ছবি : কবি ও মা
মায়া - ৪
অথচ চমৎকার পত্রমিতালী হতে পারতো মায়া ও মানুষে, হলো না। আমি তো মায়ার চাষবাস নিয়েই ফুরিয়ে যাই, বারবার। ফুরিয়ে গেলেই অভাব হয়, প্রয়োজন বোঝা যায়। নিজের ভেতরে নিজের অভাববোধ জাগে। অথচ কতবার চেয়েছি, জন্মের ঋণশোধে যাবতীয় শব্দ অকুণ্ঠ তুলে দেবো তোমার কাছে। মায়াময় শব্দগুচ্ছ গাঁথা চোখ অপেক্ষারত। মনে আছে- সেই সন্ধেয়, তুমি হাত বাড়ালে সংকোচে, ঈষৎ হাসিতে ঠোঁট হলো পেটানো কমলার রঙ। শেষবার তুমি-আমি সল্টলেকের রাস্তায়; যে চোখে তাকালে সভয়ে, আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি তোমার হাত ? ভয় কেনো ? কেউ কি ছাড়ে সজ্ঞানে; নিবিড় আনন্দ, আশ্রয় ? প্রাপ্তির হিসেব যেখানে শূন্য, স্পর্শ সেখানে প্রাণাধিক !
বোঝোনি কি ?
জরায়ুর গা ঘেষে তাবৎ জলের সাথে ভাসতে চেয়েছি আজীবন, জানাতে পারি নি। তোমার তারুণ্য দিয়ে পুষেছিলে এক কন্যা শিশু, সে এখন স্রোতের উপরে ভেসে থাকতে পারঙ্গম। জানো তো ? সাঁতারের চাইতে ভেসে থাকতে পারা অনেক কঠিন। অনবরত সত্য-সঙ্গে নিঃসঙ্গ থেকেছি আমি, বোঝোনি কেনো ? তুমি তো জানো, নিঃসঙ্গে মৃত্যুর দূরত্বকেও তাৎক্ষণিক মৃত্যু মনে হয় ! তাইতো আতকে উঠেছিলে ওমন, খোলামেলা দুপরের পরে, সল্টলেকে ! জানি তো, চায়ে তোমার ভালোলাগা আছে ঢের ! আঙুল টলকে উঠতেই বড্ড ভয় পেয়েছিলে অজান্তে; হাত বাড়াতে পারো নি নিসঙ্কোচে, আমার দিকে। ভেবে দেখো, আমি তো আছি তোমার যৌবন হতে, রোদের উত্তাপ সয়ে শতাধিক শ’য়ে !
নিষ্ঠুর অ্যালঝাইমার তোমার মস্তিষ্কের কোষ খেয়ে নিচ্ছে দ্রুত। তুমি নিঃসঙ্গতায় বন্ধ চোখে অন্ধ; আনিদ্রায় নিদ্রাহত থাকো প্রায়। আমি তো জেনেছি সেই কবে, তুমি ছাড়া আর কোনো ছায়া নেই, নেই বৃক্ষ সতেজ বরণ। শিশু থেকে তোমার যৌবন করেছি গ্রাস; কী এক অপরাধবোধে মরে যাই সারারাত। আমিও ঘুমোতে পারি না মা !
আমি তো ছুটেই চলেছি অনাহুত; জীবনের ভ্রম আলিঙ্গনে। ছুঁয়ে দেখো, স্পর্শে শোধ করি জন্মের খানিক ঋণ। শিরদাঁড়া ভেঙ্গে আসে প্রতিক্ষণ; সাময়িক অ্যালঝাইমার ছোঁ মারে, ক্ষয় করে স্মৃতিবিন্যাস। বেঁচে আছি ? কেনো আছি ? প্রতিজ্ঞা করি, যৌবনের কোনো এক দিনে উঠোনে ধানের ছড়ায় পা জড়িয়ে রোদে পুড়বো। তোমার সোনালি হাতে সোনালি চুড়ির গোছায় ঝলসে যাওয়া রোদ। আঙুলের সাথে মিতালি করে আছে শরৎ; তোমার প্রিয় উপন্যাস ‘পথের দাবী’। কী অসামান্য বোধ; ভাবা যায় !
অথচ ভয়ংকর অ্যালঝাইমারের বিষ মেরে ফেলে রোদ ! স্মৃতিহীন হও; বড় হতে হতে ঘুরেফিরে শিশু হয়ে যাও তুমি ! আমি যেনো ‘মা’ হয়ে উঠি স্নেহকাল থেকে।
প্রতিজ্ঞা করি, দেখো- ফি-জন্ম আমিই তোমার ‘মা’ হব শেষে।