হিন্দুদেবী শ্যামা বা শক্তির উদ্দেশে রচিত একপ্রকার ভক্তিগীতি, যা শ্যামাসঙ্গীত নামে সুপরিচিত। শ্যামাসঙ্গীতকে অনেকেই শাক্তগীতিও বলেন। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি শাক্তধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং যতটুকু জানা যায়, একে কেন্দ্র করেই শাক্তগীতি চর্চার ধারা বহমান হয়েছিল। পরবর্তীতে, আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কবি রামপ্রসাদ সেন এতে প্রাণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে শাক্তপদাবলি বা শ্যামাসঙ্গীত নামে একটি বিশেষ সঙ্গীতধারা প্রতিষ্ঠিত করেন। সাধক রামপ্রসাদের চেষ্টা ছিল শক্তিসাধনাকে নীরস অধ্যাবসায় ও তান্ত্রিকতা হতে মুক্তি দিয়ে একটি সহজ সাঙ্গীতিক পরিবেশ প্রদান করা। শ্যামা বা কালীকে ঘিরে বিকৃত বা বিভৎস শক্তিসাধনার যে অশোভন সংস্কার সমাজে প্রচলিত ছিল, তা পরিহার করে মা ও সন্তানের মধ্যে বাৎসল্য ও ভক্তির যে শাশ্বত সম্পর্ক, তিনি তারই সাঙ্গীতিক রূপ দেন। শ্যামাসঙ্গীতের এমন একটি ধারা তিনি সৃষ্টি করেন যা সতন্ত্রভাবে পরিচিত। তাঁর এ গানগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় সকলের কাছে ‘রামপ্রসাদী গান’ নামে। প্রকৃতপক্ষে, ‘ এমন মানব জমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলত সোনা’ -এমন গানগুলি আজও আমাদের মনকে ভক্তি-শ্রদ্ধায় ভরিয়ে তোলে।
শ্যামাসঙ্গীতকে তত্ত্বগত দিক থেকে দুটি ধারায় বিভক্ত করা হয়ে থাকে, ভক্তিরসাত্মক বা তত্ত্বমূলক এবং উমাসঙ্গীত, আগমনী বা বিজয়ার গান। ভক্তিরসাত্মক গানগুলি আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত ও গীত হয়ে থাকে। এই গানগুলিও বিশেষভাবে শ্যামাসঙ্গীত নামে পরিচিত। ভীন্নদিকে সামাজিক ধারায় রচিত পদাবলি উমাসঙ্গীত, আগমনী বা বিজয়ার গান নামে পরিচিত। শ্যামাসঙ্গীতের মূল আবেদন মা ও সন্তানের মধ্যে মান-অভিমান, ¯েœহ-বাৎসল্য, প্রেম-ভালবাসা ও ভক্তি’র রুপগত বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ। আর শ্যামসঙ্গীত যুগোত্তীর্ণ এসব কারণেই। শিল্পকলার শাখা-প্রশাখায় শ্যামাসঙ্গীত কাব্যে, রসে ও ভাবের বৈভবে এক রুচিশীল ও মানবিক অনুভূতিপূর্ণ সাঙ্গীতিক অভিব্যাক্তি। আঠারো শতকে দেশের সমাজ ও সংস্কৃতি, বিশেষকরে সঙ্গীতজগৎ ভোগবিলাসে মগ্ন ছিল। এমন সময়ে মায়ের নামে আধ্যাত্মিক চেতনায় শ্যামাসঙ্গীত রচনা ছিল অতি তাৎপর্যমূলক বিষয়। এ গানের আবেদন গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে অর্থাৎ সবধরণের মানুষের জীবনে সামাজিকভাবে সুবিস্তৃত অবস্থানে। শ্যামাসঙ্গীতে ভক্তিভাব ও বাৎসল্য মাতৃপূজার যে ধারার সৃষ্টি হয়েছে, পরে তা গণজীবনে স্বদেশভূমির মাতৃবন্দনায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
সঙ্গীতে ‘মা’ সম্বোধনের এমন আকুল আবেদন বাংলা গানের আর কোন ধারাতে আমাদের নিকট পরিলক্ষিত হয় না। তাই বলা চলে, শ্যামাসঙ্গীতের অনুকরণে দেশের গানে মায়ের নামের আহ্বান জাতীয় চেতনা বিকাশে এক সার্থক প্রয়াস। শ্যামাসঙ্গীতের সুর রচনায় লোকগীতি ও কীর্তনের প্রভাব পাওয়া যায়। সহজ সরল বাণী ও সুরের সমন্বয়ে মাতৃ আরাধনা শ্যামাসঙ্গীতের বিশেষত্ব, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পরের সময়ের গীতিকবিদের এ গান রচনায় প্রচন্ডভাবে উদ্বুদ্ধ করে। রামপ্রসাদের পরে শ্যামাসঙ্গীত রচনায় খ্যাতি অর্জন করেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। এ সাধক কবি কমলাকান্ত, রামপ্রসাদ সেনের মত শ্যামাসাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর রচিত ‘মজিল মন ভ্রমরা, কালীপদ নীল কমলে/ যত বিষয় মধু তুচ্ছ হইল/ কামাদি কুসুম সকলে’ একটি বিখ্যাত গান। পরবর্তীতে দাশরথী রায়ের পাঁচালি ও রামমোহন রায়ের বক্ষ্মসঙ্গীতের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এসে আধুনিক ধারায় তা স্থিত হয়। ভক্তিবাদী বাঙালির মানসপটে ভক্তিভাবসম্পন্ন গীতিধারা হিসেবে কীর্তনের পাশাপাশি শ্যামাসঙ্গীতও অত্যন্ত জনপ্রিয় গীতিধারা।
শ্যামাসঙ্গীতের ভক্তিরসপূর্ণ নান্দনিক প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মরমী ও ভক্তিগীতি এবং দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে আজও প্রবহমান। অপরদিকে, শিব ও পার্বতী অথবা উমা ও দূর্গা’র কাহিনী অবলম্বনে রচিত এক ধরনের বাংলা গান, তা হলো আগমনী বিজয়া। এই গানের সাথে দূর্গাপূজার একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আমরা জানি, ধনাঢ্য গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল দরিদ্র শিবঠাকুরের সঙ্গে। বিয়ের পর পার্বতী স্বামীর ঘরে চলে গেলে সেখানে মেয়ের দারিদ্র জীবনের কথা চিন্তা করে মা মেনকার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। যতটুকু জানা যায়, শারদীয় কোন এক রাত্রে মা ও মেয়ে উভয়ে নিজেদেরকে স্বপ্নে দেখেন। পরের দিন মেয়ে উমাকে নিজ গৃহে আনবার জন্য মা মেনকা স্বামীকে অনুরোধ করেন। পিতা-মাতার অনুরোধে মাত্র তিন দিনের জন্য উমা পিতৃলয়ে আগমন করেন। এই আগমন কেন্দ্রিক গানগুলিই আগমনী গান নামে পরিচিত। অপরদিকে, পিতৃগৃহে অবস্থানের পর উমা যখন পতিগৃহে ফিরে যান তখন স্বভাবতই বিরোহী সুর বেজে ওঠে। এই বিষাদ কেন্দ্রিক গানগুলি বিজয়া গান নামে অভিহিত। উক্ত দুই প্রকার গানকে একত্রে আগমনী-বিজয়া গান বলা হয়। আগমনী-বিজয়া গানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন। পরবর্তীতে আরো অনেকেই যাঁরা এই গান রচনায় খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রামবসু ও দাশরথি রায়। আগমনী-বিজয়া গান মূলত: বৈষ্ণব গীতিকবিতা থেকে অনুপ্রানিত হয়েছে। উভয় প্রকার গানের প্রকৃত রস একই, আর তা হলো মধুর সুরে নিবদ্ধ। তবে আগমনী-বিজয়া গানে করুণ রসেরও পরিচয় মেলে এবং আগমনী-বিজয়া গানে থাকে সার্বজনীনতার সুর ও বৈষ্ণব কবিতায় থাকে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রাধান্যতা। উভয় গানের বিষয়বস্তু হিন্দু বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা দেখেছি জীবনের সুখ, দু:খ, আনন্দ, বেদনা, বাস্তবতা ইত্যাদির ছায়া পরিস্ফুটিত হয় এসব গানে। হিন্দু বাঙালি পরিবারের মেয়ে ও মেয়ে-জামাই গৃহের বিরোধের কথাও কখনও কখনও সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয় এ গানে। শাক্তপদাবলির সংসারমুখী প্রবনতা আগমনী-বিজয়া গানের মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা যায়। একসময় বাঙালি হিন্দু মেয়েদের যখন বাল্যবিবাহ হতো তখন মা মেনকার মত বাঙালি মায়েরাও স্বামীগৃহে মেয়ের সুখ-দু:খের কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হতেন। তাঁরাও উমার মা মেনকার মত আকুলভাবে মেয়েদের কাছে পেতে চাইতেন, আর মেয়েরাও উমার মত পিতৃগৃহে আসার জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকতো। আর সে সুযোগটি ঘটত সাধারণত শারদীয় দূর্গাপূজার সময়ে। এ সময়ে মেয়েকে কাছে পেয়ে মা স্বস্তি বোধ করতেন, আনন্দিত হতেন, আবার বিদায়ের সময় মেনকার মতোই দু:খে কাতর হতেন। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে আগমনী-বিজয়া গান বাঙালি জীবনে এক অস্থায়ী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তবে সম্ভবত, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে বাংলা গানের এ ধারা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাই এ গানের ধারা খুব বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি বলে মেনে নেয়া হয়। তারপরও বাঙালি হিন্দুরা এখনও শারদীয় দুর্গাপূজার সময় উমা-শিবকে নিজেদের মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে অভেদ জ্ঞান করে আনন্দ-বেদনা অনুভব করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গানের অনেকগুলি পর্যায়ের মধ্যে ভক্তিমূলক গান অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভক্তিগীতি দুটি শাখায় বিভক্ত, হিন্দুধর্ম বিষয়ক ও ইসলামী ঐতিহ্যের অবলম্বনে রচিত গীত। আমরা প্রথম শাখার গানগুলিকে ভীন্ননামে হিন্দুধর্মসঙ্গীতও বলতে পারি। হিন্দুধর্মসঙ্গীত পর্যায়ে নজরুলের অজস্র গান হিন্দুধর্মীও উৎসবগুলিতে গাওয়া ও বাজানো হয়। নিরাকার ঈশ্বরবন্দনাসহ কালী, দূর্গা, সরস্বতী, লক্ষèী, বিষ্ণু, শিব, সূর্য, রাধা-কৃষ্ণ, সীতা, রাম, রামকৃষ্ণ প্রভৃতি দেব-দেবী ও অবতার-মহাপুরুষদের প্রশস্তিমূলক কয়েকশত গান এই পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত। শুধুমাত্র কালী বা দূর্গার প্রশস্তিই যথেষ্ট নয়, সনাতন পৌরাণিক কাহিনীর নানান দিক অবলম্বনে তিনি সঙ্গীত রচনা করেছেন। নিত্যকালী, ভদ্রকালী, মহাকালী, শ্মশানকালী, শক্তিদেবী, চ-ী, কৌষিকী, দূর্গা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, সতী, গৌরী, দশমহাবিদ্যা, ঊমা প্রভৃতি নানান রূপ বর্ণনা করেন তিনি তাঁর সঙ্গীত রচনায়। কি গভীর ব্যুৎপত্তি থাকলে এত গভীর, বিপুল ও বিচিত্র করে বিষয়গুলিকে সঙ্গীতে রূপায়িত করে এমন দূরহ রচনা করা সম্ভব তা ভাবলে আমাদের স্তম্ভিত হতে হয়। যতদূর জানা যায়, অপর কোনো বাঙালীর সঙ্গীত রচনায় এত বৈচিত্রের প্রতিফলন ও পৌরাণিক বিষয়ের এমন বিপুল সমাবেশ ঘটেনি।
বিষয়বস্তু অনুসারে নজরুল ইসলামের হিন্দুধর্মবিষয়ক ভক্তিগীতি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। ‘ঈশ্বর বন্দনা’ পর্যায়ের সঙ্গীতে নজরুল পরমেশ্বরের স্বরূপ রচনা করেন। এটি মূলত: বক্ষ্মসঙ্গীতের অনুসারি। সৃষ্টিকর্তা এখানে এক, অখন্ড ও নিরাকার। আহার দেবেন তিনি রে মন, অন্তরে তুমি আছ চিরদিন, আমাদের ভাল কর হে ভগবান, অনাদিকাল হতে অনন্তলোক, ওগো পূজার থালায় আছে আমার, খেলিছ এ বিশ্বলয়ে, তোমার মহাবিশ্বে কিছু, তোমায় কি দিয়ে পূজি ভগবান, মধুর আরতি তব, হে চিরসুন্দর বিশ্ব চরাচর, মন বলে তুমি আছ ভগবান, হে মহামৌনী প্রভৃতি নজরুলের রচনার অন্তর্গত ঈশ্বর বন্দনামূলক গান। ‘শ্যামা সঙ্গীত’ পর্যায়ের বিষয়বস্তু দেবী শ্যামা বা কালী মায়ের মহাত্ম্যবর্ণনা। বাংলা গানের ধারায় শ্যামা সঙ্গীতের প্রাচুর্যে যে ক’জন উল্লেখযোগ্য রচয়িতার নাম পাওয়া যায়, কাজী নজরুল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা শ্যামা সঙ্গীতের ভান্ডারে যে গানগুলি কালোত্তীর্ণ গৌরব লাভ করেছে তাঁদের মধ্যে নজরুল রচিত গানের সংখ্যা যথেষ্ট পরিপূর্ণ।
নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত দুটি ধারায় রচিত, একটি হলো- কালীর রৌদ্ররূপের বর্ণনা এবং অন্যটি হলো- দেশাত্ববোধক চেতনা। শ্মশান কালীর রূপ দেখে যা, থির হয়ে তুই বস দেখি মা, নাচেরে মোর কাল মেয়ে, আর লকাবি কোথায় মা কালী, বলরে জবা বল, মহাকালের কোলে এসে, আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, আমার কালো মেয়ে পালিয়ে বেড়ায়, আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, আমার ভয়ের অভাব লয় হয়েছে শ্যামা ভাব সমাধীতে, তুই কালী মেখে জ্যোতি ঢেকে পারবিনা মা ফাঁকি দিতে, আমার হৃদয় হবে রাঙা জবা, মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি প্রভৃতি শ্যামা সঙ্গীত পর্যায়ের গান। ‘দূর্গা বিষয়ক’ গানে দেবী দূর্গার মাহাত্ম্যবর্ণনা পাওয়া যায় যা অনেকটা শ্যামা সঙ্গীতের ন্যায়। নজরুলের এই পর্যায়ের রচনায় বন্দনামূলক, স্বদেশ ও দূর্গা দেবীর বর্ণনা পাওয়া যায়। জয় জগৎ জননী, জয় দূর্গা জননী শক্তি, জয় দূর্গা দূর্গতিনাশিনী, ভবানী শিবানী দশপ্রহরধারিণী, মাগো কে তুই কার নন্দিনী, মৃন্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রী দূর্গা প্রভৃতি গানে দূর্গার প্রশস্তি রচিত হয়েছে। ‘আগমনী’ পর্যায়ের নজরুল রচনা বাংলা সঙ্গীতের ধারায় ঊমারুপিণী দূর্গাকে নিয়ে রচিত সঙ্গীত। দেবী দূর্গার মর্ত্যে আগমনকে এই গানে কৈলাসে স্বামী শিবের গৃহ হতে পিতা হিমালয়ের গৃহে উমার আগমনের প্রতিরূপ হিসেবে গণ্য করা হয়। আমার আনন্দিনী উমা আজো, আমার উমা কই গিরিরাজ, আয় বিজয়া আয়রে জয়া, আয় মা উমা ! রাখবো এবার, এলো রে শ্রী দূর্গা, ওরে আলয়ে আজ মহালয়া, কী দশা হয়েছে মোদের দেখ উমা আনন্দিনী, জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী, তোর মেয়ে যদি থাকতো উমা, মা এলোরে মা এলোরে, যাসনে মা ফিরে প্রভৃতি গীত নজরুলের আগমনী ধারায় রচিত গান।
পুত্র বুলবুলকে নিয়ে নজরুল যখন গজল রচনায় নিবিষ্ট হন, ঠিক তখনই রচনা করেছিলেন ধ্রুপদাঙ্গের দুটি ‘শিব সঙ্গীত’। গান দুটি হলো- গরজে গম্ভীর গগণে এবং কে শিব সুন্দর শরৎ চাঁদ চূড়। পরবর্তীতে আরো কিছু শিব সঙ্গীত পাওয়া যায়। এসো শঙ্কর ক্রোধাগ্নি, মৃত্যুকালী শঙ্কর সঙ্গে, ভগবান শিব জাগো জাগো, সৃজনছন্দে আনন্দে, হর হর হর শঙ্কর, জাগো ওরুণ ভৈরব প্রভৃতি শিব সঙ্গীত। নজরুল সঙ্গীত রচনায় হিন্দু ধর্মসঙ্গীত পর্যায়ের ভক্তিগীতি গানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ‘শ্যাম সঙ্গীত’ রূপে অভিহিত করা হয়। কৃষ্ণ অথবা শ্যাম বিষয়ক কাহিনীর নানা পর্যায় অবলম্বনে রচিত গীত শ্যাম সঙ্গীত। শ্যাম সঙ্গীতকে আবার দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনকারী কৃষ্ণ-নারায়ণের মহিমা যেসব গানে বর্ণিত হয়েছে সেগুলি একটি ভাগে এবং অপরভাগে অন্তর্ভূক্ত করা যায় সেই সব গান যেখানে কৃষ্ণ উপস্থিত হয়েছেন ব্রজবিহারী, রাজবল্লভরূপে। এ ছাড়াও কীর্তন, কৃষ্ণলীলা প্রভৃতি বিষয় তো রয়েছেই। জয় নারায়ণ অনন্ত রূপধারী, তিমির বিদারী অলখ বিহারী, দাও দাও দরশন পদ্মপলাশ লোচন, কারা পাষাণভেদী জাগো নারায়ণ, পূজা দেন্নলে শঙ্খ নাহি বাজে, মোর বেদনার কারাগারে জাগো, হে প্রবল প্রতাপ দর্পহারী প্রভৃতি গান এই শাখার অন্তর্ভূক্ত। কৃষ্ণলীলা নিয়ে রচিত এই পর্যায়ের কিছু গান খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরী, দাদরা, ধূণ সহ নানা প্রকার হিন্দুস্তানী লোক সঙ্গীত ভাঙা সুরে রচিত। কোথাও কোথাও কীর্তনভাঙা সুরও এই শ্রেণির গানে প্রযুক্ত হয়েছে। পদাবলী কীর্তনের ঐতিহ্যানুসারে নজরুল যথেষ্ট কীর্তন রচনা করেন। আমি কলহের তরে কলহ করেছি, আমি কেন হেরিলাম নবঘনশ্যাম, একি অপরূপ রূপের কুমার, ওগো প্রিয় তুমি চলে গেছ আজ প্রভৃতি গান। এছাড়াও কৃষ্ণের ব্রজলীলা শাখায় নজরুলের অনেক গান মেলে। আমার নয়নে কৃষ্ণ, আমার হৃদয় মন্দিরে ঘুমায়, আমি কেমন করে কোথায় পাব কৃষ্ণ চাঁদের দেখা, আমি গিরিধারী সাথে মিলিতে যাই, আমি রবনা ঘরে, আমি রচিয়াছি নর ব্রজধাম, এল নন্দের নন্দন নবঘনশ্যাম, এস আনন্দ সুন্দর ঘনশ্যাম, এসো নওল কিশোর, এস নূপুর বাজাইয়া, এস প্রাণে গিরিধারী, এস হৃদি রাসমন্দিরে, ও তুই যাসনে রাই-কিশোরী, ওরে নীল জমুনার জল, তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম, বিজন গোঠে কে রাখাল বাজায় বেণু, রাধাকৃষ্ণ নামের মালা, শ্রকৃষ্ণ নামের তরীতে, নন্দদুলাল নাচে রে ইত্যাদি।
ঝুলন উৎসব কৃষ্ণলীলার একটি অংশ। এরমধ্যে কৃষ্ণ কানাইয়া, ঝুলন দোলায় দোলে, সোনার হিন্দোলে কিশোর কিশোরী দোলে প্রভৃতি গান। ভক্তিগীতির মধ্যে কিছু গানকে নজরুল নিজে ভজন বলে আখ্যায়িত করে গেছেন। এই শ্রেণির গানের বিষয়বস্তুও কৃষ্ণ সম্পর্কিত। ভজন শাখায় যেসব গান পাওয়া যায় তন্মধ্যে কেহ বলে তুমি রূপসুন্দর, খেলনা আর আমায় নিয়ে, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, তুমি বেণুকা বাজাও লয়ে কার নাম, তোমার আমার এই বিরহ, নাচো শ্যাম নটবর, প্রভূ রাখ এ মিনতি, ভেঙোনা ভেঙোনা ধ্যান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া, বিদ্যাদেবী সরস্বতী সম্পর্কে নজরুল বেশ কিছু গান রচনা করেন। গানগুলির মধ্যে জয় মর্ত্যরে অমৃতবাদিণী, নমস্তে বীণা পুস্তকহস্তে, কেন আমায় আনলি মাগো, জয় বাণী বিদ্যাদায়িণী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শ্রীরামচন্দ্র সম্পর্কে তাঁর রচিত গানগুলি হলো: মন জপ নাম শ্রী রঘুপতি রাম, নবদূর্বাদলশ্যাম, রঘুকুলপতি রাম চন্দ্র, শ্রী রঘুপতি রাম ইত্যাদি। এমন আরো বেশকিছু সনাতন ধর্মীয় বিষয়ে তাঁর লেখনি পাওয়া যায়। যেমন- সূর্য, সীতা দেবী, শ্রী গৌরাঙ্গ, শ্রী রাম কৃষ্ণ, জয় বিবেকানন্দ প্রভৃতি বিষয়ের উপর তাঁর সঙ্গীত রচনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নজরুল রচিত হিন্দুধর্মবিষয়ক ভক্তিগীতি পর্যায়ের গানগুলি বিস্ময়করভাবে বৈচিত্রময়ী এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় অবস্থানে সুদৃঢ়। বাংলা গানের ধারায় অপর কোন বাঙালী সঙ্গীত রচয়িতার রচনায় এমন বিপুল হিন্দুধর্মসম্পৃক্ত ভক্তিগীতি প্রত্যক্ষ করা যায়নি। তাঁর রচনা শুধু বাংলা সঙ্গীতের ভান্ডারকে পূর্ণই করেনি, তাঁর রচনাকে করেছে সমৃদ্ধ ও স্বার্থক।
*তথ্যসূত্র:
১। খান মো: সাঈদ (আগমনী-বিজয়া) বাংলাপিডিয়া
২। দুলাল ভৌমিক (শ্যামা সঙ্গীত) বাংলাপিডিয়া
৩। বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের অবস্থান, ড. করুণাময় গোস্বামী (পৃষ্ঠা-৩৬০-৩৭৪)