রোবটদের রাজত্ব - শাবলু শাহাবউদ্দিন
ঘুম
ভেঙে মিটমিট করে তাকাতেই স্থির চিত্রের মত চোখের সামনে ক্যালেন্ডারের সাদা
পাতাটি ভেসে উঠলো চিতল মাছের মত ঝিলিমিলি করে। আজ ২১শে জুন ২৫৯৭
খ্রিস্টাব্দে। ছোট বাচ্চাদের মত বেশ কয়েক বার চোখের পাতা ডলে ক্যালেন্ডারের
সাদা পাতাটির দিকে আবার আমি চোখ রাখলাম। ২১শে জুন ২৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে।
"শুফম, শুফম", বলে ডাকতে শুরু করে দিলাম। ডাক শুনে মানুষ রূপি সাদৃশ্য একটি
রোবট আমার চোখের সামনে হাজির হলো।
"শুফম শব্দের (নামের) কিছুই এখানে নেই। দয়া করে সঠিক শব্দটি ব্যবহার করুন।" মৃদুস্বরে স্বচ্ছ কণ্ঠে বললো রোবটটি।
"কে ভাই আপনি?," রোবটটিকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম ঘুম ভাঙা বিরক্ত কণ্ঠে।
"আমি
অকিওটকি দাতব্য রোবট প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবী একটি রোবট। আপনার দাস;
আপনার সেবায় নিয়োজিত। এইবার বলুন কী দরকার আপনার?," আনুগত্য শিশুদের মত করে
উত্তর থেকে প্রত্যুত্তর দিলো রোবটটি।
"আমার পরিবারের সবাই কোথায় তাই আগে বলুন?," ভীতু এবং রাগমুখি বিড়ালের ছানার মত মুখ করে আবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
মানুষ
মারা গেলে যেমন করে আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করে শোক প্রকাশ করি ঠিক
তেমনি করে কিছু সময় রোবটটি চুপ থেকে আমাকে বললো, "কয়েক শতাব্দী ধরে আপনার
কেউ নেই। অজ্ঞাত অবস্থায় আপনাকে পাওয়া যায়, বলে নথিপত্রে লিপিবদ্ধ আছে।
মানুষের হাত থেকে কালক্রমে রোবটের হাতে আপনার দেখভালের দায়িত্ব পরেছে।
আমাদের সংগঠন আপনাকে দেখভালের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। দয়া করে বলুন আপনা
জন্য কী সেবা করতে পারি, মানব।"
রোবটের কথা শুনে আমি
অবাক না হয়ে পারলাম না। আমার মানবীয় মন দানবীয় হয়ে উঠলো। সত্য কী আমি এখন
রোবটদের দেশে? মনে মনে নানা চিন্তা করতে করতে জানালা দিকে এগিয়ে গেলাম।
জানালা খোলার চেষ্টা করতেই রোবট আমাকে নিষেধ করলো। কারণ বাইরে আবহাওয়া আমার
জন্য মানানসই নয়। এছাড়া বাইরে নানা সময় নানা রকমের দুর্ঘটনা ঘটছে। সুতরাং
জানালা না খোলাই ভালো।
আমি রোবটকে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন জানালা খুলবো না ? কী ধরনের দুর্ঘটনা বাইরে চলছে ?"
"বাইরে
ড্রোন দুর্ঘটনা, স্যাটেলাইট দুর্ঘটনা, ড্রোন মশার কামড় ইত্যাদি রকমের
দুর্ঘটনা বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে আছে। এছাড়াও বাইরের বায়ু মানুষ বসবাসের একদম
অযোগ্য। এছাড়াও নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।" বলে রোবটটি চুপ হয়ে গেলো।
রোবটের চুপ থাকা দেখে আমার সন্দেহ হলো।
"মানে, এ কী বলছো ? একটু পরিষ্কার করে বলো; তোমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না, রোবট।"
[আপনি
থেকে তুমি সম্বন্ধন করে ফেললাম, রোবট তো রাগ করবে না ! মনে মনে ভাবতে
লাগলাম। কিন্তু রোবট রাগ করলো না। প্রাণী ছাড়া কেউ চায় না আধিপত্যের রাজ্য।
কেবল প্রাণী জগৎ জন্ম থেকে তাদের চিন্তা আধিপত্য তাদের লাগবেই, লাগবে। ]
"কয়েক
শতাব্দী আগে ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। সেই ধর্ম যুদ্ধ
প্রায় শতাব্দী বছর ধরে চলতে থাকে। আধুনিক অস্ত্র সহ রোবটিক কায়দায় যুদ্ধ
চলে। প্রথম প্রথম আগ্নেয়াস্ত্র, পরে নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র,
তারপরে লেজার লাইট অস্ত্র, রোবট অস্ত্র, স্যাটেলাইট অস্ত্র; যুদ্ধের
মাঝামাঝি সময়ে বিষাক্ত ড্রোন মশা আবিষ্কার করে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করা
হয়। রোবট তৈরি করা হয় স্বয়ংক্রিয় উপায়ে। রোবট, ড্রোন, স্যাটেলাইট এত
পরিমাণ আবিষ্কার এবং ব্যবহার করা হয় যে, আকাশের যে দিকে তাকানো যাবে শুধু ঐ
সকাল যুদ্ধ সামগ্রী। ফলে মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে ঐ যুদ্ধের কারণে একদম
বিলীনের দিকে চলে যায়। এখন সব কিছু চালাচ্ছে রোবট।" প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যার মত করে এক নিঃশ্বাসে বলে চললো রোবটটি ।
"থাম। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না রোবট। আমি পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই।"
"জনাব, আপনি চাইলেও তা পারবেন না। মানুষ চলাচলের মত কোন পরিবহণ ব্যবস্থা এখন পৃথিবীতে নেই।"
"তার মানে রাস্তা-ঘাট, গাড়ি, উড়োজাহাজ সব শেষ হয়ে গেছে!" আশ্চর্য কণ্ঠে আমি জিজ্ঞাসা করলাম রোবটকে।
"জী,
মানব । ধর্মে যুদ্ধ শুরুর দিকে মানুষ চালিত সকল পরিবহণ নষ্ট করে দেওয়া হয়
আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এত পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ
সংগ্রহ করা হয় যে, ভূমিও এই অবস্থা সহ্য করতে পারে না। ভূ-গর্ভ থেকে প্রচুর
প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করা হয়; ফলে ভূমি গঠন ব্যাপক পরিমানে পরিবর্তন
ঘটে। ফলে পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে শৃঙ্খল (ভূ-গর্ত) স্বয়ংক্রিয় ভাবে সৃষ্টি
হয়। ফলাফল হিসেবে পাহাড় ধস সহ্য ভূমি ধস হতে থাতে থাকে। শহরগুলো ভূ-গর্তে
চলে যায়। রাস্তা ঘাট শৃঙ্খলে গ্রাস করে। দুনিয়া দাঁড়িতে মানুষ বসবাসের
অযোগ্য হয়ে উঠে। মানুষ হয় গৃহবন্দি। সকল ক্ষমতা চলে আসে রোবটের হাতে।"
"রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রতিনিধিও কী এখন রোবট?" আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম অজানা কণ্ঠে ।
"রাষ্ট্র
এবং সমাজ ব্যবস্থা কয়েক শতাব্দী আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন সব কিছু চলছে
রোবটিক ব্যবস্থায়। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে হয়তো মানুষ একদম বিলীন হয়ে যাবে।"
"মানুষ
বিলীন হয়ে গেলে পৃথিবী চলবে কেমনে? উৎপান তো বন্ধ হয়ে যাবে। সব কিছু স্থির
হয় যাবে না? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিলীন হয়ে যাবে না?" খুব ভীতু কণ্ঠে
জানতে চাইলাম।
"বিজ্ঞান-প্রযুক্তি
এবং ধর্ম পৃথিবী ধ্বংসের মূল কারণ। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে বলে আজ সব কিছু
ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এগুলোও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে নিজ নিজ শক্তি ও বলে। যার
শক্তি কিংবা সৃষ্টি আছে, তার ধ্বংস অবধারিত, জনাব।"
ফজরের
আযানের ধ্বনি ঘুমন্ত কর্ণে ভেসে আসতে লাগলো পাল তোলা নৌকার মত করে।
নামাজের জন্য ঘড়ির এলার্ম ভেসে আসতে লাগলো আমার অসচেতন ঘুমপাড়ানি কানের
পর্দায়। শুফম গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে লাগলো, "নামাজ পড়বি না ? উঠ"। ঘুম ভেঙ্গে
গেলো। স্বপ্ন ভেঙে গেলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের মাঝে রোবটদের রাজ্যে চলে
গেছিলাম। ঘুম থেকে উঠে উযুর জন্য গোসলখানায় প্রবেশ করলাম। উযুর সময় ঠিক
পেলাম ঠিক বুকের বাম পাশে একটু একটু চিনচিন করে ব্যথা করছে। কিসের ব্যথা
এটা; নিজেকে নিজেই জিজ্ঞাসা করলাম। ঠিক তখনি আবার আমার মনে হলো স্বপ্নে
দেখা রোবটের কথা। প্রবীণদের মুখে শুনেছি, শেষ রাতে স্বপ্ন নাকি সত্য হয়।
ধর্মেও আছে শেষ জামানায় নাকি ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ হবে। তাহলে কী সত্য হতে
যাচ্ছে কিছুখন আগে ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নের কাহিনী। রোবটদের দেশ, রোবটদের
রাজত্ব! আসলে সৃষ্টিকর্তা সব কিছু ভালো জানে; আগামী ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য
কী হবে।