মানুষের শখ-আহ্লাদের কি কোন সীমা পরিসীমা আছে?
জগতে এই একটি ব্যাপারে মানুষের মাঝে কোন পার্থক্য নাই।ধনী,গরীব,জাতি,ধর্ম,সব কিন্তু সমান।শখ-আহ্লাদের ব্যাপারে সবাই যে এক কাতারে দাঁড়িয়ে-সেটি বলতে আর সময় নেয়া লাগেনা।
ঝুলন খাঁ সেই রকম একজন মানুষ।
সে হত দরিদ্রদের একজন হলেও,শখের দিক থেকে বিবেচনা করলে তাকে কোন ভাবেই দরিদ্র বলা চলেনা।
ঝুলন খাঁ,তার বাড়ি আর ইউনিয়ন অফিসের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত একটি ইটের ভাটায় মাটি ছানার কাজ করে।হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ।
ঝুলন খাঁর বয়স ছিয়াত্তর।তারপরও সংসারের সবার মুখে দু’মুটো খাবার তুলে দেবার জন্য এ বয়সেও তাকে এতো খাটতে হয়।
তার স্ত্রীর বয়স কম,সাত চল্লিশ।অবশ্য এটি তার চতুর্থতম স্ত্রী!
আগের তিন জনের মধ্যে দু’জন পরপারে চলে গেছে।একজন কোথায়,কি রকম আছে আল্লাহই জানেন।তবে ঝুলন খাঁর মন বলে সে বেঁচে আছে।
ঝুলন খাঁর বাড়ি ভাটি অঞ্চলে।জীবিকা নির্বাহের জন্য আরো অনেকের সঙ্গে দল বেঁধে,দূর দূরান্তের উজান দেশে বেরিয়ে পরতো।মাসের পর মাস গৃহস্থালি,চাষাবাদ,এধরণের সব কাজ করে বেড়াতো।সে সুবাদে যে অঞ্চলে গেছে-বিয়ে একটা করার চেষ্টা করেছে।বিয়ে করেছেও।
বিয়ে করা ঝুলন খাঁর একটা শখ ছিলো।শখ ছিলো সন্তানেরও।কিন্তু আগের তিন পক্ষের কেউই তাকে সন্তান দিতে পারেনি।
শেষ বয়সে স্থানীয় এক কন্যা শেফারা বেগমকে বিয়ে করলো।সে ই তাকে তিনটা ছেলে আর একটা মেয়ে উপহার দিলো।
শেফারা বেগমকে বিয়ে করার পর ঝুলন খাঁ আর উজান দেশে একটি বারের জন্যও যায়নি।সামান্য ব্যবসা করার চেষ্টা করেছে।দূরের,বড়ো বাজার থেকে,নানান ধরণের সুটকি কিনে এনে,নিজের অঞ্চলের,এ গ্রাম সে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেছে।
তারপর চেয়ারম্যান সাহেব যখন ইটের ভাটা দিলেন,আরো কয়েকজনের সঙ্গে তাকেও কাজ দিলেন।
চেয়ারম্যান সাহেব জানতেন,ঝুলন খাঁ উজান দেশে বেশ কিছুদিন ইটের ভাটায়ও কাজ করেছে।
সেই থেকে,দীর্ঘদিন ধরে সে এই ইটের ভাটার শ্রমিক হয়ে আছে।
অভাব অনটনে সংসার চলেছে খেয়ে না খেয়ে।ছেলে,মেয়ে গুলো বড়ো হয়েছে যে যার মতো, বেখেয়ালে।
তিন ছেলে,এক মেয়ের মধ্যে মেয়েটা দু’নম্বর।বিয়ের বয়স হয়েছে।ঝুলন খাঁরও বড়ো শখ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে,নাতী,নাতনীর মুখ দেখার।শিশুদের সঙ্গ তার অত্যন্ত ভালো লাগে।
কিন্তু মেয়ে তার বড়ো ভাইয়ের মতো বিয়ে এখন করবেনা।
ঝুলন খাঁর বড়ো ছেলেটা,এক ট্রাক ড্রাইভারের সহযোগির কাজ নিয়েছে কিছু দিন হলো।সেই ড্রাইভারের সঙ্গে দূর দূরান্তে,শহরে ট্রি প নিয়ে যাওয়া আসা করে।
সে নাকি বোনকে বলেছে শহরে ভালো একটি গার্মেন্টসে কাজে লাগিয়ে দিবে।
কি হচ্ছে না হচ্ছে,এসব ব্যাপারে ঝুলন খাঁর কোন ধারণাই নাই।ছেলে,মেয়েরা আর তাদের মা,তার কোন কথাই শোনেনা,মানেনা।তার কথায়,তার সিদ্ধান্তে এরা বিয়ে শাদি করবে,সে অনেক দূরের ব্যাপার।
তারপরও ঝুলন খাঁ মেয়ের বিয়ের জন্য এক পাত্রের সন্ধান আনলো।পাত্র তারই সাথে ইটের ভাটায় এসিস্ট্যান্ট সুপার ভাইজারের কাজ করে।বড়ো ভালো ছেলে।পাশের গ্রামেই বাড়ি।
বিয়ের কথা ঝুলন খাঁ তুলতেই,মেয়েটা তেড়ে এলো!মুখের কাছে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করে বললো,’খবরদার বলছি,আমার বিয়া নিয়া কথা কইবি না।গার্মেন্টসে কাম ধরবার পর আমার যোইগ্য জামাই আমি দেইখ্যা লইমু’।
ঝুলন খাঁ ভয় পেলো।আর একটু হলে মেয়েটা হয়তো গায়েই হাত তুলতো।সে তার স্বাধ আহ্লাদ কে ইটের ভাটায় মাটি চাপা দিয়ে-ইটের মাটি ছেনেই যেতে লাগলো।
তিন মাস পরের ঘটনা।
পৌষের এক দুপুর বেলা,ইট ভাটার কয়েকজন কাদা মাখা ঝুলন খাঁর লাশ বয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো।
ঘন্টা খানেক আগে,মাটি ছানতে ছানতে ঝুলন খাঁ নিজেই সে মাটিতে ঝুলে পড়েছে-আর উঠে দাঁড়ায়নি।
লাশ দেখে মা,মেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে,আশে পাশের সমস্ত লোক জড়ো করে ফেললো।
বড়ো ছেলেটা ট্রি পে।তিন দিন পর আসবে।ছোট ছেলে মেয়ে গুলোও মা,বোনের সঙ্গে গলা মেলালো।
এর ন’দিন পর,মেয়েটা তাদের গ্রামেরই একটা বেকার ছেলেকে বিয়ে করে ফেললো।সেই ছেলের পিতা এক গৃহস্থ বাড়িতে বাঁধা মেন্তির কাজ করে।
ছেলেটির সাথে মেয়েটির সম্পর্ক ছিলো।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে সন্তানও হয়তো হবে।
তা দেখার জন্য,নাতি,নাতনী নিয়ে খেলা ধুলা করে সময় কাটিয়ে,শখ-আহ্লাদ মেটানোর জন্য ঝুলন খাঁ ই শুধু দুনিয়াতে রইলোনা।