শেষ বিকেলের গান
অনেকগুলো বিকেল বেচে কিনেছি একটা বিকেল
অগণিত রাতের বিনিময়ে কিনেছি একটা বিকেল
সহস্র ভোরের বিনিময়ে কিনেছি একটা বিকেল
শুধু তোমার জন্য।
সেই বিকেলে জলেশ্বরীর পাড়ে দূর্বাঘাসের ওপর বসবো দু'জন
গোধূলির রঙ মেখে পাখিদের চোখে খুঁজবো নীড়ে ফেরার মায়া
একদিন বিকেলে ঘর-গেরস্থালীর কাব্য শুনবো পাখিদের ঠোঁটে
অতঃপর পূজার ঢালিতে রক্তজবার হাসি দেখবো
এবং তোমার সিঁথিতে ছুঁয়ে দিবো রক্তিম সিঁদুর,
তারপর যেদিকে চোখ যায় আমি চলেই যাবো...
সেই বিকেলের পর তুমি তোমার চোখে অযুত বিকেল জমিয়ে রেখো
জল জোছনায় সাঁতার কেটে কেটে রতি সুখ খুঁজে নিয়ো
অন্য বুকে অন্য মায়ায়।
শোনো, মায়া-
অস্তগামী সূর্যের ডাক আমি উপেক্ষা করবো না আর।
ছুঁয়ে দাও জেগে ওঠবো
ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে
আমার মুমূর্ষু দমগুলো পরিযায়ী পাখি হতে চাচ্ছে
পাখিগুলো খাঁচা ভেঙে উড়াল দিতে চাচ্ছে
আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে লিখতে চাচ্ছে আমার মৃত্যু সংবাদ
ইন্না লিল্লাহি- ধ্বনি তুলতে চাচ্ছে উত্তরের হাওয়া
সারাদিন গা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে কার ভাল্লাগে?
বলো।
রোগীর বালিশের পাশে কমলার ঘ্রাণও অসহ্য লাগে
অসহ্য লাগে সূর্যের আলো, জোছনার নীল ঢেউ
বিস্তৃত আকাশ, উচ্ছ্বল নদী, স্বপ্নালু সবুজ ও তেপান্তর
কিচ্ছু ভাল্লাগে না।
ডাক্তারের চেম্বারে অপরাধীর মত বসে আছি
প্যাথলজি বিভাগ থেকে রিপোর্ট এসেছে
সব রিপোর্টই- পজেটিভ!
অথচ
তুমি নামের এক মহাঅসুখের সন্ধানই পায়নি ডাক্তার!
একবার এসে যদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে,
'কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি আছি না?'
আমি হুড়মুড় করে অসুখ থেকে সেরে ওঠতাম, মায়া।
কথাদের করাঘাতে চৌচির হয় হৃদপিণ্ড
লাশকাটা ঘরে কাটা হচ্ছে ছেলেটার নিথর দেহ
ছুরি, কাঁচি, হাতুড়ি ও বাটালির টুসটাস শব্দে
কাটা হচ্ছে ছেলেটার পাঁজরের হাঁড়গোড়,
বুকের ছাতি খুলে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ডোম-
ছেলেটার বুকের ভেতর পুঞ্জিভূত কথাদের হাসফাঁস
বুকের চার দেয়ালে কথাদের বিশ্রীরকম করাঘাত
অলিন্দে অলিন্দে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ
পোড়া ফুসফুস
জলশূন্য চৈত্রের মাঠের মত চৌচির হৃদপিণ্ড...
অতঃপর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ডাক্তার লিখে দিলেন-
কথা বলার মানুষের অভাবে ছেলেটা মারা গেছে।
সানগ্লাস
সানগ্লাস পরলে পৃথিবীর রঙ পাল্টে যায়
প্রজাপতির বর্ণিল ডানার রঙ পাল্টে যায়
বিস্তৃত চা বাগানের দু'টি পাতা একটি কুঁড়ির রঙ
আকাশের রঙ, মাঠ ও অরণ্যের রঙ পাল্টে যায়,
পাল্টে যায় দিন ও রাতের আলোর পার্থক্য।
কেবল তুমি স্থির ক্যানভাসের মত
ঝুলে থাকো আমার চোখের তারায়।
তোমার কোনো রঙ আর পাল্টায় না
তুমি আরো ঘন হয়ে বসো আমার মনে; সংগোপনে।
সানগ্লাসকে কেউ কেউ রোদ চশমা বলে,
আমি বলি- কান্না লুকানোর আড়াল।
অতঃপর একদিন
একদিন
আমি দু'হাতে সরিয়ে দিবো সমস্ত বেদনা
এক পলকায় মুছে দিবো কষ্টের জলছাপ
একদিন
আলগোছে সরিয়ে দিবো তোমার অবহেলার পাহাড়
এক ফুঁৎকারে তুলোর মত উড়িয়ে দিবো
তোমার ছোঁড়া ঘৃণার তীর
সারিয়ে তুলবো তুমি নামের মহাঅসুখ
আমার এইসব রাত জাগা;
তুড়ি মেরে তাড়িয়ে দিবো অন্ধকারের গোপন যন্ত্রণা।
সেদিন
এসব দেখে তুমি ভিমরি খাবে- জানি,
হঠাৎ আমার চলে যাওয়া তোমাকে কাঁদাবে নিশ্চিত।
আবার আমাদের দেখা হবে
অন্য একটা প্লাটফর্মে
অন্যরকম শেষ বিকেলে
তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে।
অন্য একটা মানুষ পাশে
তোমার পাশে মুচকি হাসে
অন্য অনুভবে।
অন্য আমি অন্য মনে
তোমায় খুঁজি সংগোপনে,
অন্য তুমি অন্য চোখে
কারে খোঁজো মনে মনে?
অন্য ট্রেনে হঠাৎ চেপে
অন্য পথের দৈর্ঘ্য মেপে
অন্য তুমি যাবে চলে,
অন্য আমি অন্য ব্যথায়
বন্য আমি হারাই কোথায়
ভিজে চোখের জলে?
মায়া-বিষ
চায়ের কাপের টুংটাং শব্দ থেমে গেলে
কাপ থেকে উড়ে যায় ধোঁয়ার কুণ্ডলি
ঘড়ির কাটায় চক্রাকারে ঘূর্ণনমান লাল রঙ
স্থির হয়
লিকারের তলানিতে জমা হয় খয়েরি রঙের চা-পাতি।
চুমুকে চুমুকে একবুক তৃপ্তি নিয়ে ফের তুমি ওঠে যাও
টং দোকান ছেড়ে তুমি হেঁটে যাও অন্য কোনো পথে
চলতি পথে ফের তুমি খুঁজে নিবে টং দোকান; রঙ চা।
চায়ের কাপের তলানিতে ফের জমা হবে চা-পাতি;
নিঃশেষিত চা-পাতি দোকানী ফেলে দিবে উচ্ছিষ্টের স্তুপে।
মানুষের উড়াল স্বভাব;
পাখির মত মানুষও চলে যায় একদিন
চা-পাতির মত মানুষের বুকেও মায়া জমে
সেই মায়ায় বিষ আছে জেনেও মানুষ মায়া ছুঁড়ে ফেলে না
বরং মায়াগুলো নিয়ে মানুষ নাড়াচাড়া করে
হাসি মুখে চেটেপুটে খায় মায়া-বিষ;
স্মৃতির বিষে নীল হয় অহর্নিশ!
সুনন্দার চোখে জল
প্রচণ্ড হিংস্রতায় তুমি আমাকে বললে, 'চলে যাও।'
বুঝলাম- বসন্ত উৎসবে পাতা ঝরা দিন এসে গেছে
আমি চলে যাচ্ছি, সুনন্দা।
আমি আর আসবো না তোমাদের পাড়ায়
ভরদুপুরে দাঁড়িয়ে থাকবো না গলির মাথায়
সূর্যের প্রতিহিংসায় আমি আর পুড়বো না গলগলে রাস্তায়।
তোমাকে এক পলক দেখার তৃষ্ণায়
জমিরের টংদোকানে বসবো না আর,
আমি আর পোড়াবো না নির্লিপ্ত নিকোটিন
চায়ের কাপে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া; অযুত প্রতীক্ষায়।
আমি চলে যাচ্ছি, সুনন্দা।
যতটা অবহেলা তুমি আমাকে দিয়েছো জ্যামিতিক হারে
যতটা ঘৃণায় ছিঁড়ে দিতে চেয়েছো বিশ্বাসের হাওয়াই ঘুড়ি
সবটুকু পাঁজরের নিচে লুকিয়ে আমি চলে যাচ্ছি
একলা একা এই রাঙামাটির দীঘলপথ হাঁটা বড্ড ক্লান্তিকর
বেরসিক কোকিলের কুহুতানও ভেঙচি কাটছে ভরদুপুরে
আমি চলেই যাচ্ছি।
এ কী সুনন্দা! তুমি কাঁদছো?
তোমার চোখের টলমল জলই সাক্ষ্য দিচ্ছে...
তুমি আমাকে ভালোবাসো
ভীষণরকম ভালোবাসো
বড্ড বেশি ভালোবাসো।
সুনন্দা, তোমার চোখে জল!
সুনন্দা, আমার চোখেও জল।