১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিলেন সাহসী এই নারী, স্বাধীন দেশে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেছেন নিজের লেখা বই ‘৭১-অর জননী’৷ দেশে বিদেশে তৎপর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের মোকাবেলায় একাত্তুরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমী বাঙালির জন্য এক অনন্য আদর্শ। মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম আর দুই ছেলে হারানোর পরও যুদ্ধপরবর্তী সময় থেকে একাকী সংগ্রামী জীবন কাটিয়েছেন তিনি। সব হারানোর আগুনে দগ্ধ হয়েও সমাজ আর জাতির বিবেকে আলো জ্বালানোর দায় নিয়েছিলেন বিপ্লবী এই নারী।
১৯৩৬ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রমা চৌধুরী। বলা হয়ে থাকে, তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) নারী। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত একজন বীরাঙ্গনা জননী তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তখন তার স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদাররা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। তাঁকে জোর করে নিয়ে যায় পাশের নির্জন ঘরে। হারান সম্ভ্রম। সন্তানের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও মানসিক এক অসীম কষ্ট সেই থেকে বয়ে বেড়ান। সম্ভ্রম হারানোর পর তাদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে যখন আত্মরক্ষার জন্য লুকিয়েছেন, তখন হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাঁকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। সন্তানের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও মানসিক এক অসীম কষ্ট সেই থেকে বয়ে বেড়ান। এসব ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার সন্তান সাগরের। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা যায় সাগর। একাত্তরের জননী গ্রন্থে রমা চৌধুরী লিখেছেন, ‘ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কাঁদতে থাকেন, `আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)।’ একই অসুখে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তানও।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর। ১৬ই ডিসেম্বর বেদনার পথ পেরিয়ে আসে বিজয়ের ক্ষণ। কিন্তু রমা চৌধুরী থেকে যান আধারেই। স্বামী ফিরে এলেও সমাজের ভয়ে সেই যোদ্ধা স্বামী তাকে ঘরে তোলার সাহস পান নি। এতে করে প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়েও প্রতারণার শিকার হন। সেই স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
স্বাধীনতার পর ২০ বছর তিনি লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঘর-বাড়ি, সংসার-সম্ভ্রম, নিজের সৃষ্টি সর্বোপরি দুই সন্তানকে হারানো বিপর্যস্ত জীবনসংগ্রামী রমা চৌধুরী শেষ জীবনে হয়েছেন বইয়ের ফেরিওয়ালা। নিজের লেখা বই নিজেই ফেরি করে বিক্রি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করা এই বৃদ্ধা। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। বীরত্বের সাথেই তিনি তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, লেখনীর মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত তিনি বলে গেছেন রক্তস্নাত সেই সময়ের কথা।
হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাসী ছিলেন না রমা চৌধুরী। তাই তিন সন্তানকেই দেয়া হয়েছে মাটিচাপা। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পড়েননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপীড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পড়া শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেয়া। এরপর গত ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলেছেন রমা চৌধুরী।
তাঁর ছিল অগাত দেশপ্রেম। সেই প্রেম থেকেই শিক্ষক, সাংবাদিক কিংবা লেখক হিসেবে তিনি জ্ঞান ও নৈতিকতার আলো ছড়িয়েছেন নতুন প্রজন্মের মাঝে। ২০১৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নগরীর জামালখানে জার্মান ভাষা শিক্ষাকেন্দ্রে ‘রমা চৌধুরী: তাঁর কথা তাঁরই মুখে’ শীর্ষক আলাপচারিতায় নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘১৯৭১ সালে এদেশের মাটি স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু দেশের মানুষের মুক্তি আদৌ আসেনি। মানুষের মুক্তি না আসলে সেই স্বাধীনতার কোন ভিত্তি নেই।লেখাপড়া শিখে অনেকে বিদেশে চলে যায়। ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য দেশকে বঞ্চিত করা উচিৎ নয়। যে মাটিতে জন্ম, সেই মাটি আর মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করতে হবে। তরুণরা দেশপ্রেমে জাগ্রত হতে হবে।’
স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের পরতে পরতে কতো ইতিহাস কতো বেদনা, লাঞ্ছনা, কতো গৌরবগাঁথা জমে আছে তার কতটাইবা আমরা জানি। ইতিহাস বিকৃতির উৎসবে আমাদের চেতনায় জায়গা করে নিয়েছে সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মীয় উন্মাদনা। ফলে এখনও আমাদের লড়তে হচ্ছে মুক্তি যুদ্ধের পক্ষ–বিপক্ষ হিসেব কষে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এ দেশের নারীদের যে ত্যাগ তাঁর স্বীকৃতি শুধু বীরাঙ্গনা উপাধিতেই সীমাবদ্ধ।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জাতির জনক বলেছিলেন, ‘আজ থেকে প্রত্যেক বীরাঙ্গনার পিতার নামের জায়গায় আমার নাম বসিয়ে দাও ঠিকানা লিখে দিবে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি।’ বঙ্গবন্ধু জীবিত অবস্থায় অনেককেই বিভিন্নভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের আরেক কালো রাতে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে যায় । কেমন আছেন একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার আমাদের সেইসব ভগ্নি, জননী, কেউ তাঁদের খবরও রাখেনি। তেমনি রমা চৌধুরীও সর্বস্ব হারিয়ে জাতির কাছে পেয়েছিলেন শুধুমাত্র ‘বীরাঙ্গনা’ তকমা। হয়তো কষ্টভরা অভিমানে হয়তো এর চেয়ে বেশি চানওনি স্বাধীনতার এই বীরজননী।
রমা চৌধুরী নিঃসন্দেহে বীরত্বপূর্ণ এক সংগ্রামের নাম। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর পুরো জীবনটাকেই তছনছ করে দিয়েছিল। কিন্তু সবকিছু হারিয়েও তিনি প্রবল তেজস্বীতায় সবাইকে নিয়েই মাথা উঁচু করে সমাজে দাঁড়িয়েছেন। জীবন নিয়ে লড়াই করেছেন সময়ের সাথে। ‘একাত্তরের জননী’-খ্যাত বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী আজ ৩ সেপ্টেম্বর সোমবার ভোর ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শারীরিকভাবে তিনি পরপারে পাড়ি জমালেও তাঁর বিপ্লবগাঁথা জীবনকাব্য জাতির জন্য অনুপ্রেরণার।