হলুদ পাতার গল্প
—এমন কেন হয়? আমরা কেন আজীবন সবুজ থাকি না!
অরন্যের বিশাল জগতে নানা জাতের নানা আকৃতির গাছের ছড়াছড়ি, গাছে গাছে কিলবিল করছে পাতা। বেশিরভাগ পাতাই সবুজ, অল্প কিছু হলুদ—বেশিরভাগ হলুদ পাতারা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বেতাল বাতাসের সাথে হাত ধরাধরি, উড়ছে তারা।
সবুজ, জীবন্ত পাতাগুলো বাতাসের তোড়ে তিরতিরিয়ে কাঁপে। কথা বলে অন্যান্য পাতার সাথে, গান গায়, শিস দেয়। কেউ কেউ চুপ, বাড়বাড়ন্ত মনখারাপ তাদের।
কুয়াশার দিন। নিমগ্ন অরন্যে বাকহীন পাতারা কার যেন অপেক্ষায়
আছে। পাখি ডাকছে না। এমন থমথমে দিনে তিন দিন বয়সী কচি পাতাটি একটি হলুদ
পাতাকে দেখিয়ে বৃদ্ধ সবুজ পাতাটিকে প্রশ্ন কডলো—উনি আমাদের মতো সবুজ কেন
নয়?
বৃদ্ধটি বিষণ্ন হয়। বলে—ওর দিন শেষ। বার্ধক্যের জরা ওকে গিলে নিয়েছে। এই ঝরে পড়লো বলে।
শিশু পাতাটি খুব বেশি কৌতুহলী।—তাহলে ওই পাতাটি? তার বয়স তো খুব একটা বেশি মনে হচ্ছে না।
বৃদ্ধটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। —ওর! দুঃখী ও, ধার দেনা আছে, হতাশা আছে।
কচি পাতাটি থামবে না।—ওই যে ওটা?
—ওরা অভাবী। কদিন আগেই মা মরে গেছে। দেখছিস না গাছটি ভেঙে পড়ে আছে।
—আর ও? ওই যে জারুল পাতা, হলুদ, না না লালচে...
—প্রেমে ব্যর্থ। প্রেমিকাটি অকালে ঝরে গেছে।
একের পর এক হলুদ পাতার দুঃখ বলে যায় বৃদ্ধ পাতাটি। শিশুটি শোনে। পাতাদের সংসারে ঝরে যাওয়ার দুঃখ ছাড়া আর কোন গল্প নেই।
শিশুটি ভাবে। তার ভাবনার নদী খলবলিয়ে বয়ে যেতে থাকে দিনের পর দিন। চোখের
সামনেই বৃদ্ধ পাতাটি দূরারোগ্য ব্যাধিতে পড়ে, শরীরের সবুজ আভাটি বিলুপ্ত
হয়। পীতবর্ণ ধারন করে সে। ঝরে যায়।
শিশুটি এখন বড় হয়ে গেছে অনেক, যুবক হয়েছে। তার সাথে ভাব হয়ে গেছে প্রতিবেশী পাতাকন্যাটির।
—বুঝলে সুকন্যা, আমাদের আয়ু খুব কম। এইটুকু আয়ু তোমাকে ভালবাসতে কম পড়ে যাবে আমার।
কন্যাটি হাসে।
—আমরা কি নিয়মের বাইরে যেতে পারি! বয়স বাড়লে হলুদ ছড়িয়ে পড়বে শরীরে, ঝড়ে যাবো আমরা। কে কোনদিকে উড়ে যাবো তারপর কে জানে!
তরুনী পাতাটির শীতল বাক্যটি আমূল বদলে দেয় তরুণটিকে। বলে—চলো নিয়মের বাইরে যাই। মৃত্যুর অপেক্ষায় না থেকে হাত ধরে একসাথে উড়াল দেই। অন্তত একত্রে মরার নিশ্চয়তাটুকু তো থাকলো!
তীব্র বাতাস বয়। বাতাসের মুখে তারাও হাত ধরে দুলতে দুলতে নিচে নেমে আসে। টুপ করে জলের শরীর ছুঁয়ে দেয়। না বাতাস, না অরন্য কিংবা জল—কেউ আঁচ করতে পারে না তাদের এই ষড়যন্ত্রের কথা।
***
দুঃখবিলাস
যে মদমাতাল লোকটি তার বন্ধুদের সাথে রাতভর তাস পেটায়, আজ সে আসেনি। আজ তাই বিরতি, তাসগুলোর বিশ্রাম।
সবগুলো তাস বিশৃঙ্খল পড়ে আছে বিছানার কোণে, গল্পগুজব করছে এলোমেলো।
ইস্কাপনের সাত, রুইতনের দুই কিংবা হরতনের গোলাম কেউ চুপচাপ বসে নেই।
কথামুখর তাসের জগতে একমাত্র ইস্কাপনের রাজা চুপ, তার মুখে কথা নেই, ভেতরে
ভেতরে পাক খাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। কেউ খেয়াল না করলেও তিনি টের পেয়েছেন, তার
রাণী এই জটলার মধ্যে নেই। আরো একজন নেই, সে হল ইস্কাপনের গোলাম।
রাণীকে তিনি অসম্ভব ভালবাসেন। অথচ...
তিনি ভাবেন, যদিও কূল-কিনারা পান না ভাবনার। মনে মনে সংকল্প করেন রাণী
ফিরলে কঠিন শাস্তি দেবেন। গোলামকেও কয়েদ করে রাখবেন কালকুঠরিতে।
রুইতনের দুই, হরতনের ছয় কিংবা ইস্কার তিন—এরকম ছোটলোক প্রজাদের ভীড় এড়িয়ে
অন্য রাজারা এসেছেন ইস্কার রাজার কাছে। সবগুলো টেক্কাও এসেছেন। এলোপাতারী
গল্পের মধ্যেও ইস্কাপনের রাজা ভেতরে ভেতরে বিষণ্ণ, কাঁদছেন তিনি।
রুইতনের রাজা তুললেন সেই মদমাতাল লোকটির কথা, যিনি এসে পড়লে এই অখন্ড অবসর
মিলতো না তাদের। লোকটি ভীষণ বাচাল, প্রচুর মদ খায় আর উচ্চস্বরে বিরবির করে।
লোকটির কথা মনে আসতেই ইস্কাপনের রাজা আরো বেশি বিষণ্ন হন। তিনি এলে খেলা
চলতো রাতভর, ব্যস্ত থাকা যেত। ব্যস্ততার বাহানায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে
থাকা যেত নিজের ব্যর্থতা।
ভাবছেন রাজা। লোকটি নিজেও কি তার মতো ব্যর্থ! ব্যর্থতা ভুলতেই হয়তো সে রাতভর ব্যস্ত থাকে।
অথচ—লোকটিকে বহুবার বলতে শোনা গেছে স্ত্রীকে খুব বেশি ভালবাসতেন তিনি।
***
থ্রিসাম
স্বামীর সাথে সঙ্গম করছি। চোখে ভাসছে প্রাক্তন প্রেমিকের মুখ।
***
ফাঁসি
পুলিশ আমাকে সার্চ করে জামার পকেটে পেল তিন-চারটে মানুষ। তিন?
নাকি চার? আকস্মিকভাবে পুলিশের মুখোমুখি হওয়ায় আমি একটু নার্ভাস হয়ে
পড়েছিলাম, যে কারনে সংখ্যাটি নিয়ে দ্বিধা তৈরি হলো। পুলিশের খাতায় চারটেই
লেখা হলো।
ফলে, সন্দেহ ও কৌতুক নিয়ে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে হাজতে নিয়ে গেল।
আমার সঙ্গে যে ছোট হাতব্যাগটি ছিলো, তার মধ্যে তন্ন তন্ন করে কিছু একটা
খুঁজলো তারা। তাদের হাতানোর ভঙ্গিটি বলছে, তারা আসলে কি খুঁজছে সে বিষয়ে
তারা নিজেরাও নিশ্চিত নয়।
আমি মাদক নেই না, অতএব তেমন কিছু যে পাবে না তা তো জানা। অস্ত্র নেই,
পরিধেয় বস্ত্র নেই, চিরুণি আয়না চশমার খাপ—কিছুই নেই। এমনকি দেয়াশলাই কিংবা
সিগ্রেটের প্যাকও। একটা পতন্ডুলিপি ছিলো, দর্শনের নতুন যে বইটি লিখছিলাম,
তার। ওরা পান্ডুলুপিটি নেড়েচেড়ে দেখলো, পুলিশের এসআই বললেন—বইটি সম্ভবত
রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কিছু হবে।
রাষ্ট্র সবসময়ই এত সন্দিহান কেন থাকে আমি জানি, এজন্যই ''সম্ভবত" শব্দটি তার খুব প্রিয়।
প্রশাসনের তৎপরতায় আমি মুগ্ধ। আধাঘন্টার মধ্যেই আমাকে নেয়া হলো ডিবি অফিসে,
তারও ঘন্টাখানেক বাদে এলো প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট। এদেশে এত দ্রুত কাজ হয়
জেনে আমি খুশি হলাম, স্বভাবসুলভ কারনেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম সাধারণ মানুষ
এসবের সুফল পাচ্ছে কিনা!
তদন্ত রিপোর্টটি বেশ চমৎকার। আমার পকেটে পাওয়া চারজন মানুষের একজন ধর্ষক, একজন খুনি, তৃতীয়জন আত্মহত্যা করেছেন এবং শেষেরজন নিখোঁজ।
বললাম—ধর্ষকটি আমার ভাতিজিকে রেপ করেছিলো। তারা আমাকে প্রশ্ন করলো—আপনি সাহায্যকারী ছিলেন না তো!
একজন দার্শনিক এবং গল্পকার হিসেবে আমাকে যথেষ্ট সময় নিয়ে মানুষ পড়তে হয়। এই চারজনকে পড়ছিলাম কদিন ধরে।
যেহেতু আমি ধর্ষনের কারন বলতে পারছি না, খুন কিংবা আত্মহত্যার পেছনেও আমার
কোন ভূমিকা নেই—সেহেতু আমি কোন সদুত্তর দিতে পারিনি। কোর্টে আমার আইনজীবিও
কিছু বলতে পারলেন না। রাষ্ট্রপক্ষ হেসেখেলেই অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিলেন এইসব
মানুষের পরিনতির পেছনে আমার হাত আছে। ফলে বিচারক একটু মুচকি হেসে আমার
মৃত্যুদন্ডাদেশে সই করে কলমটা ভেঙে ফেললেন। মনে হলো তিনি খুব তৃপ্ত, অবশ্য
রাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে পারা আসলেই তৃপ্তিকর একটি ঘটনা।
আমার ফাঁসির আয়োজনটিও বেশ রাজকীয় ছিলো। তখন গলায় ফাঁস আর পিছমোড়া করে বাঁধা
হাত নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি ফাঁসিমঞ্চে। হঠাৎই মনে হলো আমার সামনে এসে
দাঁড়িয়েছেন—ঈশ্বর অথবা শয়তান। তার মুখে চওড়া একটা হাসি। যদিও, আমার ধারনা
এটা নিতান্তই হ্যালুসিনেশন। কেন না আমি কোনদিনই ধর্মে বিশ্বাস করিনি।
যুক্তি ও দর্শনই আমার কাছে ঈশ্বরপ্রতিম।
জানতে চাইলাম, আপনি কে?
সে বললো, আমি রাষ্ট্র। একটু বিরতি নিয়ে সে আবারও বলতে লাগলো, Mr.
Philosopher. You are such an idiot! You don't know, Every man has two
options. He may agree with the state or go to hell.
***
নারী দিবস
—কি গো, তোমার রান্না শেষ হতে কতক্ষন লাগবে আর? প্রোগ্রামে যেতে হবে।
আয়নার সামনে চুলে চিরুণি চালাতে চালাতে হাঁক ছাড়ে সুলতান।
—এই তো হয়ে গেছে প্রায়। আজ আবার কিসের প্রোগ্রাম?
রান্নাঘর থেকে গলা বাড়িয়ে জানতে চায় সুফিয়া।
—বিশ্ব নারী দিবসের অনুষ্ঠান। একটু তাড়াতাড়ি করো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সুলতান মাহমুদ স্থানীয় ডিগ্রী কলেজের লেকচারার, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে যুক্ত।
খেতে বসে সুফিয়া কৌতুক করে বলে, তা নারী দিবসের অনুষ্ঠান যেহেতু আমাকেও নিয়ে চলো না! নারীজীবনের দুঃখ দুর্দশার কথা বলে আসি গিয়ে।
—তুমি তোমার কাজ করো। ঘর সামলাও। বুঝলে!
খাওয়া শেষ করে তড়িঘড়ি বের হয়ে যায় সুলতান, মনে মনে আওড়াতে থাকে বক্তৃতায় কি কি বলবে।
তার পেছনে সুফিয়ার দীর্ঘশ্বাসটি সুলতানের জুতার শব্দে চাপা পড়ে যায়।