স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন কণ্ঠশিল্পী। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে যার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে আশা জাগানিয়া কিছু গান। বর্তমানে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পীকর্মীদের তালিকাভুক্তির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় উঠে আসে সেই সময়ের অনেক অজানা ইতিহাস।
দীর্ঘ এ আলাপচারিতায় সঙ্গে ছিলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক আকন মোশাররফ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাহিত্যবার্তার সহকারী সম্পাদক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ-
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শুরুর কথাটা শুনতে চাই-
মনোয়ার হোসেন খান: যুদ্ধকালীন এদেশে যখন বেতারে কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না; তখন কলকাতায় স্থাপন করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমি যখন যাই; তখন আমি কলেজ অব মিউজিক নামের সংগীত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র। কেবল ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। ১৯ বছর বয়স আমার। ওই সময় এ দেশের একমাত্র সংগীত মহাবিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত এটি। এখান থেকেই বেশি কর্মী অংশগ্রহণ করে। এছাড়া সরকারি বেতার প্রতিষ্ঠানের অনেকেই যোগ দেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এর প্রশাসনিক কাঠামো ছিলো। আমরা পনেরো জন যোগ দিয়েছিলাম তখন। আমাদের সঙ্গে বেতার পাকিস্তানের কর্মীরাও ছিলেন। অনেকেই ধারণা করেন, হয়তো কয়েকজন সংগীত শিল্পী নিয়ে গঠিত হয়েছে, আসলে তা নয়- এটা একটি সরকার চালিত বেতার কেন্দ্র ছিলো। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক গঠিত একটি বেতার কেন্দ্র।
স্বাধীন বাংলা বেতারে কাটানো সময় সম্পর্কে যদি একটু বলতেন-
মনোয়ার হোসেন খান: প্রথম দিকে আমরা ২৮ সেগুনবাগিচায় অবস্থিত সংগীত শিক্ষা কেন্দ্রে গান শিখতাম। বর্তমান শিল্পকলার পাশেই জমিদার বাড়ির মতো একটি বাড়িতে শিক্ষাকেন্দ্রটি ছিলো। সংগীত মহাবিদ্যালয় এই শিক্ষাকেন্দ্রটি পরিচালনা করতো। সেখানে আমরা জমিদার বাড়ির কর্মচারীদেরথাকার কক্ষে ছাত্রাবাস করেথাকতাম।স্বাধীনতা আন্দোলনর তখন তুঙ্গে। আমরা তখন খোলা জায়গায় গণসংগীত করতাম। এরপর যুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালানোর অপরাধে পাকিস্তান সরকার বেতার কেন্দ্রেহামলাকরলে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। তখন ওখানে আমরা পত্রিকা বিছিয়ে শুতাম। বালিশ হিসেবেও পত্রিকাই ব্যবহার করতাম। বিজয়ের পরে আবার শিলিগুড়িতে স্থাপন করা হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতারের কাঠামো কেমন ছিলো?
মনোয়ার হোসেন খান: সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে তথ্য বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন এমএলএএম এ মান্নান। এছাড়া চারজন অনুষ্ঠান সংগঠক ছিলেন। তারা হলেন- শামসুল হুদা চৌধুরী, আশফাকুর রহমান খান, মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, বেলাল মোহাম্মদ। বেলাল মোহাম্মদ স্বাধীন বাংলা বেতারের সূত্রটা করেছিলেন। সে কারণে তাকে সংগঠক পদে রাখা হয়েছিলো। অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনুষ্ঠান প্রযোজকের ভূমিকা ছিলো প্রধান।
স্বাধীন বাংলা বেতারের কাজ কি ছিলো?
মনোয়ার হোসেন খান: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সংবাদ প্রচার, জরুরি ঘোষণা, যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে সংগীত, কথিকা, চরমপত্র পাঠ করা হতো। এমনকি প্রপাগান্ডা ছড়ানোও আমাদের কাজ ছিলো। যা ‘সাউন্ড গ্রেনেড’ হিসেবে পরিচিত ছিলো। পাকিস্তানি সৈনিকদের ভেতরে বিভ্রান্তি বা ভয় সৃষ্টির জন্য এ কাজটি করতাম আমরা। এটাও যুদ্ধের একটি কৌশল। এ কেন্দ্রের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে আটক করার আগেইতিনি টেলিগ্রাম-টেলিগ্রাফের মাধ্যমে ঘোষণাটি রেখে গিয়েছিলেন। এর আগে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতে চাইলে তৎকালীন সামরিক সরকার তাতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। খবর পেয়ে তিনি ভাষণেই বেতার সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে যান। বেতারে আমাদের খবর প্রচার না করলে তিনি যেতে নিষেধ করেন। ফলে বেতারকর্মীরা ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড করে রাখে।এ সময় আটক বা প্রাণনাশের ভয়েতারা আত্মগোপনে চলে যান। বেতার পাকিস্তান বন্ধ হয়ে যায়। ইয়াহহিয়া সরকার যখন বেতার চালু করতে বলেন। তখন দাবি করা হয় যে, ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতে দিলে বেতার চালু করা হবে। এতে ইয়াহহিয়া সরকার রাজি হয়। এর একদিন পর ৮ মার্চ কালুর ঘাট প্রচার কেন্দ্র থেকে ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করা হয়। এখানে বেতারকর্মীরা এসে খবর বা অনুষ্ঠান প্রচার করেই চলে যেতো। তবে মিটিং হতো অন্য জায়গায়।
কালুর ঘাট প্রচার কেন্দ্রের কার্যক্রম সম্পর্কে যদি কিছু বলেন-
মনোয়ার হোসেন খান: কালুর ঘাট ছিলো পাকিস্তান বেতারের একটি প্রচার কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া ঘোষণাপত্র ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান পাঠ করেন। পরে অবশ্য স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অনেক বিতর্কের জন্ম দেওয়া হয়েছে। যেহেতু আমি আগেও বলেছি, বঙ্গবন্ধু আটক হওয়ার আগেই ঘোষণাপত্রটি তিনি রেখে গিয়েছিলেন। তিনি লিখে গেছেন, ‘ইহাই বোধ হয় আমার শেষ বার্তা- আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এই ঘোষণাটিই শুধু পড়েছেন জিয়াউর রহমান। এই ঘোষণার ফলে ২৮ মার্চ প্রচার কেন্দ্রে বিমান হামলা চালানো হয়। ওই সময় কিছু যন্ত্র নিয়ে একটি ট্রাকযোগে কলকাতার দিকে যাত্রা করে কিছু বেতারকর্মী।
আপনি কয়টি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন?
মনোয়ার হোসেন খান: আমি মোট পাঁচটি গানে কণ্ঠ দিয়েছি।
স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের বয়স তখন কেমন ছিলো?
মনোয়ার হোসেন খান: সেখানে প্রায় সববয়সী কর্মীরাই ছিলেন। শিশুশিল্পী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ শিল্পীও ছিলেন। নারীদের মধ্যে ১৩ বছরের একজন ছিলেন যিনি বুলবুল মহলানবীশের ছোটবোন ছিলেন। ১৪ বছর বয়সের একজন কিশোর ছিলেন যার নাম ডা. দিলীপ কুমার ধর। কথিকা লিখেছিলেন ৬৪ বছর বয়সের গজেন্দ্রলাল। চরমপত্র পড়তেন এম আর আক্তার মুকুল। বর্তমানে উইকিপিডিয়ায় কিছু ভুল তথ্য রয়েছে।এবং অনেকেই নিজেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী বলে দাবি করেন।
উইকিপিডিয়া ছাড়াও আর কোনো ভুল তথ্য রয়েছে কি না?
মনোয়ার হোসেন খান: অনেকেই দাবি করেন- ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটি বিজয়ের আগেই রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’- কথাটি কি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই বলা সম্ভব? তাহলে গানটি কিভাবে আগেই রেকর্ড করা হয়? তখন তো আমরা সময়ের প্রয়োজনেই গান সৃষ্টি করতাম। নির্ধারিত গীতিকার-সুরকাররা মিলে গান সৃষ্টি করতেন। আমরা কণ্ঠশিল্পীরা কণ্ঠ দিতাম।