কবি : রোখশানা রফিক
আমার কৈশোর
খাঁ খাঁ বিরান মরুভূমি
একবুক তৃষ্ণা জাগে
হৃদয়ে আমার।
নির্মল কোনো ভোরে
শিউলি ফোটা শিশির ধোয়া
প্রাঙ্গণে যদি আবার হাঁটি
কোনো সকালে, তবে কি
ফিরে পাবো আমার সোনালি
কৈশোর?
হয়তো সে বসে আছে
আমারই অপেক্ষায়
ব্রক্ষ্মপুত্র নদের তীরে
বটের ছায়ায় পা ডুবিয়ে
শান্ত শীতল জলে। কিংবা
খোলা নীল আকাশের তলে
ডিঙি নাওয়ে বসে শাপলার ঝিলে।
অথবা আমের বোলের ঘ্রাণমাখা
ঝড়ে পাতা ঝরা স্নিগ্ধ বিকেলের কোলে।
প্রতি প্রত্যুষে জেগে উঠে
আমি খুঁজি তারে ইতিউতি।
লাউয়ের জাংলায়, সীমের মাচানে,
মটরশুঁটির ক্ষেতে, ব্যস্ত জনপদে,
সোডিয়াম আলোভেজা পথে ।
খুঁজে তারে পাইনা আর কোথাও,
যেন সে লুকিয়েছে পিতার গন্ধমাখা শীতের পশমি শালের উষ্ণতার আড়ালে।
মেঘের দিন
এমন মন কেমন করা মেঘের দিনে
এসো না তুমি, একা থাকার দিনে।
কিছু হাওয়া খেলে যাবে এলোচুলে,
কিছু অধরা চুম্বন থমকে রবে ঠোঁটের কোনে,
শ্রাবণের মতো ধারা জমবে চোখে।
অরণ্যের হৃদয় কাঁপিয়ে
হু হু হাওয়া গাইবে বিরহের গান।
ভীরু লজ্জায় পাখিরা খুঁজবে
সবুজ পাতার আড়াল।
পর্দাগুলো কি যেন খুঁজে খুঁজে না পেয়ে
উড়বে উথাল পাথাল।
এসো না এমন মেঘের দিনে
কখনো তুমি। এদিন থাকুক শুধু
মন কেমনের দিন হয়ে।
অলকানন্দা
অলকানন্দা জলে যখন
খোঁপার ফুলের সাথে
ভেসে গেছি নিজেই
আমি, তখন দিগন্তে
সন্ধ্যা নেমেছে সবে।
কুলকুল বয়ে চলা নদী
কানপেতে শোনে
বাতাসের কল্লোল।
হিমহিম মাঠে নেমেছে
কুয়াশা পরী, আবছায়া
দূরের কুটির। টিমটিমে
আলো জোনাকের বনে,
আঁধার ঘনিয়ে আসে
কৃষাণের গেঁয়ো মনে।
ফাঁকা পড়ে থাকা
মাঠের মতোন
জীবন পড়ে থাকে তার
রবিশস্যের বীজে।
অংকুরিত স্বপ্নগুলো
সে পারেনা রোপিতে।
আমি একা তাই
রোজ সন্ধ্যায়,
ইহাদের দুঃখকথা
বুকে বয়ে নিয়ে
অলকানন্দার জলে
দূরে ভেসে যাই।
ফানুশ
চায়ের চুমুকে ছলকে ওঠা
সকালের কিছু রোদ,
স্বাগত জানায়
দিনের ট্রাফিককে।
আড়মোড়া ভাঙ্গা এ শহরে
চলছে ক্ষুধার্ত বিক্ষোভ,
কেউ মোটরকার, কেউবা
সাইকেল কিংবা অটোরিক্সায়
হুড়োহুড়ি তাই ছোটে
সহস্র কড়কড়ে বা দু'টি
ছিন্ন মলিন টাকার নোটের
খোঁজে।
কেউ খাবে মাংসের নলি,
কচকচে অস্থি-মজ্জা,
কেউবা শাক ডাল ভাত।
অতঃপর তবুও বাছারা
যে পোশাকে যে যানে চড়ে
বা পদব্রজে, যেমুখেই
ছোটো, দিনশেষে হিসেব
কিন্তু সেই একই
অন্ন বস্ত্র বাসস্থান আর
সাথে কিছু বাড়তি মেদের
জীবন চর্চাতে।
বকওয়াজ তাই আস্তে
ঝাড়ো হে বাপধন
আজ জীবনের ভাঁজে।
হিসেবী সময়
হায় প্রেম! তোমার চোখের দিকে চেয়ে,
আজো কাঁদি বসে আমি একা।
সন্ধ্যানদী ফিরে যায়
রাতের মোহনায় আমার ছেঁড়া
স্বপ্ন বয়ে নিয়ে।
তারপর নিশুতি চরাচর আমার
চোখের দিকে চেয়ে জাগে রাত।
ভোরের আলো ফোটে
প্রদোষবেলার পাখির কলতানে।
আবারো হিসেব গুনে গুনে
আঙুলের কড়ে বুঝে নিতে হয়,
একা বয়ে যেতে হয় নদীটির
জীবনের বিকিকিনি হাটের দোকানে।
না বলা কথা
আমি কাহারে কি যেন
বলিতে চাই! সে কথা থাকে
চোখে, মনের গভীরে,
বুকের গোপন ভাঁজে।
কিছু বলি তার আনমনে,
কিছু শোনাই মেঘ পাখিদের,
কিছু দিয়ে গাঁথি মালা গল্পের।
তবু ফুরোয় না!
এরা রয়ে যায় না বলা কথা হয়ে,
না পাওয়া স্বপ্ন হয়ে, না দেখা
ভোর হয়ে। তবু ঘুরেফিরে কি কথা
যেন আমি কাহারে বলিতে চাই!
কাহারে বলিতে চাই সে কথা আমি?
আমি নিজেও কি তা জানি ছাই!