।
সুজনের ফোন পেয়ে আঁৎকে ওঠে । বেচাইন স্বরে জানতে চায়---
: হু, কি খবর হইল বাহে ?
: আরে মিয়া খবর এক্কেরে পাক্কা । সব ফিট কর রাখিচুঁ । তুই বেহার প্রস্তুতি লে । আর মোর ঘটকালির ফিসটা ভুলে যাইস না ফির ।
: কিন্তু হামার তো পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই হয়নি এলাও ।
: আরে মুই থাকিতে তোর ওগিলা লে চিন্তা না করবা লাগবে । রাখচুঁ । পরে কথা হবে ।
জুয়েলের বাড়িতে সবার প্রবল আপত্তি । এক রকম জোর করেই বিয়েটা করে সে । বিয়ের রাতে কাঁটাতারে লেগে তার উরুর মাংস কেটে যায় ।
দূর্বাঘাস মুখে চিবিয়ে ক্ষতস্থানের রক্তপাত থামায় ।
সুজন মাগনা কোন কাজ করে না । তাকে দশহাজার টাকা সম্মানী দেয়া হয় ।
বুকভরা আবেগ নিয়ে তারা ঘর বাঁধে । কোল আলোকিত করে আসে ফুটফুটে একটা মেয়ে । মেয়ের নাম রাখে হ্যাপি ।
মুখে এক চিলতে স্বর্গীয় হাসি লেগে থাকে তার ।
পাসপোর্ট এখন ঠাকুরগাঁওয়ে করা যায় শুনে
পাসপোর্ট করে ফেলে ইতোমধ্যে ।
শ্বশুরঘর থেকে দুঃসংবাদ আসে । সেই বুড়ি আর বেঁচে নেই ।
দাফনের কাজে তাদের যাওয়া লাগবে । তখন ভিসা লাগানোর ফুরসত কই ।
সুজন ব্ল্যাকদার মারফত তারা সীমান্ত পাড়ি দেয়। ঐ রাতেই ফিরে আসে জুয়েল । মা মেয়ে থেকে যায় শ্বশুরবাড়ি ।
গ্রামময় একটা দুর্বোধ্য অস্থিরতা আর ভয়ের সৃষ্টি হয় ।
দোকানের টিভিতে চীন, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে শত শত মানুষের লাশ দেখে বুক
কাঁপে তার ।
করোনা করোনা ! ওলা বিবি ! আকাল আসছে বাহে আকাল।
কেউ বলে আল্লার গজব !
দোকানে আড্ডাবাজ মানুষের কথা শুনে পেরেশান হয়ে যায় সে ।
হুলস্থুল কান্ডে ঘটে যায় একদিন । গ্রামের লোকজন খালি রং চা খেতে চায় । তাও
আবার গোলমরিচ আর কালোজিরা দিয়ে । কিন্তু রং চায়ে আদা ছাড়া সে কিছুই দেয় না
।
গোলমরিচ রাখবো নি, কালোজিরাও নাই !
কিয়ের দোকান করিস তুই রে । লোকজন
অযথা ধমকাধমকি করে তাকে ।
কাল সে গিয়েছিল শ্বশুর বাড়ি থেকে সুফিয়া আর হ্যাপিকে আনতে ।
সুজনই সব ব্যবস্থা করে দেয় । আট দশজন মেয়ের একটা দল নিরাপদে পার করায় সুজন ।
এরমধ্যে বিএসএফের টহলরত একটা গাড়ি আসে । সুজন আর জুয়েলের আসতে দেরি হয়।
শেষমেষ কাঁটাতার পার হয় দুজন দুমুখে যাত্রা করে ।
জংলা মত একটা জায়গায় সে লুকানো সাইকেল নিয়ে রওনা দেয় ।
এমন সময় ঘটে ঘটনাটা ।
আকাশ কাঁপিয়ে বাজখাঁই টাস সসস শব্দে
আরেকটা বুলেট এসে মাথা ছিন্নভিন্ন করে দেয় ।
টহলরত বিএসএফ সিপাহী পৈশাচিক আনন্দে গোঁফে তা দেয় ।
তাকে কে বুঝাবে জুয়েল কোন চোরাচালানের সাথে জড়িত নয়, সে ব্ল্যাকদার নয় ।
শুধু মাত্র সুফিয়ার ভালবাসাটুকুই সে চুরে করেছে মাত্র । সে কারো সাতপাঁচেও নেই ।
মহামারি রোগ যেন তার ভালবাসার মানুষ কলিজার টুকরা মেয়েটাকে ছুঁতে না পারে তার কসুর করেছে শুধু ।
পাষাণ বিএসএফ সদস্যরা যদি বুঝতো ---একজন স্বামীর বা একজন বাবার হৃদয়ের আকুতি !