মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান-এর কবিতাগুচ্ছ
মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান-এর কবিতাগুচ্ছ
দুর্ভাগ্য

কথার ভাজে কত কথা যে চাপা পড়ে গেছে,
সে আর বলতে
ক্লাসে বসে থাকতে টিফিন পিরিয়ডে
কিন্তু কোনো কথা বলতে না
কত কিছু বানিয়ে বানিয়ে তোমাকে বলেছি —
একবার একটা পরী এসে আমাকে
ওদের দেশে নিয়ে গিয়েছিলো
পকেট থেকে গোলাপ পাপড়ি
বের করে তোমাকে দেখলাম
শুধু হাসলে,
পাপড়ি গুলো হাতের মুঠোতে দিয়ে,
চলে এলাম
কিছু বললে না
পিছু ডাকলে না
এভাবেই একদিন শেষ হয়ে এলো
পড়াশোনার পাঠ ...
বিদায় না জানিয়েই বাড়ি চলে গেলে
এবার অনেকগুলো রক্ত গোলাপ রেখেছিলাম,
সাথে দুঃসাহসী এক চিঠি —

এইটুকু বলে, থেমে গেলেন,
দুটো ঔষধ খেলেন গ্লাস ভর্তি জলে
হাঁপাচ্ছিলেন
বললাম, কি হয়েছে আপনার ?
উত্তর দিলেন না
উদ্ভ্রান্তের মতন তাকিয়ে রইলেন জানালার দিকে
খানিকক্ষণ বাদে, বললেন
বড়ো ভালো হতো
যদি আগেই চলে যেতে পারতাম
... ওরা ওকে নিয়ে গিয়েছিলো
পরে সব জেনেছি আমি
বিয়ে ঠিক হয়েছিল
এক মহাজনি কারবারির সাথে
অঢেল সম্পদ, প্রভাব,
ঠিক জমিদারদের মতো চালচলন
পারমিতা একটা চিঠি দিয়েছিলো
যাবার আগে
আমার হাত অবধি পৌঁছায়নি
সৌমিত্রের মা মারা যায়,
তাই ওর আর খেয়াল ছিল না
চিঠিতে লিখাছিলো —

সুজনেষু,

তোমার সেই গোলাপ পাপড়ির পরীকে আমি শুরু থেকেই চিনি, পাছে তোমার লেখাপড়া নষ্ট হয় বলে এতদিন কিছু বলিনি, অপেক্ষা করেছি । ওরা আমায় জোড় করে নিয়ে যাচ্ছে, তোমায় ছাড়া কি করে থাকবো জানি না ।

ইতি
তোমার পারো

অনিমেষ বাবু এটুকু বলে বিছানায় ঢলে পড়লো
শ্বাস চলছিলো না
ডাক্তার এসে বললো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া
বন্ধ হয়ে তিনি এই ধরিত্রী ত্যাগ করেছেন
বাড়ির চাকর দিবাকর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে
আমি বললাম বাবু আর নেই রে
পারমিতা দিদি কোথায় থাকে কিছু জানিস ?
তাকে তো খবরটা জানাতে হবে !
দিবাকর অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো কেন —
তিনি তো বিয়ের রাতেই গলায় দড়ি দিয়ে ছিলো !

টেলিফোন

টেলিফোনটা বেজেই চলছে
১৯৭৪ সাল
চারদিকে শুধু দুর্ভিক্ষ
ব্রহ্মপুত্রের পানি উপচে পড়েছে
ভেসে যাওয়া মানুষের লাশের গন্ধ কি নির্মম
জয়নুলের ছবি মানুষের শুষ্ক দেহ ঠুকরিয়ে
কাক খাচ্ছে, পাশে কুকুর, একটা ডাস্টবিন
কঙ্কালসার দেহ যেন
কোনো এক মা মেরি নিয়ে বসে আছে
পিয়েতার কথা মনে পরে যায় ;
টেলিফোনটা বেজেই চলছে
কে হতে পারে ওপারে ?
অবিনাশ !
ও তো আর কথা বলবে না বলেছে
তাহলে কি শশাঙ্ক ?
এই ভর দুপুরে কে হতে পারে ?
নির্মলা শাড়িটা সামলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো
না আর কোনো শব্দ নেই
তাহলে কি টেলিফোনটা বাঁজছিলো না ?
আমার মনের ভুল ?
অবিনাশ গেছে দুর্ভিক্ষের জন্য
লঙ্গরখানায় কাজ করতে
শশাঙ্ক তো বিলেত থেকে ফেরার কথা
বাবা বলেছে ও ফিরলেই আমাদের নাকি বিয়ে !
অবিনাশকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না
যাবার ক’দিন আগে বললো, ভুলে যেও
পারো যদি মুছে ফেল সব চাওয়া
পাওয়া হবে না এ জীবনে আর
যা কিছু সোনার মতো দামি
হীরের আংটি আমি কোথায় পাব ?
আমার যে আধবেলা খাবার জোটে না
খবরের কাগজে চাকরি এক বিভীষিকার নাম
বৈষম্যকে জোড়াতালি দেবার
পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ
সম্পাদক খোঁজে খবর
আমাদের খবর রাখে কে ?

নির্মলা ভাবে
কেন এই অবিনাশকেই তার এতো পছন্দ ?
কেন ভালোবাসা লাগামহীন একটা পাগল ঘোড়া ?
শশাঙ্কর তো সব আছে
বনেদি পরিবার
এই দুর্ভিক্ষে ওদের চালের বড়ো আড়ত লুট হয়েছে
খাবারের জন্য মানুষের হাহাকার
উৎসিষ্টও নেই কোথাও
অনেক রাস্তার কুকুর মরে গেছে
টেলিফোনটা আবার বেজে উঠলো
সত্যি তো বাজছে
— হ্যালো
নমস্কার, নির্মলা দেবীকে চাইছিলাম
— হাঁ বলছি
আমার নাম সামন্ত, অবিনাশ আমার বন্ধু
— ও কোথায় আছে এখন ?
কোথাও নেই
— বুঝিনি, কি বলতে চাইছেন
ও আর নেই, আজ ভোরে কলেরায় ...
সৎকার করে খবরটা জানালাম আপনাকে

একটা শব্দ হলো, নির্মলা মেঝেতে
পাশের ঘর থেকে ওর মা এসে দেখলো
নিথর একটা দেহ পরে আছে শুধু
বিকেলের জানালার কার্নিশে
দুটো শালিক মরে পরে আছে ।

ভালোবেসো না আমাকে

আমাকে ভালোবেসো না
ভালোবাসলে,
না পাওয়ার অধিক ব্যথায় কাতরাবে
ভালোবাসো
ফুল, পাখি, নদী
মাটি ও মানুষ, ভালোবাসো
পাল তোলা নৌকার মাঝি যখন ভাটিয়ালি গায়
ভালোবাসো, সুনীলের কবিতা, সাথে চায়ের চুমুক
বিষাক্ত সিগারেটের টান — ওতে ক্যান্সার হয়
আমাকে ভালোবেসো না
কেননা আমি তোমার নই
আমি কারো বাবা, ভাই, দাদা, ছেলে, স্বামী
বন্ধু, এমনকি প্রেমিক নই
হওয়া সম্ভব নয়
নিয়তির কাছে সঁপে দিয়েছি আমার মন
চাওয়া, পাওয়ার ভেতর তফাৎ অনন্ত বিস্তারি
ভালোবেসো না আমাকে
সময় পেরিয়ে যাবে, ভোর হবে না কোনো দিন
অন্ধকারকে কে বেসেছিলো ভালো, কবে ?
ওই যে আকাশ, তাকে ভালোবাসো
মেঘের দিনে মুখটা বাড়িয়ে দিও
বৃষ্টির জল সব কান্না ধুয়ে দিবে ;
এখনো শহরে শহরে ভবঘুরে পালিয়ে বেড়ায়
দেখবার কেউ নেই
কেউ তাদের ভালোবাসেনি
রাস্তার টোকাইটা নেশা করে বুঁদ
খাওয়া নেই, ভাবনা নেই জীবনের
কত কত মানুষের কোনো দাম নেই
প্রানের কি নিদারুন অপচয় !

ভালোবেসো না আমাকে
ভালোবাসলে,
পেয়েও পাবে না আমাকে !

আত্মহত্যা

যখন বলো, ভালোবাসি
আত্মহত্যার তারিখটা পিছিয়ে দেই
এভাবেই বেঁচে থাকতে থাকতে
বিব্রত আমি
মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরি প্রতিদিন
বয়স যায় বেড়ে
ছুঁতে পারিনা তোমার আঙুল,
মুখের অবয়ব, চুলের ফাঁক ফোঁকর গুলো
হাঁতড়ে না পাওয়াগুলো আশফাশ করে
হুহু করে বেড়ে ওঠে জ্বর ...
তবুও এভাবেই কতটা সময় পেরিয়ে এলাম
তুমিও পারলে না ভুলে যেতে
পারলে না পাশকাটিয়ে, যা কিছু বাস্তব
তারপরও কেন বলো, ভালবাসি
ঐটুকুতে কি আর হয় ?
আত্মহত্যার তারিখটা পিছিয়ে দেই
আকাশের মরা চাঁদটাকে দেখি
একা একাই ঘুমাই
একাই রাত ভোর করি
সকালের কাগজ পড়ি
... পেঁয়াজের দাম ঝাঁজালো হয়েছে
দুইশত টাকা কেজি
দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হবে নাকি ?
কোনো মন্ত্রী পদত্যাগ করবে ?
না, কিছুই হবে না
ট্রেন দুর্ঘটনায় মানুষ মরেছে ...
রেলে ভর্তুকি চলছে ...
অদৃশ্য কারা জানি চক্রান্ত করছে
বিদেশী শত্রু ...
রাজনীতির কিছু বায়বীয় ভাষা আছে ;
কার জানি প্রেম কাহিনী ফাঁস হয়েছে ...
সোশ্যাল মিডিয়া কেঁপে উঠেছে ...
জুকারবার্গ মিটিমিটি হাসছে ... রেভিনিউ বাড়ছে
... কার জানি বউ বিয়ে করেছে ... ?
গাম্বিয়া মামলা ঠুঁকেছে ... গণহত্যা !
মায়ানমার ঘুমাচ্ছে
বাটপার রাষ্ট্রের ছায়া আছে
আছে টাকার গন্ধ ... তেল, গ্যাস,
আরো কতো কিসের খনি আছে রাখাইন রাজ্যে ...
ভালোবাসা, আবেগ আর রাজনীতি এক নয়
যে রাজনীতি ভালোবাসে
সে মানুষ ভালোবাসে না ...
জ্বরটা কমে গেছে
চায়ে চুমুক দিয়ে ফোনটা হাতে নিলাম
একটা নীল প্রজাপতি উড়ে গেলো
দেয়ালে সজোরে ধাক্কা খেয়ে মেঝে পরে গেলো
ঠুনকো জীবন, বিধাতার সৃষ্টি
অথচ রহস্যে ঘেরা ...
কেন নিউফাউন্ডল্যান্ড কুকুর
আত্মহত্যার জন্য জলে ডুবে মরে ?
কেনোইবা মানুষেরা আওকিগাহারা জঙ্গলে
মৃত্যুর স্বাদ নিতে যায় ?
তুমি আমার কাছে নেই
এর থেকে বড় কষ্ট আর কিছুই নয়
আমি ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র, বিশ্ব সংসারের
সবকিছুতে আমার কিছুই করার নেই
শুধু তুমি ভালোবাসি বললেই
আত্মহত্যার তারিখটা পিছিয়ে দেই ...
ফোনে পাচ্ছি না
শান্তি মিশনে কোথায় কোন
গোলাবারুদের ভেতরে আছো
আফ্রিকা এক বিচ্ছিন্ন মহাদেশ
বিশ্ব রাজনীতির কোন চালে চলছে
ঐসব উগ্রবাদী অথবা জাতিগত দাঙ্গা ...
দরজায় কড়া নাড়ছে কে জানি
এতো সকালে আবার কে এলো
একটা জীপের শব্দ, বুটের শব্দ
ঘোরের মতন লাগছে
শরীরটা ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছে
দরজাটা খুললাম
ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসেছে, বললো
ওখানে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছিলো
তোমার লাশটা আজ রাতে দেশে আসবে ।

আত্মহত্যার তারিখটা আর পেছাব না !

আমার কিছু বলার ছিলো

আমার কিছু বলার ছিলো
থমকে গেছি বহুবার
বহুবার আয়নার সামনে বিড়বিড় করে
ট্রায়াল করেছি, অঙ্গভঙ্গি, চুলের ভাঁজ
করেছি ঠিকঠাক
মতিঝিল থেকে একটা ব্ল্যাক কোট কিনেছি
তিনশ টাকায়
সাথে একটা একশ টাকার সাদা শার্ট
আমার আর সুখেনের জুতোর মাপ একই ছিল
ওর নতুন সু’ খানা ধার করেছি
তারপরও বলতে পারিনি ক-থা-গু-লো
“... তোমায় আজ খুব সুন্দর লাগছিল ...”
নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট আমরা আজ নিঃস্ব
পৃথিবীর সব সম্পদ কায়দা করে লুটে
নিয়ে গেছে — নামে বেনামে —
প্রলেতারিয়েত থেকে প্রিক্যারিয়েত
পকেট আজ শুন্য
দামি ডিগ্রি আছে — চাচা নেই মামা নেই —
চাকরির নামে তিন জনের কাজ একজনের
তাদের সুপারম্যান চাই !
তাহরির থেকে তাকসিম — আন্দোলন, ধরপাকড় বাঙ্কসির গ্রাফিতি
যুবকের পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের বদলে ফুলের তোড়া
শাহাবাগ কিনে নিয়েছে সরকার —
সুবোধ হারিয়ে গেছে অথবা ধরে নিয়ে গেছে
উর্দিপরা লোকেরা ... যেমন হারিয়েছে কল্পনা চাকমা
হারিয়েছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর
আমি হারিয়েছি তোমাকে
আমার তুমি নেই, তাই কিছুই নেই

আমার কিছু বলার ছিলো
থমকে গেছি বহুবার
আজ আমি বলবো, তুমি শুনবে
এখানে কোনো বায়ুদূষণ নেই
দিল্লি বহুদূর, ঢাকা ঢেকে গেছে ধুলার চাদরে
রাজনীতিবিদদের স্বপক্ষে যুক্তি আছে
তারা জীবৎদশায় কোনো ভুল করেনি
তারা নির্ভুল
আমি নির্ভুল নই, ভুল হয়েছে
আগেই বলা দরকার ছিলো, সাহস ছিলনা বলে
আজ এই তাড়ণার হাহাকার
এখানে বস, তোমার চুলগুলো আলুথালু
চোখে বিস্ময়, মনের ভেতর বিষন্নতা
পরনে সাদামাটা সালোয়ার-কামিজ
ছোট্ট একটা ফুটফুটে বাচ্চা, ডিভোর্সড
বাবার নেই, ভাইয়েরা দখলে নিয়েছে সবকিছু
মেয়েদের অধিকার নেই
এই নাও তোমার কাপাচিনো কফি
খুব পছন্দ করতে এক সময়
এক সময় আমরা ক্লাসে অপলক
তাকিয়ে থাকতাম
সবাই বলতো এদের রসায়ন চলছে
মনে আছে তোমার, তুমি গাড়ি করে আসতে
একদিন বৃষ্টিতে রিক্সায় এলে
ভিজেই গেছো, শরীরে লেপ্টে ছিল শাড়িটা
ভেজা চুলে মুখের অবয়বটা লুকোচুরি করেছিলো
অনেকের চেহারাটা ছাড়া কিছুই নেই
ফেইসবুক জুড়ে থাকে বাহারি ঢঙের ছবি
বাজারি সংস্কৃতি
সৌন্দর্যটাই যখন যোগ্যতা —
তখন মনের খবর কে রাখে ?
তোমার রুচি ছিল, নানান বিষয়ে মতামত ছিল
নিজস্ব ভাষা ছিল, দক্ষতা ছিল অজস্র বিষয়ে
দেশ বিদেশের খবর রাখতে
চিৎকার করতে মিছিলে — মানবতা থমকে গেলেই
তোমার মতন আর কেউ নেই
এতো বৎসর আমি তোমার জন্যেই অপেক্ষা করেছি
আমার পরনে এরমেনযিলদো, মাইবাহ গাড়ি
আরো কত কি !

আমার কিছু বলার ছিলো
থমকে গেছি বহুবার
আজ আমি থামবো না, থমকে যাব না
কফিতে চুমুক দাওনি
ওটা ঠাণ্ডা হলে ভালো লাগবে না
একটা ডানহিল ধরাই
কথাটা বলেই ফেলি
... আ-মি তোমাকে ভা-লো-বা-সি বহুকাল ধরে ..
সুপর্ণার চোখ গড়িয়ে জল পড়তে লাগলো ...


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান