বিত্তহীন বৃত্তে
তরুন হাঁটছে। হাঁটছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। এক লাইব্রেরি থেকে আরেক লাইব্রেরির দিকে। একটি গ্রন্থের সন্ধানে। বিত্তহীন বৃত্তে। গল্প গ্রন্থ। একটি লাইব্রেরিতে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে আরেকটিতে। অথবা সেখানেও ব্যর্থ হয়ে ফুটপাতের কোনো পুরোনো বইয়ের মেলায়। হন্যে হয়ে খুঁজছে গ্রন্থটি। ভীষণ ক্লান্তিতে আক্রান্ত ও। সাথে বিপুল বিষণ্নতার ইঙ্গিত গোটা অবয়ব জুড়ে। ফুটপাতের পাশেই একটি রেস্তোরায় বসে পড়লো। এক কাপ চা খেয়ে আবারও খুঁজতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত ফুটপাতেরই একটি নামহীন জীর্ণ দোকানে পেয়ে গেল গ্রন্থটি। অতঃপর বইটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করবে, এমন মুহূর্তেই স্বপ্নটি ভেঙ্গে গেল। প্রবল দীর্ঘশ্বাসের সাথে ‘উহ’ উচ্চারণ করলো।
স্বপ্ন যদিও রঙ্গিন তবুও স্বপ্ন তো স্বপ্নই। বাস্তবতার প্রখর রৌদ্রালোকে যার রংটি একেবারে ম্রিয়মাণ। তবুও টাটকা স্বপ্নের পরশে তরুনের হৃদয় ডাকঘরে বার্তা আসলো-দীর্ঘদিনের লালিত আকাক্সক্ষাটির অকাল মৃত্যু ঘটে নি। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলো আকাক্সক্ষাটি হয়ত পূরণও হয়ে যেতে পারে। হয়ত যে কোনোভাবেই ও পেয়ে যেতে পারে ওর ঈপ্সিত সেই দুর্লভ বস্তুটিকে।
আজকের এ স্বপ্নটি বুঝি সে ইঙ্গিতই দিয়ে গেল ওকে। সীমাহীনভাবে উদ্দীপিত তরুন। স্বপ্নটি ভেঙ্গে যাবার পরেও বেশ কিছু সময় ধরে শুয়ে রইলো বিছানায়। গাঢ় বেগুনী রঙের পাতলা কাঁথাটি সরে গিয়েছিল। কাঁথাটিকে পুনরায় গায়ের সাথে জড়িয়ে নিলো। চিন্তার স্রোতধারকে প্রবাহিত করলো বিভিন্ন কোণে। তৃপ্তি পেতে চাইলো স্বপ্নটিকে নানাভাবে রোমন্থন করে। তৃপ্তি পেলও হয়তোবা শুধু এই ভেবে যে আজকে হয়তো গ্রন্থটি পেয়ে যাবে ও। গ্রন্থটি না পাবার ব্যথা ওকে প্রতি মুহূর্তেই যেন এক অভাবনীয় যন্ত্রণার অন্তিম সীমায় পৌঁছে দিচ্ছিলো বার বার করে। অথচ এ যন্ত্রণাকে ধারণ করবার আত্মিক ক্ষমতাও ছিল না ওর। উঠে দাঁড়ালো তরুন বিছানা থেকে। বুঝতে পারলো প্রথম ক্লাসটা মিস হতে পারে। তবুও দ্রুত প্রস্তুত হলো। রুম থেকে বের হবে এমন সময় টেবিলের দিকে তাকালো। দৃষ্টি পড়লো সৌমিকের হাতে লেখা ছোট্ট চিঠিটির দিকে। ‘অনেক রাত জেগে পড়েছিস তাই ডাকলাম না, উঠে খেয়ে নিস, ক্যাম্পাসে দেখা হচ্ছে।’ চিঠিতে চোখ বুলিয়ে যাত্রা করলো ক্যাম্পাসের দিকে।
সৌমিকের সাথে তরুনের পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পূর্ব থেকেই। সময়টি ২০১৪ এর মার্চের। ভর্তির জন্য প্রতিটি বিভাগে ছিল শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। প্রতিদিন এই ভীড়ের দৃশ্যটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতো দুজনই। কতজন ভর্তি হলো আর কতটি সিট ফাঁকা রইলো এই হিসেব কষতো ওরা। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন না থাকায় দুজনই ছুটেছিল দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। দশের অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল ভর্তির জন্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে- এটি ছিল ওদের অকৃত্রিম স্বপ্ন। কোথাও সুযোগ না পেলেও প্রান্তনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষমাণ তালিকায় ছিল দুজনই। সঙ্গত কারণেই ভীষণভাবে সতর্ক ছিল-অন্তত নিজেদের ভুলে যেন কোনোভাবে ভর্তি বঞ্চিত না হয়। সুযোগের দোলাচলে প্রতিটি মুহূর্ত নিরন্তর অপেক্ষা করতো বিভাগের সামনেই। পরিচয়ও হয়েছিল সেখানেই। এক পর্যায়ে হৃদ্যতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সূত্র ধরেই ঘুরে বেড়াতো ওরা প্রান্তনগর শহরে। কখনো শুধুই বিকেল বেলা। কখনোবা বিকেল থেকে রাত অবধি। গল্প করতো নানা বিষয়ে। তবে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হবার বিষয়টি নিয়ে ভাবনা বিনিময় করতো দুজনই। আক্ষেপ ফুটে উঠতো ওদের কথোপকথনে। অবশেষে সুযোগ পেয়েছিল তীব্র যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষার পর। তরুণ ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে এবং সৌমিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। বিষয়ের ভিন্নতা রয়ে গেলেও সেটি সম্পর্কে কোনো ক্রিয়া করে নি। ভর্তির পরপরই একই মেসে সিট নিয়েছিল। দু’বছর ধরে আছে এক সাথেই। সম্পর্কের গভীরতাটি উর্ত্তীণ হয়েছে অনন্য এক মাত্রায়।
বিদ্যাব্রতী সড়কের পাশেই ছাত্রাবাসটি। জ্ঞান তরী। পুরোনো হাফ বিল্ডিং। দেয়ালগুলিও ধূসর। তবে কক্ষগুলির ভেতরের অংশ সুবিন্যস্ত। তরুনের রুমের টেবিল, বিছানা, আলনা সবই গোছালো। টেবিলটি ইতিহাসের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থরাজি দ্বারা পরিপূর্ণ। টেবিল দেখে সহজেই অনুমান করা যায়-গ্রন্থ পাঠের প্রতি ওর ঐকান্তিক আগ্রহের বিষয়টি। আর এ কারণেই হয়ত ওর ভাবনাগুলি দিনে দিনে পরিণত হয়ে উঠেছে। বিভাগের সকল অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করে শিক্ষকবৃন্দের আস্থাভাজন হয়েছে। প্রান্তনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক দলের নেতৃত্বের দায়িতও¡ পেয়েছে। সেই সুযোগে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকবৃন্দের কাছাকাছি আসবার সুযোগও হয়েছে। পরোক্ষভাবে একটি আদর্শ জীবনের প্রতিলিপির দীক্ষা পেয়ে যাচ্ছে তাদের কাছেই। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকে কীভাবে সেবা প্রদান করবে সেটিও মোটামুটি ঠিক করেছে নিজ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি শিক্ষকবৃন্দের পরামর্শে। আর সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করছে। সৃজনশীল গ্রন্থ পাঠের প্রতি সবসময়ই আগ্রহী করে তুলবার চেষ্টা করে তরুন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৌমিককে। কিন্তু পারে না। এ বিষয়ে কোনো আগ্রহই নেই ওর। সৌমিকসহ বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের এ ধরনের উদাসীনতা ভাবিয়ে তোলে ওকে। চাকরির প্রস্তুতি নিয়েই অবিরত ব্যস্ত থাকে সবাই। সৌমিকও একই কাজটি করে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে দল বেধে চাকরির প্রস্তুতি নেয়। সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি অবস্থান করে লাইব্রেরিতেই। পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ করবে, স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করবে- এটিই তার মূল ভাবনা। এর বাইরে কিছু ভাবতে পারে না ও। তবে তরুনের উন্নত চেতনাগুলিকে শ্রদ্ধা করবার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করে না। অনুপ্রেরণা দেয় তরুনের সৃজনশীল কাজগুলিকে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে চেষ্টা করে যে কোনো বিষয়ে সহযোগিতা করবার।
এগারোটার ক্লাসটি আজ হলো না। কলাভবনের সামনেই রয়েছে একটি বৃহৎ কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ। সেই বৃক্ষতলেই বর্ণ ও বৈশাখীসহ চলে এলো তরুন। কিছুক্ষণ পর ওদের সাথে যোগ দিলো সৌমিক ও বীথিকা। বন্ধু হিসেবে এরা চারজনই তরুনের বিশ্বস্ত। বর্ণ ও বৈশাখী নিজ বিভাগের হলেও সৌমিক ও বীথিকা বাংলা বিভাগের। সৌমিকের মাধ্যমেই বীথিকার সাথে পরিচয়। উচ্চতায় মাঝারি ও গড়নে শীর্ণ। গোলাকার শ্যাম বর্ণের মসৃণ মুখখানি লাবণ্যে সমৃদ্ধ। চুলগুলি ঘাড় অবধি প্রলম্বিত। আচরণে অত্যন্ত পরিশীলিত। কণ্ঠস্বরটি অসাধারণ। দারুণ আবৃত্তি করে। বাবা প্রান্তনগর শহরেরই একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেন। মা গৃহিনী। একমাত্র বড় ভাই পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশুনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বীথিকা। তরুনের সাথে বেশ কিছু বিষয়ে সামঞ্জস্য রয়েছে ওর। শুরুর দিকে তরুনের চারিত্রিক বিশিষ্টতায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল। চিরদিনের জন্য তরুনকে কাছে পাবার অভিপ্রায়ে বিভোর হয়েছিল। স্বপ্ন বুনেছিল হৃদয়ের অসীম আকাশে। কিন্তু ভালোলাগার বিষয়টি প্রকাশ করতে অনেক সময় নিয়েছিল। প্রত্যাশা করেছিল হয়ত তরুনই ওকে আহ্বান জানাবে। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও সেটি না হওয়ায় সংকোচের সকল সীমানা পেরিয়ে একদিন নিজেই প্রেম নিবেদন করেছিল। ভেবেছিল তরুনও সম্মতি জানাবে। কিন্তু তরুনের ভাবনাটি ইতিবাচক হয় নি। প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক বাবার সীমাবদ্ধতা ও ছোট ভাইবোনের কথা ভেবে সাহস পায় নি। ‘আমরা সবাই তোর পথ চেয়ে আছি, তুই ভালো কিছু করলেই না তোর ভাইবোনদের দ্বারা ভালো কিছু করা সম্ভব হবে।’ গৃহিনী মায়ের এমন আবেগীয় আবেদন কোনোভাবেই ওকে ভিন্ন কোনো চিন্তার দিকে ধাবিত করতে পারে নি। বীথিকার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলেছিল ‘বৃত্তের মাঝে নিজেকে আবৃত রেখে অনন্ত পৃথিবীকে ক্ষুদ্র করতে চাই না।’ তরুনের এমন উত্তরে নিজেকে নিজেরই কাছে অত্যন্ত ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল বীথিকার। ‘তবে বন্ধু হিসেবে তোমার সাহচর্য পাওয়া যে কোনো ছেলের জন্য অসীম প্রাপ্তির।’ মন্তব্যটি শুনবার পর তরুনের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ বেড়েছিল বীথিকার। তারপর থেকেই একজন প্রকৃত শুভাকাক্সক্ষী হিসেবেই তরুনের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কটি বজায় রেখে এসেছে। সবসময়ই চেষ্টা করেছে তরুনকে জ্ঞান চর্চার বিষয়ে সহায়তা করবার। তরুনও জ্ঞানচর্চাসহ যে কোনো বিষয় বিনিময় করে বীথিকাসহ ওদের সাথে। আলোচনার মধ্যবিন্দু হয়ে ওঠে। আজও গল্পে গল্পে প্রায় ঘণ্টা খানেক পেরিয়ে গেল। প্লাস্টিকের নীল বর্ণের মোটা ঘড়িটির দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো তরুন। গল্পের মাঝেই তরুন ওর অণে¦ষিত গ্রন্থটির কথা উপস্থাপন করলেই চারজনই গ্রন্থটি সংগ্রহের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো।
‘নারে এখনো পাই নি। তবে ভাবছি এখন আবু ইসহাক রোডে গিয়ে খুঁজবো। না পেলে পুরোনো বইয়ের দোকানেও যাবো। তা তোরা আয় না সন্ধ্যের দিকে।’ বললো তরুন। বলবার সময় ওর চোখে মুখে গ্রন্থটি না পাবার একটি ম্লান ভাব ফুটে উঠলো।
‘যেতে পারি, তবে শর্ত আছে। বই পেলে খাওয়াতে হবে।’ মিষ্টি কণ্ঠে হাসোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বললো বীথিকা। পূর্বে অনেকবারই ভাইয়ার মাধ্যমে তরুনকে বই সংগ্রহ করে দিয়েছিলো বীথিকা। বীথিকার বক্তব্যে জোরালো সমর্থন জানালো বাকীরা।
সন্ধ্যের দিকে ওদেরকে আসবার কথা বলে হাঁটতে থাকলো তরুন। উঁচু উঁচু লাল রঙের সুদৃশ্য ভবনগুলির মাঝ দিয়ে। মূল গেটে পৌঁছুবার উদ্দেশ্য। গেটে পৌঁছবার সামান্য পূর্বের রাস্তাটির দু’ধার দেবদারু বৃক্ষে সারিবদ্ধভাবে সাজানো। সেই বৃক্ষের পাশ দিয়ে হাঁটছে তরুন। একাই। উচ্চতায় লম্বা। দেহের গঠনটি পুষ্ট। মুখের রংটি শ্যামলা। মাঝারি আকারের চুল। বোধকরি মাঝারি চুলই ওর পছন্দের। কাঁধে ঝোলানো ভার্সিটি ব্যাগটি ধূসর নীল রঙের। গায়ে কলারযুক্ত হালকা গোলাপী রঙের টি শার্ট। টি শার্টের উপরের বোতামটি উন্মুক্ত। হেঁটে হেঁটেই মূল গেট অবধি চলে এলো ও। গেটে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলো কিছু সময়। লাল রঙের চকচকে একটি অটো রিকশায় উঠে পড়লো। ভার্সিটি ব্যাগটি কোলের উপরই রাখলো। ডান পাটি বাম পায়ের উপর রেখে আরাম করে বসলো। স্বল্প সময়েই স্টার্ট হলো অটোটি। বিশ্ববিদ্যালয় সীমানার পাশ দিয়ে ধীরলয়ে চলছে। সারি সারি কৃষ্ণচূড়া, জারুল ও করবী ফুলের বৃক্ষ মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের গা ঘেঁষে। ফুলে ফুলে সৌরভের কাব্য নির্মাণ করেছে বৃক্ষগুলি। তরুনের দৃষ্টি অনায়াসেই প্রক্ষিপ্ত হলো সেদিকে। প্রকৃতির এমন নিটোল সৌন্দর্যে মুগ্ধতায় ছুঁয়ে গেল ও।
কিছুক্ষণের মধ্যে অটোরিকসাটি চলে এলো ইসহাক রোডে, লাইব্রেরিগুলির সামনে। প্রান্তনগর শহরের লাইব্রেরিগুলি ঢাকার বাংলাবাজারের মতো পাশাপাশি নয়। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো। একটি লাইব্রেরি থেকে আরেকটিতে যেতে কষ্ট হয়। তবুও হাঁটছে তরুন। বেশ কিছু লাইব্রেরিতে প্রবেশই করলো না, দূর থেকেই সিলেবাসের বইয়ের সমাহার দেখতে পেয়ে। ভীষণভাবে ক্ষুব্ধও হলো। সবাই যদি সিলেবাসের পাঠেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে তবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম! ভাবতে থাকলো। ভাবনার এক পর্যায়ে একটি প্রসিদ্ধ বইয়ের দোকানের সামনে চলে এলো। সিলেবাসের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থে পরিপূর্ণ দোকানটি। দুপুর বাড়বার সাথে সাথে শহরের ভীড়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফুটপাতের অবৈধ দোকানগুলির কারণে ঠিকমতো হাঁটাও যাচ্ছিলো না। সেই ভীড়ের প্রভাব পড়েছে বইয়ের দোকানগুলিতে। এ কারণেই বেশ কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হলো ওকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থের দিকে তাকাবার চেষ্টা করলো। এবার এগিয়ে এলো। চটপটে, চিকন ও মধ্যবয়সী একজন কর্মচারীকে গ্রন্থটির কথা জিজ্ঞেস করলো। ‘দুঃখিত’ বলে অন্য ক্রেতার সাথে কথা বলা শুরু করলেন কর্মচারী। উপায় না দেখে সামনের দিকে এগুতে থাকলো তরুন। সামান্য দূরত্বের আর একটি দোকানে প্রবেশ করলো। ভীড় কম থাকায় সরাসরি গ্রন্থটির কথা জিজ্ঞেস করলো মালিককে। চেয়ারে বসেই ছিলেন মালিক। হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে। ফর্সা মুখম-লজুড়ে সৌজন্যতার ছিটে ফোঁটা লক্ষিত হলো না। বরং ক্রুদ্ধ একটি ভাব ফুটে উঠেছে-বোঝা গেল। উত্তর না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন তিনি। উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলো তরুন। ‘ওসব গল্প টল্প আমরা রাখি না।’ অবশেষে বললেন দোকান মালিক। গ্রন্থটি না পেয়ে যতটা না খারাপ বোধ হলো, তার থেকে তার ওই কথাটি যেন নির্মমভাবে জখম করলো তরুনকে। কিছু না বলেই দোকান থেকে চলো এলো। এ ধরনের মানুষ কেন যে বইয়ের দোকান পরিচালনার সুযোগ পায়! নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো তরুন।
সামনে বেশ কিছু বইয়ের দোকান থাকলেও আর প্রবেশ করলো না। সামনের দিকেই হাঁটতে থাকলো। অবলীলায় ‘বিত্তহীন বৃত্তে’ গ্রন্থটির কাহিনী কেমন হতে পারে ভাববার চেষ্টা করলো। সে জানতো না গ্রন্থটি কেমন হতে পারে, কতটাই বা মানসম্পন্ন। ক্ল্যাসিক গ্রন্থের পর্যায়ে পড়বে কিনা? এক বয়োজ্যেষ্ঠ বোদ্ধা পাঠকের কাছ থেকে গ্রন্থটি সম্পর্কে জেনে আগ্রহী হয়েছে। এই মুহূর্তে এ ধরনের গ্রন্থই খুঁজছে ও। প্রান্তনগর পাবলিক লাইব্রেরিতেই তার সাথে পরিচয়। বই পাঠের সুবাদে। গ্রন্থটি তার ব্যক্তিগত সংগ্রহেই ছিলো। কিন্তু হারিয়ে যাবার কারণে তরুনকে দিতে পারেন নি। আর না পারার জন্যে যে আক্ষেপ তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিল তরুন সেটি থেকেও অনুমান করতে পারছে- গ্রন্থটি কোন পর্যায়ের হতে পারে? বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে এসেছে তরুন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। ডান দিকে তাকালো। দুর্লভ একটি বইয়ের দোকান চোখে পড়লো ওর। দেখবার পরমুহূর্তেই আশ্চর্য হয়ে গেল। ‘গ্রন্থ প্রবাহ’। বুঝতে পারলো দোকানটি নতুন। এর পূর্বে কখনো দেখে নি ও। কিছুটা আশ্চর্যও হলো। ‘এই শহরে এমন বইয়ের দোকান, ভাবা যায়!’ বিস্ময়ের ছন্দোবদ্ধ ঢেউ দোলা দিয়ে গেল হৃদয়ে। একটা পেরিয়ে গেছে। প্রখর রৌদ্রালোকে ঘেমে গেছে ও। টি-শার্টের ভেতরের অংশটুকু ভিজে গেছে- অনুভব করলো। ভেতরে প্রবেশের পূর্বেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। বাইরে থেকেই গ্লাসের ভেতর থরে থরে সাজানো গ্রন্থগুলি দেখতে থাকলো। ঠিক ঢাকার নামকরা বইয়ের দোকানগুলির মতো। বেশ কিছু বিদেশী ধ্রুপদী গ্রন্থের অনুবাদ দেখে বিস্মিত হলো। ফুলের মতো চোখদুটি দিয়ে দেখতেই থাকলো। প্রায় মিনিট বিশেক বাইরে থেকেই গ্রন্থগুলি দেখলো। ‘এ ধরনের বইয়ের দোকানই তো প্রতিটি শহরে দরকার।’ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো ও। কাক্সিক্ষত জায়গাটি যে খুঁজে পেয়েছে ও সেটি ওর অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট হলো।
এবার ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রবেশ করেই বাকহীন হলো। একদম ফাঁকা। মনে হলো সমুদ্রের মাঝে একটি মুক্তো দানা হয়ে ও সমুদ্রের বিশালতাকে উপভোগ করছে। দোকানের সমস্ত গ্রন্থগুলি যেন নীল জলরাশি হয়ে ওকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেও ইচ্ছে মতো স্বচ্ছ জলরাশির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভেসে বেড়াচ্ছে। অবিলোল জলস্রাতে স্রাত হচ্ছে ওর প্রতিটি শিরা-উপশিরা। চকলেট কালারের বুক সেলফগুলি ওর চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে। সেলফের অধিকাংশ গ্রন্থই পেপারব্যাক মলাটের। লক্ষ করলো। পেপারব্যাক মলাটে তৈরী গ্রন্থের মূল্য তুলনামূলক কম হয়। পাঠকের ক্রয়সীমার আয়ত্তে থাকে। হয়ত এমন ভাবনা থেকেই দোকান মালিক এ ধরনের গ্রন্থ সংগ্রহ করেছেন। বিষয়টি স্বস্তি দিলো তরুনকে। ‘ঠিকই আছে, মানুষ তো পড়বে বইয়ের ভেতরের অংশ। শব্দ শৈলী ও বিষয়বস্তু যদি ঋদ্ধ হয় তবে বাইরের চাকচিক্য দিয়ে লাভটা কি।’ ক্লেশহীনভাবেই ভাবনাটি চলে এলো ওর চিত্তের গুহায়।
অনিমেষ দৃষ্টি নিয়ে দেখতে থাকলো তরুন। এক সেলফ থেকে আরেক সেলফে। সেলফের প্রতিটি গ্রন্থই ধ্রুপদী ও মানসম্পন্ন। এ ধরনের একটি গ্রন্থ কিনে পাঠ করা শুরু করলে অবশ্যই পাঠকের আর একটি গ্রন্থ পাঠের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে। সেই পাঠকের ভাবনাজুড়ে লেখক সম্পর্কে একটি উচ্চ মার্গীয় ধারণা ও শ্রদ্ধাবোধ আপনা আপনিই জেগে উঠবে। বিভ্রান্ত হবার কোনো সুযোগই সৃষ্টি হবে না। বিষয়টি সহজেই অনুমান করতে পারছে তরুন। এরই মাঝে দুটি অনুবাদের গ্রন্থও বাছাই করেছে। ‘অবশ্যই কিনতে হবে।’ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু ‘বিত্তহীন বৃত্তে’ গল্পগ্রন্থটি খুঁজে পেল না। সময় স্বল্পতার কারণে আর খুঁজবারও সুযোগ পেল না। ডান হাতে বাছাইকৃত গ্রন্থ দুটি নিয়ে দোকান মালিকের কাছে গেল। কালো, দীর্ঘাঙ্গ এবং মধ্যবয়সী মালিকের অবয়বজুড়ে রয়েছে মুগ্ধতাভরা আন্তরিকতা। দীর্ঘ সময় অবধি তিনি লক্ষ করছিলেন তরুনকে। বিষয়টি টের পেলেও বুঝতে দেয় নি তরুন। তবে ওই সময়ই তার আন্তরিক মুখাবহটি আবিস্কার করতে পেরেছিল। পরনে সবুজ রঙের পাঞ্জাবী ও নীল রঙের জিন্সের প্যান্ট। টেবিলে বসে পড়ছিলেন তিনি। কাছাকাছি আসবার সঙ্গে সঙ্গেই ওর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। তরুনও সুযোগ বুঝে দোকানটির নান্দনিক সৌন্দর্যের নেপথ্য কারণগুলি জানবার চেষ্টা করলো। দোকান মালিকও আগ্রহ নিয়ে বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করলেন। এরপর গ্রন্থের দাম পরিশোধ করে বিদায় নিলো তরুন। বিদায় নিলো তৃপ্ততামাখা অনুভূতিকে জয় করে। প্রানোচ্ছল ভাব নিয়ে মালিক আবারও আসবার আমন্ত্রণ জানালেন তরুনকে। দোকানের দরজা পেরুবে এমন মুহূর্তে আবারও দাঁড়ালো তরুন। একটু দূরত্বে থেকেই জিজ্ঞেস করলো -‘আচ্ছা ভাইয়া, ‘বিত্তহীন বৃত্তে’ গল্পগ্রন্থটি কি আপনার কাছে পাওয়া যাবে?’
‘আমার কাছে নেই। তবে আপনি পুরোনো বইয়ের দোকানে পেতে পারেন?’ বিনয়সূলভ অভিব্যক্তিটি জেগে উঠলো দোকান মালিকের কথায়।
ধন্যবাদ জানিয়ে মেসের দিকে হাঁটতে শুরু করলো তরুন। গ্রন্থ প্রবাহের পরিবেশ বিমোহিত করলো ওকে। এ ধরনের বইয়ের দোকানই তো কেবল জাতিকে ঋদ্ধ করবার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। নিশ্চিত উপলব্ধি করলো ও। দ্রুত গতিতে হাঁটছে। হাঁটবার মধ্যে দিয়েও ‘বৃত্তহীন বৃত্ত’ গ্রন্থটির কথা আবারও ভাবনায় এলো। গ্রন্থটি না পাবার যন্ত্রণা ওকে বিচলিত করতে থাকলো। প্রাইভেট শেষ করেই পুরোনো বইয়ের দোকানের দিকে যাত্রা করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলো। দুপুর তিনটেয় পড়ানো আছে। পড়ানোর অর্থ দিয়েই নিজ ব্যয় নির্বাহ করে ও। পরিবারের কথা ভেবেই বাড়ী থেকে একটি টাকাও নেয় না। পাশাপাশি প্রতি মাসেই গ্রন্থ ক্রয় করে ওই অর্থ দিয়েই। দুজনকে পড়ায়। একজন এস.এস.সি পরীক্ষার্থী। অন্যজন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। দুজনই ধনীর দুলাল। দ্বিতীয় শ্রেণির বাচ্চাটিকে সব বিষয়ই পড়ায়। অপরজনকে সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্ম ও কৃষি। এ প্লাস যাতে মিস না হয় এ লক্ষ্যেই এসব বিষয়ের শিক্ষক রেখেছেন অভিভাবক। মোট পাঁচজন শিক্ষক এসে বাসায় পড়ান এই শিক্ষার্থীকে।
শাহরিক কোলাহলের ব্যস্ততা অক্ষুণœ রয়েছে। ভীড়ের মাঝেও জোরে হাঁটছে ও। কাঁধের ব্যাগটি সামান্য সমস্যা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যস্ত সড়ক ছেড়ে নিরিবিলিতে আসলো। রাস্তা প্রায়ই ফাঁকা। হেলেদুলে হাঁটবার ইচ্ছে জাগলেও টিউশন থাকবার কারণে পারলো না। দ্রুতই ছাত্রাবাসে আসবার প্রচেষ্টাটি সার্থক হল্। সে রুমে বসেই ছিলো সৌমিক। দীর্ঘ কপাল, ভ্রু দুটিও কপালের মতোই দীর্ঘ। লম্বা লম্বা গোছানো চুল, বড় বড় চোখ। গায়ের রংটি ফর্সা। দীর্ঘাকৃতির এবং স্বাস্থ্যবান। গায়ে সাদা রংয়ের ছ্যান্ডো গেঞ্জি। দু’হাতের স্থুল পেশী দেখা যাচ্ছে। বেশ প্রফুল্ল মনে হচ্ছে ওকে। কারণটি অনুমান করতে পারছে না তরুন। প্রচন্ড- ক্ষুধার্ত থাকায় সরাসরি ডাইনিংয়ে প্রবেশ করলো। খাবারের মান ভালো নয়। মেসে সাধারণত যা হয় তাই। বিশ্ববিদ্যালয় হলের খাবারেরও একই অবস্থা। প্রায়ই খেতে যায় ওরা সেখানে। বিষয়টি নিয়ে প্রবল আক্ষেপ ওর। যে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে তাদের খাবারের এমন অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যদি এই অবস্থা চলতেই থাকে তবে কীভাবে সম্ভব শিক্ষার্থীদের দ্বারা উন্নত রাষ্ট্র গড়বার স্বপ্নটিকে সার্থক করা! বৃহদাকার টেবিলে খাবারের পাত্রগুলি সাজানোই ছিল। কিন্তু ওর খাবারের পাত্রটি খুঁজে না পেয়ে আশ্চর্য হলো। মিল অফ করবার কারণটি বুঝতে পারলো না। ও তো মিল অফ করে নি। বেশ কিছু সময় ভাববার পর নিশ্চিত হলো। সৌমিকও এখনও খায় নি। বুঝতে পেরে কিছু বললো না ওকে। বরং ড্রেস পড়ে বাইরে যাবার জন্যে তাড়া দিলো। এমন সময় নিজ টেবিলে পেপার দিয়ে আবৃত খাবারটির দিকে তাকালো সৌমিক। তরুনও তাকালো সেদিকে। আবৃত পেপারটি এক হাত দিয়ে সরে ফেললো সৌমিক। খাবারের পাত্রটি দেখেই আশ্চর্য হলো তরুন। আশ্চর্যের ভাবটি দেখে হেসে উঠলো সৌমিক। পোলাও ও মুরগীর মাংসের ঘ্রান শুকে আনন্দে উল্লসিত হলো তরুন। ‘মামা আসছিল কখন?’ বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো সৌমিককে। জিজ্ঞেস করবার সময় ওর গালের মাংসগুলি ফুলে উঠবার পাশাপাশি দাঁতগুলিতে বিকীর্ণিত হলো খুশির প্রভা।
‘সে কথা পরে হবে। আগে হাত ধুয়ে নে। শালা, কতক্ষণ ধরে তোর জন্য অপেক্ষা করছি জানিস।’
উত্তর না দিয়ে হাত ধুতে গেল তরুন। প্রায়ই প্রান্তনগর শহরে আসেন সৌমিকের মামা। অফিসের কাজে। কাজ শেষেই দেখতে আসেন সৌমিককে। খোঁজ নেন পড়াশুনার। তরুনকে পছন্দ করেন তিনি। ভাগ্নের সাথে তার বন্ধুত্ব অত্যন্ত স্বস্তি দেয় তাকে। পরম তৃপ্তি সহকারে খেল দুজনই। খাওয়া শেষে শুয়ে পড়লো। একই বিছানায়। অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে। নিয়ত তাই করে। ক্ষুধার কারণে কিছুক্ষণ আগের রুক্ষ ভাবটি কেটে গেছে। দুজনকেই প্রফুল্লতার পাশাপাশি চনমনে দেখাচ্ছে।
‘বইটি কি ইসহাক রোডে পেলি?’ পেলবতা মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সৌমিক।
‘পাই নি, তবে প্রাইভেট শেষে পুরোনো বইয়ের দোকানে যাবো। সবাইকে নিয়ে আসিস। ’নিচু স্বরে উত্তর দিলো তরুন।
‘বলি, এসব বইটই পড়ে লাভটা কি? মিছেমিছি সময় নষ্ট। এগুলো কি চাকরির পরীক্ষায় আসবে? বরং চাকরির জন্যে পড়াশুনা কর। কাজে লাগবে।’ অনর্গল বলে গেল সৌমিক।
‘শোন, বোকার মতো কথা বলবি না, বুঝলি।’ কিছুটা ক্ষুব্ধতা নিয়ে বিস্ফোরিত চোখে বললো তরুন।
‘এতে বোকামির কী আছে। ধর এই উপন্যাসটা। এর লেখক কিংবা মূল বিষয়বস্তু কী। পরীক্ষায় এর বাইরে কি কিছু আসবে?’
‘মানলাম। চাকরি পেলে অফিসার হবি সেটিও ঠিক আছে। কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’
‘বল, বলে ফেল না, তোর প্রশ্ন।’ চেঁচিয়ে উঠলো সৌমিক।
‘চেতনাগত উৎকর্ষ না ঘটলে কি সেই অফিসারের দ্বারা রাষ্ট্রিক উন্নয়ন সম্ভব হবে? তিনি তো শুধু নিজের কথাই চিন্তা করবেন। আত্মসিদ্ধির জন্যে যা ইচ্ছে তাই করবেন। পৃথিবী তো কুয়োর মতো ছোট হয়ে আসবে তার কাছে। পড়াশুনা করে দেখ, সমাজকে পাঠ করবার চেষ্টা কর। নির্মল হৃদয়ের অধিকারী হয়ে উঠতে পারবি। চেতনাগত দায়বদ্ধতা তৈরী হবে। দেশের সম্পদকে নিজের সম্পদ ভাবতে শিখবি। বিশ্বপরিবারের একজন সদস্য হিসেবে নিজেকে মনে করতে পারবি। কিন্তু গ্রন্থ পাঠ, সমাজকে পাঠ করা ব্যতীত কি সেটি সম্ভব? উত্তর দে। দে উত্তর।’ সৌমিকের মুখের উপর মুখ রেখে বললো তরুন।
‘ সে পরে দেখা যাবে, এখনই এতসব চিন্তা করে লাভ নেই বাবা।’
‘এখনই চিন্তা করতে হবে। অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে এখন থেকেই। আর তোকে কে বলছে চিন্তা করতে। তোর ভালো না লাগলে করবি না। আরেকজনের পেছনে লাগিস ক্যান?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, বাবা। সারেন্ডার করলাম। এখন থাম তো।’
না, থামবো কেন। আমার কথা শুনতে হবে। মনে রাখবি একটা কথা- জীবনের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পড়াশুনার কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞানভিত্তিক সমাজই গড়ে তুলতে পারে আদর্শ রাষ্ট্র। আর চাকরি। চাকরিও পেয়ে যাবো দেখে নিস।’
‘বুঝলাম, সক্রেটিস ভাই, বুঝলাম তো। তবে চাকরি পেয়ে আমাদের দিকেও একটু নজর দিয়েন।’ বলেই মুচকি হাসি দিলো সৌমিক।
‘আবার ফাজলামি। দাঁড়া দেখাচ্ছি।’ ক্ষেপে গিয়ে সৌমিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলো তরুন। বিষয়টি বুঝতে পারলো সৌমিক। এ রকম আগেও হয়েছে বহুবার। হাসতে হাসতেই রুম থেকে বের হয়ে এলো ও। দ্রুত পাশের রুমে প্রবেশ করলো। দরজাও লাগিয়ে দিলো। ‘ভাই, আমাদের একটা চাকরি দিয়েন, ভাই। কিছু লাগলে বলিয়েন।’ ভেতর থেকে সমস্বরে বলতে থাকলো সৌমিক ও মেসের বাকী শিক্ষার্থীরা।
‘চাকরি! দাঁড়া, চ্যান্সেলরকে বলে তোদের সব কটার ছাত্রত্ব বাতিলের ব্যবস্থা করছি।’
‘সক্রেটিস ভাই, আমাদের ওপর এমন নির্দয় হবেন না, একটু দয়া করুন।’ অনুনয়ের ভান করে আবারো বলতে থাকলো সবাই।
ওদের এমন মজা করবার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো তরুন। প্রায়ই এমন দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে ওরা। সাথে যোগ দেয় পাশের রুমের বন্ধুরাও। তরুনকে ক্ষ্যাপালেও ভালোবাসে ভীষণ। যে কোনো সমস্যা হলে ওর কাছ থেকেই পরামর্শ নেয়। তরুনও সবার সাথে হার্দিক সম্পর্ক বজায় রাখে। চেষ্টা করে ওদের চিন্তাগুলিকে প্রকৃত পথে ধাবিত করবার। মুচকি হাসির আভা নিয়েই রুমে চলে এলো ও। তাড়াহুড়ো করে তৈরী হয়ে মেস থেকে বের হলো। টিউশনের সময় ঘনিয়ে আসছে। প্রতিদিনই যায়। একই সময়ে। আজ একটু দেরী হচ্ছে। রিকশায় যাবে নাকি হেঁটে, ভাবতে থাকলো। অনেক ভাবনার পর রিকশাতেই উঠলো। দর কষাকষির সুযোগ হলো না। পাঁচ থেকে দশ মিনিট দেরী হলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। টানা চারজন শিক্ষক ধারাবাহিকভাবে পড়ান এস.এস.সি পরীক্ষার্থীটিকে। তরুনকে দিয়েই শুরু। ওর দশ মিনিট দেরী হলে বাকী শিক্ষকদের দশ মিনিট করে অপেক্ষা করতে হয়। পরোক্ষভাবে দায়টিও তার কাঁধেই এসে বর্তায়। বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেন না অভিভাবকও। সুতরাং সতর্ক থাকতে হয় ওকে।
ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে রিকশা। গতির এই মন্থরতা দেখে বিরক্ত হলো তরুন। দ্রুত চালানোর জন্যে বললো রিকশাওয়ালাকে। বাড়তে থাকলো রিকশার গতি। কিছুদূর গিয়ে আবারও মন্থর হলো গতি। আবারও তাগিদ দিলে বৃদ্ধি পেল। সামনের দিকে তাকিয়েই অনবরত জোরে চালানোর চেষ্টা করলো রিকশাওয়ালা। তাগিদ প্রদান করবার সময় তরুনের কথাগুলিতে ককর্শতার ভাবটি পরিস্কার হলো। এমন মনোভঙ্গি ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। প্রয়োজনের তাগিদেই এমনটি করতে হলো। আহা রে কেন যে এমন করে বললাম! আফসোসের অগ্নিশিখায় পুড়ে গেল ওর বিবেক। নির্ধারিত সময়েই বাসার সামনে পৌঁছে গেল রিকশাটি। ভাড়া দেবে এমন সময় আঁতকে উঠলো তরুন। রিকশাওয়ালার চেহারা দেখে সন্দেহ জাগলো- প্রকৃত রিকশাচালক কিনা? অল্প বয়সী, লম্বা, শীর্ণকায়। আগ্রহের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলবার পর নিশ্চিত হলো শিক্ষার্থী। ক্লান্ত দৃষ্টিতে শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে তরুনের দিকে। অসহায়ত্বের ছাপটি ফুটে উঠেছে তার চোখে মুখে। সাদা রঙের দাগযুক্ত টি- শার্ট ও নীল রঙের প্যান্ট পরিহিত। মাথায় একটি পুরোনো ক্যাপ। দু’কান ও কপাল বেয়ে অবিরাম ঘাম ঝরছে। তৈলাক্ত হয়ে গেছে পুরো মুখোম-লটি।
নাম রানা। রূপগঞ্জ হাই স্কুল থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। ফর্ম পূরণের অর্থ সংস্থানের জন্যে শহরে এসেছে। ভাড়া করা রিকশা চালাচ্ছে। সকালের ট্রেনে শহরে এসে রাতের ট্রেনেই গ্রামে যায়। অর্থ সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত রিকশা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওর স্কুলের কয়েকজনও একই কাজটি করছে। কথাগুলি হজম করতে পারলো না তরুন। কান দুটি পচে যাওয়ার অবস্থা হলো। রানাকে কিছু অর্থ প্রদানের চিন্তা করলো। কিন্তু কী ভেবে পরক্ষণই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো। এগিয়ে গেলো পাশের একটি স্টেশনারির দোকানে। রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রানা। পর্যাপ্ত কাগজ ও কলম কিনে এনে উপহার দিলো রানাকে। ‘মন দিয়ে পড়াশুনা করবা ভাইয়া। কখনোই ভেঙ্গে পড়বা না। আর রিকশা চালানোর বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে দেখবা। ঠিক আছে।’ বলেই আলতো করে জড়িয়ে ধরলো রানাকে। এরপর প্রবেশ করলো শিক্ষার্থীর বাসায়। মনোযোগ সহকারে পড়াতে পারছে না শিক্ষার্থীটিকে। বারবার রানার ক্লান্ত প্রতিচ্ছবিটি ভেসে উঠছে ওর মানসলোকে। পায়ে কাঁটা বিঁধবার মতো যন্ত্রণা অনুভব করছে। সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো টলমল করছে ওর চিন্তার নৌকোখানি। দুজন শিক্ষার্থীর মাঝে এত বৈষম্য! মেনে নিতে পারছে না ও। এমন হবে কেন? একই দেশে এমনটি কি হওয়া উচিত? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো তরুন।
দ্রুততার সাথে অপর টিউশনটিও সম্পন্ন করে সোজা পুরোনো বইয়ের দোকানের দিকে হাঁটতে থাকলো । যেভাবেই হোক এবার গ্রন্থটি খুঁজে বের করতে হবে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হবার উপক্রম। প্রকৃতিও বেশ অনুকূলে। রাস্তার কোলাহলও অনেকটাই স্বাভাবিক। লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটছে তরুন। দূর থেকেই পুরোনো বইয়ের দোকানগুলি দেখতে পাচ্ছে। ‘এবার পেয়ে যাবো।’ আস্থা নিয়েই ভাবলো ও। সৌমিককে একবার কল দেবার কথা চিন্তা করলো। কিন্তু করলো না। ওরা তো আসছেই। বরং গ্রন্থটি খোঁজা যাক। গভীরতা ভরা আগ্রহ নিয়ে গ্রন্থটি খুঁজতে থাকলো। প্রতিটি দোকানই আয়তনে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তবে পর্যাপ্ত পুরোনো গ্রন্থরাজি দ্বারা পূর্ণ। পুরোনো গ্রন্থের প্রাচুর্য দেখে খোঁজার মাত্রাটি বাড়িয়ে দিলো। খুঁজবার এক পর্যায়ে একটি দোকানের কর্মচারীকে গ্রন্থটির কথা জিজ্ঞেস করলো।
‘বিত্তহীন বৃত্তে’- ছিল, এখন নেই যে ভাইয়া। খোঁজ করুন না, পেয়ে যাবেন।’ কোমল কণ্ঠে মধ্যবয়সী কর্মচারীর কথা শুনে আশ্বস্ত হলো তরুন। বিরতিহীনভাবে কয়েকটি দোকানে জিজ্ঞেস করতে থাকলো। কিন্তু কেউই ওর কাক্সিক্ষত উত্তরটি দিতে পারলো না। কিছুটা হতাশ হয়েই একটি দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। মুখ ভার করে অপেক্ষা করতে থাকলো সৌমিকদের জন্য। ওর বাম পাশেই ছিল একটি বুক সেলফ। হঠাৎ গিয়ে চোখ পড়লো সেলফটির দিকে। বেশ কিছু গ্রন্থের মাঝে ‘বিত্তহীন বৃত্তে’ বিবর্ণ হয়ে আসা শব্দ দুটি দেখতে পেল। বিশ্বাস করতে পারছে না ও। একদম কাছে গিয়ে দেখলো গ্রন্থটি। নিশ্চিত হয়ে হাতে নিলো। ‘ইয়েস!’ উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যে মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো শব্দটি। মুহূর্তেই স্বপ্নের সীমান্তে সীমাহীন উল্লাসের ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো যেন। নবরূপে উদ্দীপিত তরুনের হৃদয়তন্ত্রীতে সঞ্চিত ব্যথার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলি ধীরে ধীরে উৎসাদিত হতে থাকলো। যেন হারিয়ে যাওয়া কোন অপ্সরীর রূপসূধা নতুনভাবে নির্ণিমেষ চোখে পরিক্ষণে ব্যস্ত ও। অনুসন্ধিৎসু হাতটি অবচেতনাতেই গ্রন্থটির আপাদমস্তক ছুঁয়ে গেল। অতি উৎসাহ দেখালে দাম বেশি বলতে পারে। তাই নিজেকে সামলে নিলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো গ্রন্থটির প্রকৃত মূল্য। সরু হাতে বইটি নেড়ে চেড়ে দেখলেন কর্মচারী। কিছু সময় ভাববার পর বললেন ‘ ত্রিশ টাকা দিলেই হবে।’
‘পাঁচশ টাকার খুচরো হবে?’ দ্রুত বললো তরুন।
‘হবে না।’ নিরস কণ্ঠে কর্মচারীর কথা শুনে কিছু না বলেই দ্রুত হেঁটে হেঁটেই ফ্লেক্রি লোডের দোকানে গেল ও। ‘জিপি ছাড়া লোড হবে না, ভাই।’ দোকানদারের শক্ত কথাটি বিচলিত করলো ওকে। মুহূর্তেই চোখ দুটি ভেতরে ঢুকে গেল। ভ্রু জোড়াও কুঞ্চিত হয়ে এলো। কপালের বলিরেখাগুলি যেন উপরে উঠতে থাকলো। ওর নম্বরটি রবি হওয়ায় ব্যর্থ হলো। পাশেই ছিল আরেকটি দোকান। দ্রুত সেখানে গেল। লোড দিয়ে টাকা খুচরো করলো। দ্রুত খুচরো নিয়ে ভীড়ের মধ্যে ঊর্ধ্ব গতিতে হাঁটতে শুরু করলো তরুন। অনিঃশেষ আনন্দের পাশাপাশি উদ্বিগ্নতা ওর হৃদয়কে তোলপাড় করছে। গ্রন্থটি না পাওয়া পর্যন্ত হয়তো সেই উদ্বিগ্নতার ভাবটি কাটবে না। বীরের মতো এগিয়ে যাচ্ছে ও। মানিব্যাগটি পকেটে। ত্রিশ টাকা হাতেই রয়েছে। স্বল্প সময়ের মাঝেই চলে এলো।
‘এই যে ভাই নিন, ত্রিশ টাকা।’ ভরাট হাসিতে ওর ধবধবে সবকটি উজ্জ্বল দাঁত বের হয়ে এলো।
‘কিসের টাকা?’ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন দোকান মালিক।
‘ওই যে ‘বিত্তহীন বৃত্তে’ গ্রন্থটি দেখলাম না।’ বিষয়টি স্পষ্ট করবার জন্য ইশারায় দেখিয়ে দিলো কর্মচারীকে।
‘ও আচ্ছা, বুঝতে পারছি।’ বলেই কর্মচারীকে বইটি দেবার জন্যে নির্দেশ দিলেন। ‘একটু অপেক্ষা করুন, দিচ্ছি।’ বলেই বুক সেলফের দিকে তাকালেন কর্মচারী। কিন্তু দেখতে পেলেন না গ্রন্থটি। সজ্জ্বিত গ্রন্থগুলির মাঝের একটি অংশ ফাঁকাই রয়ে গেছে। কর্মচারীর সাথে তরুনও তাকিয়েছিল সেদিকে। ফাঁকা অংশটি দেখবার পর কিছুই জিজ্ঞেস করলো না কর্মচারীকে। বিমর্ষ হয়ে উঠলো তরুন। লাল হয়ে এলো ওর গোল মুখখানি।
‘দুঃখিত ভাইয়া, একটু আগেই বিক্রি করেছি। টেবিলেই ছিল। দেখামাত্রই এক ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম আরও কপি আছে।’ আরও কিছু বলবার উপক্রম করলেও তরুনের মনমরা ভাবটি প্রত্যক্ষ করে নিজেকে সংযত রাখলেন কর্মচারীটি।
নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো তরুন। বইয়ের দোকানটির সামনেই। ভেতরে ভেতরে ভয়ানকভাবে অস্থির হয়ে উঠলো। রাজ্যের অন্ধকার মুহূর্তেই এসে ওর তারুণ্যকে আবৃত করলো। অপ্রত্যাশিত একটি যন্ত্রণা কল্পনার টুটিটি চেপে ধরলো। মনের আয়নায় সিঞ্চিত চরিত্র,আবহ,আবেগ ও শব্দের ভেলাগুলি মুহূর্তেই দূর হতে অতিদূরের কোনো নির্লিপ্ত নগরে প্রক্ষিপ্ত হল। পেছনে দোকান মালিক, কর্মচারী, হাজার হাজার গ্রন্থ আর সামনে দাঁড়িয়ে তরুন। নেই শুধু একটি গ্রন্থ ‘বৃত্তহীন বৃত্তে’। একজন জ্ঞানপিয়াসী পাঠকের অতি আকাক্সিক্ষত গল্পগ্রন্থ।
এরই মাঝে সৌমিকরা চলে এলো। ওদেরকে দেখবার পরও স্বাভাবিক হতে পারলো না তরুন। কথা বলবার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললো। ওর এই মানসিক অবস্থা দেখে সবাই বুঝতে পারলো এবারও গ্রন্থটি পেতে ব্যর্থ হয়েছে ও। তবে সবার মাঝেই নীরবতার ভাবটি জোরালো হলেও প্রাণবন্ত মনে হলো বীথিকাকে। লাল সবুজ রঙের একটি নতুন জামা পড়েছে। কপালের গাঢ় সবুজ টিপটিতে অপূর্ব লাগছে ওকে। সময়ের সাথে সাথে ওর মুখের প্রদীপ্ত প্রভাটি রুপোলি সূর্যের মতো দ্বিগুণ হতে থাকলো। মূল কারণটি অনুমান করতে পারলো না কেউ। সবার ভেতর চলমান এই নীরবতার মাঝেই তরুনের একদম কাছে এলো বীথিকা। ভার্সিটি ব্যাগের ভেতর থেকে বের করলো একটি প্যাকেট। তুলে দিলো তরুনের হাতে। উজ্জ্বল আকাশী রঙের র্যাপিং পেপারে মোড়ানো প্যাকেটটি। অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো সবাই। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে প্যাকেটটি খুলতে থাকলো তরুন। র্যাপিং পেপারের শব্দ দ্বিধাযুক্ত অনুরণন সৃষ্টি করলো তরুনসহ সবার মাঝে। উত্তেজনা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলো প্রবলভাবে। প্যাকেটের ভেতর থাকা গ্রন্থটির নাম দেখেই অবাক হলো তরুন। স্বর্ণের মতো চকচক করতে থাকা ‘বিত্তহীন বৃত্ত’ শিরোনামটি তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। দীর্ঘদিন ধরে ওর অনুজ্জ্বল আকাশে প্রাপ্তির ডালা মেলে আরক্তিম হয়ে উঠলো সূর্য, অন্তরের ভেতর প্রবেশ করতে থাকলো রামধনু রঙের কিরণ। ভরাট হাসিতে মুখখানি ভরে গেলো ওর। ওর এই হাসিতে সৃষ্টি হলো মুগ্ধতার আবেশ। আর এই আবেশে আবেশিত হয়ে খুশিতে চিৎকার করে উঠলো সবাই। অতঃপর যাত্রা করলো রেস্টুরেন্টের দিকে।