রহমান হেনরী'র খেরোখাতা
রহমান হেনরী'র খেরোখাতা

কবি, বিশ্বকবিতার বাঙলায়ন কর্মী, ‘পোয়েট ট্রি’ নামক কবিতাকাগজের সম্পাদক।
জন্ম: ১৪ জানুয়ারি ১৯৭০, তদানীন্তন রাজশাহী জেলার নাটোর মহাকুমায়। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত শৈশব কেটেছে নাটোর শহরে।


পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের নির্বহিী বিভাগে কর্মরত , বর্তমানে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করছেন।
উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ:
বনভোজনের মত অন্ধকার (১৯৯৮), গীতঅনার্য(১৯৯৯), প্রকৃত সারস উড়ে যায়(২০০০), সার্কাসমুখরিত গ্রাম(২০০১), খুনঝরা নদী (২০০৫), তোমাকে বাসনা করি(২০০৫), গোত্রভূমিকাহীন(২০০৯), দুঃখ ও আরও কিছু আনন্দ(২০১১), ব্রজসুন্দরীর কথা(২০১২), প্রণয়সম্ভার (২০১৪);
বাঙলায়নকৃত কবিতাগ্রন্থ:
আদোনিসের কবিতা(২০১২), অধিকৃত ভূখণ্ডের কবিতা (২০১২), কবিতার ত্রিভুবন (২০১২), নোবেলজয়ীদের কবিতা(২০১৪);

খেরোখাতা: অক্টোবর ০৩

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

ফাঁদের কোলাহল ছিন্ন করে, নিশ্চিন্ত শিকার গেছে— দিগন্তের সৌখিনতা ছুঁতে।শিশু-ফসলের মাঠে, বায়ুর খরগোসগুলো নৃত্যমগ্ন। কাঁচা-রং সুর আজ স্বরের মুদারা পেয়ে, ঊর্ধগামী; ছুঁতে চাইছে— তারা। হতভম্ব চুলে চুল: গিট্টুরত। নিঃস্ব ফাঁদের আর্তনাদ: চলচ্চিত্রে যুক্ত করছে— বাড়তি আস্ফালন...
.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

কে এক সন্ন্যাসী আজ বাতাসে মিশিয়ে দিচ্ছে ভাং। নিশ্বাসে নিশ্বাসে, মনে, নেশার আনন্দ মেখে যায়... আসবে সে; এই পূর্বাভাস: সমতল, জলভূমি, পাহাড় পেরিয়ে তীব্র নীল ঘোড়া— ছুটে আসছে; বাতাসে বাতাসে তার এত মিষ্টি ঘ্রাণ! মৃতদের জন্য যত আনন্দ সংগীত, জীবিতের জন্য শোকগাথা নিয়ে— বসে আছো নদীমূলে, বিলাপবৈরিতা।

জীবন কী বিচিত্র, দেখো! বেঁচে থাকলে— স্মৃতিভূমি, কর্মস্থল, বিছানা— বদল হয়ে যায়; প্রথম দিনের হাওয়া, একই রূপে কোনওদিন নিকটে আসে না। তবু, পূর্বাভাস আসে; সমুদ্রফেনার মনে মেখে যায় নীল।

তোমার পতাকা নিয়ে নিঃসঙ্গ কন্ঠস্বর— বসে থাকে: মাঠে—
.
.
[তৃতীয় পৃষ্ঠা]

অগণন বৃক্ষের ভিড়ে, অরণ্যভূমিতে, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৃক্ষ বেড়ে ওঠে যদি; একদিন, টের পাওয়া যাবে। রেলজংশনের দৃশ্যে, দুয়েকটি ট্রেনের দেহ, অন্য কোনও ট্রেনকেও অনায়াসে গোপন ও আড়াল করে থাকে— নিবিষ্ট ভ্রমণকারী, ঠিকই চেনে: গন্তব্যের ট্রেন। স্বপ্নকে সম্পূর্ণত উদ্ধৃত করা: আসম্ভব। স্মৃতিকেও। কিছু কথা অবর্ণিত থাকে। ওটুকুই অধরা সুন্দর—

আমি সেই অধরা অধরে, প্রত্যহ পাঠিয়ে থাকি স্বতন্ত্রসাধনে গড়া প্রার্থনানিষ্ট চুমুগুলো। সবই তার অপচয়ে লটকে যাবে: দিগন্তের ফাঁদে— বিশ্বাস করি না। একটি কবরতলে লুক্কায়িত থেকে যেতে পারে— আরও সব শতাব্দীর প্রাচীন কবর; এ প্রকার সম্ভাবনা এবং বাস্তব, অস্বীকার করি না কখনও। তা সত্ত্বেও, সম্পূর্ণ স্বপ্নের স্মৃতি লিখে রাখি: উদ্ধৃতির রেশমি জমিনে; আর,

মনে রাখি: নিথর সমুদ্রজলে, একদিন ঝড় উঠে যাবে—
.
.
[চতুর্থ পৃষ্ঠা]

নির্বাক গ্রন্থ আর ততোধিক মৌন একটা গান— স্তম্ভিত, একঘেঁয়ে; আমার যন্ত্রণাস্তম্ভ ঘিরে, চুপচাপ বসে থাকুক— এর বেশি চাইনি কিছুই। গ্রন্থ কি স্বপঠিত হয়ে উঠলো? ইত্যবসরে! গানের নিঃশব্দবাণী মনে মনে ভেঁজে নিচ্ছে: যুতসই সুর এবং যন্ত্রণাস্তম্ভ হতবাক; এ তিনের কোনটা যে তুমি— সে প্রশ্ন এখনও গুরুত্বপূর্ণ নয়।

অতীত ও ভবিষ্যত— একই উত্তেজনাবাহী নদী হলে, প্রশ্নটা গুরুত্ব পেতে পারে। আপাতত, পাথরই প্রধান। গর্ভবতী। পুষ্পসম্ভাবনা নিয়ে কাতরাচ্ছে: প্রসববেদনা—
.
.
[পঞ্চম পৃষ্ঠা]

ইতিহাস বলছে: বিন বখতিয়ার খিলজী ছিলেন: তুর্কি। ক্ষিপ্রতাই তুর্কীয় প্রাণশক্তি। আমি বলছি: ক্ষিপ্রতা, প্রাণঘাতিও হতে পারে।

ইতিহাস বলছে: তিনি যখন নদীয়া পৌঁছান, খণ্ডিত ছিলেন— শক্তিতে। সিংহভাগই, পেছনে পড়ে গিয়েছিলো। আমি বলছি: অতর্কিতকে, সেন যদি, অতর্কিতে প্রত্যাঘাতের সাহস দেখাতেন— গল্পটা, অন্য কালিতে লেখা হতো।

আমি ও ইতিহাস, প্রস্থানে গেলে— যাত্রাপালার বিবেক বলছে: ঘটনাপ্রবাহের নির্লিপ্ত উপস্থাপক: ইতিহাস। সে কোনও মন্তব্য করে না; অথচ সেই বর্ণনভঙ্গি, প্রায়শই বলতে চায়, ‘‘শুরুতেই ভূত হয়ো না, আগে মরো!’’

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ২২

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

কে আমাকে বাসলো ভালো, ডাকলো কাছে আজ; কে আমাকে মাথায় তুলে নাচলো ভীষণ: ভৃঙ্গ-নটরাজ। কে আমাকে, ঈর্ষামগ্ন, এমন অন্ধরাতে— ডুবিয়ে দিলো, ঘৃণায়-অবজ্ঞাতে। কে আমাকে নাম দিলো: তার পোষা-প্রাণির সাথে। কী এসে যায়, তাতে?

আমি: পিপীলিকার চেয়েও ক্ষুদ্র প্রাণি। তবু, জানি: হৃদয়-খোলা উদ্ভাসনের প্রাতে, আমি তো ঠিকই জানি: ভয়াল-ঝড়ে, চোখ-ধাঁধানো অন্ধকারের রাতে, এসেছিলাম— একটি মশাল হাতে। চোখ খোলোনি;

আমার কী আর দোষ হয়েছে তাতে?

.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

যে কোনও দুঃখই বিরল প্রজাতির বীজ হয়ে উঠতে পারে। অঙ্কুরোদ্গমের মধ্য দিয়ে যতক্ষণ না তারা হয়ে উঠছে: ভালোবাসার চিরহরিৎ তরুশ্রেণি; দুঃখগুলো পাকতে পাকতে, যতক্ষণ না— প্রেমফল; যতক্ষণ না ছড়িয়ে দিচ্ছে: তোমার অমৃতহাসি ও জ্যোৎস্নার সম্মিলিত সুগন্ধি;

বর্ণমালার কসম, ততক্ষণ, ওদেরকে আমি প্রকাশ্য করবো না।

.
.
[ তৃতীয় পৃষ্ঠা ]

খোসা ফেটে, নগ্ন বেদানা থেকে, হঠাৎ ছড়িয়ে পড়লো: দানা দানা আলো। দূর্বাঘাসে— ভোরের শিশির রেখা। জোয়ারের ফেনা থেকে উঠে আসা নুন নয়, দুয়েকটি উদ্ভ্রান্ত হরিণ চেটে খাচ্ছে: ঘাসের লবণ। বহুদূরে, চাষের দুনিয়া থেকে উঠে আসছে: কৃষকের হাই। হরিণজন্মের এই মুক্ত আসমান, তোমার পথের দিকে কেঁপে ওঠে— অপ্রতিভ। তোমার ঘুমের পাশে, এক কাপ গরম কফির ঘ্রাণ— রেখে আসে প্রভাতের মায়াবি বাতাস।

এ রকম একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে চেয়ে, আমরা প্রত্যেকেই, হয়তো চলে গেছি: নিদ্রার দখলে!

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

বিরক্তিকর, একঘেঁয়ে, বাদলা। শেষই হচ্ছে না। মাটির মেঝেতে ছক টেনে, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের বাঘ-বকরি খেলছি—

উসকো-খুসকো চুল। বহুদিনের না-কামানো গোঁফদাড়ি। নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতা। অপেক্ষা করছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, শেকড় গজাচ্ছে। পা দুটো ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে... বাদলা দিনের অবসান নেই। শেষ হচ্ছে না বাঘ-বকরি। আরও একটা দশক দৌড়াচ্ছে পঞ্জিকার মাঠে;

ঢোঁড়াসাপ-কবলিত ব্যাঙের, একটানা আর্তনাদ, বহুদিন— আমাদের জাতীয় সংগীত।
.
.

[পঞ্চম পৃষ্ঠা]

বালক শোনাবে এক বৃদ্ধাকে, অশ্রুতপূর্ব রূপকথা— সন্ধ্যা তার আয়োজন করে। আদমের আর্তনাদ: অক্ষরে মুদ্রিত। বিবি হাওয়া, ইলশেগুঁড়ি জ্যোৎস্নায়, নেমে এলো বৃষ্টির আসরে। রেশমগুটির রাত, জীবন্ত নীলের মধ্যে ডুব মেরে, অধিধ্বনি শব্দ ছড়ায়।

আজ রাতে, মাৎস্যবোবা নারীকে ডেকেছি: স্মৃতিলতা!

বল্কানো জলের মধ্যে, আমাদের মাদুরবৈঠক শুরু হলো— এইবার শোনা যাবে: বোবা ও বধির ভেবে, কে কাকে, কতবার শুনিয়েছে রাষ্ট্রীয় গোপন। কতবার রীতির উচ্ছ্বলও। জানিয়েছে: গান শুনে, সুর আর বাণীব্রতে, পাখিদের নাম রাখা হয়।

ব্যক্তি তার অস্তিত্বের মালিকানা, রাষ্ট্রকে দেয় না, নিশ্চয়! রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডজুড়ে, চিরকাল, তবু তার স্বত্ব জারি থাকে...

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ১৮

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

বিষাদ, গোপনে এসে, জেঁকে বসলো— নম্র ভূগোলে; বিভূতি, কোথায় থাকো তুমি! অশ্রু পালিয়ে গেলে, বহুবার ভেবেছি যে, আমি হয়তো অনুভূতিহীন, খুব নির্বিকার কেউ; কিন্তু দেখো, একবিংশ শতাব্দীর এই এক তুচ্ছ ঘটনা, অশ্রুগ্রন্থিকে আজ নবজন্ম দিলো:

‘‘স্বীকারোক্তি, অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়া, আগে থেকেই ওঁৎ পেতে থাকা, আকস্মিক গুলিবর্ষন, আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি... পালিয়ে যাবার চেষ্টা, এলোপাথারির মধ্যে— গুলিবিদ্ধ—’’

এই এক মৃত্যুদৃশ্য, গল্প, বিবরণ— প্রতিদিন ছায়ালিপি হতে হতে, শত ও সহস্র পৃষ্ঠা,
ক্রমশ জটিল গ্রন্থ— বাকরুদ্ধ বিষাদ এখানে এসে, ডুকরে কেঁদে দিলো: ‘‘বিভূতি, কোথায় থাকো তুমি?’’

.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

বাঘেদের বিড়ালত্ব পুষেছি যে-মনে,
সেখান থেকেই দেখি: অবশ্যম্ভাবী কালো দাগ;

পদে-পদবীতে গেলে— লোকালয়ে, নিরিবিলি বনে
বিড়ালও কেমন যেন, হয়ে ওঠে— বাঘ!

.
.
[ তৃতীয় পৃষ্ঠা ]

ভোর হলো। অচেনা সুদূরে এক চেরাগের শিখা, ধারাক্রমে, নম্র-উদারা থেকে গনগনে তারস্বরে গেয়ে উঠলো মধ্যাহ্নের সুর; অথচ এখানে, দেখো, সমুদয় বৃক্ষে, তৃণে, শিশিরে শিশিরে, বিন্দু বিন্দু রাত জমে আছে— প্রহরবিভ্রম জাগে। নদী থেকে মাছেরও কাতরধ্বনি উঠে আসছে— পাড়ভেদী। তাদের শরীর চিরে, ছুটে যাচ্ছে তীব্র জলযান, উচ্চাকাঙ্ক্ষী গতি; এ কৃত্রিম আলোড়ন, ঢেউ-বিপর্যয়, কখন স্তিমিত হবে?

বসে আছি, খেয়াহীন, নদীর কিনারে। সাঁতারে প্রস্তুত মন; তোমার লালসাক্ষেত্র পার হয়ে, চলে যাবো— নদীর ওপারে।

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

অনাগত দিন ও নদীর জন্য অনন্ত অপেক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকি, আর মধ্যরাতে মনে পড়ে: পুরনো বন্ধুর সাথে বহুদিন দেখা হয় নাই— সে সময়, লক্ষ করো, নবিশের হাতে, এইসব চলতি দায়িত্ব দিয়ে, পুরাতন চাঁদ গেছে— অবসর প্রস্তুতি ছুটিতে; ধাঁধা-জ্যোৎস্নার আলো বিভ্রান্তি ছড়ায়। বন্ধুদের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে, মধ্যবর্তী পথের ফাঁপরে পড়ে যাই; ভুলে যাই নিজগৃহ, বন্ধুর ঠিকানা—

থৈ থৈ শিশিরে গড়াচ্ছে স্মৃতি, আর্দ্রসবুজ ঘাসে, আমাদের বিচ্ছিন্ন অঙ্গাদি পরস্পর সমন্বয় খোঁজে। মনে পড়ে: আমাদেরও কোথাও যাবার কথা: নিজগৃহে, পুরাতন বন্ধুর বাড়িতে, অনাগত দিন কিংবা ভবিষ্যত নদীর নিকটে—
.
.

[পঞ্চম পৃষ্ঠা]

এভাবেই ইতি টানা ভালো। এই বিষাদকরুণ সুর— একটানা অনেক বছর, নির্জন রাত্রির গ্রামফোনে, একা একা শুনে— নটে গাছটি মুড়ে দেয়া ভালো।

অতি সাধারণ বৃষ্টি। তবু আজ বর্ষণের শব্দজুড়ে: এই যে তোমার নাম বাজে, এ-তো সেই নারীকণ্ঠ! একদিন মাঠের কিনারে, যে তোমার কঙ্কাল ফেলে রেখে, চলে গেছে অন্যভূগোলে!

তারই ঘ্রাণে বাতাস সুগন্ধী হয়ে আছে। ও হাতের স্পর্শ পেয়ে, মাঠভরা টাটকা শাক-সব্জি-আনাজ— রন্ধনশালায়: এতো রুচিকর খাদ্যাবলী অধীর, উন্মুখ...

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ১৬

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

কে আনে আশ্বিন মাসে কাঁচা বাঁশে
এত এত, এত যে ভ্রমর;
জলকে নীলাভ করে— কার পূণ্যহাত?

সুদূর, তোমাকে ভাবি শরৎ-আভাসে,
আমার মনের যত কাটে না তো ঘোর!
পূর্ণিমায়, তোমার পাশেই বসবো, সোমের সভাতে;
প্রগাঢ় সবুজ রাতে আসমানের ডাক যদি পাই—
এইসব ভেবে, আজও, কেটে যাচ্ছে দিন...

অথচ অরণ্যঢেউয়ে তোমার তো সাড়ামাত্র নাই!
নিকটেই বসে আছে: নিঃসঙ্গ আশ্বিন;
মাইল মাইল একা নদীদীর্ঘ রাত
আমাকে যে বলছে: ‘‘ধরো, স্মৃতিভেজা হাত!’’

.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

জগতে যতদিন মানুষ টিকে থাকছে; আগুনের আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক নয়—

পুড়ে যাচ্ছে হরতনের টেক্কা; আর আমি সমুদ্রকে বলছি: ‘‘জল সর্বদাই অগ্নিনির্বাপক— এমন সিদ্ধান্ত:অগাণিতিক’’। ইস্কাপনের বিবি পুড়ছে; আর আমি পৃথিবীকে বলছি: ‘‘অগ্নিকাণ্ডমাত্রই দমকল বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা— এ ফের কোন আইনের কথা? ‘’

বক্তৃতায় যতদিন আগুনের কথা থাকছে; প্রকৃত সত্য লুকিয়ে পড়বে ভস্মকণায়—

চিড়তন পুড়ছে না। রুইতন উড়ে যাচ্ছে— একুশ বা একচল্লিশের দিকে; অার আমি ইমার্জেন্সি কল করছি: ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রদর্শিত নাম্বারগুলো ধরে ধরে—

.
.
[ তৃতীয় পৃষ্ঠা ]

পথের দুপাশে; কিংবা বহুদূরে, ফুটে আছে— পুষ্পবিভ্রম।
অথবা বিভ্রান্তি বলে কিছু নাই— ফোটেনি ওসব;
ভেজা কম্বলের মতো অন্ধকার চেপে ধরছে: রাত্রির দম,
আকাশে যা উড়ে যাচ্ছে— পাখি নয়, পাখিদের গতিময় শব।

স্বপ্ন বাঁচাচ্ছো বলে, স্বপ্নকে মন্দিরের যূপকাষ্ঠে তোলা,
তোমাতে সম্ভব। কানাকড়ি পায় নাই যে ভিখিরীভোলা,
তোমার ভাণ্ডার থেকে, তারই তো অপূর্ব গানে গানে
সারারাত্রি প্রশান্তির ঘুম নামে চোখে! আবার প্রত্যূষে,
তাকে বেঁধে ফেলো; হাতের চাবুক ওঠে ফুঁসে।
মহিয়সী, রাজকীয় রীতিনীতি— সবিস্তার জনতাও জানে।

আমিও শিক্ষিত হই, দিনে দিনে, ও ক্ষমতাবতী,
তোমার ইশকুলে পড়ি আজকাল, তোমারই কল্যাণে;
জানো না? বিরহে নয়— মিলনেই সর্বাধিক ক্ষতি!
ফুলের বিভ্রম তুমি, ফুটে আছো— আগাছা-উদ্যানে।

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

নিদ্রাহীনতার সাথে গল্প করতে করতে, অনেকগুলো সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছিলো— রাত। একটু পরেই ভোর হবে। ধীরে ধীরে, পাখিরাই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে— পাখিদের।

পোড়াতে চাও? —চিতায় সাজানো কাঠ, আগুন, আরও যতো উপকরণ... কী দরকার এতসব আয়োজনের? আমার জন্য, তোমার নীরবতাই যথেষ্ট।
.
.

[পঞ্চম পৃষ্ঠা]

যত প্রকারে সম্ভব, সত্যকে অস্বীকার করতে করতে,
আমরা কাঁচা-বাজারের দিকে যাবো—
অম্নি, সত্যের লাফিয়ে ওঠা হাত,
অামাদের টুঁটি চিপে ধরবে;
সহুংকার বলবে: ‘‘যা আছে, বের কর্!’’

সত্যকে অস্বীকার করতে করতে,
আবারও, আমরা, বাড়ির পথে ছুটবো—

আমাদের রান্নাঘর: থৈ থৈ জলে ভাসবে...

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ১২

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

জাহাজ ভেঙে যাবার পর— ঢেউ ও স্রোতের বিপরীত-সাঁতারে,
যারা পৌঁছে গিয়েছিলো উপকূলে, আমরা, এখন আবারও
তরণী-সহায়হীন ওইসব দৃঢ় নাবিকের কথা বলবো;
সবুজ বনভূমি, নদী, ঋদ্ধপ্রান্তর, পাখি এবং
দূরন্ত সব অশ্বারোহী‘র কথা বলবো;
আর দেখবো: দলবদ্ধ কুকিম্ভূতেরা
সবৃক্ষমাটি খাচ্ছে, নদী গিলছে,
সাধের বদ্বীপ চৌচির হচ্ছে
অদৃশ্যত, দৃশ্যমান
ভূমিকম্পের
প্রকোপে;

.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

মেঘই থাকতে চেয়েছিলাম— বৃষ্টি হবার আগ্রহ ছিলো না। উষ্ণবৃষ্টির প্রতীক্ষায়, উন্মুখ আর উন্মুক্ত থাকবে: বিলাসী ও রমণপ্রিয় বালিকারা; তাদের কথা ভেবে, বেড়াতে গিয়েছিলাম যে জঙ্গলে, সেটা ছিলো— অবারিত ফসলের মাঠ। সরলতা খুঁজতে, সারাটা জীবন আমাকে স্থির তাকাতে হয়েছে: আলোর উৎসগুলোর দিকে। লেডিস হোস্টেলে, দেখলাম: হোস্টেল নেই, মেসবাড়ি; বিদ্যুৎহীনতায় সারারাত হ্যাজাক জ্বলছে— সেই শাদা আলোর মধ্যে, ম্যান্টেল হয়ে, সমগ্ররাত্রির জন্য পুড়তে হয়েছিলো— আমাকেই। হাতগুলো অদৃশ্য। ওরা মাথা রেখেছিলো— চেয়ারের হাতলে; এবং রাতভর গেয়েছিলো— একমাত্র গান:

‘‘ধূলি কি তরল? বলো! ধূলি কি কঠিন?
ধূলি কি আচমকা তপ্ত উদাসীন হাওয়া?
কল্পবিজ্ঞানে ফোটে ফিকশানের দিন,
বস্তুমাত্র ছদ্মবেশী; ত্রিবিভূতি-ছাওয়া!’’

প্রত্যূষে আমাকে মৃত পাওয়া গিয়েছিলো— শরতের চরে। কাশবতী বলেছিলো: এই লোক মারা যাবে, কিন্তু তার মৃত্যু হবে না—

.
.
[ তৃতীয় পৃষ্ঠা ]

অনেক বছর ধরে, তাকে খুঁজছিলাম আমরা। তার অফিসে এবং বাড়িতেও। মাঝেমাঝে পেয়েও যেতাম; কিন্তু তার অফিস ও বাড়ি কোনওদিনই খুঁজে পাওয়া গেল না। ভাবো তো! একটা রাজধানীর মধ্যেই সেই অফিস থাকবে এবং তার বাড়িটাও— এমনটিই আমাদের ধারণা; অথচ মাঝেমধ্যেই তাকে হারিয়ে ফেলতাম। আর তার অফিস ও বাড়ি, উড়ে যেতো— মহাশূন্যের দিকে।

কী যেন প্রয়োজন ছিলো। পিতৃহীন নগরের মধ্যে, আমাদের হাহাকার, ঝাঁকুনি খাচ্ছে— এভিন্যুগুলোর খানাখন্দে। যুগাধিক বয়সের ভাগাড় থেকে উঠে আসা অচেনা একটা গন্ধ, বস্তা সেলাইয়ের সুচ হয়ে, স্মৃতি ও বিস্মৃতিকে এফোঁড় ওফোঁড় করছে—

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

একাধ্বনি শব্দগুলো, মাঝেমধ্যেই, আতঙ্কে ফেলে দেয়। কোনও কোনও দোকাধ্বনি শব্দ ভেবেও চিন্তায় অস্থির লাগে খুবই।

ফুট আর বল তো পরস্পর বন্ধু নয়! আজন্ম লাত্থি খেতে খেতে, বলেরও ছাল ছুটে যায়— গণতন্ত্র পেতে চাইলে, জনতাকেও ইট হতে হয়। ইটের সামনে, দেখো— কত সম্ভাবনা! নির্মাণকালে, কেউ কেউ আস্ত থাকে। কেউ আধলা, কেউ আবার হাতুড়ির ঘাঁই খেয়ে, খোয়া হয়ে যায়—
.
.

[পঞ্চম পৃষ্ঠা]

সৌড়ঝড়ের আগে মনে হচ্ছে: আবার তোমাকে ভাবা যাক। আলোর ঝলক আসছে, এমন ঔজ্জ্বল্য এসে আমাদের পৃথিবীতে আছড়ে পড়ছে—রেডিও তরঙ্গে লাগছে ভয়ানক চাপ! যোগাযোগ মাধ্যম— স্তব্ধ।

সুর্যকেন্দ্রে, দাহ্যমান চুল্লির ভেতরে, কিছু কিছু অঙ্গার নিভে যাচ্ছে; আলোতে ও কসমিক জ্যোতির্বলয়ে, আরও আরও জটিল ঘটনাবলী ঘটে যাচ্ছে— অলক্ষে, নীরবে। এইসব: ব্রহ্মাণ্ডের নিরন্তর খেলা। চলমান।

জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, সর্বমাধ্যমে আজও, তোমার পথের দিকে প্রতীক্ষারা জেগে আছে— জীবন্ত আকাঙ্ক্ষা আছে ডানাময়—আমার বিদ্যুৎকণা, তুমি কোন শূন্যমাধ্যমে বসে আছো?

আবার চুল্লিতে আসো! অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাক— রক্তসঞ্চালনে!

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ১১

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

দেখো
সিঁড়িগুলোকে:
মখমলে মুড়িয়ে দেয়া
হয়েছে; অথচ প্রতিটি ধাপের
নিচেই মাংসাশী পশুর গর্জন— সতর্ক
থেকো, ওইসব সুগন্ধী আর পোশাকী জেল্লা
থেকে। রূপযৌবন এবং চাকচিক্য খুবই কার্যকর
ব্যবস্থাপনায়, সচেতনের বিবেক আর বোকাদের বেদনাকে
ঘুম পাড়িয়ে দিতে জানে। নিশ্চয় তোমরা ছলনা ও মেকাপে বিভ্রান্ত নও!

.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

সমতলে, উপত্যকায়; এবং ছোটখাট চরাঞ্চলে, গাছে লটকে থাকা মৃতলতার মতো আটকে আছে গোলযোগপূর্ণ— আবহাওয়া। কোনওদিক থেকেই কোনও সুসংবাদ আসছে না।

গতকালও হতোদ্যম ছিলাম। আজ হাতুড়িচূর্ণ করছি: শব্দপাথর। আঁঠা বানানো হবে— বলা চলে, ফুটোফাটা বুঁজিয়ে দেবার পুডিং। ঝড়ো হাওয়ার শনশন বাজছে— দূরে। জলাভূমি ছেড়ে, এবার, একটু মধ্যম উচ্চতায় যেতে হবে।

আবারও বানাতে হবে: কাঠের ও টিনের বাড়িঘর, আসমান, মেঘ—

.
.
[ তৃতীয় পৃষ্ঠা ]

ছুটির দিন। বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাই নয়— ডুবেও যাচ্ছে ঢাকা। অনেক গাড়ি। পথেই আছি; দাঁড়িয়ে আছি। স্তব্ধ সবার চাকা। আবার চলছে। একটা গাড়ির জানালার কাচ নামে— ‘তোমায় আমি কিনতে চাই গো, ভালোবাসার দামে;’ তাকে এখন কী বলি, মন? ঘড়ির কাঁটায়, সন্ধ্যা যাচ্ছে রাতে— ভিজতে ভিজতে, উঠলাম তার সঙ্গে, তৎক্ষণাতে।

এও সম্ভব! ভাবছি। তিনি বলছেন চালককে: ‘যাচাই করবো, বোটানিক্যালে নিয়ে চলো বালককে’। আমি তো বালক। সারাটা জীবন বালক থাকতে চাই-ই— কিন্তু গেলাম বোটানিক্যালে; নিজেও ছিলাম দায়ী? আমাকে বললো: ‘ সুন্দর তুমি, দৃঢ়তা আছে; যথেষ্ঠ সুঠামও’। কখন যে তার ঘর চলে এলো! নারীটি বললো, ‘নামো!’

তারপর যা, বলবো না আর। টাকাও পেলাম কিছু— সুন্দরী সে। অপরাধ তবু ছাড়েনি আমার পিছু!

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

ভুলো মন। আর্ট-ফিল্ম দেখতে চেয়ে, বহুবার ঢুকে পড়েছি: সার্কাসের তাঁবু গুলোতে— যেখানে, বাঘ-সিংহ-হাতির চেয়ে, ক্লাউনের সংখ্যাই বেশি।
.
.

[পঞ্চম পৃষ্ঠা]

প্রগলভ শতাব্দী; সে এক নিপুণ সওদাগর। নকল মুদ্রায় কিনে নিচ্ছে: আমাদের রেশমিচুড়ি মন—

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ১০

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

আপেল-বাগানবেষ্ঠিত, সেই বাড়িটির স্বপ্ন, আমাকে ডেকে নিয়েছিলো— কাশ্মির অব্দি। পাপের ভয়; বা পূণ্যের কাঙ্ক্ষা নয়— আমার সমস্ত রাজনীতি যোগ দিয়েছিলো— সুন্দরের দলে। আহ, কী ভয়ানক সেই বাস্তবতা! যখন, জেনে ফেললাম: মারণাস্ত্রগুলোও কম সুন্দর নয়; এবং রাষ্ট্ররক্ষার নামে, সেগুলো জমা হচ্ছে: মানুষেরই বিরুদ্ধে। আস্থা হারাতে হারাতে, নিঃসঙ্গ মেষপালকের দুঃখকেও হার মানাতে বসেছি। আর আমার স্বপ্নগুলো, মৃত গবাদির মতো অবিরাম ভেসে ভেসে, পাক খাচ্ছে: জলোচ্ছ্বাসের বিনাশী স্রোতে...

হায়, আমার আপেল-বাগানের স্বপ্ন! সুন্দরের পক্ষে, হায়, আমার রাজনীতিতে যোগ দেয়া—

.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

কর্মস্থলে, রান্নাঘরে, পাঠ্যপুস্তকের ভেতর দিয়ে, পথে পথে— বয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণনগতির জীবন। ঘড়ির ডিজিটে দেখছি: ভোর, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা... ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠার ভেতরে, বদলে যাচ্ছে— একেকটা দিন। যেন, ক্রমধাবমান তারিখগুলোই জীবনের উপভোগ্যতা!

বর্ণগন্ধরূপরসহীন সময়ের ধারণার মধ্যে— ফুরিয়ে যাচ্ছে আয়ু। কিন্তু ইতিহাসের ভেতরে, বারবার নড়েচড়ে উঠছেন— রানি। তরতাজা আর জীবিত— ইংল্যন্ডের।

সুবাসিত মধুভাণ্ডের মধ্যে, তার রাজত্বকাল, শেষই হচ্ছে না—

.
.
[ তৃতীয় পৃষ্ঠা ]

আমার আয়না, বুকের মধ্যে অনেক মমতা লুকিয়ে রাখি— তোর জন্যে। তোকে, অপেক্ষায়, দাঁড় করিয়ে রাখতে চাই না— নিরানন্দ গৃহকোণে। সামান্যই চাহিদা তোর: দিনে-রাতে, মাত্র তো দু’চার বার সামনে দাঁড়ালেই হেসে উঠিস, প্রতিফলিত আমার মুখচ্ছবি দেখে, আনন্দিত হ’স। তবু ছুটতে হয় আমাকে, তোকে ফেলে রাখি: অালোক-বিচ্ছুরণহীন তালাবন্দি অন্ধকারে। বুকের ভেতর, ফাঁপর জমে থাকে— কখন ফিরবো।
কখন তোকে আবার দেখাবো: লাঞ্ছনা-লুকানো হাসিমুখটি। বিশ্বাস কর— ও রূপালিসুন্দর, শুধু তোর কথা ভেবে, কোনও অপমানই গায়ে মাখি না আর। কারও উপেক্ষা-অবহেলায়, কী এসে যায়! যখন, প্রেমিকার প্রতীক্ষা নিয়ে, বসে আছিস তুই, কেবলই আমার জন্যে—

আয়না আমার, জগতের যাবতীয় সুন্দর চোখবন্দি করে, আমি তো তোরই কাছে ফিরি—তোর রৌপ্যদ্যুতির কাছে! যে তুই, একমাত্র এই মুখের প্রতিফলন চেয়ে, আয়না হয়েছিস!

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

কোনও বস্তকেই প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। প্রতিবিম্বের একটা ধারণাকেই আমরা প্রকৃত বস্তু বলে শণাক্ত করি। সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষাই একেকটা অনুমান। যে কোনও প্রমাণই একটা আন্দাজ মাত্র।

সময়কে কেউ কেউ চিনতে পারে; কেউ কেউ কালের অন্তিম-অব্দি, শণাক্তই করতে পারে না। বহুবিধ পঞ্জিকাকৌশল অনুশীলন করতে করতে, একটা বুধবারকে আমি দীর্ঘ এক ঋতু হিসেবে— অনুধাবন করেছিলাম।

তার পথের দিকে, কোনও গতিবিদ্যা নেই। তার দিগন্তে নেই, এমনকি, আসমানেরও কাল্পনিক প্রপঞ্চ—
.
.

[পঞ্চম পৃষ্ঠা]

বন্ধুগণ, শুভ অন্ধকার! আলো অধিগৃহীত হতে চললো। অন্ধকারের মধ্যে, দিনটি ঢুকে যাচ্ছে— রাত্রির গহ্বরে। হ্যাঁ, আপনাদের পাইলট বলছি: সম্মানিত যাত্রিগণ, এবার একটা ক্রাশ-ল্যান্ডিং করতেই হচ্ছে, আমরা নিরুপায়, বন্ধুগণ! সামনের ট্রে টেবিলগুলো লক পজিশনে রাখুন। লুকিয়ে চুরিয়েও, সিগ্রেট জ্বালবেন না। নিজ নিজ মাথা হাঁটুর মাঝখানে ঢুকিয়ে ফেলুন। দুহাতে, যার যার নিতম্ব চেপে ধরুন। হ্যাঁ, আপনাদের পাইলট বলছি: এখানেই, অবতরণ করবো আমরা।

সত্যি, আপনাদের ষোল কোটি যাত্রীর জন্য একটা স্মরণীয় দিন হতে যাচ্ছে— আজকের দিনটি। এখনই সময়— মুহূর্তকে রেকর্ড করে রাখার সময়। হুমমম… আপনাদের পাইলট বলছি: বেশ একটা মজা হতে চলেছে। মজা পাচ্ছি খুবই; কেন জানেন?

আদিম অরণ্যের গুহা থেকে উঠে আসা— এক একটা মানুষ আমরা; প্রত্যেকেই।আমাদের মাথার পেছন দিকেও আছে: এক জোড়া চোখ। রেকর্ড করুন, রেকর্ড করুন মুহূর্তটিকে! এক্ষুণি, এই বিমান, আছড়ে পড়বে মাটিতে। দু’ হাতে চোখ ঢাকুন। ঝাঁপ দিন— বিমান থেকে। এটাই সেই স্মরণীয় মুহূর্ত— রেকর্ড করুন টাইম।

এই যে, দেখুন! আর কোনও পাইলট রইলো না— বিমানে। ঝাঁপ দিন— মনে রাখবেন: কেউই একা নন— আপনারা ষোল কোটি। একটু সাবধানে… রেকর্ড করুন, টুকে রাখুন সময়। ঝাঁপ দিন... বন্ধুগণ, বিমান ক্রাশ করতে যাচ্ছে, একটু সাবধানে—

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ৯

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

দৃশ্যশীর্ষে ঝরে পড়ছে—
হেমন্তমাসের কাচা
হলুদিয়া ভ্রম,
অনিঃশেষ...

তোমার গানের মতো আরও গান
ইতঃপূর্বে অশ্রুত, নতুন
বেজে উঠছে বৃক্ষতলে; আধানাগরিক—
ছায়া তার এত গাঢ়!
তাকে তো উপেক্ষা করে
ছুটে যাচ্ছে:
অবসরহীন দ্রুতযান!
তুমিও কি লক্ষ্য করো? কারা আসে,
কারা চলে যায়— বারবার,
বিপ্রতীপ জীবনের দিকে! এখানে, বকুলতলা;
যৌন প্ররোচনা
পশলাবৃষ্টি শেষে, আঘ্রাণে ম’ ম’ করে—

আহা রে, ভিক্ষুক,
তোমার মৃত্যুর পর
ভিন্ন পোশাকে ফেরে
একই চেনা গান—
অথচ অশ্রুতপূর্ব। আচমকা
নতুন সুরে বেজে ওঠা:
টাটকা, রঙিন;
তোমার পুরনো গান
পুনরায়, নবজন্মে জাগে—
.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

নীরব ও ধনাঢ্য নৈঃসঙ্গ্যের পাশে, গলনরহিত মূর্তি— বরফের; পাষাণদৃঢ়তা পাচ্ছে, ধীরে; সেই মৌন নিঃশ্বাসের ক্রন্দনগান: শুনতে পেয়েছি, মিহি— কাদাজল, পাহাড় ও বিরান পেরিয়ে, এইখানে এসেছি— সবুজ; ব্যাঙ-ডাকা-ভোরে। এসে দেখছি: করুণ, বিষণ্ন, নগ্ন পায়ের কল্পনা থেকে আট বছর দূরে— একটি নূপুর শুধু পড়ে আছে।

কবিতাকম্পিত রাত, তাকে ঘিরে, থৈ থৈ অশ্রুছ্ছন্দে নাচে—

.
.
[তৃতীয় পৃষ্ঠা]

এত কর্দমাক্ত তুমি— তুমুল বর্ষণে, তবু, ধৌত করা অসম্ভব আজ। এত অন্ধকারে লিপ্ত... তোমার মূর্তিকে ঘিরে, রাত্রি কোনও পটভূমি তৈরি করছে না। গণিতের সাধ্য কী যে, তোমার শ্মশানে বসে গণনা সমাপ্ত করে: কত চিতা প্রজ্জ্বলিত হলো!

তোমার সমস্ত ঘোড়া, স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠছে— মাঠের ভেতরে... যুদ্ধে যুদ্ধে, পরস্পর
ওরাই রচনা করবে— নতুন শ্মশান!

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

অগ্নিকূপের পাশেই ছিলো— তুষার-মাখানো জলের খনি;

তীব্র দাবদাহে,
আমাদের দেহবাসনা ঝাঁপ দিলো: লাভাকুণ্ডে।

.
.
[ পঞ্চম পৃষ্ঠা ]

লাঠি-হাতে, পাইক ও বরকন্দাজ এলো। বললো: ‘‘দৌড়াও!’’ আমরা শুয়ে পড়লাম। এখন তো বিরতিহীন অশ্বপ্রবাহ— এক, দুই, তিন— আটবার; আমাদের পিঠে পিঠে খুরধ্বনি তুলে, ছুটে যাচ্ছে;

এবং চিঁহিসুরে গাইছে: ‘জন জন, জনতা হে, জনতা’’...

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ৮

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

তোমার চোখজোড়া: দুটো পদ্মদিঘি— পাশাপাশি। সেখানে, অজস্র যুগলে ফুটে আছে— বিষণ্নকমল; দুইফোঁটা জল, জমতে জমতে বরফ হয়েছে। নির্জন বাগানে, একা, বহুকাল দাঁড়িয়ে রয়েছো: দীর্ঘশ্বাস...

তোমার ভাস্কর জানে, কোন চোখে প্রেম; কোন চোখে নিষ্ঠুর-রসিকতা নাচে—
.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

দুটো বিন্দু, মিশে আছি পরস্পর; বয়ে যাচ্ছি— মহাসমুদ্রের দিকে। বিস্মৃতিপ্রবণ নীল আসমানের তলদেশে, আরও অসংখ্য স্রোতধারা বয়ে চলেছে, অবিরাম; ওদের কেউই তোমার নামোচ্চারণ করছে না, আমারও না।

এই যে অভিন্নপ্রায়-দেহে সময়যাপন, একেকটা জীবন পার করা— এটা প্রেম নয়; বরং বলা যায়: হঠাৎ সহযাত্রা। পথে থাকে: ভয়, ক্লান্তি, দুর্বিপাক, একঘেঁয়েমি। ভালোবাসা-প্রেম-বিবাহ: এইসব নামে, আমরা তো নিরাপদ হতে চাই! যে যার মতো পরিত্রাণ চাই; হায়, এর নাম ভালোবাসা নয়—

.
.
[তৃতীয় পৃষ্ঠা]

জল দু ভাগ করেছো। দু ভাগ করেছো শহীদমিনার। তোমার দু’ চোখের কোণায় নোংরা পিঁচুটি হয়ে বসে আছে: হিংসা, হিংসা—

বাতাস টুকরো টুকরো করেছো। ব্যক্তিগত কালিমায়, অনেক পাটে ভাঁজ করে রেখেছো স্মৃতিসৌধ। ডিম থেকে ইলিশের জাটকাগুলো দু’ রঙের শরীর নিয়ে বেরোচ্ছে: আলকাতরা ও পাকাধান; হিংসা হিংসা—

দুটো মাত্র নদী দিয়ে অনেকবার ছিঁড়েছো একটাই রুটিকে। তোমার অহমিকার সমাধিস্তম্ভ বৃক্ষের ক্রমবর্ধিষ্ণুতা পেয়ে যাচ্ছে— যথেষ্ঠ আগাম। ক্ষতের ভেতর থেকে ছাঁটাইযোগ্য মাংসপিণ্ড ঊর্ধমুখি হচ্ছে। হিংসা হিংসা—

ছোট্ট একটা বাঙলাশব্দে, তোমার সবকিছুকে ঢেকে দেবো। তোমার প্রকৃত কবরের দশদিগন্তে, আ-ভূমি-আসমান লিখে দেবো: ‘‘হিংসা ও প্রতিহিংসার সম্রাজ্ঞী’’।তাজিওডংয়ের চে’ উঁচু করে, লিখে দেবো: ‘‘তোমাকে চাই না’’।

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

রান্নাঘরেই জন্ম নিচ্ছে— ক্ষুধা। ডাইনিংয়ে তো ক্ষুধার গন্ধ ওড়ে! শয়নশয্যা নিবিষ্ট, একমনে, সমস্ত রাত ক্ষুধার খনি খোঁড়ে... দূরের বনে, কালচে সবুজ অজগরের ডানা; পেঁচিয়ে গেলো, লতায়-কাঁটাঝোপে; তার কী হবে? ভাবতে বসে, বৃষ্টির প্রকোপে, জলেশ্বরীর মতো ভাসছে দিনকানা, রাতকানা—

রাজার ঘরেই সবচে বড় ভিক্ষাযাঁচের ঝোলা! ভিখিরিরা দিশেহারা পথে— জনপদে নামবে কি দিন? কোন দেবতার রথে? রান্নাঘরেই জন্মালো হা-মুখ। টেবিল-মাদুর, সবখানে তার লালা— এঁটো খাবার খাওয়াই যেতে পারে; কিন্তু আরেক জ্বালা:

কুণ্ডলিনী বেরিয়ে আসে, খুললে— ভাতের ডালা।

.
.
[ পঞ্চম পৃষ্ঠা ]

শোভিত উদ্যান— তাকে অযত্নসম্ভূত জড়-জঙ্গল মনে করে, ফেলে গ্যাছো; লীলাক্রমে বুঝে গ্যাছো খাঁচার মহিমা! ওভাবেই থাকো। অবারিত উদ্ভিদের দিন আর তোমার অপেক্ষা নিয়ে, বসে থাকবে না। খাঁচাকেই মেনে নিও— নন্দন কানন!
.
২.
.
খাদে, পড়ে আছে বাস; আসে নাই উদ্ধারের ক্রেন।

পাশাপাশি সর্বশেষ ট্রেন
প্লাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে— ঝড়োহাওয়া এতো শব্দমান!
হুইসেল বেজে যাচ্ছে... তবু তাকে যাচ্ছে না শোনা;
এখনও তো সর্বশেষ যাত্রীটি এলো না!

জেরানিয়ামের দিকে ছুটে চলো, ভারক্রান্ত, নীল মনোযান—

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ৬

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

ওইসব সংগীতের উপাসক আমি; যে গুলো জন্ম নেয় আর বেজে ওঠে: ক্ষরণরঞ্জিত রাত্রির পথে পথে— তখন টু-শব্দহীন নিশাচর পাখি ও প্রাণিরা। ঢুলুঢুলু তাকিয়ে দুলতে থাকে: সুদূরের নক্ষত্রপুঞ্জ। রাত্রির হাওয়া ও নৈঃশব্দ্যের অচেনা নদী থমকে দাঁড়ায়; এবং মিহি কান্নার একটা গুঞ্জন ওঠে— চারপাশে। তাকিয়ে দেখি: সেই বিলাপের মসলিন ফেঁড়ে, বিগত শতাব্দ ও সহস্রাব্দের দিগ্বিজয়ী সম্রাট, চিত্রকর, কবি ও বুদ্ধিজীবিরা; এবং তাদের অটল সুন্দরী স্ত্রীগণ: প্রস্ফুটিত হচ্ছে। টের পাই: সংগীতের প্রতিটি উচ্চনাদী ও সূক্ষ্ণতম ধ্বনিও পাথরের কেন্দ্রদেশ থেকে তুলে আনছে— বিগত সময়ের ইতিহাসসমগ্র! ওইসব সংগীতের ভেতর থেকে জন্ম নিয়ে, প্রতিটি রাত্রির প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ান: একেকজন স্বর্ণরূপসী; যাদের উজ্জ্বলতা ও কমনীয় ত্বকের দিকে যৌন আগ্রহে এগিয়ে যেতে যেতেও, কোনও রাত্রিতেই আর এগোনো হয় না। কেননা, তাদের শরীরময় মাতৃগন্ধ; আর সেইসব দেবীমূর্তির ভেতর বেজে ওঠে: অস্ফুট 'মা, মা' বিলাপ; ফলে তো, আমাকেও রোদনমুখর লুটিয়ে পড়তে হয়: হাজার হাজার রাত্রির মঞ্চবেদিতে!

এভাবেই, সারাজীবন, আমার উপাসনাগুলো চলে যাচ্ছে: সংগীতময় রাত্রির নিঃশব্দতম নিবেদনের কাছে! কোনও ধর্ম, ঈশ্বর কিংবা ক্ষমতাকেন্দ্রের দিকে কিছুতেই এগোতে পারি না—
.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

আর এটা হলো সেই নিদ্রাপরীর উপাখ্যান— স্বপ্ন ও মৃত্যু পেরিয়ে, চতুর্থ এক রূপান্তরের ভেতরে যার বসবাস; অতি অপরিচিত একটা বাদ্যযন্ত্রের অনুচ্চ তানের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো সে। এখনও, নিদ্রার চেয়ে উচ্চতর আর মৃত্যুর প্রায় সমীপবর্তী সেই নিশ্চেতনে, বিরামহীন একটা স্বপ্নই বারবার চক্রাকারে ঘুরছে তার নিউরনে; এবং একমাত্র সংগীতের মূর্চ্ছনাই সতেজতা দিচ্ছে চলৎশক্তিহীন ওই দেহবিভাকে। অনাস্বাদিত সেই অভিজ্ঞতার গল্প স্বয়ং তার মুখেই শুনবো বলে, এক জীবন এই অরণ্যের পাশে, নদীবর্তী আমার বসে থাকা। এর নাম হয়তো প্রতীক্ষাই!

রূঢ় পশ্চিমের কোনও একটা ঝিলের অনৃত ঢেউয়ে, শৈশবের অবোধ খেলায়, তাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই দুর্ঘটনার অনেক বছর পর, একটা গোলাপের চেয়েও অধিক উজ্জ্বল কোনও দুপুরের নিরুদ্বিগ্ন রোদে, আবার সে জেগে উঠবে; স্পর্শ করবে— পরিত্যক্ত নিজ লাবণ্য মহিমা এবং উড়ে উঠবে পুবের দিকে— প্রতিটি চন্দ্রকলায়, একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে: চাঁদের দেহ; আর সেই নিদ্রাপরীর পুনর্জাগরণ-মুহূর্ত আসন্নতা পাচ্ছে, ক্রমশ...

পৌষসংক্রান্তির পূর্ণিমা যে বার চৌদ্দই জানুয়ারি আর শুক্রবার ছুঁয়ে উদিত হবে; ঠিক তার পরবর্তী চন্দ্রিমাই সেই মাহেন্দ্রপ্রহর— সে দিন, সেই পরী এসে ছুয়ে দেবে: প্রায়ান্ধ এক কবির আঁখিপল্লব; এবং সে দিনই, পূর্বদেশে নবপূর্ণিমাা—

.
.
[তৃতীয় পৃষ্ঠা]

আদিতে, একটা বিন্দু ছিলাম। মিশে গিয়েছিলাম— সমগ্র জলপৃথিবীর সাথে। ধীরে ধীরে আমার বর্ধিত হওয়া—

ছোট্ট, অনেকটা অঞ্জনি আকৃতির একটা মাছ হলাম। একখণ্ড পাথরের ছায়ায় আড়াল করতে পারতাম নিজেকে। ঘাসমাঠে অঞ্জনি হলাম।তারপর, ডানাময়। তারপর: বানর, গাধা... প্রবর্ধিত হতে হতে, মানুষ হলাম। কোনও জন্মেরই কোনও ক্ষতিপূরণ পেলাম না। কেবলই বিবর্তিত হতে থাকলাম— উদ্দেশ্যহীন।

একবিন্দু জল থেকে, আমার এ মানুষজীবন: জলেরই সম্প্রসারণ।আবারও মিশে যেতে চাই— সলিলসংসারে। সংক্ষিপ্ত হতে হতে, একফোঁটা জল— ডুবে-মিশে, অন্তর্ধানে যেতে চাই: জলগহনে...

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

খোয়াড় থেকে লাফিয়ে উঠলো। তারপর, উড়তে লাগলো—শুয়োরগুলো। খুব একটা উঁচুতে নয়;

ভয় হচ্ছিলো। একেকটার যা ওজন! উড্ডয়নচ্যুত হলে, স্কুলগামী শিশুরা না থেঁতলে যায়...

.
.
[ পঞ্চম পৃষ্ঠা ]

কত না হ্যাডম, সুখ— শরীরের; আরাম ও আয়েশের কত আয়োজন!
অথচ হাতিয়ে দেখি: ফের, খালাসী টোলায় আজও পড়ে আছে মন!!

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ৩

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

বাহাত্তর ঘন্টা অর্ধমৃতাবস্থার পর, নিদ্রা, তার ময়ূরপালক হাতে সুশ্রূষায় এগিয়ে আসে; তারপর আধামৃত্যুর প্রথম দফা— এবং আমরা যখন আমের পেছনে ছুটতে ছুটতে কেবলই আমসত্ত্ব পাই, তখনই, দ্বিতীয় দফায় আসো তুমি। যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত তোমার— যতই বলি: আজ যার জন্মদিন, হত্যা কোরো না তাকে! শুনতে চাও না কিছুই। তোমার যূপকাষ্ঠ পুনর্বিবেচনায় নেই। লঘু দেবতাদের জন্য অসীম তোমার পক্ষপাত। তোমার শ্রবণে আর দৃষ্টিতে, একচোখা দানবের কালো পট্টি বাঁধা, জেদি ষাঁড়— সবুজায়নের নামে, বনভূমি ও বৃক্ষনিধন ছাড়া শান্তি নেই তোমার... দুঃখিত, সোমবার, তোমাকে নিয়ে আমার মনে যথার্থ সংশয়। ভেবে দেখো: নথিপত্রাদি খুবই আগোছালো রেখেছো— হঠাৎ হুইশেল বেজে উঠলে, প্রমাণাদি তো দূরে থাক, নিজের বেণীও গোছাতে পারবে না। জানি: নির্বোধের চেয়ে দুঃসাহসী আর কেউই হতে পারে না; প্রিয় সোমবার, দীর্ঘ বিরহের পর, পুনর্মিলনের উত্তেজনাময় দিন হিসেবেও গ্রহণ করবো না তোমাকে—

প্রত্যাশা ও ভয় নিয়ে, আমার সামনে হাজির হয়: রোববারগুলো; কিন্তু যদি পারতাম—পঞ্জিকা থেকে মুছে দিতাম ওই নাম। সোমবার, তুমি অনন্ত সোমবারগুলোর ভেতর দিয়ে, বিলীন হয়ে যাও...
.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

যেখান থেকে রক্ত ঝরবার কথা, সেখান থেকে নয়— ঝরছে অন্য কোনওখানে। সন্ধ্যা নামার বেশ কিছু আগেই, মাঠের ঘাসে ঠোঁট মুছে, উড়ে যাচ্ছে— দানাখোর পাখিরা।যেখানে তোমার স্তনদ্বয় থাকবার কথা, সেখানে: ফোঁড়ার স্ফীতি; পুঁজ টসটস করছে। আর এত লেহনচিকিৎসা! অসুখ টেরই পাচ্ছো না—

এবার, শীত নামার আগেই, উড়ে আসবে পরিযায়ী পাখিদল। ক্ষত ও ফোঁড়ার গন্ধ— কত আগেই টের পায় ওরা! কারও কারও ঠোঁটই তলোয়ার। চিরে দেবে— গোপন ও পর্দার আড়ালে রাখা সত্যগুলোকে...

.
.
[তৃতীয় পৃষ্ঠা]

অবর্ণনীয় সুন্দরের মধ্যে ছুটে চলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতরেই, আমার হাত থেকে সে ছাড়িয়ে নিলো, নিজের হাত। তখন বৃষ্টি হচ্ছে। বসন্তরাত্রির দমকা বাতাস। লিঙ্গনির্বিশেষে, বিপুল কোনও সুন্দরের মধ্যেই, মানুষ ছেড়ে যায়— প্রিয়তম অন্য মানুষটিকে। কেঁপে-কেঁদে ওঠে: সুন্দরের বুক।

যখন তার কথা ভাবি, মনোরম সেই দৃশ্যাবলী আর রাত্রিটির স্বপ্নাবিষ্ট স্মৃতিই মনে পড়ে, সব চে’ আগে। শেষবারের মত, যখন, সে আমাকে ছেড়ে গেল— সেটা ছিলো অধিকতর সুন্দর আর মোহময় এক রাত্রির শহরতলী। শীতকাল। বহুক্ষণ আমি সাঁতার কাটলাম— ঝিলের পানিতে। তখন, হাওয়া খেতে আসা মানুষেরা, প্রায় সবাই ফিরে যাচ্ছে— যে-যার কম্বলের আশ্রয়ে। আকাশ মেঘহীন। বাতাস বরফের ছোট বোন। বাঁধের দু’পাশের জলগন্ধ আর সারি সারি অট্টালিকার পাশ দিয়ে, হেঁটে হেঁটে, ফিরে এলাম— নৈঃসঙ্গ্যের জমাট অন্ধকারে। এবং কী নিপুণভাবেই না ওই জলগন্ধ ও চকমেলানো দালানকোঠার অহমিকা, নিঃস্ব করে দিলো আমাকে!

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

আগেও বহুবার বলেছি। এখন, আরও জোর দিয়ে বলতে চাই: উড্ডয়ন আমাদেরকে শিখতেই হবে; নইলে, পাখির ডানাও চলে যাবে— চালকবিহীন বোমারু বিমানের দখলে।

তোমাকে বলছি। হ্যাঁ। এই যে, তাকাও, তোমাকে! যে-তুমি কখনই পড়ো না, পড়বে না—উদ্বেগাশ্রিত এই শব্দাবলী; তুমিই তো প্রকৃত পাঠক!

অপঠিত এইসব শব্দ, একদিন হুবহু তোমার বুকের মধ্যে বেজে উঠবে— আবৃত্তির ঝংকারে। মনে হবে: এই কবিতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে— এশিয়ার ভবিষ্যত। তা সত্বেও, আজ, আবারও বলছি: উড্ডয়ন আমাদেরকে শিখতেই হবে। নইলে, একদিন, মাছেরাও ছদ্মবেশি ক্লাস্টার-বোমা হয়ে উঠবে...

.
.
[ পঞ্চম পৃষ্ঠা ]

সবুজাসক্তি কাটছিলো না। বিজন বনভূমে, দিনমান, শরীরে লেপলাম— ক্লোরোফিল। পাতারঙজলে, স্নানে নামলাম— গোধূলিতে। তরল সেই সবুজ বল্কে উঠলো।

রক্ত
রক্ত
আর
রক্ত...

লালে, ভেসে আছি: মৃতদেহী মাছ। পরিধানে সমগ্র রাত্রি চাপিয়ে, বনভূমি পেরিয়ে যাচ্ছো তুমি— তোমার দীর্ঘশ্বাস থেকে, লাফিয়ে ওঠা ঘূর্ণিঝড়ে চূর্ণ, কাচা-পাতার কুচিগুলো: একেকটা স্প্লিন্টার হয়ে গেঁথে যাচ্ছে— শিশুস্বপ্নের কোমল শরীরে...

আহ, পলাতকা, অগণন মৃত্যুর মোকাবেলায়, দাঁড়িয়ে না পড়লে— কে, কবে, বাঁচতে পেরেছিলো?

খেরোখাতা: সেপ্টেম্বর ১

.
[প্রথম পৃষ্ঠা]

শৃগালে-মুরগিতে ক্ষণবন্ধুত্বও বেনজীর নয়—

পাঁচ-ছ’টি জপমন্ত্রে, আজও যারা সম্মোহিত— মুগ্ধ, বিগলিত; তারা হয়তো বুঝতে পারে না: সাধুভাণ্ডে যতটা ভণ্ডামি লুক্কায়িত— সহসাই, হাঁড়ি ভেঙে, ছিটকে পড়বে এইসব ভক্তের চাক্ষুষে। কোনও কোনও জলদেশে, ব্যাঙেরাও ঢোঁড়ামুগ্ধ থাকে। যথেষ্ট স্থিতধী ঢোঁড়া— কালক্রমে, ভোজে তোলে: সর্ব উভচরে।

এইসব আছে বলে, তুষানলে, পৃথিবীই নারকীয় গ্রহ। কিন্তু মোহভঙ্গ— অবশ্যম্ভাবী; অতএব, নরকেও স্বর্গ জন্ম নেবে...
.
.
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠা]

তোমার কবিতা, এক মধ্যরাতে, উড়ে এলো— আমাদের ছাদে। তখন তুমুল বৃষ্টি; আঁধারের কোটি কোটি কালির দোয়াত, উল্টে গেছে। সে উন্মাদ রঙের সন্ত্রাস— বালকৃষ্ণ কাঁচাদেহে,সহে না রে, সোনা! কী করে বাহিরে যাবো? অন্তরে-অন্দরে, তবু কবিতারই ঢাকঢোল, সানাই-সেতার বেজে ওঠে—

তোমার কবিতা আজ মধ্যরাত। উড়ে এলো— আমাদের ছাদে। তখন তুমুল বৃষ্টি গৃহকোণে। কী করে ভেতরে থাকা যাবে?

গৃহকোণ ভঙ্গ করো। বৃষ্টিচ্যুত, ছাদহীন আমাকে উড়িয়ে নাও: কবিতার তপ্ত হিমের মধ্যে; রতিপটু নির্জনের তৃণগালিচায়। অগণন ডিম্বানু-শুক্রাণু শব্দ— আজ রাতে, জাইগোটের পরিণতি চায়...

.
.
[তৃতীয় পৃষ্ঠা]

রাষ্ট্র নামক ধারণাটির উত্পত্তির পর, বহু শতাব্দী কেটে গেছে। বিকাশের এমন এক স্তরে পৌঁছে গেছে সে— যেখানে, সাপ হয়ে ওঠে আত্মঘাতি; লেজের দিক থেকে গিলতে শুরু করে: নিজেই নিজেকে। তার আর বন্ধুকে প্রয়োজন নয়, দরকার বন্দুক। গান নয়, মেশিনগান। ধাতব নলের ওপর, কোমল গুহ্যদেশ রেখে, চেপে চেপে সম্পূর্ণ না বসা অব্দি, তার কোনও স্বস্তি নেই...

এই সত্য, জনে জনে রাষ্ট্র হয়ে গেছে—

.
.
[ চতুর্থ পৃষ্ঠা ]

পথে পথে পরিব্যাপ্ত। ধুলোবালি, মাটি বা পাথরচূর্ণ: যে-নামেই থাকি। আছি— সিলিকন। পিষ্ট হতে হতে, তবু,

একটু একটু মেপে নিচ্ছি: প্রত্যেকের দেহ আর আত্মার ওজন।

.
.
[ পঞ্চম পৃষ্ঠা ]

হলদে ফুলের গন্ধে, তোমায় ফুটিয়ে দিচ্ছি রোদ। তুমি আমায় মন্দবাসতে পারো—বলতে পারো: কীট-পিঁপড়ের কথা। চিকিৎসকের রক্ত ফুঁড়ে, বুনো ঘোড়ার ডানা, উড়ে উঠলে— প্রথম তাকে ‘বোরাক’ বলেছিলো: মরুদেশের খেজুর-খাওয়া ছেলে। নাম কী ছিলো, সেই ছেলেটার? আমাকে এই প্রশ্ন করতে পারো— বলতে পারো: ধর্মপাগল ইতিহাসের স্মৃতি।

আমি তোমার স্তব্ধ-বোবা ঠোঁটে, সার্বভৌম করেছিলাম বিকেল বেলার হাসি— এই ভেবে যে, আয়ুরেখার দৈর্ঘ্য যেন সীমার মধ্যে থাকে...

.

.

.


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান