হাজী হাশেম আলি হাসেন কম।
কথাও কম বলেন।কেউ কিছু বললে বা কিছু জিজ্ঞাসা করলে,তিনি তাঁর বড়ো বড়ো চোখ দুটোকে আরো বড়ো করে তাকিয়ে থাকেন।কিছু বলেননা।
হাজী হাশেম আলি জন্ম সূত্রেই এরকম।তাঁর বাবা,মা,গল্প করেছেন-শিশুকালে তিনি একেবারেই কাঁদতেননা।খিদা লাগলেও না।শিশুরা যে বয়সে হাত পা নেড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলে,হাসে,খেলে,সে বয়সেও হাজী হাশেম আলি সে সব কিছুই করতেননা!
শান্ত শিষ্ট লক্ষি ছেলে বলে বাবা মা আরো বেশি আদর করতেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চেহারায়,স্বভাবে গাম্ভীর্যতা আরো প্রকট হয়ে ফুটে উঠলো।বাবা মা বলতেন,ভেতর জ্ঞানী ছেলে।
সেই ভেতর জ্ঞানী ছেলে হয়ে হাজী হাশেম আলি সারাটা জীবন কাটিয়ে আজ বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছেন।আজো তিনি সেই ভেতর জ্ঞানীই আছেন।
ভেতর জ্ঞানী বলেই তিনি সব কিছু বুঝেও কখনো কিছু বলেননা।সবাই ভাবে তিনি কিছু বুঝতে পারেননা।তাঁর বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি।এ বয়সে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কথা।দৃশ্যত এরকম মনে হলেও হাজী হাশেম আলির ভেতরের হুস জ্ঞান সব স্বাভাবিকই আছে।বয়স জনিত রোগ,ব্যায়ারাম নিয়েও তিনি বেশ আছেন।
তাঁর স্ত্রী বিগত হয়েছেন অনেকগুলো বছর হলো।তাঁর পাঁচ ছেলে তিন মেয়ে।সবাই নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত।তাদের ছেলে মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে।সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে আছে।
হাজী হাশেম আলির খুব ইচ্ছা করে নাতি,নাতিœদের দেখতে।তাঁর ইচ্ছা ছুটি ছাটায় হলেও তারা এসে তাঁর কাছে থাকুক।তাঁর সঙ্গে দু একটা দিন থেকে যাক।
তারা আসেনা।তাদের সময়ের বড়ো অভাব।
হাজী হাশেম আলি বুঝতে পারেন,তাঁর প্রতি ওদের কোন টানই নেই।টান না থাকারই কথা।তিনি জানেন একেকটা প্রজন্ম একেক ধরণের মন মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে।আগের প্রজন্ম দাদা,দাদী,নানা,নানী,এঁদের জন্য আলাদা একটা মায়া,মহব্বত,শ্রদ্ধা আর টান অনুভব করতো।এঁদের সংগে ঘনিষ্ঠতা ছিলো অতুলনীয়।
সময়ের বিবর্তনে সকল সম্পর্কের মধ্যেই ভীষণ হাল্কা একটা ভাব এসে গেছে।
হাজী হাশেম আলি নিজের ছেলে মেয়েদের মধ্যে সম্পর্কের অবস্থা-খুব সূক্ষ ভাবে লক্ষ্য করে,বিভিন্ন দিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখেছেন।
সম্পর্কের টানা পোড়ন কখন,কোথা দিয়ে আসে,বুঝা না গেলেও আসে।এবং তা যে কতোটা ভয়ংকর ভাবে আসে হাজী হাশেম আলির নিজের ছেলে মেয়েরাই এর প্রমাণ।
তাঁর ছেলে মেয়েদের মধ্যে আশ্চর্য সুন্দর একটা সম্পর্ক তাদের ছোট কাল থেকেই দেখে এসেছেন।বিশেষ করে তাঁর ছেলেদের মধ্যে।তারা শুধু ভাই ভাই না,বন্ধুর মতো ছিলো।তাদের মধ্যে মতের কোন অমিল,
মায়া মহব্বতের অভাব কোনদিন লক্ষ্য করেননি হাজী হাশেম আলি।
ছেলে মেয়েরা-একে অন্যে অন্ত প্রাঁণ ছিলো।
তারপর একে একে মেয়েদের যখন বিয়ে হয়ে গেলো,ছেলেরা যখন বিয়ে করে বউ ঘরে আনলো-পরিবর্তনের শুরুটা তখনই হলো।
ছোট খাটো ব্যাপারে মতের অমিল,
ঝগড়াঝাটি হতে লাগলো।
আগে ভাইদের মধ্যে যে এতো স্নেহ মমতা ছিলো,মায়ার একটা বন্ধন ছিলো-বিয়ের পর সেটা দ্রুতই হারিয়ে যেতে লাগলো।
হাজী হাশেম আলি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করলেন,কি ভাবে তার ছেলে গুলো অতি দ্রুত বদলে যেতে লাগলো।তিনি চেষ্টা করেছেন তাদের বুঝিয়ে-আগের মতো করে দিতে।
পারেননি।
ছেলেদের মাথায় তখন আরো অতিরীক্ত মগজ যুক্ত হয়েছে।বুদ্ধিতে আরো শাখা-প্রশাখা গজিয়েছে।চিন্তা ধারায় যুক্ত হয়েছে শকুনের প্রখরতা।কণ্ঠস্বর দখল করেছে শিয়ালের তীক্ষ্নতা।
ভেতর জ্ঞানী হাজী হাশেম আলি পারেননি ছেলে মেয়েদের মধ্যকার সম্পর্ক অটুট রাখতে।
ছেলে গুলো একে একে হোমলেস হয়ে আলাদা সংসার পেতেছে।কেউ কারো মুখ দেখতে চায়না।দেখেনা।
এরকম করে তারা কি সুখে আছে?
হাজী হাশেম আলির সন্দেহ হয়।
তিনি অনুমান করতে পারেন-তাঁর ছেলে গুলো সংসার জীবনে সুখি নয়।
যদিও তারা কেউ সেভাবে মুখ ফুটে কিছু বলেনা,তিনি তাদের হাব ভাব দেখেই সব বুঝতে পারেন।
বিয়ের আগে ছেলে গুলোর মধ্যে একতা ছিলো,একে অন্যের দুঃখ,সুখ বুঝতো।একে অন্যকে সহযোগিতা করতো।এখন তারা একজন আরেকজনের বিপক্ষে কথা বলে।
বাবাকে দেখার অজুহাতে তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আসে।এক সঙ্গে কখনো আসেনা।
হাজী হাশেম আলি বিস্মিত না হলেও দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শোনেন,তাঁর এক ছেলে আরেক ছেলে সম্বন্ধে কি রকম আজে বাজে কথা বলে।অবলীলায় একজনের নামে আরেক জন বদনাম করে যায়।
তিনি বরাবরের মতো কিছু বললেন না।বললেও তারা শোনবেনা।তারা এসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অভাব অনটনের কথাও বলে।
কেনো বলে তাও তিনি বুঝতে পারেন।
হাজী হাশেম আলির লন্ডনে তেমন সম্পদ না থাকলেও দেশে প্রচুর সম্পদ আছে।প্রচুর টাকার সম্পদ।তার ছেলে মেয়েরা এ সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা করে,যার যার অংশ বেঁচে দিয়ে টাকা এখানে নিয়ে আসতে চায়।অনেক দিন ধরেই তারা এই পায়তারা করে আসছে।
হাজী হাশেম আলি বুঝেও না বুঝার ভাণ করে আছেন।ভেতর জ্ঞানী বলে কথা!
তিনি জানেন,যতোদিন পর্যন্ত ঐ সম্পদ নিজের নামে রাখবেন,ততোদিন পর্যন্ত তাঁর ছেলে মেয়েরা অনিচ্ছা সত্বেও তাঁর কাছে আসবে।তিনি তাদের দেখতে পাবেন।ছেলে মেয়েরা না চাইলেও তিনি তাদের কাছে চান।প্রাঁণ ভরে,দু চোখ ভরে তাদের দেখতে চান।
তাই তাদের অভাব অনটনের কথা জেনেও তিনি চুপ করে থাকেন।
হাজী হাশেম আলি জানেন তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেননা।আর তখনতো সব সম্পত্তি ছেলে মেয়েরাই পাবে।কিছু দিন অপেক্ষায় তেমন কষ্ট হবেনা।
হাজী হাশেম আলি শুধু ছেলে মেয়েদের কাছে পাবার জন্যই এ চালাকিটা করে যাচ্ছেন।
ভেতর জ্ঞানী বলে কথা!