সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই পরিবার, সমাজ, পরিণত একটা বয়সের পর জাতির কাছে ঋণী হয়ে যায়, আমি বলছি না যে, সেটা দলিল দস্তাবেজ অথবা খাতায় কলমে কোন প্রকার লিখিত ঋণ।
সেই ঋণ হলো বেঁচে আছ, খাচ্ছ, ঘুমাচ্ছ, শরীরের বাড়তি কিংবা ঘাটতি মেটানোর জন্য অতিরিক্ত পুষ্টি সঞ্চয় করছো, তারপর একটা বয়সে পড়াশোনা করে বড় হচ্ছো, মাথা, গা - গতরে যতোবড় হচ্ছ,- ঠিক এভাবে পড়ালেখায় , ধনে -মানে বড় হচ্ছো,বড় চাকরি করে নিজকে প্রমাণ করছো, এই যে এতকিছুর জন্য প্রকৃতি তোমাকে যথেষ্ট সময়, শ্রম, অথ', শক্তি, মেধা, মূল্যায়ন, সম্প'কের বন্ধন দিচ্ছে সবো'পরি তোমার সকল দায় নিয়ে নিচ্ছে, বিনিময়ে তুমি প্রকৃতিতে তোমাকে নিয়ে আসা, পরিবার, সমাজ, সমাজে অবস্থানরত মানুষের জন্য কী করছো?
আমরা জানি সমাজে যারা প্রতিভাধর ব্যক্তি আছেন তাদের সবাই সম্মান করি, ভয়ও করি। সেকারনে আমরা কোন অন্যায় কাজ থেকেও বিরত থাকি। তাঁরা আছেন বলে সমাজের উন্নতি হয় বলে তাদের ভক্তি করি। বারবার সালাম ঠুকি।
তাঁরা সামনে এলে ভক্তি ভয়ে জড়সড় হই ।
আমরা একবার ভাবি, আমার মতো সবাই একবার ভাবুন তো, - তাঁদের প্রতিভা, মেধার গুণে তাঁরা সমাজের গুণিজন, তবে আমি নই কেন?
আমার আর তাঁর মধ্যে ব্যবধান কতটুকু? হাতে, পায়ে, গড়ন- গঠনে, মেধা- মস্তিষ্কে, রক্তে- মাংসে, জন্মে- জঠরে, পরিবেশ- পরিচয়ে?
ব্যবধান কোথায়?
কোথাও পেয়েছি! আমিতো বলবো সবই এক, ঈশ্বর মানুষজাতিকে একই বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, হয়তো জ্ঞান- দশ'নে তফাৎ আছে ,থাকবে । তবে এটাও ঠিক ধন, সম্পদে কেউ বেশি, কেউ কম। রাজার ছেলে রাজা হয়, ভিখারির ছেলে ভিখারি হয়, সেটা স্বাভাবিক অযুত , নিযুত, আর তারল্যে। এটাও মানি, গোবরে পদ্মফুল ফোটে, সেটা আমাদের মনুষ্য সমাজে দূ'লভ।
কিন্ত এমনটা হয় তো? না কি হতে মানা আছে...!
অনেক বাবা, মা আছেন সন্তানকে দৌড়াদৌড়ি করতে মানা করেন। কারন পড়ে গিয়ে সন্তান ব্যথা পাবে, গাছে চড়তে নিষেধের কড়াকড়ি চলে, কারন হাত,পা ভেঙে অঘটনের চেয়ে হাত,পা নিয়ে বাড়িতে বসে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
কজন বাবা,মা আছেন যে, সন্তানকে বলে দৌড়া, পড়ে গিয়ে উঠে আবার দৌড়া আবার পড় , পড়ে ব্যথা পেলে কাঁদিস না, ওতে হাড়গোড় মজবুত হয়। এইরকম সাহস দেবার মতো কেউ নেই, পিছিয়ে পড়ে ক্ষুদ্রপ্রাণ, ক্ষুদ্রতা নিয়ে গায়ে গতরে বড় হয়।
আমার মূল উদ্দ্যেশ্যটুকু বোঝাতে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই-
সূয' মেঘে ঢাকে, পৃথিবী অন্ধকার হয়। মাঝেমাঝে সারাদিন সূযে'র মুখই দেখা যায় না। বৃষ্টিবাদলে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয় (বলা বাহুল্য যে সবার জন্য বৃষ্টি আশি'বাদ নয় অভিশাপ ও বটে) তাই বলে কী পরদিন সকাল হয় না? সূর্য উঠে না?
আমি আমার উদ্দ্যেশ্যে ফিরে আসি, ব্যথা পাবার ভয়ে সন্তান পড়ে না গিয়ে নিজকে গড়বে কোন তাগিদে, পড়ে গিয়ে যে উঠে দাড়াঁতে হয়, আবার দৌড়ে প্রথম হওয়ার মানসিক শক্তি প্রয়োজন হয় সেটা বুঝতে দিতে সমস্যা কোথায় আমাদের?
আমরা মনুষ্য সমাজে বাস করি, একে অপরের সাথে মত বিনিময়,একে অপরের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি, এদের মধ্যে ব্যতিক্রম মানুষের বৈশিষ্ট্য আছে। জ্ঞানলব্ধ , বিচক্ষণ, উদারনৈতিক এককথায় সুস্থ পরিপুষ্ট মানসিকতার ক'জন আছে?
উপরে লিখিত গুণসম্পন্ন মানুষ নিজে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি অন্যদের ও জ্ঞান লাভে পথ দেখায়। জীবন চালাতে গেলে অর্থাৎ নেহায়েত ক্ষুৎপিপাসা মেটাতে অন্নের সংস্থান করতে হবে তা একমাত্র জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সম্ভব। বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বুঝাতে একটা ছোট্ট উদাহরণ টানছি-
সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের কথাই ধরি,
দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চাতালে কাজ করা একজন শ্রমিক তার কর্মজ্ঞান ও শারীরিক কর্মক্ষমতার বলেই কাজ করতে সক্ষম । উল্লিখিত শ্রমিক কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উপকার করছেন, ওই শ্রমিক তার আশেপাশের মানুষ, পরিবার সকলের কাছে অপূরণীয় ঋণ শোধ করে যাচ্ছে। আমরা হলাম সে ঋণে ঋণী। সমাজ, দেশের স্বার্থে সকলেই কর্মের দ্বারা একরকম ঋণ পরিশোধ করে যাচ্ছি, তবে এটাও ঠিক এর দ্বারা আমরা নিজেদের ভূমিকা তুলে ধরছি। এটা ভাবছি না, কারা উপকৃত হলো? আর কারা হলো না।
অর্থাৎ যারা সুবিধা পাচ্ছে তারা সবসময় সবক্ষেত্রেই পাচ্ছে, যারা পাচ্ছে না তারা একেবারেই পাচ্ছে না, তাদের কোন উন্নয়ন হচ্ছে না। যদি হতো তবে সবাই একই কাঠামোর আওতায় আসতো। পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিক,মনস্তাত্ত্বিক, বৈষম্য সৃষ্টির কারন হিসেবে পর্যাপ্ত সুবিধা লাভের বিষয়টি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো কারন নয়, এটিও একটি কারন হতে পারে।
এই বোধটুকু জাগ্রত হলেই আমরা মানুষ হিসেবে সার্থকতা খুজেঁ পাবো নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভে আমরা যতটা মুখিয়ে আছি, অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা বাস্তবসম্মত শিক্ষার জন্য ততটা পিছিয়ে আছি।
আমাদের সামনে বেড়া দেয়া আছে , ইচ্ছা করলেই বেড়ার অতিক্রম করা সম্ভব। তার জন্য প্রথমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ও সম্মানিত শিক্ষকগণ ছাত্রদের দু’চারটি কথার মাধ্যমে প্রত্যেককে জাগিয়ে তোলার শিক্ষা দিতে পারেন। সমাজে এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যারা আতœগঠনমূলক কাজ করে যাচ্ছেন কিন্তু এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালে । কেউ তাদের নামই জানে না, আমাদের কি উচিৎ নয় তাদের পথ অনুসরন করা? তাদের দেখানো পথে চলা?
সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়ার বিষয় হলো সর্বোতমুখী শিক্ষার দিকে। একমুখী শিক্ষায় পেট চলবে, কিন্তু সমাজ জীবন থেমে যাবে।
বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে, আমরা এখন সন্তানকে বুঝতে সময় দেই না, স্কুল জীবন শুরু হতে না হতেই ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখাই।
শিশুটি ভারী বোঝা কাঁধে নিয়ে বড় হয়। শিশুটির মানসিক বিকাশ হবার আগেই দায়িত্বের বাধনে বাঁধা পড়ে এভাবে যে , ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছি যেন ভালো রেজাল্ট করে ভালো বেতনের চাকরী করে উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারো। এটা বলছি না যে, সে যা করবে তা শুধুই নিজেকে গড়ে তোলার জন্য, সমাজ তথা দেশের জন্য সে পড়াশোনা করে বড় হচ্ছে, এতে সে বাবা, মাকে ধন্য বা কৃতার্থ করছে না বড়জোর সে তার ভালো কর্মের দ্বারা নিজেই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, মানুষ তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। যদি এমনটা না হয়, তার দায়ভার বাবা মা নেবে না, বাবা মা একজন পথ প্রর্দশকমাত্র। কারন বিশ্বের বুকে সে একা নয়, বিশ্বও তার জন্য একমাত্র নয়।
বিশ্বতোমুখী শিক্ষা অন্তত সে কথা বলে না। আমরা হয়তো চক্ষু খুলে জ্ঞান অর্জন করি, মনের দরজা বন্ধ রেখে জ্ঞান অর্জন করলে সে জ্ঞান কাজে আসবে না। মোটামুটি জ্ঞান নিয়ে হয়তো নিজেকে তুষ্ট করা যায়, সামাজিক কর্মকান্ডে অংশ নেয়া যায়, ধর্মকর্ম করা যায়। সমাজের অন্যকেউ উপকৃত হয়না, সমাজও সুগঠিত হয় না। প্রকৃত শিক্ষিত লোক সমাজে অফুরন্ত শক্তির উৎস, সমাজকে উন্নত করার মানসে নির্ভয়ে ঋণের বোঝার ভারমুক্ত হই। নিজেকে আলোকিত করি, সমাজে হাজারো আলো বিচ্ছুরিত হোক, উদ্ভাসিত হোক মানের জগৎ। জীবনকে প্রসারিত করার মানসে এগিয়ে যাবে জীবন, সমাজে অন্ধকারে বেঁচে থাকা মানুষগুলো আলোকিত হোক তোমাদের আলোয়।