রাজন্য রুহানির একগুচ্ছ মা
রাজন্য রুহানির একগুচ্ছ মা

 

মা ছাড়া পৃথিবী

 

মা ডাকতে ইচ্ছে হলে অরণ্যে লুকাই,

যেরকম মাতৃজঠরে ছিলাম দিবারাত্রি ভুলে।

জঠরসমুদ্রআমি তাতে ঝিনুকের সুর

জীবনবাতাসে লেগে থাকা বাবার সার্গাম।

 

মা ডাকতে ইচ্ছে হলে দশদিকে ছুঁড়ে দিই তুমুল চিৎকার।

ঝরাপাতার মৌসুম প্রতিধ্বনি বয়ে আনে,

মায়ের মতন হজম করে না যাপনের দুঃখ-কাতরতা,

বুকের ভেতর জ্বলন্ত উনুন নিয়ে

নিরন্ন থালায় বেড়ে দেয় না শান্তির ওম।

 

মা ছাড়া পৃথিবী সার্কাসের মঞ্চ আর আমি একটা ক্লাউন।

সবাই আমাকে দেখে হাসে, হাততালি দেয়।

কেউ মুছে দেয় না বন্দীত্ব,

কেউ বলে না হাসির আড়ালে তোরও কিছু হাসি থাক।

 

মা ডাকতে ইচ্ছে হলে গভীর পিপাসা আঁকি।

সুপেয় জলের ছন্দে মা আসেন মরুময় আঙিনায়,

যে আঙিনা বেড়ে ওঠে ধীরে অনাথ হৃদয়ে।

 

মায়ের মৃত্যুদিন এতিম আধুলি

 

অশ্বত্থের ছায়া নিভে গেলে অন্ধকারে আমার হারিয়ে যায় চোখ। অন্ধের আয়ুর কাছে যেমন শব্দেরা হাঁটু গেড়ে নৈশব্দের মাদল বাজায়, অন্তস্থিত আকাশের ওপারে আকাশ খোঁজে সেই স্বরলিপিযে হারমোনিয়ামের রিডেরা দিগ্বিদিক ছুটে গেছে প্রভঞ্জনের উৎসবে, আঁচলের গিঁট খুলে একটা পালক ফেলে গেছে শুধুএতিম আধুলি।

 

সে আধুলি নিয়ে আমি কবরের পাশে বসে থাকি নুলোর মতন, ইষ্টনামও কী তোমার প্রসব বেদনার কাছে গুঁড়ো গুঁড়ো ভেঙে পড়ে নি তখন? জারুল পাতারা জানে, জবাগাছ ফুল না ফোটালে সেও উচ্ছিষ্টের দলবাগানের বিষদৃষ্টি। চতুর্থ বোনের পর মা আমার তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চক্র থেকে চুরি করেছিল কয়েদখানার চাবি। সেই থেকে ক্রমশ পৃথিবী দেখা আরম্ভ যে হলোতীব্র তীর্যক, সবুজ লাল, বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণে ঠেসে দেয়া কোটরের ভিতর কোটর আর গলাকাটা জামার প্রণয়বিনিময়প্রথার যাপনে আজো মানুষের ভানের সংসারে জেগে আছে দানুমা গো, ক্লেদের বাইরে আর কোনো সৌরভ দেখি নি কেবল তোমাকে ছাড়া।

 

মাছ ধরার পলর মধ্যে আমাকে নিয়েই বন্দি থেকেছিলে সাতদিনকবিরাজের উৎকণ্ঠাবাবার উদ্বেগ লালঝুঁটি মোরগের সাথে নিয়ে যেত চতুর ভিখারি। তখনো শনির ভয় ছিল রেশমগুটির চারপাশে। রাহু কেতুর নাগপাশ ছিঁড়েমা আমার, কেনইবা শোয়ালে তুমি শোষকের বিছানায়?  চ্যাপ্টা পথে পথে মা, আজ তোর মৃত্যুদিনে ছাড়পোকা আর জোঁক তবু শেষের এতিম আধুলিটা কেড়ে নিতে চায়।

 

সবুজ আলোটাই মা

 

বুকে পিঠে মাতৃছায়া নেই, কাফনপায়রা ওড়ে

রক্তের আকাশে, এইক্ষণে চাঁদের কিরণ ভালো

রূপনেশা চোখে জেগে থাকে ভালোবাসবার আলো।

তবু প্রদীপদায়িনী মায়েদের ক্রোড়ে

চারাগাছ বটছায়া হোক

যেখানে মিলেছে মায়া-স্নেহ-প্রীতিলোক

ছুঁড়ে ফেলে বন্ধ্যা পদযুগলের ভ্রান্তি।

 

স্তবকের খাঁখাঁ দ্বীপে হাহা করে বিদ্যুৎ চমকালো।

পতনে বজ্রের কেবল মগডালঝোঁক।

চারদিকে প্রমত্ত সংক্রান্তি।

 

তবু হারানো আঁচলে গেরো দিই শারদীয় ভোরে

পাখির নজরে

শান্তি...শান্তি...শান্তি...

 

মা

 

মা, -মা, মা-গো, ডেকেছি কত;

সাড়াহীন দিনে অথর্ব শব্দের কান্না

এলোমেলো ঢেউ

উড়ুক্কু নিশানে মুছে কপালের ঘাম

মাথা থেকে কেড়ে নেয় আশ্রয়ের চাবি

 

এখন প্রখর রৌদ্রদাহে

নারীর ভিতর খুঁজি মায়ের আঁচল-

মা নারী নন, নারীও মা নয়,

ওটুকু দূরত্বে বসে হাসেন সাঁইজি

বিকল্প গৌরব নেই জেনে

 

আজ ফ্যালফ্যালে চোখে ভাসে রুগ্ন শয্যা

ঘড়ির দোকানে

 

মা' মৃত্যুদিনে

 

শাড়ির আঁচলে থাকে মায়ের সন্তান

গেরো দেয়াসে আঁচল বড় হতে হতে

আসমান হয়ে গেলে সন্তান নক্ষত্র,

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তখন মাতৃরূপী আয়ু।

 

মা বিগত হলে বাবার অস্তিত্ব শূন্য

যেরকম ভাঙা গ্লাসে জল ঢালা বৃথা,

কুকুরের তাড়া খেয়ে যেদিকে দৌড়ানি

সে বাড়িটির নাম মাযমের সামনে

যিনি প্রতিবার প্রাণান্ত রক্ষাকবচ।

 

মাহীন পৃথিবী জুড়ে ধানকাটা মাঠ

খাঁখাঁ করেএতিম আধুলি তবু গায়

খরতপ্ত বুকে বোনা ফসলের গান।

 

ললনা রমণী মা

 

প্রতিরাতে তোমার দুয়ারে আড়টোকা দেয় পাড়ার মস্তান।

মুখ ঢেকে বের হয়ে আসে কত হাতিপাতি নেতা।

মাঝেমধ্যে অক্ষম আক্রোশে ঘেউঘেউ করে ওঠে যে উঠতি যুবকেরা

তাদের সর্বাঙ্গে ঢেউঢেউ বিষাক্ত ছটফটানি।

এসব উত্তাপ আড়ালে রেখেই বিড়ি জ্বালে একটা পাগল

কোনো গৃহত্যাগী জোছনায়।

 

সূর্যের খাতায় তোমার নামের ঘরে সিলমারা,

লালকালির বিশাল থুতু;

দিনে তুমি তাঁহাদের পায়ে পেষা কীট,

রাতে তাঁরাই তোমার পায়ে আঁকে প্রমিত চুম্বন।

 

পাগলের কাছে তুমি দিনরাত্রির অমল ধোঁয়া;

অনাহারী সন্তানের অন্নদাত্রী তুমিই ঈশ্বরী

পাপপুণ্যহীন এক মমতাময়ী মা।

 

ক্রুশজন্মের পৃথিবী

 

ক্ষরণের নাভি ক্রস করে উড়ে গেলে মাছি, হাতেপায়ে ক্রুশ জেগে ওঠে। আমি তখন মা মা চিৎকারে সাদা ফুল আঁকি লাল পিঁপড়ের বিছানায়।

 

উল্কাপতনের শব্দে ভোর ছুটে এলে, দেখি,  চিহ্নে চিহ্নে মা-মেরীর ছবি, দুধমুখে বালখিল্যের পৃথিবী শুয়ে আছে নদীর আদরে।

 

হৃদয় এবং মা সমার্থক

 

হৃদয়ের কাছে মাথা নত করে দেখি

সবাই আদুরে শিশু

আর পৃথিবী মায়ের কোল।

 

উপাসনালয়ে মা থাকে না

নেই সমাজেও

রাষ্ট্র তো এমন বাবা যে মায়ের দেহ খেতে খেতে

আবার উগরে দেয়

শুধু পড়ে থাকে থেঁতলানো প্রাণ

সেখানেও মা নিয়ে জাবর কাটা ছাড়া

কিছুই পারে নি দিতে গল্পফাঁদা ধূর্ত সংবিধান

 

সব পথ ভাঁজ করে ট্রাংকে তুলে রাখি

সেইসব মানুষের জন্য

যারা হার্টবিট ফেলে হাপর-চিন্তায় গড়ে তোলে জাতিসংঘ

আর পাদ মেরে অযুছোটা অজুহাতে ভেঙে দেয় ইবাদত

 

সব ফেলে হৃদয়ের কাছে মাথা নত করে দেখি

সবাই আদুরে শিশু

আর মায়ের শরীর নির্ভেজাল স্বর্গ সন্তানের।

 

হৃদয়ের কাছে মাথা নত করা মানেই মায়ের কোলে ওঠা...


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান