শামীম আহমদ এর বাছাই দশ কবিতা
বিজেতা ও নপুংসক
ক্রমশ প্রকাশ্য
জীবনের সমগ্র সমুদয় প্রাসঙ্গিক টপিকগুলো এখন-
কেবলই পথের পাঁচালীর মতো ড্রামাটিক ।
সমাজের নাগরিক বিচরণে বেহালার করুন রাগিণী ধীরলয়ে মিশে যায় শরীরে,মননে, রন্দ্রে রন্দ্রে ;
নিতান্ত অবহেলায় জীবনের উত্থান পতনে আমরা যেনো অপু আর দূর্গা ।
গোধুলী থেকে সন্ধ্যা হয়ে রাত্রি গড়িয়ে এলে আঁধার ঘন হয়ে আসে একটি সুপ্রসন্ন প্রভাতের অপেক্ষায়,যদিও প্রভাত হয় প্রকৃতির নিয়মে কিন্তু ধর্ম, সামাজিক বৈষম্য হয় না দূর ,
যাঁরা দেবীর মূর্তি গড়েন মেধা আর মনের মাধুরী মিশিয়ে, শৈল্পিক সৌন্দর্য যাঁদের আরাধনা দেবালয়ে তাঁরাই আশ্রয়হীন নিগৃহীত যুগের পর যুগ !
এক সময় আমরা ঐ আঁধারের খোলস ভাঙার চেষ্টা করে আবার নিজেরাই অন্ধকারে মিশে একাকার হয়ে যাই ,তারপর সমাধির এপিটাফে অক্ষরের কঙ্কাল হয়ে ঝুলে থাকি সময়ের সাক্ষী হয়ে কেউ হয়তো বিজেতা আর কেউ নপুংসক ।
অক্ষর, কবি ও মিসিং মিটিওরাইট
অক্ষরগুলো কোন মিসিং মিটিওরাইট নয়
মহাশূন্য থেকে ছিটকে পড়ে
বায়ুমণ্ডলেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে,
অক্ষর হলো প্রাণের স্পন্দন
হৃদয়ের বিস্তৃর্ণ মানচিত্র জুড়ে যার নির্মল হৈহুল্লোড় ,
হীমেভেজা রাতে পেঁজা তুলোর মতো ওড়ে
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে কবিতা হয়ে ,
এ যেনো কবির অরূপে স্বরূপ আরাধনার মতো ।
কবিতা ধীর পায়ে হাঁটে ,বহুদূর যায়
বাতাসের পায়ে যেনো ছন্দনূপুর ।
নিকষ আধাঁরে ,বজ্রের পথচিহ্ন ধরে ,কবি পথচলে
যেতে যেতে এক সময় ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি কবি ,
কালোকে আলো করে মাটির তবকে জ্বেলে আগুন
জ্যোৎস্নার শরীর যখন পুড়ে হয় ছাই অমাবস্যার তাপে !
এ আগুন পোহাতে এসোনা সখি ,ভস্ম হবে ।
যদি হও অনলের কোরক
যদি ভালবাসা হয় ফুলে
যদি ভালবাসা হয় কবিতায়
তবে পুড়তে হবে নির্ঘাত জেনো
সাথে পোড়াতেও পারো তাবৎ ব্যথিত হৃদয় ।
ফাগুনের চিৎকার
ভাঙা পাথরের পথে এখনও হামাগুড়ি দেয় -
বাংলা বর্ণমালাগুলো
বুকের গভীরে কে যেনো জ্বালিয়েছে হোম
নিঃশ্বাসে বিষ ঢালে দুরন্ত সময় ,
দাঁড়াতে পারেনা আর ,পাথরের ধারালো নখের
আচড়ে রক্তাক্ত হয়ে মৃতপ্রায়
একটি আটই ফাল্গুনের অধীর অপেক্ষায় ।
বেনিয়া বুদ্ধিজীবীদের ঠোঁট থেকে হায়নার মতো
টুক্ করে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে
ভিনদেশি শব্দের আগ্রাসন
ফেব্রুয়ারি গিলে খায় আটই ফাল্গুনের ভুবনরাঙা
শিমুলের হাসি ,
ফাগুনের চিৎকারে আগুন লাগে বাসন্তী বনে
আর পুড়ে পুড়ে ভস্ম হয় ভাষাশহিদের অমলিন স্বপ্নগলো ।
বিস্তৃর্ণ আনন্দলোকে আগুন
প্রান্ত থেকে প্রত্যন্তে -
উতলা পৃথিবীর বুকে কেবলই অন্ধকার ঝরে
অগ্রিম অন্ধকারে গিলে খায় রেনেসাঁর মশাল ।
কালো রাত অন্ধকারে আরো কালো আজ
দুর্যোগ ঘনঘটা, অবাধ্য সাপের মতো সময়ের গতি,
দুধারি খঞ্জর কেটে দেয় হাজার বছরের সঞ্চিত বোধ ,
এ যেনো সুঁতাকাটা ঘুড়ির মতো হৃদয়ে ওঠে থরথর কম্পন ।
যখন দেখি ইতিহাস আহত ঘোড়ায় চড়ে রণে ভঙ্গ দেয়
আমার স্বপ্নিল ক্যানভাসে হয় মহাজাগতিক বিস্ফোরণ
নিমিষেই বিস্তৃর্ণ আনন্দলোকে জ্বলে ওঠে আগুন ;
বিদগ্ধ হয় নীলাকাশ ,সমুদ্রের মীন পুড়ে গরল অগ্নি লাভায় !
হৃদয়ের বৃন্ত ছিড়ে যায় ,হৃদয়ের বৃন্ত ছিড়ে যায়
জলাতঙ্কে অস্থির সময়
সময়ের ইতিহাস ক’জন পড়ে বলো
বোধবৃক্ষ যখন শিকড়হীন ,
মাসরুমের মতো বেড়ে ওঠে ফাংগাসের-
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নির্লজ্জ সামন্তবাদ ।
ইতিহাস মানো অথচ সত্যেকে কেনো উপেক্ষা ?
অকাতরে মানবতার মর্মমূলে নিশ্চুপ বলিদান ।
জলাতঙ্কে কাঁপে অস্থির সময়
মাংসরা নেচে যায় মাতাল-মুদ্রায়,নিস্তব্ধ বাতাস
আমার জানালার গ্রীলে এসে করে আত্মহত্যা ,
জুবিলী পার্কের ম্যাপলবৃক্ষের পাতাগুলো হলদে হয়ে আসে
তারপর একে একে ঝরে পড়ে বিচ্ছেদ যন্ত্রনায় ...
জোনাকির আলো মেপে মেপে ইতিহাস উল্টোপথে হাঁটে
বক্তার বর্ধিষ্ণু বক্তৃতা অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ধীর লয়ে ।
নৈষ্ঠিক ঋষি
জমে যাওয়া বরফের মতো
পলকহীন চেয়ে থাকে রাতজাগা তারার দল ;
এখানে হীমেলে বাতাস এসে কেটে দেয়
অলিভ বৃক্ষের পাতা ,
ছায়ার মাছ , সমস্তরাত সাঁতার কাটে
দুধসাদা জ্যোৎস্নার জলে ,ধীরে ধীরে
তারাগুলো পড়ে গলে গলে ,পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাসে !
তারপর সব যেনো মিশে হয় দিনের কোলাহল
মাছগুলো ঝরাপাতা ,চোখগুলো জমে থাকা জল !
সব যেনো নথি করে পাঁচশত ছিয়াত্তর ম্যাগাপিক্সেল
টাইম ল্যাপসের ফিতায় ...
হে বন্ধু আমার ,তুমি কি দেখো নৈসর্গিক বিলাস ?
আমি সব দেখে চোখ বুজি
নৈষ্ঠিক ঋষির মতো
বুকে গভীরে পুঁতে রাখি আরাধনার বীজ ।
দুঃস্বপ্নের লিঙ্ক
এই দুঃস্বপ্নের দেশে স্বপ্নের কোন লিঙ্ক খোঁজে পাইনা
আত্ম বিধ্বংসী কবিতার মতো এখানে কবি রোজ
দেহ বিসর্জন দেয় আর আত্মাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে
কাল থেকে কালান্তরে!
কবির মৃত্যু নেই তাই আমিও মহাকাল জুড়ে হাঁটি
বিস্তীর্ণ কাব্যলোকে ...
আমি আর আমার কবিতা
আজকাল কবিতাগুলো
মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো ফ্যাকাশে
দ্বীপ্রহরেও মনে হয় এই বুঝি সন্ধ্যা ঘনায় !
দিখণ্ডিত চাঁদ,আর এক হাঁড়ি জল,
হাঁড়িতেই সারারাত সাঁতার কাটে চাঁদ পারের আশায় ,
চাঁদের শীতল বুকে বুদ্বুদ ফুটে ক্ষুধার পৃথিবী।
বাকরূদ্ধ কারার প্রকোষ্ঠে বোবা কয়েদির মতো
আমিও ছোট্ট হাঁড়ির মধ্যেই ডুবে তল হয়ে যাই
দৃষ্টির অতলে,
এ যেনো-
কূলহীন জলধি ,প্রমত্তা পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ
আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় , শেষ মোহনায় ,
যেখানে সাগর সঙ্গমে নদীর পরম সার্থকতা অথচ
আমার কবিতা সিহর্সের পুচ্ছ ধরে দোদুল্যমান
সাথে আমিও ,
আমি ভেসে উঠলে কবিতাগুলো ডুব দেয় গহীনে
আমি তল হলে ওরা টেনে তুলে ডাঙ্গায় ...
বৈকালিক ক্যাপোচিনো কাপে যখন ভেসে উঠে ভাঙ্গা চাঁদ ,চাঁদের গায়ে এখনও দেখি গ্রহণকাল, ক্ষুধার্ত পৃথিবী কাঁদে
কাঁদে সুরমার বিন্দু বিন্দু জল ,রক্তাশ্রু ঝরায় -
জেরুজালেমের আকাশ ,আল আকসার প্রান্তর জুড়ে প্লাবন ;
আমি রক্তাক্ত প্রান্তরে বসে কবিতা লিখি
একবুক আশা নিয়ে,গ্রহণের বাদে যদি আবার
পূর্ণ চাঁদের আলোয় রোমাঞ্চিত হয় পৃথিবী ,
যদি আবার জেরুজালেমের আকাশে ডানা মেলে
মাটির পাখি ...
কোভিডে নীল আজ শহস্র গোলাপ
প্রকৃতির ঠোঁটে শেষ চুম্বন এঁকে দেয় ছিন্ন দীর্ঘ নিঃশ্বাস
হাওয়ার সাথে উড়ে যায় সমুদ্রের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঢেউ
আমি সব ভূষণ খুলে রাখি পৃথিবীর শ্যামল তটে ;
ছায়াবৃত্তে হারিয়ে যাবার আগে,আমার চোখ যেনো
কুপি বাতির মতো নিভু নিভু করে
আর একবার ধপ করে জ্বলে ওঠে বাঁচার প্রচণ্ড অভিপ্রায়ে ,
তাবৎ পৃথিবীর স্বপ্ন এসে জড়ো হয় চোখে ,
তারপর
চেনা পথ অচেনা নগরে হয় লীন !
বেদনায় নীল হয় প্রতিদিন রক্তিম গোলাপ ।
ছায়া দীর্ঘ হলে রাতের বারতা জানায় একঝাঁক বুনোহাঁস ।
অমাবস্যার মতো এই বুঝি অন্ধকার নেমে এলো চোখের তারায় !
চেয়ে দেখি অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে
এক এক ঝরে পড়ছে আঙুলের ফুল,নির্বাক ওষ্ঠদ্বয়
আকাশও কেঁদেছে অবিরাম ,নক্ষত্রের তলে,
জড়িয়ে ধরে পৃথিবীর গলে,
অগনিত মানুষ
চলেছে রোজ ,অনাকাঙ্ক্ষিত অনন্ত বিশ্রামে ।
যদিও ইলিউশনে দ্বিধাগ্রস্ত চোখ
একবার জ্বলে ওঠো আলো ,জন্মান্ধ চোখে ,
মোহনও মন্ত্রে ,
মেমব্রেন ছিন্ন করে
রেটিনার গভীরতম প্রকোষ্ঠে, যেখানে স্বপ্ন জেগে থাকে ,
একবার পাঁজরে পাঁজরে ঘর্ষণ লেগে জ্বলে ওঠো আগুন
যেখানে নিঃশ্বাস লুকোচুরি করে মৃত্যুর সাথে বাঁচার তাগিদে ।
এসো হাতের আঙুলগুলো মেলে ধরি আকাশের বিশালতায়
যেখানে চন্দ্র-লোকে বৃক্ষের ছায়ায় বসে নক্ষত্রের শহর !
এখনও আসেনি সময় জীবনকে প্রত্যাখ্যান করার
যদিও মহামারীর ইলিউশনে চোখ দ্বিধাগ্রস্ত ।
ব্যাকুল মন
চেয়ে দেখো রোদভরা অন্তহীন মাঠে হাওয়ার উল্লাস
বিনিদ্র সাগর দর্জির মতো
ঢেউ সেলাই করে করে এগিয়ে যায়
তীর ছোঁয়ার তীব্র আশায় ,
আর বিশাল সাগরবক্ষে উত্তাল ঢেউয়ের ছন্দে
শুশুকের নির্মল জলকেলি জীবনের উচ্ছ্বাসে ।