মনুষ্যত্বববোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মনুষ্যত্বের কার্যকর উপস্থিতির মধ্যেই ‘মানুষ’— এর প্রকাশ। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি–রহস্য, একটুখানি সহায়তা, একটু স্নেহের বাক্য, অসহায়ের প্রতি একটুখানি দয়া প্রদর্শন, একটুখানি নম্রতা, একটুখানি সৌজন্যতাই মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। ‘মানুষ’ জন্মগত ভাবে ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–“ভালো–মন্দের দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে ভালোকে বেছে নেবে বিবেকের দ্বারা, প্রথার দ্বারা নয়—এই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ জুড়ে ছিল মানুষ, মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা। তার সাথে তিনি আরো যুক্ত করেছেন বিশ্ববোধ। বিশ্বমানবতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ।
র্রবীন্দ্রনাথের সমাজ পরিবর্তনের ভাবনা
ছিল গভীরভাবে মানবিক ও অধিকার পরিপ্রেক্ষিত-নির্ভর।
জমিদারি পরিচালনার কাজে তিনি এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি
এসে তিনি সমাজের নানা অসঙ্গতি ও সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্দশা হৃদয় দিয়ে
অনুভব করার সুযোগ পান। প্রজাদের অভাব ও দুঃখ দূর করার জন্য নানা প্রাতিষ্ঠানিক
উদ্যোগ ও জীবনঘন সামাজিক সংস্কারে তিনি হাত দেন। শিলাইদহ ও পতিসরে কৃষি উন্নয়ন, কুটির শিল্পের
প্রসার, শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, পূর্তকর্ম,
স্বাস্থ্যসেবা, সালিশ বিচারসহ
অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজে নিজের উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা ও অর্থের সম্মিলন ঘটান। নিজের
সন্তান, বন্ধু ও
আত্মীয়দের পর্যন্ত এসব কর্মে যুক্ত করেন। এসব কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতায় শান্তিনিকেতনে
শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিটি ক্ষেত্রের মূলে ছিল মানুষের সম্মিলন। মণ্ডলী, হিতৈষীসভা কিংবা
সমবায় সমিতি যে নামেই জানি না কেন,
প্রতিটি উদ্যোগেই ছিল মানুষের সংগঠিত প্রয়াসের প্রতিফলন। তিনি যে সাধারণের হিতাকাঙ্খী এবং
তাদেরই একজন সে কথা বলতেও ভুল করেননি। পরিচয় কবিতায় তাই তিনি লিখেছেন,
মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়,
এই হোক শেষ পরিচয়।
লোকসাধারণের কল্যাণের জন্যেই রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষকে একত্র করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, মানুষ সংগঠিত হলে উন্নয়ন সহজ হয়। সেজন্যই তিনি ১৯০৪ সালে লেখা ‘স্বদেশী সমাজ ’ প্রবন্ধে ‘সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। শিলাইদহে সমগ্র এলাকাকে কয়েকটি মণ্ডলে ভাগ করে কবি সমবায়ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করেন। যদিও তা পরবর্তীতে নানা কারণে বেশি দূর এগোয়নি। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে গঠিত ‘শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী সমিতি’, শিলাইদহে ‘পল্লী সমিতি’, পতিসরে ‘লোকসভা’, ‘ মণ্ডলী’, ও ‘ হিতৈষীসভা’ পল্লীমঙ্গল সমিতি , পল্লীশ্রীনিকেতন সহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।
এসব ভাবনা ও উদ্যোগের পেছনে রবীন্দ্রনাথের সাধারণ জনগণের
কল্ল্যান কামনার চিন্তা ছিল একেবারেই মৌলিক ও সৃজনশীল। তাঁর সেই ভাবনার অন্তর্নিহিত সুরটি ধরতে পারলে আমাদের সমকালীন উন্নয়নভাবনাকে আরো মানবিক ও অধিকারভিত্তিক করার তাগিদ অনুভব
হবে বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর ‘কালান্তর’ পর্বের ‘
লোকহিত’ প্রবন্ধটি সকল
অর্থেই একটি যুগান্তরী রচনা। এখানে তিনি এমন কিছু মৌলিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা
বর্তমানের সমাজ ভাবনাকেও সমানতালে প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা রাখে।
আজকাল প্রতিটি রাজনৈতিক দলই জনহিতকর কাজের দীর্ঘ তালিকা দিয়ে থাকে। নির্বাচনী
ইশতেহারে দলগুলো
এখন আরো সুপরিকল্পিতভাবে এসব লোকহিতকর চিন্তাকে তুলে ধরে। উন্নয়নের ফর্দ এখন নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান অংশ। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে এই ভাবনার মূলে যেন নাগরিক সমাজের অধিকারের ও জনগণের বিষয়টি শক্ত করে প্রোথিত থাকে সে শিক্ষাই আমরা পাই রবীন্দ্রচিন্তা থেকে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, পরের উপকার করার জন্যে প্রথমেই অধিকার অর্জন করা চাই। ‘মানুষ কোনোদিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে।’ (লোকহিত, রবীন্দ্র রচনাবলি (রর), দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৫৪৮)।
এখানে
‘প্রাপ্য’
শব্দটির মধ্যেই অধিকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। তাঁর মতে
লোকসাধারণকে সকল অর্থেই ছোটো জ্ঞান করে,
অনুগ্রহ প্রার্থী মনে করে দৃশ্যমান হিত করার মাঝে মানুষের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষতই
করা হয়। এতে করে তাদের বরং আহতই করা হয়। যারা প্রকাশ্যে হিত করার আত্মাভিমানে মত্ত তাদের
জন্যে রবীন্দ্রনাথের বার্তাটি হচ্ছে যে,
‘হিত করিবার একটিমাত্র ঈশ্বরদত্ত অধিকার আছে, সেটি প্রীতি। প্রীতির দানে কোনো অপমান নাই কিন্তু হিতৈষীতার
দানে মানুষের অপমান হয়। মানুষকে সকলের চেয়ে নত করিবার উপায় তাহার হিত করা অথচ
তাহাকে প্রীতি না-করা।’ (
ঐ, পৃ.
৫৪৮)
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের ডেকেও ভালো সাড়া না পাবার প্রসঙ্গ টেনে
রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন যে সেটিই ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কেননা, দীর্ঘদিন
উপেক্ষিত মুসলমান সমাজকে প্রীতির ডাকে সাধারণ সামাজিকতাটুকু পালন করেনি সে সময়ের
সমাজের নেতৃস্থানীয়রা। হৃদয়ে আঘাতপ্রাপ্ত মুসলমানকে হঠাৎ ‘ভাই বলিয়া
’ ডাকলেও
প্রত্যাশিত সাড়া মেলার কথা নয় বলে তিনি লিখেছেন।
এই উদাহরণ শুধু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্যেই প্রযোজ্য নয়। সমাজ আজ যেভাবে
অভিজন ও অভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাতে আর্থ-সামাজিকভাবে
উপেক্ষিত শেষাংশকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে না পারলে তাদের জন্য বাহ্যিক হিত করার
মাধ্যমে সামাজিক শান্তি বজায় রাখা বেশ কঠিনই হবে। ভদ্রলোকের মনে যতক্ষণ পর্যন্ত এই
মৌলিক ব্যর্থতার চিন্তা না অনুপ্রবেশ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত দুই বর্গের মানুষের মাঝে
শান্তির সম্পর্ক স্থাপন করা নিঃসন্দেহে সহজ হবে না।
প্রকৃতপক্ষে যে মানুষ অপর মানুষকে সম্মান করতে পারে না, সে মানুষকে উপকার
করতে অক্ষম। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাশিয়ার
চিঠিতে লিখেছেন শিক্ষাই সবচেয়ে বড় রাস্তা যা মানুষকে সম্পূর্ণতা এনে দেয়। কেবল রাশিয়ায়
নয়, মধ্য
এশিয়ায়ও বন্যার বেগে বিজ্ঞানভিত্তিক মানবিক শিক্ষার বিস্তার হয়েছে। কবি ভারতবর্ষের
সম্ভাবনা ও বাস্তবতার সাথে এইসব অঞ্চলের মানুষের উচ্চ মানবিক চেতনা উন্নয়নের
প্রয়াসের ব্যবধান অনুভব করে আহত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমাদের সকল
সমস্যার সবচেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ
সুযোগ থেকে বঞ্চিত-ভারতবর্ষ
তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে (রাশিয়ায়)
সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়
তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এই জন্যে কী
প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। আমরা শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি এরা সমস্ত দেশ
জুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে। আমাদের কর্মীরা যদি কিছুদিন এখানে এসে শিক্ষা করে
লাভ যেতে পারত তা হলে ভারি উপকার হতো। প্রতিদিনই আমি ভারতবর্ষের সঙ্গে এখানকার তুলনা করে দেখি আর ভাবি, কী হয়েছে আর কী
হতে পারত।’ (‘রাশিয়ার
চিঠি’, রর,
দশম খণ্ড, পৃ.
৫৫৫-৫৫৬)
আমরা যারা সুবিধেলোভী ভদ্রলোকেরা সর্বক্ষণ সুবিধেবঞ্চিতদের শুধুই দান করে, কৃপা করে মন জয়
করতে আগ্রহী তাদের জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’
ভাবনাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন মহাজন ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করে থাকে। সেই সুদ অনেক সময় আসলকেও ছাড়িয়ে যায়। সেই মহাজন যদি ঋণগ্রহিতার কাছে সুদের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতাও আদায় করতে চায় তাহলেই মুশকিল। তাকে তিনি
‘শাইলকেরও বাড়া’ বলে মনে করেন।
এরা কখনও হৃদয় দিয়ে পেছনে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে কাছে টানেনি। তাই তাদের প্রতি কোনো
বিশ্বাস নেই। সমকালীন বাংলাদেশেও আমরা এমন অসংখ্য হিতকারীদের দেখতে পাই যাদের মাঝে
এ ধরনের আত্মাভিমানের বাড়াবাড়ি দেখতে পাই।
এভাবে দেশপ্রেমিক হওয়া যায়না। দেশহিতৈষায়
হিতৈষার চেয়ে দেশের অংশ যতক্ষণ বেশি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই সঙ্কট থাকবেই।
অন্তরের একান্ত তাগিদ থেকে প্রীতির বন্ধনে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের পিছিয়ে পড়া
মানুষগুলোকে বাঁধতে না পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত লোকহিতের অন্তসারশূন্যতা থেকেই যাবে।
আমরা যখন লোকসাধারণের কাছে হিতসামগ্রী নিয়ে যাই তখন শুধুই তাদের বর্ধিত হাতটাই
দেখতে পাই। তাদের অন্তরের দুঃখটা অনুভব করতে পারি না। হৃদয়ের আদান প্রদান নেই বলে
শুধু তাদের হাতপায়ের নড়াচড়াই দেখতে পাই। সমাজ এখন ধনের নিরিখে পুরোপুরি বিভক্ত।
মানুষের পেটের জ্বালা আমরা শুধু ব্যবসায়ীর চাহিদার চোখে দেখতে পাই। ধন জিনিসটাই যে
অসাম্যের বাহন এটা অনেক সময় বুঝতে পারি না। ধনীর ধনই যে দারিদ্র্য সৃষ্টির
প্রধানতম হাতিয়ার সে কথাটি বুঝেও না বোঝার ভান করি। ধনীর ধনেও যে গরিবের হক আছে সে
কথাটিও আমরা অনেক সময়ই স্বীকার করি না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা গরিবের মনেও আয়
রোজগার করে ধনার্জনের অধিকারের বিষয়টি গেঁথে দিতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত হিতচিন্তার
এই নেতিবাচক দিকটি থেকে আমরা মুক্তি পাব বলে মনে হয় না।
বর্তমানে ধনের বৈষম্যের চাপে সাধারণ মানুষ ছটফট করছে। তাই তারা শক্তি হিসেবে
আবির্ভূত হতে চাচ্ছে। তারা তাই আর ভিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, বরং তারা এখন
দাবি করে। নিতান্ত প্রাণের গরজেই তাদের মনে এই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। তাই দয়া
করে নয়, নিজের
গরজেই তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করাই আমাদের কাজ। কেননা, তারা এখন আমাদের
ভাবিয়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগেই এমনটি যে হবে তার অনুমান
করেছিলেন। ‘আমাদের
ভদ্রসমাজ আরামে আছে, কেননা
আমাদের লোকসাধারণ নিজেকে বোঝে নাই। এইজন্যই জমিদার তাহাদিগকে মারিতেছে, মহাজন তাহাদিগকে
ধরিতেছে, মনিব
তাহাদিগকে গালি দিতেছে, পুলিশ
তাহাদিগকে শুষিতেছে, গুরুঠাকুর
তাহাদের মাথায় হাত বুলাইতেছে,
মোক্তার তাহাদের গাঁট কাটিতেছে,
আর তাহারা কেবল সেই অদৃষ্টের নামে নালিশ করিতেছে যাহার নামে সমন-জারি করিবার জো
নাই। আমরা বড়োজোর ধর্মের দোহাই দিয়া জমিদারকে বলি তোমার কর্তব্য করো, মহাজনকে বলি
তোমার সুদ কমাও, পুলিশকে
বলি তুমি অন্যায় করো না এমন করিয়া নিতান্ত দুর্বলভাবে কতদিন কতদিক ঠেকাইব।
চালুনিতে করিয়া জল আনাইব আর বাহককে বলিব যতটা পারো তোমার হাত দিয়া ছিদ্র সামলাও সে
হয় না; তাহাতে
কোনো এক সময়ে এক মুহূর্তের কাজ চলে কিন্তু চিরকালের এ ব্যবস্থা নয়। সমাজে দয়ার
চেয়ে দায়ের জোর বেশি।’ (লোকহিত,
রর, দ্বাদশ খণ্ড,
পৃ. ৫৫১)
সমাজের সেই দায় নিশ্চিত করতে হলে লোকসাধারণের পরস্পরের মাঝে একটা যোগাযোগের
রাস্তা চাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সেটা যদি
রাজপথ না হয় তো অন্তত গলিরাস্তা হওয়া চাই।’
আর তাঁর মতে ‘লেখাপড়া
শেখাই এই রাস্তা’। এ শিক্ষা হয়তো গাঁয়ের
‘মেটে রাস্তা’
।
‘কেবলই রাস্তা
’।
আপাতত এ-
ই যথেষ্ট
,
কেননা এই রাস্তাটা না হইলে মানুষ আপনার কোণেবদ্ধ হইয়া থাকে। ‘সে কারণেইএকটা বৃহৎ লৌকিক যোগের জন্য চাই তার অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা। মানুষ যদি মনের চালাচালি না করতে জানে,
দেশের জন্য তার অনুভব কোত্থেকে আসবে?
মানুষের মনকে বিস্তৃত না করা গেলে মানুষ তার অন্তরের শক্তি কোত্থেকে পাবে?
এ প্রসঙ্গে তিনি ইউরোপের কথা পেড়েছেন। ওই সময় ইউরোপে প্রাথমিক শিক্ষার
প্রয়োজনীয় প্রসার ঘটেছিল বলেই সেখানকার সাধারণ মানুষ লিখতে পড়তে শিখে পরস্পরের
কাছে পৌঁছানোর উপায় খুঁজে পেয়েছিল। তাদের হৃদয়ে হৃদয়ে গতিবিধির বাধা দূর হয়েছিল।
আর এ কারণে সেখানে অধিকার সচেতন লোকসাধারণ আলাদা সত্তায় আপন শক্তিতে জেগে উঠতে
পেরেছিল। রাশিয়া ভ্রমণে কবি সেখানকার শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপে তাদের শিক্ষা
ব্যবস্থার লোকহিতকর দিকটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। ‘রাশিয়ার চিঠি
’তে কবি এমনি একটি
অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, ‘…এদের
শিক্ষা কেবল পুঁথিপড়ার শিক্ষা নয়। নিজের ব্যবহারকে চরিত্রকে একটা বৃহৎ লোকযাত্রার
অনুগত করে এরা তৈরি করে তুলছে। সেই সম্বন্ধে এদের একটা পণ আছে এবং সেই পণ রক্ষায়
এদের গৌরববোধ।’ (‘রাশিয়ার
চিঠি’, রর,
দশম খণ্ড, পৃ
. ৫৭১)
এই প্রসঙ্গে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের
কাছ থেকে কবির আকাক্সক্ষার কথা প্রকাশ পেয়েছে এভাবে, ‘আমার ছেলেমেয়ে এবং শিক্ষকদের আমি অনেকবার বলেছি, লোকহিত এবং
স্বায়ত্তশাসনের যে দায়িত্ববোধ আমরা সমস্ত দেশের কাছ থেকে দাবি করে থাকি
শান্তিনিকেতনের ছোটো সীমার মধ্যে তারই একটি সম্পূর্ণ রূপ দিতে চাই। এখানকার
ব্যবস্থা ছাত্র ও শিক্ষকদের সমবেত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা হওয়া দরকার সেই
ব্যবস্থায় যখন এখানকার সমস্ত কর্ম সুসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে তখন এইটুকুর মধ্যে আমাদের
সমস্ত দেশের সমস্যার পূরণ হতে পারবে। ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে সাধারণ হিতের অনুগত করে
তোলবার চর্চা রাষ্ট্রীয় বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে হতে পারে না, তার জন্য ক্ষেত্র
তৈরি করতে হয় সেই ক্ষেত্র আমাদের আশ্রম।’
(ঐ, পৃ.
৫৭১-৫৭২
)
বিশ্বায়নের প্রভাব পড়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। তাই লোকহিতকর শিক্ষার
বড়োই অভাব অনুভূত হচ্ছে। শিক্ষা এখন যেন অধিকার নয়, গণ্য হচ্ছে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে। ফলে সমগ্র
শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ধরণের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক বৈষম্য
ও নীতিহীনতা। শিক্ষার মানের তারতম্যের কারণে এক বাংলাদেশে কয়েক বাংলাদেশ সৃষ্টি
হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন এই বাংলাদেশের সমাজ,
সংস্কৃতি, আশা-
আকাক্সক্ষা ভিন্নতর হতে বাধ্য। গুণগতমানের নৈতিক ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কেটে যাবে সমাজের বিদ্যমান কূপমণ্ডূকতা।
রবীন্দ্রনাথের নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা ভাবনা আমাদের সন্তানদের মনে লোকহিত চিন্তার বিকাশ ঘটাক সেই প্রত্যাশাই করছি।
মানুষের ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা রবীন্দ্রসাহিত্য ও
রবীন্দ্রমননের মূল ভিত্তি। তাই রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ও লেখায় মানবতাবাদী ভাব-ধারণার উজ্জ্বল
প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তাতে প্রাচ্য মানবতাবাদের প্রভাব যেমন চোখে পড়ে
তেমনি পাশ্চাত্য মানবতাবাদের লক্ষণও দুর্লক্ষ নয়।
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় যে উপনিষদের প্রভাব পড়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু
উপনিষদের মানবিকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মানবিকতার কিছুটা পার্থক্যও বিবেচ্য।
উপনিষদের মানবিকতার ভিত্তি সার্বস্বয়বাদ। রবীন্দ্রনাথ সার্বস্বয়বাদকে স্বীকার করে
নিলেও ঈশ্বরের আলাদা অস্তিত্বকেও স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে উপনিষদের মানবিকতার ধারণার আধুনিক রূপ দেখা যায় বিবেকানন্দের দর্শনের
মধ্যে। সে দর্শনের মূল কথা হলো,
সকল জীবের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটলেও মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বিশেষ প্রকাশ
উপলব্ধি করা এবং বিশ্বমানবের সেবাকে ঈশ্বরের সেবা বলে গণ্য করা। রবীন্দ্রনাথের
পরিণত মানবচিন্তার সঙ্গে এই মতের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।
তবে আধুনিককালে মানবতা বলতে আমরা পাশ্চাত্য হিউম্যানিজমকেই বুঝি। চোদ্দো থেকে
ষোলো শতকে ইউরোপে যে রেনেসাঁস হয় তখন তা ভাবাদর্শগত আন্দোলনের রূপ নেয়। এর মূল কথা
হলো, মানুষের
মর্যাদাকে সবার উপরে স্থান দেয়া,
মানুষের কল্যাণ, তার
সার্বিক বিকাশ, মানুষের
সামাজিক জীবনের উপযোগী অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ। ধর্মীয়
গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে
স্বীকার করা, মানুষের
ইহজাগতিক প্রয়োজনীয়তা ও আকাক্সক্ষা মেটানোর জন্য মানুষের অধিকারকে সমর্থন, ধর্মের চোখে নয়
, মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে সব
কিছু বিচার-বিশ্লেষণ।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ঈশ্বর ও মানুষ দুই-ই
বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তার সাহিত্যভাবনায় ইউরোপীয় মানবতাবাদের সুরটি দুর্লক্ষ নয়।
দেবতা বা ঈশ্বর মানুষকে রক্ষা করে-
এ তিনি মানেননি। তাঁর মতে,
মানুষই নিজের চিন্তা,
কর্ম ও জ্ঞানের শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছে এবং করছে। বস্তুত, মানব-বিশ্বাসের
রেনেসাঁসধর্মী ঐতিহ্যকেই তিনি তার সাহিত্যকর্মে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এদিক থেকে তিনি
পরিপূর্ণ জীবনবাদী। তার রচনা মানবের জয়গানে মুখর। মানব জীবনের সমস্ত বদ্ধ দুয়ার
ভেঙে ফেলার প্রেরণা সেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পেও তার এই মানবতাবাদী ভাবনার আশ্চর্য প্রতিফলন দেখতে
পাওয়া যায়।
‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবিক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। এতে বৃহত্তর মানবতার সুর ধ্বনিত।
এই গল্পে মানুষের স্নেহ-মমতাকে
সর্বজনীনতামণ্ডিত করে তিনি দেখিয়েছেন,
মানবতার মৌল সম্পর্কের ক্ষেত্রটি জাতিধর্ম ও দেশ-কালের ঊর্ধ্বে।
অনেকগুলো গল্পে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছে সমাজ জীবনে
মানুষের অধিকার, স্বাভাবিক
জীবন বিকাশ ও অস্তিত্বের সংকটকে কেন্দ্র করে। যেমন বরপণ প্রথার হৃদয়হীনতার ছবি
ফুটে উঠেছে ‘দেনা-
পাওনা’, ‘ঠাকুরদা’, ‘
পণরক্ষা’, ‘হৈমন্তী’, ‘
অপরাজিতা’ ইত্যাদি গল্পে।
‘দেনা-পাওনা’
গল্পে বিধৃত হয়েছে নির্ধারিত পণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় শ্বশুর বাড়িতে বধূর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের ঘটনা ।
‘হৈমন্তী’ গল্পে পুরুষ গল্পকথকের জবানীতে রবীন্দ্রনাথ
পণপ্রথা-
কবলিত নারীর নিষ্ঠুরঅবমাননার জ্বলন্ত ছবি এঁকেছেন। পণপ্রথা কীভাবে নারীর জীবনকে তিলে তিলে মৃত্যুও দিকে ঠেলে দেয় হৈমন্তী তারই গল্প ।
কন্যাপণ
ও অর্থলোলুপতার বশবর্তী একশ্রেণির মানুষের অমানবিক রূঢ়তার ছবি পাওয়া যায় ‘অপরাজিতা
’
গল্পে।
মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনার বেদনাকে মূর্ত করা হয়েছে
‘রাকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা
’
গল্পে। এ গল্পে সত্যনিষ্ঠ ধর্মভীরু মানুষের মনুষ্যত্ব লাঞ্ছিত ও
উপেক্ষিত হওয়ার অসহায় বেদনাকে রামকানাই চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে ।
সামাজিক
বিবেচনাহীনতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরিচয় রয়েছে ‘বিচারক’
গল্পে। যেপুরুষ নারীত্বের
মহিমাকে ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে তাকে বিচারকের আসনে বসিয়ে বিবেকহীন সমাজের বিরুদ্ধে ও মানবিকতার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদমুখর হয়েছেন এই গল্পে ।
মানবতাবাদী
রবীন্দ্রনাথ তার কয়েকটি গল্পে জাতীয় চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাকে প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
তবে স্মরণীয়, তিনি বিশ্বাস
করতেন,
জীবন সমস্ত রাজনৈতিক আলোড়নের ঊর্ধ্বে। সেই জীবনের পূর্ণমূল্য দিয়েই মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সম্ভব। তার ‘
মেঘ ও রৌদ্র
’ গল্পে
ইংরেজদের আমলাতন্ত্রের নিষ্ঠুর বর্বরতাকে চূড়ান্ত ধিক্কারে জর্জরিত করা হয়েছে।
ইংরেজ শাসক, মালিক-
ম্যানেজার ও বিচারকের জুলুম, আইনের
প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা, শাসিত
জাতির প্রতি জুলুম ও দম্ভ ইত্যাদির বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে জমিদার-নায়েবদের
বিরুদ্ধে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন ।
অন্যদিকে, ‘দুর্বুদ্ধি’
গল্পে দেশিআমলাদের
হৃদয়হীনতা ও নির্লজ্জ লোভের জ্বলন্ত ছবি ফুটে উঠেছে। দারোগা ও ডাক্তারেরপাপচক্রের স্বরূপ উদঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে লাঞ্ছিত অপমানিত জনগণের বেদনাকে তুলে ধরা হয়েছে ।
ছোটোগল্পে
চিরন্তন মানবের মহিমার প্রকাশ ঘটলেও এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।
তিনি একান্তভাবে বিশ্বাস করতেন,
মানুষের জীবনের অন্ধকার দিকটাই একমাত্র সত্য নয়। তাই তিনি মানুষের
জীবন সংগ্রামের কালো দিকটাকে চিত্রিত করাকে তার সাহিত্যিক দায়িত্ব বলে গণ্য
করেননি। তিনি সাহিত্যে মানুষের আশা ও আনন্দকে চির জাগরূক করে রাখতে চেয়েছেন ।
‘নামঞ্জুর
গল্প’ ও ‘
সংস্কার’ গল্পে মানুষে মানুষেভেদাভেদের হীনমন্যতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেইসঙ্গে হীনবর্ণভুক্ত মানুষের প্রতি প্রকাশ করেছেন তার গভীর ভালোবাসা ও তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণের
দাবি। ‘অনধিকার
প্রবেশ’ গল্পে
ধর্মের নামে, বর্ণভেদ
ও জাতিভেদের সংকীর্ণতার প্রতি প্রচণ্ড বিদ্রুপাত্মক আঘাত ও কঠোর প্রতিবাদ মূর্ত
হয়েছে ।
জাতিভেদ, বর্ণভেদ
,
ধর্মহীনতা
-
সব ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ সবার উপরে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন। তাই ‘রবিবার’ গল্পের অভীককে
দিয়ে তিনি বলিয়েছেন : ‘যে দেশে
দিনরাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি সে দেশে সর্ব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো
নাস্তিকেরই।’ ‘ল্যাবরেটরি’
গল্পের নন্দকিশোর সামাজিক অর্থে ধর্মকে স্বীকার করেনি এবং মোহিনীর মতো নিম্নস্তরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে বর্ণাশ্রয়ী সমাজের মানসিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন ।
রবীন্দ্রনাথের
অনেকগুলো গল্পে সমাজের নিচুতলার নিপীড়িত,
লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার অসুখী প্রকাশ ঘটেছে। যেমন
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিষ্ঠুরতায় একদিকে জমিদারদের জীবন উৎসবমুখর হলেও দরিদ্র
মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার মর্মান্তিক ছবি আঁকা হয়েছে ‘শাস্তি
’ গল্পে ।
‘মুসলমানি
গল্পে’ রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছেন। এ ধরনের গল্পে ধর্মনিরপেক্ষ হৃদয়ধর্মের প্রতি
তাঁর আজন্ম আকর্ষণ তীব্র ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ।
মানবতাবাদী
রবীন্দ্রনাথ নারীসমাজের মর্যাদা ও মহিমার পক্ষেও কলম ধরেছিলেন। পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীর মুক্তিপথের নানা অন্তরায়
তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। পণপ্রথা,
সহমরণ, বিধবা বিবাহ ও বহুবিবাহের মতো যে সমস্ত সমস্যা সেকালে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর অবস্থানকে অমর্যাদাকর ও সংকটাপন্ন করে তুলেছিল,
পাশ্চাত্যের নারীর অবস্থান,অধিকার ও
মর্যাদার আলোয় রবীন্দ্রনাথ তাকে বিচার করেছিলেন। স্বভাবতই নারীমুক্তির প্রসঙ্গ
হয়েছিল তার ভাবনার বিষয়। আর তাই নারীর পক্ষে পূর্ণ সহানুভূতি লক্ষ করা যায় তার
ছোটোগল্পে ।
নিষ্ঠুর
সমাজ-শাসনে নারীর অসহায় অবস্থ’
ার
ছবি তুলে ধরে তাই তিনি যেন চাবুক মেরে সমাজেরচেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন। সন্ন্যাসীর স্ত্রী কুসুমের বঞ্চিত জীবনের হাহাকারকে তিনিবাক্সময় করে তুলেছেন
‘ঘাটের কথা’ গল্পে। ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের দুর্ভাগা
কাদম্বিনীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে সে মরেওনি। ‘কঙ্কাল’
গল্পে নারীর রূপ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও স্বরূপ তুলে ধরে
রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে,
তা নারীর মানবিক জীবন-চেতনার
পথে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ।
‘খাতা’
গল্পের বালিকা বধূ উমা লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখাতে গিয়ে বিড়ম্বিত হয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত স্বামীর কাছে।
‘পয়লা নম্বর’
গল্পে বুদ্ধিজীবী পুরুষের নিষ্ঠুর নিস্পৃহতা ও কর্তৃত্বপরায়ণ ক্ষমতা-বলয়ের কবলে পড়া নারীর অবমাননার স্বরূপ ও তার অন্তর্বেদনার
রূপটি ফুটে উঠেছে ।
এক কথায়
সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার ও নারীর
অধিকারহীনতার স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ উদঘাটন করেছেন তার ছোটোগল্পগুলোতে। শুধু তাই নয়, এই অমানবিক
সমাজের বেড়াজাল ভেঙেচুরে বের হয়ে আসার প্রেরণাও তাঁর গল্পে রয়েছে। ‘স্ত্রীর পত্র
’ গল্পে
রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন ব্যক্তিত্বসচেতন নারী মৃণালের জবানীতে
আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে। মৃণাল সংসারের অন্যায়-অবিচার,
হৃদয়হীনতা ও বৈষম্য সইতে না পেরে অবশেষে বিদ্রোহ করেছে। তার বিদ্রোহী নারী
হৃদয় হৃদয়হীন সংসারের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে লাভ করেছে মুক্তির স্বাদ। ‘বদনাম
’ গল্পের সৌদামিনীও
এমনিভাবে বিদ্রোহী হয়েছে ।
সুতরাং
দেখা যাচ্ছে, কাব্যে ও প্রবন্ধে
রবীন্দ্রনাথ যেমন মানবতার বাণীকে বাক্সময় করে তুলেছেন তেমনি তার ছোটোগল্পেও চিত্রিত
হয়েছে তার বহুবর্ণিল ছবি।
রবীন্দ্র-কাব্যের মূল সুর প্রকৃতির সৌন্দর্যসম্ভোগ, মানবমহিমাবোধ এবং প্রকৃতি ও মানবের মিলনে অতীন্দ্রিয়ের স্পর্শানুভূতি। কবির কাছে প্রকৃতি জড় নয়, প্রাণময়ী। রবীন্দ্র-কাব্য পরিক্রমা করলে আমরা দেখতে পাই, এই প্রাণময়ী প্রকৃতি তাঁর কাব্যের উৎস, তাঁর আবেগ-সঞ্চারিনী শুধু তাই নয়,
রবীন্দ্র-প্রতিভার সামগ্রিক পরিচয় দেয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সৃষ্টিশীল মহৎ ব্যক্তি। বাঙালি কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিশাল রূপান্তর বা পরিবর্তন, পরিমার্জন , সংযোজন ও বিয়োজন করেছেন। তাঁর কর্মকুশলতা, চিন্তা-চেতনা ও সৃষ্টিশীলতা এই সংস্কৃতিকে দিয়েছে নানা রূপময়তা, রঙ, গন্ধ ও বৈচিত্র্যমুখিতা। সংস্কৃতির এত বড় সংগঠক প্রাচীন, মধ্য ও বর্তমান আধুনিককালেও বাঙালি সমাজে জন্মগ্রহণ করেনি। তিনি আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির প্রধান রূপকার। যদিও এই আধুনিককাল চূড়ান্ত নয়। আমাদের বোধ, মেধা ও মনন যাকে আধুনিক বলে জানতে, বুঝতে চাচ্ছে তা কতটুকু আধুনিক ও উৎকৃষ্ট সে সম্পর্কে এ যুগের মানুষ হিসেবে তার বিচারে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান বা প্রজ্ঞার পরিধি পরিমাপ করার সাধ্য আমার মতো অধমের নেই এটা সত্য, এর পরেও এই স্বল্প পরিসরে কিছু নমুনা উপস্থাপনের চেষ্টা করছি বিজ্ঞ পাঠকদের করকমলে। মহান কবি লিখেছেন-
‘হায় গগন
নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা!
ওগো তপন, স্বপন
দেখি যে, করিতে
পারিনে সেবা।’
অন্তরের নিবিড়তম,
সত্যতম কথাটি এমন সহজ সুরে কে গাইতে পারে? মানুষের ব্যক্ত-অব্যক্ত,
জানা-অজানা,
বোঝা-না-
বোঝা, চেতন-
অবচেতন সব লোকেরই কথা কবি বুঝেছেন এবং তা ব্যক্ত করেছেন। মানুষের মনের বিচিত্র আনন্দ-বেদনা, তৃপ্তি-
অতৃপ্তি, পাওয়া-
না-পাওয়ার কথা ফুট
ওঠে তাঁর প্রতিটি ছন্দে। সর্বমানবের মনের মর্মকথার মূর্ত প্রতীক রবীন্দ্রনাথ ।
রবীন্দ্র-প্রতিভা সূর্যেরই মতো বিরাট বিস্ময়কর ব্যাপার।
অফুরন্ত বিচিত্র বিচ্ছুরিত উজ্জ্বল সূর্যরশ্মির যেমন পরিমাপ করা
যায় না এবং সমগ্রভাবে তা ধরাও যায় না,
রবীন্দ্র-প্রতিভা
সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করাও আমাদের পক্ষে তেমনি অসম্ভব। এত বড় বিরাট প্রতিভার সামনে
দাঁড়াবে কে? তা ছাড়া
আর একটা কথাও অন্তরের মধ্যে বিশেষভাবে নাড়া দেয় যে, যে অতিমানবীয় প্রতিভা বা ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথ অধিকার করেছেন
সে প্রতিভা বা ক্ষমতা না-কি তাঁর
নয়! এ কথা
কবি বহুবার বলেছেন যে, কোনো এক
অদৃষ্ট শক্তি বা প্রেরণা তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন তিনি তাই করেছেন। কবি বলেছেন-
অন্তর মাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সঙ্গীতস্রোতে কূল নাহি পাই,
কোথা ভেসে যাই দূরে।
কবি কত কিছু বলেছেন সে তো কবির নিজের কথা নয়, সে তাঁর অন্তরের
আদেশ; তাই একে
বুঝতে চাওয়া সহজ নয়।
তবুও দুর্নিবার আগ্রহ,
অসীম সাহস মানুষের, জানবার।
দুঃসাধ্য সাধন করতে চায় মানুষ,
দুর্লঙ্ঘকে লঙ্ঘন করতে সাহসী হয় মানুষ,
অপ্রাপ্যকে করায়ত্ত করতে চায়-
সেও তো মানুষ। অজানাকে জানতে হবে,
অপ্রাপ্যকে পেতে হবে,
মানুষকে পেতে হবে অমিত,
দিতে হবে অমিত, তাকে হতে
হবে অমিত মানব। এই সাধনা সহজ নয়,
দুঃখের দুর্গম পথেই এর জয়যাত্রা। মানুষ সুখের কাঙাল নয়, দুঃখভীরু নয়
, তাই সে এই পথই
বেছে নিয়েছে ।
রবীন্দ্র-প্রতিভার কোনো একটি দিকের আস্বাদন করতে
হলে এই সাধনা ও একান্ত তন্ময়তার প্রয়োজন। একাগ্র ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনা,
ধ্যান
-ধারণায়
মানুষের অন্তরেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ আরআবিলতামুক্ত হয়। তখন যা অজ্ঞেয় রহস্যময়তায় সমাচ্ছন্ন তাকে জানা যায়, বোঝা যায়, উপলব্ধি করা যায়।
এই সাধনার বেদনা যে বহন করতে পারে চির-আকাক্সিক্ষত
প্রিয় বস্তুটি তার কাছে এসে আপনি ধরা দেয়। যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা যায়, তাকেই সত্যরূপে
জানতে পারা যায় ।
তাই
রবীন্দ্র-প্রতিভার কোনো একটি
দিকের সমগ্র পরিচয় পাওয়া অসম্ভব হলেও এ কাজে কোনো কোনো দুঃসাহসী অগ্রসর
হয়েছেন। তার কারণ ভালোবাসার মধ্যে ঐশ্বর্য-ভয়-
ভীতি তো কিছু নেই, সেখানে শুধু
অনাবিল মাধুর্য আর চির-পরিচয়ের
স্বচ্ছ-আনন্দ।
এই দাবিতে আমরাও কবিকে দেখব,
জানব, বুঝব,
নিবিড় করে কাছে পাব ।
রবীন্দ্রনাথ
বাংলার কবি, রবীন্দ্রনাথ
ভারতবর্ষের কবি, রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বের সকল দেশের ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র
বহুমুখী অলোকসামান্য প্রতিভা সকল দেশ ও কালের গণ্ডিকে অবলীলাক্রমে অতিক্রম করে
গিয়েছে- সে গৌরব
কেবলমাত্র ভারতবর্ষের নয়,
সারা বিশ্বেরও। তাঁর বাণী ছিল বিশ্বজনীন,
তাঁর প্রেম ছিল সর্বব্যাপী,
তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল সুগভীর। অনন্তকে আস্বাদন করবার জন্য মানুষের যে আর্তি, তাই ব্যক্ত
হয়েছিল তাঁর ভাবধারার মধ্য দিয়ে ।
বাংলাদেশে
রবীন্দ্র-প্রতিভার অভ্যুদয়
পরম বিস্ময়কর এবং আকস্মিক ব্যাপার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ঠিকই,
কিন্তু একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। তার প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথ বাংলার তথা ভারতবর্ষেরই কবি, ভারতীয় ভাবসাধনার
আদর্শেই তাঁর কবিমানস অনুপ্রণিত ও পরিপুষ্ট ।
রবীন্দ্র-সাহিত্য একটি বহু রূপময় বিচিত্র শিল্পসম্ভার
;
তাতে নব নব রেখা ওবর্ণবিন্যাসের অন্ত
নেই। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতজ্ঞ, নাট্যকার
, গল্পরচয়িতা, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার
, সমালোচক, চিত্রকর, দার্শনিক
, বৈজ্ঞানিক
একাধারে সবই, কিন্তু
তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় তিনি কবি।
রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভা
শতমুখী। তিনি নিজের সৃষ্টিকে নিজেই অতিক্রম করে নতুন রূপসৃষ্টির আনন্দে চিরচঞ্চল
ছিলেন। কবি নিত্য নতুন ভাব চিন্তা আবেগ কল্পনা ভাষা ছন্দ অলঙ্কার করেছেন এবং তার
প্রকাশভঙ্গিমায় কবিমানসের সে একটি অভিনব রূপ তিনি প্রকাশ করেছেন তা জগতের কাছে পরম
বিস্ময়ের বস্তু ।
রবীন্দ্র-কাব্যে আমরা যেমন ভারতীয় সাহিত্যের ঐতিহ্যের
সন্ধান পাই,
যেমনমধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিদের রসমাধুর্যের আস্বাদ পাই,
বাউলদের মনের মানুষের সন্ধান পাই,
তেমনি পাই প্রতীচ্য সাহিত্যের তীব্র আবেগ, তার বাধাহীনতা,
দেশকালনিরপেক্ষ মানবিকতা। বিশ্ব-প্রাণের
বিচিত্র তরঙ্গমালা রবীন্দ্রনাথের ভাব ও কল্পনাকে আলোড়িত করেছে। এই আলোড়নের
অভিব্যক্তি ঘটেছে নানা রূপে,
রসে, ছন্দে ও
মাধুর্যে। রবীন্দ্র-সাহিত্যে
বিশেষ কোনো দেশের, বিশেষ
কোনো কালের বা বিশেষ কোনো জাতির নির্দিষ্ট কোনো ছাপ পড়েনি। সব দেশ কাল জাতি, সব বন্ধনমুক্ত
, সর্বজনীন ভাব, কল্পনা ও আদর্শের
ওপর তাঁর সাহিত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই তাঁর কাব্য যুগের হয়েও যুগাতীত। রবীন্দ্রনাথ
তাঁর সারাজীবনের সাধনার ধন কাব্য তথা সাহিত্যের মধ্য দিয়ে দেখেছেন যে, শান্তিময়
বিশ্বপ্রেমই মানুষের জীবনের কাম্য বস্তু;
বিশ্বজনীন ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ধরা দিয়ে তবে তার বিশেষ অভিব্যক্তি লাভ করে, আবার ব্যক্তিজীবন
বিশ্বজীবনের মধ্যে লীলায়িত হয়ে তবেই তার সার্থকতা প্রাপ্ত হয়। এমনি করে সীমায়
অসীমে, খণ্ডে
পূর্ণে, ব্যক্তিজীবনে
ও বিশ্বজীবনে একটি চিরন্তন লীলা চলছে। এই লীলাই সৃষ্টির আনন্দ ও সৌন্দর্য। এই
আনন্দ ও সৌন্দর্য রবীন্দ্রনাথ আকণ্ঠ পান করেছেন এবং তাঁর কাব্যে বিচিত্রভাবে
প্রকাশ করেছেন ।
রবীন্দ্র-কাব্যের মূল সুর প্রকৃতির
সৌন্দর্যসম্ভোগ, মানবমহিমাবোধ
এবং প্রকৃতি ও মানবের মিলনে অতীন্দ্রিয়ের স্পর্শানুভূতি। কবির কাছে প্রকৃতি জড় নয়, প্রাণময়ী।
রবীন্দ্র-কাব্য
পরিক্রমা করলে আমরা দেখতে পাই,
এই প্রাণময়ী প্রকৃতি তাঁর কাব্যের উৎস,
তাঁর আবেগ-সঞ্চারিণী
শুধু তাই নয়, যেন তাঁর
অন্তর-সত্তার
চিরসঙ্গিনী। এই সঙ্গিনীর সঙ্গে কবি নিগূঢ়-আত্মীয়তার
বন্ধনে আবদ্ধ। প্রকৃতির তুচ্ছতম বস্তুটির সঙ্গে পর্যন্ত কবি আদিজন্মের নাড়ির টান
অনুভব করছেন। তাই তাঁর কাছে-
যাহা কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,
সকলি দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।
দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ।
এই পৃথিবীর জল-স্থল,
আকাশ-বাতাস,
পশু-পাখি,
সমস্ত রূপ-রস-
স্পর্শ কবির চিত্তবীণায় নব নব রাগ-রাগিনীর
সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সব কিছুর সঙ্গে কবি স্বীয় প্রাণচেতনার স্পন্দন অনুভব
করেছেন। তাই তিনি বিশ্বাস করেছেন যে,
আদি প্রাণের যে প্রবল জীবনোচ্ছ্বাস পৃথিবীর প্রত্যেক গাছে, শিকড়ে শিকড়ে
, শিরায় শিরায়, তৃণের প্রত্যেকটি
রোমে রোমে প্রবাহিত হচ্ছে,
সেই প্রাণধারা প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই সঞ্চারিত এবং কম্পিত হচ্ছে। তাই এত বড়
বিশাল পৃথিবীকে আমাদের অনাত্মীয় বা অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে না। কবি বলেছেন-
“প্রকৃতির মধ্যে যে এমন গভীর আনন্দ পাওয়া যায়, সে কেবল তার সঙ্গে আমাদের একটা নিগূঢ় আত্মীয়তা অনুভব করে।
এই তৃণগুল্মতা, জলধারা,
বায়ুপ্রবাহ, এই ছায়ালোকের
আবর্তন, জ্যেতিষ্কদলের
প্রবাহ, পৃথিবীর
সমস্ত প্রাণীপর্যায়- এই
সমস্তের সঙ্গেই আমাদের নাড়ি-ছন্দের
যেখানেই যতি পড়েছে সেখানেই ঝঙ্কার উঠছে,
সেখানেই আমাদের মনের ভিতর থেকে সায় পাওয়া যাচ্ছে।’
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির কবি,
রবীন্দ্রনাথ আনন্দের কবি। অতুলনীয় মানবমুখিতা কবির কাব্যে একটি বিশেষ স্থান
অধিকার করেছে। রবীন্দ্রনাথ এই পৃথিবীর কবি। তিনি মানুষকে, ধরণীকে
ভালোবাসেন। রবীন্দ্র-কাব্যে
মানবের অবিনশ্বর অনুভূতির প্রকাশ অতি ব্যাপকভাবেই রয়েছে। কবি বারবার কলেছেন, ‘মরিতে চাহি না
আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের
মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
‘আত্ম-পরিচয়’-
এ কবি বলেছেন, “প্রকৃতি তাহার
রূপ-রস-
বর্ণ-গন্ধ লইয়া,
মানুষ তাহার স্নেহ
-প্রেম
লইয়া আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে। সেই মোহকে আমি অবিশ্বাস করি না, সেই মোহকে আমি
নিন্দা করি না।”
অবজ্ঞা করিনি তোমার মাটির দান
আমি যে মাটির কাছে ঋণী
জানিয়েছি বারম্বার-
কবি শুধু ঋণ স্বীকারই করেননি, তিনি মানুষকে চরম শ্রদ্ধাও দেখিয়েছেন-
তব প্রয়োজন হতে যে অতিরিক্ত মানুষ-
তারে দিতে হবে চরম সম্মান তব
শেষ নমস্কারে।
মানুষকে কবি কোনোদিনই ছোট পরিধির মধ্যে ছোট করে ভাবতে
পারেননি। মহামানবের আবির্ভাব তিনি ক্ষণে ক্ষণে দেখেছেন। মানুষের ক্ষণিক অংশের
মধ্যে চিরন্তনের অভিব্যক্তি তাঁকে বারে বারেই বিস্মিত পুলকে অবিভূত করেছে। মানুষের
স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি প্রভৃতি সুকোমল চিত্তবৃত্তির ভিতর দিয়ে তিনি চির রসময়ের
রসের পরিচয় পেয়েছেন। তাই রবীন্দ্রকাব্য মানুষের জয়গানে মুখরিত। সে মানুষ ব্যক্তিগত
পরিধি, দেশ কাল
অতিক্রম করে মহামানবে পর্যবসিত। উপনিষদের বাণীঘন মূর্তি রবীন্দ্রনাথ মানুষকে
অনন্তের সন্তান রূপেই দেখেছেন,
তাই তিনি উপনিষদের বাণীতে বলেছেন,
মানুষ মানুষ নয়, মানুষ
ব্রহ্ম ।
কবির ভগবৎ-উপলব্ধিও
মানববিমুখতা নয়। সংসারের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর স্পর্শ লাভ করতে চেয়েছেন। ‘সংসারে বঞ্চিত
করি তব পূজা নয়’ অথবা ‘
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি আমার নয়’ -এই
উক্তির মধ্য দিয়েই বুঝতে পারা যায় যে,
সংসারকে বাদ দিয়ে কবিসংসারাতীতের সন্ধান করেননি। পরন্তু এই জগতের খণ্ড স্নেহ
প্রেম প্রীতির মধ্য দিয়েই তিনি পরম প্রিয়তমের স্পর্শ পেতে চেয়েছেন। বিশ্বপ্রকৃতি ও
মানবপ্রকৃতির বিচিত্র রূপকে তিনি আনন্দময়ের অমৃত রূপ বলেই অনুভব করেছেন। সর্বত্রই
তাঁর লীলাবিলাস বিকম্পিত-
এই উপলব্ধিই রবীন্দ্র-কাব্যের
বৈশিষ্ট্য ।
রবীন্দ্রনাথ
সাধক, তবে সে সাধনা বৈরাগ্য-
সাধনে নয়
, শিল্পসাধনে, রূপ সাধনে, ভাব সাধনে। নানা রূপের ক্ষুধা
, রসের ক্ষুধা তাঁরভাবকল্পনাকে উদ্বোধিত
করেছে। বিশ্বের যেখানে যা কিছু আছে-
অণু
-পরমাণু
পর্যন্ত,
তাঁর কাছে রূপ রসে সৌন্দর্যে মাধুর্যে প্রতিভাত হয়েছে। সৌন্দর্যানুভূতিকে কবি একটি বিশেষ সত্তা রূপে দেখেছেন। সেই আদি অখণ্ড সত্তা অন্তরে বাইরে বিরাজিত। বাইরে যিনি বহুবিচিত্র
, অন্তরে তিনি একা, অখণ্ড, স্থির-
গম্ভীর। এই সৌন্দর্য
-রূপিণী
নারীকে তিনি বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ভাবে তাঁর কাব্যে প্রকাশ করেছেন ।
রবীন্দ্রনাথের
সৌন্দর্য কল্পনার মধ্যেও সেই একই সুর ধ্বনিত,
যে সুর নদী-
গিরির ওপারথেকে ভেসে আসছে। রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছেন,
বিশ্ব প্রকৃতিতে,
মানবপ্রকৃতিতে যে সৌন্দর্যউদ্ভাসিত তা সেই চিরসুন্দরেরই অঙ্গদ্যুতি। বিশ্ব-
ভ্রহ্মাণ্ড সেই আদি রূপের ঝরনাধারায় অভিস্নাত। সমস্ত খণ্ড সৌন্দর্যের মধ্যে কবি অলৌকিক ও অখণ্ড সৌন্দর্য দেখেছেন। তাই কবির কাছে কিছুই তুচ্ছ নয়,
কিছুই অসুন্দর নয়। অসুন্দর যদি কিছু থাকে তবে তা সুন্দরের খণ্ডিত প্রকাশ
মাত্র। পরিপূর্ণতার কবি সব কিছুকেই সমগ্রভাবে দেখেছেন। তাই কোথাও কিছু অসুন্দর
তাঁর চোখে পড়েনি, পড়লেও
তার সামঞ্জস্য করিয়ে নিয়ে তবে স্বস্তি পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনসাধনা, কাব্যসাধনার
বিরাট সৌধ এই সৌন্দর্যানুভূতির শ্বেত প্রস্তরের উপরেই ভিত্তি স্থাপন করেছে। তাঁর
সমস্ত অনুভূতিই সুন্দরের অনুভূতিতে রঞ্জিত ।
কবির
প্রেমানুভূতির মধ্যেও আছে এই সূক্ষ্ম মহিমাবোধ। তাই তাঁর প্রেমসাধনা
একান্ত ভোগবাসনায় পর্যবসিত না হয়ে একটি বিশেষ আনন্দবোধে উপভোগ্য হয়েছে।
সৌন্দর্যানুভূতির
সঙ্গে যে একটি ভোগতৃষ্ণা জেগে থাকে তাকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু ভোগ সৌন্দর্র্যলাভের শ্রেষ্ঠ উপায়
হতে পারে না যদি তার মধ্যে সংযত না থাকে। সেই কথাই কবি বলেছেন- “প্রবৃত্তিকে যদি
একেবারে পুরামাত্রায় জ্বলিয়া উঠিতে দিই,
তবে যে সৌন্দর্যকে কেবল রাঙাইয়া তুলিবার জন্য তাহার প্রয়োজন, তাহাকে জ্বালাইয়া
ছাই করিয়া তবে সে ছাড়ে, ফুলকে
তুলিতে গিয়া তাহাকে ছিঁড়িয়া ধুলায় লুটাইয়া দেয়। সৌন্দর্য আমাদের প্রবৃত্তিকে সংযত
করিয়া আনিয়াছে।…সৌন্দর্য
যেমন আমাদিগকে ক্রমে শোভনতার দিকে,
সংযমের দিকে আকর্ষণ করিয়া আনিতেছে,
সংযমও তেমনি আমাদের সৌন্দর্যভোগের গভীরতা বাড়াইয়া দিতেছে।” তাই আমরা দেখি
, রবীন্দ্রনাথের
কাব্যে প্রেমসাধনা দেহকে অস্বীকার করেনি,
আত্মা যেমন সত্য দেহও তেমনি,
দেহ-আত্মার
যে প্রেম তাই পূর্ণ প্রেম। ভোগ-বাসনা
কবির কাব্যে যথেষ্ট আছে, কিন্তু
সে ভোগ একান্তভাবে দেহের সীমাতেই আবদ্ধ নয়,
দেহকে আশ্রয় করে সে প্রেম দেহাতীত এক অপার্থিব সৌন্দর্যলোকে তার নিত্য আশ্রয়
খুঁজে নিয়েছে ।
রবীন্দ্রনাথের
সৌন্দর্য ও প্রেমানুভূতির এই যে বৈশিষ্ট্য, একে তিনি প্রকাশ
করেছেন এইভাবে- “জীবের
মধ্যে অখণ্ডকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা, প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্যসম্ভোগ।”
রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার রহস্যও এইরকম একটি ভাবানুভূতি বলা যেতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের সুগভীর অধ্যাত্মবোধের মূলেও আছে এই ভাবানুভূতি। যে অদ্বিতীয়
অর্ধপরিচিত দেবতার স্পর্শ তিনি বারংবার হৃয়ের মধ্যে অনুভব করেছেন, যার নিত্যনতুন
লীলায় তাঁর কাব্যজীবন নব নব আনন্দরসে সিঞ্চিত পুষ্পিত হয়ে উঠেছে, সেই চিরবাঞ্ছিত
হৃদয়দেবতাকেও তিনি লাভ করেছেন তাঁর নিবিড় অনুভূতির মধ্যে নানা রূপে। কখনো সখা রূপে, কখনো দেবতা রূপে, কখনো মানসসুন্দরী
রূপে অদৃশ্য এই সত্তার স্পর্শ তিনি জীবনের ঊষালোক থেকেই পেয়ে এসেছেন। এই প্রণয়িনীর
স্পর্শে কবি কখনো বেদনায় ব্যাকুল হয়েছেন,
কখনো আনন্দে অধীর হয়েছেন। কখনো মিলনে,
কখনো বিরহে এই মধুর স্পর্শটি ক্রমশই রসনিবিড় হয়ে উঠেছে। সুখে দুঃখে বিপদে
সম্পদে জীবনের সকল অবস্থায় কবি এই জীবন-দেবতার
স্পর্শ লাভ করেছেন। নিদারুণ দুঃখেও তিনি দুঃখরাতের রাজাকে অভ্যর্থনা করে নিয়েছেন।
এইভাবে সীমা-অসীমের,
পূর্ণ-অপূর্ণের
, খণ্ড-
অখণ্ডের লীলা-অভিসার চলেছে
রবীন্দ্র-কাব্যে।
রবীন্দ্রনাথ সত্য-শিব-
সুন্দরের একনিষ্ঠ পূজারি। কঠোর দুঃখ, নির্মম
কষাঘাতের মধ্য দিয়ে যে শান্তি লাভ করা যায়,
সত্য লাভ করা যায় তাই তাঁর কাম্য। তাই অত্যন্ত সহজেই তিনি বলতে পেরেছেন-
‘মনেরে আজ কহ যে,
ভালমন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।’
সত্যসন্ধানী কবি আরো বলেছেন-
আরাম হতে ছিন্ন করে
সেই গভীরে লও গো মোরে
অশান্তির অন্তরে যেথায়
শান্তি সুমহান।
এইজন্য তাঁর কাব্যে রুদ্র ও শিব সমান পূজা লাভ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনে
মৃত্যু একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মৃত্যুর এত মহিমাময় ঐশ্বর্যময় মাধুর্যময়
কল্পনা অন্য কোনো কবির কাব্যে আছে কিনা সন্দেহ। জীবনের সোনালি ঊষাতেই কবি
অনুরাগকম্পিত কণ্ঠে বলেছেন-
‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সম।’
মৃত্যু-বরের
জন্য জীবন-বধূ
উৎসুক হয়ে সর্বক্ষণ প্রতীক্ষা করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ জীবনের অনন্ত-অনাদি প্রবাহবোধ
স্বীকার করেছেন। জীবন-মরণ তো
শুধু ইহলোকের বিষয় নয়। তা লোক-লোকান্তরের
একটি সংলগ্ন ঘটনা- এ
বিশ্বাস তাঁর দৃঢ় ছিল। তাই তিনি জীবন ও মরণকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারেননি।
বিশ্ববোধ আর সর্বানুভূতি রবীন্দ্র-সাহিত্যের একটি মূল সুর। এই বোধের উদ্ভব হয়েছে তাঁর অতীন্দ্রিয় অনুভূতি থেকে। এই অধ্যাত্ম-অনুভূতিই সমগ্র রবীন্দ্র-জীবন ও সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ভারতের অধ্যাত্ম-সাধনায় যে ভূমার আদর্শ ‘ঈশাবাস্যং ঈদং সর্বং কিষ্ণ জগত্যাং জগৎ’- ঈশ্বরের দ্বারা নিখিল জগৎ পরিব্যাপ্ত রয়েছে, সেই সর্বব্যাপিত্বের আদর্শই রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনের মূল কথা। তিনি রসো বই সঃ-তিনি রসস্বরূপ, আনন্দানুভূতির তিনিই পরম প্রকাশ। আমাদের কবি এই সর্বানুভূতির কথা, এই আনন্দের কথা অক্লান্ত সুরে নানা ছন্দে রূপে রসে বর্ণে বৈচিত্র্যে প্রকাশ করেছেন। এই অনুভূতির প্রেরণাতেই তিনি লিখেছেন-
“পাগল
হইয়া বনে বনে ফিরি আপন গন্ধে মম
কস্তরীমৃগ সম।”
এই প্রেরণাতেই সারা জীবন ধরে তিনি পৃথিবীর নানা পথে
প্রান্তরে মরুতে পর্বতে অনন্ত পথ-পরিক্রমায়
চলেছিলেন, তিনি
চঞ্চলের চিরসহচর ছিলেন। তাঁর কাব্যে চিরদিনই এই আকুতি ধ্বনিত হয়েছে- “আমি চঞ্চল হে আমি
সুদূরের পিয়াসী।”
রবীন্দ্রনাথে সুবিপুল,
সর্বোতমুখী প্রতিভা ও বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। কত
বিচিত্র দিকে, কত
বিচিত্রভাবে যে তাঁর প্রতিভা বিকাশ লাভ করেছে, কোনটিকে ছাপিয়ে কোন দিকটি যে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তা
সমগ্ররূপে ধারণা করাই দুঃসাধ্য। সৃষ্টি,
চিন্তা ও কর্মের সমস্ত দিকে কারও প্রতিভা এমন অম্লান দীপ্তিতে প্রতিভাত হয়েছে
পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্তে দুর্লভ বলা যায়। রবীন্দ্র-জীবন ও কর্মের সম্যক ও সত্য উপলব্ধি আজো স্বদেশে-বিদেশে কোনো
দেশেই হয়েছে কি-না
সন্দেহ। কবি নিজেই তাঁর ‘আত্মপরিচয়’-
এ বলেছেন- ‘নিজের সত্য পরিচয়
পাওয়া সহজ নয়। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিতরকার মূল সূত্রটি ধরা পড়তে চায় না।…নানাখানা করে
দেখেছি, নানা
কাজে প্রবর্তিত করেছি, ক্ষণে
ক্ষণে তাতে আপনার অভিজ্ঞান আপনার কাছে বিক্ষিপ্ত হয়েছে। জীবনের এই দীর্ঘ চক্রপথ
প্রদক্ষিণ করতে করতে বিদায়কালে আজ সেই চক্রকে সমগ্ররূপে দেখতে পেলাম। তখন এটা
বুঝতে পেরেছি যে, একটি
মাত্র পরিচয় আমার আছে, সে আর
কিছুই নয়, আমি কবি
মাত্র। আমার চিত্ত নানা কর্মের উপলক্ষে ক্ষণে ক্ষণে নানা জনের গোচর হয়েছে। তাতে
আমার পরিচয়ের সমগ্রতা নেই।’
পরিপূর্ণতার প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক টান আছে, তাই আমরা আমাদের
প্রিয়তম কবিকে পরিপূর্ণ রূপেই পেতে চাই। বিশ্বের অমৃত ছবির পরিপূর্ণ সার্থক প্রকাশ
রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর কাব্যের মধ্য দিয়ে আমরা পরিপূর্ণতার স্বাদ পাই।
বিশ্বচিত্তের দূত রবীন্দ্রনাথ,
তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় তাঁর কাব্যে,
তাই তিনি সবার উপরে কবি,
তাহার উপরে নাই।