রেজা নুর  ।। পাঁচটি কবিতা
রেজা নুর  ।। পাঁচটি কবিতা

. সাঁতার

 

কখন যে জলে ভাসতে জেনেছি, মনে নেই,

স্বচ্ছ নিরেট সব তরলে তরঙ্গ তোলা

ঝরণার মতো অনাবিল হয়ে এলো অজান্তে

 

পুকুরের পানি দুহাতের পরতে পরতে

মেলে যায় প্রজাপতির আল্পনাময় পাখার মতো,

ডুবে ডুবে শুনি জলমগ্ন নূপুরের ধ্বনি

 

দীর্ঘ দীঘি প্রতিদিন বিকেলে

কিশোরীর ডাগর আকুল চোখের আহবানে

ডেকে ডেকে নেয় ...

 

কী আছে সেই পুরু-পুষ্ট জলের অতলে !

তুলতুলে মিহিন ঢেউয়ের সমতলে

শুধু আমার সাঁতার

 

নদীও

নারীর মতো একমুখি, পলায়নপর,

সুনিপুণ জলের মোহ বিছিয়ে রাখে

বোঝে না সে, জানে না সে, না মানে সে ...

কী রে মোহন-পুরুষ হয় পর?

 

বহুদিন চরের ঘাটে

গলাজলে নেমে বুঝেছি স্রোতের দুলুনি

কি নিখুঁত স্বচ্ছ বালুতল !

সাগরের অসীমতা নেই, আয়না মতো আপন,

নির্মল অদূরের শোভন আহবান

 

গাঢ়-মনে সহসা-সন্তর্পণে

বুকে তুলে নেয় জলজ-প্রেয়সী

শরীরে তার সাত সমুদ্রের টান...

 

আমার বুকের নিচে নদী

জলের সুতো চিনে চলে প্রান্তর, গ্রাম

অচেনা দিগন্তের বাঁক

 

মিছে-মনে সে

সংগোপনে, নীরব-নিঝুম

আপাত গোপনে

সয়ে যায়

তনু-সাহারার মধুর দহন ।।

 


 

. বৃষ্টির বকুলতলা

 

বাংলার আলপথে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত

কৃষকের আঙিনায় দাঁড়াব যখন,

কৃষাণী, চিরায়ত বোন আমার,

কাঁসার গেলাসের গা-গড়িয়ে পড়া পানি

আঁচলে মুছে, লাজুক দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দেবে

ধুলোমলিন হাতদুটোয় স্বপ্নের ঘোরের মতো

বেজে উঠবে কাঁচের চুড়ি, শরতের মেঘের মতো শাঁখা

ছোট্ট মেয়েটা দৌঁড়ে ঘরের ভেতর

আনতে যাবে হাতপাখা

তার দুপদাপ পায়ের আনন্দধ্বনি

বেঁচে থাকবার মানে শেখাবে আমাকে

 

উঠোনের এককোণের বকুলের পাতা

কেমন আগলে রেখেছে ঘ্রাণ

বৃষ্টির বাতাস কিছুটা তার কেড়ে এনে দেয়,

পালায় তারপর

 


. গন্ধবণিক

      

ফেরিওয়ালা হবার ইচ্ছে খুব

ঝুলির ভেতরে আতরের শিশিগুলো

শুয়ে থাকবে নিশ্চুপ

মাঝে মাঝে একে অন্যের গায়ের পরশে

মেতে উঠবে গল্পে :

 

ওদের গল্প-কথা সব সৌরভে ভরা,

ছিপি আলগা হলেই ঘ্রাণমাখা তুলো

সুবাস ছড়ায়

 

পৃথিবীর সমস্ত ফুলের বাগান

একেকটা দৃশ্যমান গন্ধবণিক,

ক্ষণিক হাওয়ার স্রোতে সুরভী ওঠে

মেরুতে মেরুতে

 

কী পরম আদরে গোলাপ

গন্ধ আগলে রাখে বুকের ভেতর,

অপরূপ রূপের গহনে লুকোতে চায়

কত কত প্রেমময় কথার ইশারা !

 

কোন্ ফুল কবে, নিজেকে কুমারী ভেবে

ঘ্রাণ তার পেরেছে গোপনে, রাখতে সেরে?

 

চোখও জানে না

কখন ভরে আসে জলে

নদীর ঘাটে তৃষ্ণিত কলস যেমন

রমণীর নরম হাতের শাসনে

মুখ নামিয়ে বাধ্য-বালকের মতো

জল পান করে...

শব্দ তোলে শেষ চুমুকে...

সে-সাড়ায় নদীরও সমুদ্র হতে সাধ জাগে,

        নদীরও সাধ হয় যেন সে সমুদ্র হয় !

 

সজল কথারা বদলে যায় সুরে,

         তৃষ্ণার নিশ্বাস গলে গলে আসে

                  নিঝুমের বুকে, তুষারের মতো

 

জগতের সমস্ত গুলবাগ, নদী- মুখী...

একটি ঢেউও আজ ঘ্রাণহীন নয়,

মুহূর্তে প্রাণ পায় অপর ঢেউয়ের শরীরে মিশে

মৎস-কন্যারা জানে না,

কেমন রে

জলের উপর থেকে জাল উড়ে আসে

 

নিঝুম, সুরময় নিশ্বাসে, স্বেচ্ছা- সীমানায়,

বন্দিনী আজ, রাজকুমারীর মতো

অনুভবের অসাড় পাহাড় তার

সুরভিত জলের চারপাশে ।।

 


 

. হওয়া না হওয়া

 

কতকিছু হতে যে চেয়েছিলাম

কিছুই হওয়া হয়নি

 

হাটবারে

খেলার মাঠে বৃত্তাকার মানুষের ভিড়ের ভেতর

উপচে পড়ত গান বাকপটু ক্যানভাসার

হারমোনিয়াম থামিয়ে দিতো তার সংগীর,

ওষুধের বিবরণে বেভুল হয়ে উঠত জনতার মন

—— এই ওষুধে দুনিয়ার রোগ সারে,

সবচেয়ে বড় কাজের কাজ করে পুরুষ-দেহের

এমন যাদুকর ক্যানভাসার হওয়া মন্দের নয়

নতুন নতুন বাজারে,

দেখা মেলে নতুন মানুষের

 

ম্যাজিক শো এলো,

এলো যাত্রাপালা, বৈকালী অপেরা

মনস্থির প্রায় পাকাপাকি এবার

ম্যাজিশ্যান হবো :

মুহূর্তে খালি বালতি থেকে

জল ঢেলে দেবো দর্শকের মাথার ওপর

হো হো হেসে উঠবে সারা প্যান্ডেল

স্বর্গের অপ্সরীরা

ঘ্রাণ আর রূপের আলোয়

ভাসিয়ে রাখবে আমাকে

এমন সুখের জীবন আর কিসে মেলে!

 

নাহ, যাত্রা নায়ক হবো

একঝাঁক ডানাকাটা পরী

মেঘের রাজ্যে উড়িয়ে নেবে

পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শনা কন্যা

আঁচল বিছিয়ে

কেঁদে ভাসাবে আমার জন্যে

মাঠ-প্রান্তর, নদীর কিনার

 

শিল্পি হই —- কণ্ঠের আর তুলির

নিজের সুরে, নিজের ইন্দ্রিয় আনমনা হয়,

তুলিরা ঘুমিয়ে পড়ে অনায়াসে

 

সকালে নি:শব্দে স্বপ্ন ভাঙে

কাঁচের চৌচিরে সংগীতের স্বর ঝরে

ঘুম বা স্বপ্ন

কেন যে এত নীরবে ভেঙে ভেঙে যায় !

অন্তর-নিহতের খবর

বয়ে নিয়ে যায় না কোনো অলস বাতাসও,

অবুঝ-নিঝুম প্রণয়ের কাছে

 

কলরবের ক্লাসরুমের হইচই ছাপিয়ে

শিক্ষক আসেন

শুকনো লাঠিটা বিরস-মুখে শুয়ে থাকে টেবিলে :

না জানি কার পিঠে পড়তে হবে আছড়ে আবার!’

গুরু হলেও মন্দ হয় না সবার সামনে শুধু তখন

সমীহ খেলে বেড়াবে !

 

চোখ-রঙিন কৈশোর পেরিয়ে

যৌবন জেঁকে বসে

মন, পথে পথে নজর বিছিয়ে দেয়

গোলাপের পাপড়ির মতন

 

এবার ভাবনার থামবার পালা

শুধুই প্রেমিক হবো

ঘটিহাতা জামা

মুখ-গোল মেয়ের মন নিয়ে একদিন

পালিয়ে যাবো ঠিকই

মনটা তার লুকিয়ে রেখে দেবো ঘুঘুর বাসায়

মগডালে দুলবে সে মন,

      নিখিলের একক ঐশ্বর্য

…. জানবে না কেউ

     কী মধুর হাওয়ার দোলনায়

      দুলে দুলে সে, আকাশ দ্যাখে

 


 

. কবিতার জন্যে

 

কবিতার জন্যে, সবকিছু করতে পারি

 

কবিতার জন্যে, নিতে পারি সন্যাসব্রত,

হতে পারি বিবাগী নিমাই

বিষ্ণুপ্রিয়ার নিদ্রাতুর চন্দ্রমুখ ছেড়ে

জোছনার হাত ধরে চলে যেতে পারি

মমতার সবুজ বনে

 

কবিতার জন্যে

ছেড়ে যেতে পারি এই ক্রোধের শহর,

হতে পারি অচেনা গাঁয়ের পথিক,

দীঘল সবুজের বুকে দাঁড়িয়ে

কিশোরীর নরম নাকে তুলে দিতে পারি

বাবলা ফুলের তুলতুলে হলুদ নোলক

 

হতে পারিশরতের মেঘ

নীলের উঠোনে হেঁটে হেঁটে সুদীর্ঘ পথ

যেতে পারি নক্ষত্রলোকে,

ছায়াপথের ছায়ায় লিখতে পারি

অগণন নতুন কবিতা


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান