আনন্দপাঠ পাঠাগার। পাঠাগারটির অবস্থান কুড়িগ্রাম শহরে। পাঠক মূলত শিক্ষার্থী। তাদের উপস্থিতিই মুখর করে পাঠাগারটিকে। বিশেষত বিকেলবেলা। প্রতি বুধবার অনুষ্ঠিত হয় পাঠচক্র। আলোচনা হয় জ্ঞানের বহুমূখী বিয়য়ে। প্রতি পাঠচক্রেই আমন্ত্রণ জানানো হয় একজন অতিথিকে। প্রতিষ্ঠার পঁচিশ বছর পূর্তি আজ। সে লক্ষ্যেই আয়োজিত হয়েছে বিশেষ আয়োজন। আজকের প্রধান অতিথি অধ্যাপক আহমেদ সারওয়ার। মূলত স্যারের উদ্যোগেই পাঠাগারটির সৃষ্টি। কঠোর প্রচেষ্টায় শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছেন স্যার পাঠাগারটিকে। গ্রন্থ পাঠ, গ্রন্থমেলা, সেমিনার, কর্মশালাসহ জ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তৈরি করেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাঠক। একতলা বিশিষ্ট পাঠাগারটির চারিদিকে বইয়ের সেলফ। দেশী বিদেশী গ্রন্থে সমৃদ্ধ সেলফগুলি। মাঝখানে যুক্ত বৃহদাকারের দুটি টেবিল। টেবিলের চারপাশে চেয়ার। দরজা জানালাগুলি খোলা থাকায় ভেতরে প্রবেশ করছে পর্যাপ্ত আলো। বেলুন এবং ফুলে ফুলে নান্দনিকভাবে সাজানো হয়েছে পাঠাগারটি। পাঠাগারের সাথেই স্যারের বাড়ী। পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ দিয়ে গড়েছেন পাঠাগারটি।
ইতোমধ্যে উপস্থিত হয়েছেন স্যার। উপস্থিত হয়েছেন নিয়মিত শিক্ষার্থী ও পাঠকসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা। অনেকেরই দেরীতে আসার সম্ভাবনা রয়েছে বিধায় শুরু হলো অনুষ্ঠান। গ্রন্থ পাঠের প্রয়োজনীয়তার ওপর বক্তৃতা প্রদান করলেন অভিজ্ঞ পাঠকবৃন্দ। শিক্ষার্থীরাও বক্তৃতা প্রদান করলো পঠিত গ্রন্থের ওপর। তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বক্তৃতা প্রদান করলো নিজ জীবনে পঠিত শ্রেষ্ঠ গল্পের ওপর। এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং পারস্যসহ কোনো মহাদেশেরই গল্প বাদ রইলো না। সবার তাৎপর্যপূণ আলোচনায় পাঠাগারের পরিবেশে সৃষ্টি হলো একটি জ্ঞানগর্ভ আবহের।
এবার স্যারের বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে উঠলোসবাই। স্বভাবজ আগ্রহ নিয়ে তাকালেন সবাই স্যারের দিকে। স্যারের ভরাট ফর্সা মুখখানিজুড়ে ভাবনার ছাপ স্পষ্ট। সেই ছাপটি অধিকতর গভীর হয়েছে গোছানো চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা এবং সাদা পাঞ্জাবীর সাথে খদ্দরের কটিতে। শুরুতেই অভিজ্ঞ পাঠকবৃন্দের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শিক্ষার্থীদের বললেন ‘তোমরা যতসব উচ্চমার্গীয় গল্প নিয়ে আলোচনা করলে আমি তো একেবারে গুলিয়ে গেলাম।’ স্যারের স্বভাবসুলভ রসিকতাপূর্ণ কথায় হেসে উঠলো সবাই। হাসোজ্জ্বল মুখে আবারো বললেন, ‘ আমি কিন্তু এত উঁচু মানের গল্প আলোচনা করতে পারবো না। তবে আজ আমি আমার জীবনেই ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব গল্পই তোমাদের সামনে তুলে ধরবো।’ স্যারের গল্প যে শিক্ষামূলক হবে সে বিষয়ে পূর্ণ আস্থা রয়েছে সবার। তাই নড়েচড়ে বসলো সবাই। যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে তাকালো স্যারের সারল্যে আবৃত মুখের দিকে।
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা। সবে কুড়িগ্রাম কলেজে যোগদান করেছি। শিক্ষক হবো এটি ছিলো আমার স্বপ্ন। এ জন্য শুরুর দিকে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করত। মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টিতে এ পেশার গুরুত্ব সীমাহীন-এটিও এক ধরনের অনুপ্রেরণা দিত। সরকারি কলেজের স্যার বলে ছোট বড় সবাই দেখতো আমায় ভিন্নভাবে। সম্মানও করতো উচ্চ মাত্রায়। হাতে সময়ও ছিল অফুরন্ত। ডানা মেলে ইচ্ছেমতো ঘুরতাম শহরে। এবং শহরের বাইরে অরণ্যে ঘেরা দূরবর্তী গ্রামে। বন্ধু, বড় ভাই, লেখক বন্ধুসহ কখনোবা সহকর্মীদের সঙ্গে। আজকের মতো এত উঁচু উঁচু দালান, প্রশ্বস্ত রাস্তা, যানবাহনের বিকট শব্দ এসবের কিছুই ছিল না তখন কুড়িগ্রাম শহরে। পুরো শহরটিই ছিলো প্রকৃতির মায়াবী সৌন্দর্যে ঘেরা এক অপরূপ কল্পপুরীর মতো। কিছুদূর পরপরই ছিল সবুজাভ ঘাসে পূর্ণ বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ। সেই মাঠগুলোতে ঘুড়ি উড়াতাম আমরা। খেলতাম গোল্লাছুট, ছি বুড়ি এবং দাঁড়িয়া বান্দাসহ নানা ধরনের খেলা। আমাদের সাথে খেলতো পাড়ার বড় ভাই এবং আপুরাও। বিশেষত পরীক্ষা শেষে সারাদিনই পড়ে থাকতাম মাঠে। দু’টাকা করে চাঁদা দিয়ে চড়ুইভাতির আয়োজনও করতাম শীতের সন্ধ্যায়। মনে পড়লে দৃশ্যগুলো ভেসে ওঠে এখনোও।
একটা বিষয় খুব নাড়া দেয় বুঝলে, সে সময়ে প্রতিবেশীদের মধ্যে ছিল আন্তরিকতার সম্পর্ক। পাশের বাড়ীর চাচী ভালো কোনো তরকারি রান্না করলেই বাটিতে করে দিয়ে যেত আমাদের বাসায়। আমার মাও ভালো কোনো রান্না না হওয়া অবধি বাটিটি ফেরত দিত না। বলা যায়, বাটি ফেরত দেয়া নিয়ে মধুর প্রতিযোগিতা চলতো প্রতিবেশীদের সাথে। কমবেশী প্রত্যেক বাড়ির মহিলারাই সামর্থ্য অনুযায়ী তরকারি বিনিময়ের এই প্রথাটি চালু রাখতো। আজ হতাশ হতে হয় যখন দেখি পাশের ফ্ল্যাটের কেউ মারা গেলেও খোঁজ নেয় না। যাই হোক, ধান কাটার মৌসুমে যখন গ্রামে যেতাম তখনকার একটা মজার ঘটনা বলি। গ্রামজুড়ে মহিলারা এক ধরনের গোল পিঠা তৈরী করত আর একত্রিত হতো বড় কোনো বাড়ীতে। সবাই একসাথে হবার পর নিয়মানুযায়ী টিনের চালে পিঠাগুলি ফেলে দিত। সেই পিঠাগুলি গড়িয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়তো আর আমরা কুড়াতাম।এক জনের মাথার সাথে আর একজনের মাথায় কখন যে ঠুকে যেত টেরই পেতাম না।গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তো বলে পিঠাগুলির নামই হয়ে উঠেছিল গড়গড়িয়ে পিঠে। এটিও ছিল এক ধরনের খেলা। বিশেষত মহিলাদের জন্য, যাদের জীবন সীমাবদ্ধ থাকতো হতো শুধুই সাংসারিক কাজের মাঝে।
আচ্ছা, এবার মূল গল্পে আসা যাক। একদিন বিকেলে বাজারের উদ্দেশ্য আদর্শ পৌরবাজারের দিকে হাঁটছি। হাসপাতাল থেকে বাজারের রাস্তাটি ছিল একদম শুনসান। রাস্তার দু’পাশে একটি দোকানও ছিল না। সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোর সীমানাজুড়ে ছিল প্রকাণ্ড কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, কদমসহ নানা জাতের ফুলের গাছ। রাস্তার মাঝেই গাছগুলি থেকে বিভিন্ন ধরনের ফুলের পাপড়িসহ পূর্ণাঙ্গ ফুল ঝরে পড়তো। দূর থেকে মনে হতো ফুলের মাদুর বিছানো অনিন্দ্য কোন সড়ক। প্রকৃতি আর মানবের মাঝে ফুলগুলি আপনাআপনিই সৃষ্টি করতো এক নিবিড় মিতালীর। আমি একদম বাজারের কাছাকাছি আসলাম। পেছন থেকে হঠাৎ সারোয়ার ভাই ডাক শুনে দাঁড়ালাম। ঘাড় ঘুরে তাকাতেই দেখলাম আজাদকে। জীর্ণ দশার একটি বাই-সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
কুড়িগ্রাম শিশু পরিবারে থেকে পড়াশুনা করত আজাদ। সে সময়ে স্বামীহারা স্ত্রী কিংবা পিতৃমাতৃহীন সন্তানের অভিভাবকবৃন্দের লক্ষ্যই ছিল, এতিমদের শিশু পরিবারে রেখে পড়াশুনা করানো। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর আজাদও ছিল শিশুপরিবারে। গর্ভমেন্ট স্কুলেই পড়তো। আমার তিন ক্লাস নিচে। তাছাড়া আমরা প্রায়ই শিশু পরিবারে যেতাম ফুটবল খেলতে। দারুণ খেলতো ও। স্কুলে পড়া অবস্থায়ই অনুর্ধ্ব-১৬ জেলা দলে সুযোগ পেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আর কখনো দেখা হয়নি ওর সাথে। ভেবেছিলাম অভাবের কারণে ওর পড়াশুনার পাঠটি হয়ত চুকে গেছে। কারণ, মাধ্যমিকের পর আর শিশু পরিবারে থাকার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশের বিষয়টি জানার পর রীতিমতো বিস্মিত হলাম। অতীত ফিরে আসতে থাকলো আমার উপলব্ধিতে। ওর প্রতি সহানুভূতি তীব্রভাবে জেগে উঠলো যখন জানতে পারলাম জায়গীর থেকে, টিউশন করে ও এই অবস্থায় এসেছে। তখনকার দিনে অন্যের বাড়ীতে থেকে পড়াশুনার প্রচলনকে জায়গীর বলা হতো। এবং এর প্রচলনও ছিল ব্যাপক। অবস্থাসম্পন্ন সব বাড়ীতেই প্রায় জায়গীর থাকতো। বাড়ীর অভিভাবকের সন্তান রেজাল্ট খারাপ করলে সমস্ত দোষ এসে কাঁধে পড়তো জায়গীরদের। দু’বেলা সন্তানদের পড়ানোর পাশাপাশি বাজারসহ পরিবাররের অনেক কাজই করতে হতো তাদের। শুধু দু’মুঠো ভাত আর আশ্রয়ের জন্যেই এমন অন্যায় আচরণ হজম না করেও কোনো উপায় থাকতো না জায়গীরদের।
কিন্তু মাস্টার্স পাশ করেও আজাদের কপালে চিন্তার রেখা দেখে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না নিজেকে। কোনোভাবেই মেলাতে পারছি না ওকে ওর পূর্বের চেহারার সাথে। চোখদুটো ঢুকে গেছে কোটরে, ফর্সা মুখখানিতে পড়েছে কালচে ছাপ, ঘন চুলগুলিও হয়েছে ঝরে পড়া শুষ্ক পাতার মতো। ধূসর হয়ে আসা একটি হলদে রঙের শার্ট গায়ে সাইকেলের জং ধরা হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোভাবেই অনুমান করা যাচ্ছে না, এই ছেলেটিই মাস্টার্স পাশ। বিস্তারিত কথোপকথনে জেনে নিলাম ওর মননে কাঁটা হয়ে বিঁধতে থাকা নেপথ্যর কারণগুলি। ‘ভাইজান, সারাজীবন মানুষের সন্তানকেই পড়িয়ে গেলাম। আর আজ, নিজে যে কারো কাছে চাকরির জন্য পড়বো সে সামর্থ্যও নেই।’ অসহ্য দুঃখ নিয়ে বলতে থাকা ওর কথাগুলি ভীষণ দাগ কাটলো আমার হৃদয়ে। সেই সময় বিনা বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু কিছু দরিদ্র্য শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছিলাম আমি। ওদের সিলেবাস এবং চাকরি প্রস্তুতির সিলেবাস প্রায় একই ছিল। তাই কোনো চিন্তা না করেই ওকে আসতে বললাম আমার কাছে। ওর মুখের প্রচ্ছন্ন হাসি দেখেই বুঝতে পারলাম ওর ইতিবাচক আগ্রহটি।
শহর থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে ছিল ওর বাড়ী। রংপুর থেকে ফিরে এসে সেখানেই থাকছে। ধরলা নদী পেরিয়ে যেতে হয়। সে সময় নদীতে কোনো সেতু ছিল না। এই নদীটিই ছিল শহরের সাথে উত্তরের উপজেলাগুলির দীর্ঘ দূরত্বের কারণ। অসংখ্য শিক্ষার্থী গ্রাম থেকে কাকডাকা ভোরে শহরের স্কুল কলেজে আসতো আর সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ী ফিরতো। তাছাড়া গ্রামগুলিতে অভাবও ছিলো তীব্র। বন্যার সময় তো পুরো এলাকাই নদী হয়ে যেত। আটাশি এবং আটানব্বই এর বন্যার কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে উঠি। আটাশিতে গ্রামেই ছিলাম আমরা। স্পষ্ট মনে আছে এখনো। আমাদের বাড়ীটি ছিলো অনেক উঁচু। আশপাশের এলাকা থেকে অনেকই এসে আশ্রয় নিয়েছিলো আমাদের উঠোনে। গবাদি পশু দিয়ে ভর্তি হয়েছিল পুরো উঠোনটি।
শহরে আসার পরেও গ্রামের বাড়ীর সাথে যোগাযোগ রাখতেন আমার বাবা। আমাদের বাড়ী ছিল ধরলা থেকে আরো দূরে, প্রায় ব্রহ্মপুত্রের কাছাকাছি। স্কুল ছুটি হলে আমরা নৌকায় চড়ে যেতাম গ্রামের বাড়ীতে। থাকতাম ছুটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত। চাচাতো আর মামাতো ভাইবোনদের সাথে মাছ ধরতাম, ব্রহ্মপুত্রে সাঁতার কাটতাম আর হেঁটে হেঁটে যেতাম ধরলা সংলগ্ন হাটবাজার আর মেলায়। ইউনিয়নের বড় মাঠে অনুষ্ঠিত মেলায় বায়োস্কোপ, পুতুল নাচ, লাঠি খেলা দেখতে দেখতে কীভাবে যে দিন কেটে যেত টেরই পেতাম না। পাশাপাশি ঘোড়দৌড় ও নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতার তীব্র উত্তেজনার কথা ভাবলে এখনো ছবির মতো অশ্বারোহীদের প্রতিলিপি চোখের আরশিতে ভেসে ওঠে। গ্রামের বাড়ী থেকে কুড়িগ্রামে ফেরার সময় খুব খারাপ লাগতো।আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, গরুর গাড়ী, অরণ্যে রূপ নেয়া কাশফুলের সমারোহ, ছোট ছোট শাখা নদী, ডিঙি নৌকো, নতুন সাইকেল বাঁধা রেডিও সমেত নববধূকে নিয়ে বরের হেঁটে চলা, পাকা ধানের গন্ধ, ধানক্ষেত থেকে ধ্বনিত হওয়া কৃষকের উদাত্ত কণ্ঠে ভাওয়াইয়া গান এখনো মনে পড়লে বুকের ভেতর পৃথক সুখানুভূতির সৃষ্টি হয়।
দীর্ঘ এই পথ সাইকেল চালিয়েই আসতো আজাদ। সাইকেল থেকে নেমে যখন বেঞ্চে বসতো তখন ওর গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতো। বুকের সাথে লেপ্টে যেত ওর শার্ট। সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করত। এমন অবস্থায় মনে হতো ও যেন নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করছে। প্রাণপন চেষ্টা করছে ওর এই দীর্ঘ পথ পেরুনোর পরিশ্রমের ক্লান্তিটিকে প্রাঞ্জল করতে। খুব মায়া হতো আমার। চেষ্টা করতাম সর্বোচ্চ মেধার প্রয়োগ ঘটিয়ে ওকে বোঝাবার। ও যে যে বিষয়গুলিতে দুর্বল ছিল সেগুলির ওপর কাজ করতাম। সবসময়ই প্রেষণামূলক গল্প শোনানোর মাধ্যমে ওর ভেতরে প্রতিভার আগুনটিকে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। যা পড়তে দিতাম তাইই পড়ে আসতো ও। ভাইজানের পরিবর্তে ও একসময় আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছিল। নিষেধ করলেও মানতো না। ভীষণভাবে শ্রদ্ধা করতো আমায়। এভাবেই কেটে গিয়েছিল প্রায় দুটি বছর। ওর প্রস্তুতিও একটি মানসম্পন্ন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল।
“ভাইজান, চাকরি তো হচ্ছে না। সবাই বলে টাকা ছাড়া নাকি চাকরি হয় না’ পর্যাপ্ত পড়াশুনার পরও একদিন হঠাৎ ওর এই কথায় চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি।
কে বলছে তোকে, চাকরি হবে না, অবশ্যই হবে। আর অন্যায় পথে চাকরি নিলে তো তোর পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। ধৈর্য ধর। মনে রাখবি, অন্যায় পথ অবলম্বন করে চাকরি নেয়ার থেকে কৃষক হয়ে বেঁচে থাকা অনেক গর্বের। একজন অসৎ কর্মকর্তার চেয়ে একজন সৎ কৃষকের মূল্য আমার কাছে অনেক বেশী। তোর কাছ থেকে আমি এটিই প্রত্যাশা করি।’ ওর এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য ওকে সময়ে সময়ে গঠনমুলক উপদেশ দিয়ে আসতে থাকি আমি। বড় অংকের ঘুষ প্রদান করে যারা চাকরি নিচ্ছে তারা যে জাতির এবং নিজেদেরই সর্বনাশ ডেকে আনছে সেটিও বোঝাতে থাকি। এবং এক সময় ওর মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হই। এর মাঝেই বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণও করছিল ও। কিন্তু ঢাকায় যাতায়াত ও ব্যাংক ড্রাফটের ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচের কারণে ও সব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে এমনকি কখনো দরখাস্ত করতেও পারতো না। বাস্তবতা বিবেচনায় অনেক ভাবনার পর ঢাকায় থেকে প্রস্তুতির কথা ভাবছিল। এক বড় ভাইয়ের সাথে কথাও বলেছিল। একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াবে আর ভাইয়ের বাসাতেই থাকবে। সবকিছু শোনার পর আমিও সায় দিয়েছিলাম।
এরই মাঝে ঢাকায় যাবার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে ও। যাবার দিন দেখা করবে বলে জানিয়েছে আমাকে। এ কারণে নিজে থেকে আর কোনো প্রকার যোগাযোগ করিনি আমি। তাছাড়া তখন তো আর আজকের মতো মুঠোফোন, ফেসবুক, মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটস অ্যাপ ছিল না। ইচ্ছে জাগলেও কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হতো না। এখনও মনে পড়ে। আমাদের এক বন্ধুর বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। টেলিফোনে কীভাবে কথা বলতে হয় তখনও আমরা জানতাম না। অনেক অনুরোধের পর একদিন ও ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু কার সাথে কথা বলবো আমরা? আমাদের তো কোনো ফোন নম্বর ছিল না। ও কোথায় জানি ফোন করে আমার কানে ধরিয়ে দিয়েছিল। আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বাকী দুই বন্ধু। আমি হ্যালো বলার পরই ওপার থেকে , পাটোয়ারী স্যার বলছি, বলুন, শুনতে পারছি। হেড স্যারের নাম শুনেই আমাদের তো হার্ট এ্যাটাক করার মতো অবস্থা। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। পাশ থেকে আমাদের বন্ধুটি অনবরত হাসতে হাসতে লাইনটি কেটে দিয়েছিল। পাটোয়ারী স্যারকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম আমরা। সৎ হিসেবে স্যারের সুনাম ছিল কুড়িগ্রামের প্রতিটি এলাকায়। শিক্ষক হিসেবে স্যার ছিলেন যেমন কঠোর তেমনি নরম। একদিন হলো কি, ক্লাসের মাঝেই আমাদের এক বন্ধু ভীষণ রকমের বেয়াদবি করে বসলো। ভেবেছিল স্যার হয়ত বুঝতে পারবে না। কিন্তু বিষয়টি বুঝতে পেরে অনবরত বেত দিয়ে বন্ধুটিকে মারছিল স্যার। মারার এক পর্যায়ে হঠাৎ করে নিজেই সেই ছাত্রকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। এবং অশ্রুসিক্ত অবস্থায় বললো, “ তোর পিঠে দেয়া আঘাতগুলি আমার বুকের ভেতরেই আঘাত হানছে রে, আমায় ক্ষমা করিস”। সেই মুহূর্তে আমরা কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পরেই স্যার স্বাভাবিক হয়েই আমাদের নানা বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেছিল।
তবে একটা বিষয়ে আমরা সবাই নিশ্চিত ছিলাম যে, স্যাররা আমাদের মারলেও আমাদের মনে হতো আমাদের বাবামাই শাসন করছেন। এমন এক ধরনের অধিকার শিক্ষকরা সেই সময় তৈরী করতে পেরেছিল বলে এখন আমি উপলব্ধি করতে পারি। শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। আনোয়ার স্যার নামে আমার এক গণিতের স্যার ছিলেন। স্যারের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান বেশী হলেও সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো। গণিতসহ ব্যক্তিগত সমস্যাগুলি স্যারকে বলতে পারলাম অবলীলায়। এবং সেটি যে মহার্ঘ্য হিসেবে কাজ করেছে আজ তা বুঝতে পারি মর্মে মর্মে। ইসলাম স্যার, আকবর স্যার, মানিক স্যার, তুষার স্যার, এনামুল স্যার, ওয়াজেদ স্যার এবং মোস্তফা স্যারসহ অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ এতটাই বুদ্ধিমত্তার সাথে ক্লাস নিতেন যা থেকে নিজেকে বিরত রাখা অসম্ভব হয়ে পড়তো। শেষ ঘণ্টার আগে ক্লান্তি যখন আমাদের সবাইকে আচ্ছন্ন করতো তখনও মোস্তফা স্যারের অসাধারণ উচ্চারণ এবং বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপন আমাদের বিমোহিত করতো। স্কুলের বেল পড়লেও আমাদের ভেতর কোনো তাড়াহুড়ো কাজ করতো না। স্যারের স্বাক্ষরটি ছিল আমার অনেক পছন্দের। ভালো লাগা থেকেই খাতার মধ্যে প্র্যাকটিস করেছিলাম স্বাক্ষরটি। কিন্তু, একদিন হোমওয়ার্ক জমা দেয়ার সময় স্যার সেটি দেখতে পেয়েছিল। এবং উপহার হিসেবে বেশ আয়োজন করেই আমাকে মেরেছিল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন। মজার বিষয় হলো, এখনও কেন জানি স্যারের স্বাক্ষরটি মাঝে মাঝেই খাতায় প্র্যাকটিস করি। সত্যি বলতে কি আমাদের স্কুলের প্রত্যেক স্যারই অনেক ট্যালেন্ট ছিলেন। হলো কি,কলেজে যোগদানের পর একটা পাঠচক্রে এনামুল স্যারকে আমন্ত্রণ করলাম। স্যার তো আসবেনই না। অনেক জোরাজুরির পর আসলেন। বিশ্বাস ছিল সাহিত্যের ওপর স্যার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করবেন। এবং সত্যি সত্যি স্যার এত অসাধারণ বক্তব্য দিলেন মনে হলো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার বক্তৃতা দিচ্ছেন। আজও ক্লাসে যখন ইংরেজিতে কথা বলি তখন যেন সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন এনামুল স্যার, আকবর স্যার এবং ওয়াজেদ স্যাররা। এতটা সময় পেরিয়েও স্যারদের দেখলে এখনো ভয় কাজ করে।যদি বিরক্তি বোধ না করো তবে আর একজন শিক্ষকের কথা বলতে চাই।
“সমস্যা নেই স্যার, বলতে থাকুন।’ সবাই সমস্বরে বলে উঠলো।
আচ্ছা তবে শোনো। প্রাণবন্ত ও রসালো উপস্থাপনা, জ্ঞানের গভীরতা এবং হার্দিক আন্তরিকতা যে একটি ক্লাসকে কীভাবে বাঙময় করে তুলতে পারে তার আদর্শ উদাহরণ আমাদের বখতিয়ার স্যার। ধবধরে সাদা পাজামা এবং পাঞ্জাবী পড়ে একটি জীর্ণ সাইকেলে চড়ে স্কুলে আসতো স্যার। ক্লাসের মধ্যেই স্যার এমনভাবে শব্দের মালা গাঁথতেন, গল্প ও তথ্যের সন্নিবেশ ঘটাতেন মনে হতো সত্যিকারের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা তাঁর শব্দ ও ভাবনার মায়াজালে বন্দী করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন সীমানা পেরিয়ে দূর থেকে অতি দূরের কোনো দ্বীপ রাষ্ট্রে। এমন অমূল্য সরলপ্রাণ শিক্ষকের ছাত্র হতে পারা সত্যিই সৌভাগ্যের।
যাহোক, একদিন হঠাৎ নোটিশ ছাড়াই বিকেলে আমার বাসায় এসে হাজির আজাদ। অকস্মাৎ ওকে দেখে আশ্চর্য হলাম আমি। তখন ছাত্র পড়াচ্ছিলাম। ‘কিরে, তোর না ঢাকায় যাবার আগে দেখা করার কথা?’ বলতেই হুড়মুড় করে আমার কাছে আসলো ও। খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল ওকে। স্বভাবের ব্যত্যয় ঘটিয়ে উঁচু কণ্ঠে বললো, ‘ভাইজান আমার চাকরি হয়েছে, আমি চাকরি পেয়েছি।’ বলেই নিয়োগপত্রটি আমার হাতে দিল। বলিস কী, দেখি দেখি-আমি ওর নিয়োগপত্রটি উৎসাহ নিয়ে দেখতে থাকলাম। আর গভীরভাবে তাকালাম ওর দিকে। বিশ্বাস করবে না, কথাগুলি বলার সময় ওর মুখের অভিব্যক্তি এতটা আবেগঘন ছিল যে, মনে হচ্ছিল বিশ্বপ্রকৃতি যেন ওর নিজের বুকে ধারণ করে আছে। সেদিনটিতে সৃষ্টি হওয়া পৃথিবীর সকল সুখ যেন ওর মুখাবয়বে এসে আছড়ে পড়েছে,তারার মতো জলজল করে জলছিল ওর চোখের মনি দুটি। তাড়াহুড়ো করে পড়া শেষ করে আমি সব শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম মহিলা কলেজ পেরিয়ে অবস্থিত প্রসিদ্ধ রেস্তোরা হিসেবে পরিচিত‘নিরালা’তে। রৌমারী, ভূরুঙ্গামারী কিংবা রাজিবপুর থেকে কেউ আসলে অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যেত এই রেস্তোরা থেকে। সেদিন খুশিতে পেট ভরে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম আমরা। মজার ব্যাপার হলো, পুরাতন শহর কুড়িগ্রামে আরো একটি ব্যতিক্রমী হোটেল ছিল। বোধ করি এমন হোটেল দেশের আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। পাকিস্তান শাসনামলে বিক্রমপুরের এক অধিবাসী এসে হোটেলটি স্থাপন করেছিলেন। হোটেলটির নাম আশরাফিয়া মুন্সি হোটেল। এখানে এক বেলা খাবার খেলে রাতে বিনামূল্যে থাকা যেত। হোটেলের কাছেই ছিল স্টেশন, ডাকঘর, কলেজ, কাত্যায়নী প্রেস, চিত্রা সিনেমা হলসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রতিষ্ঠান। ট্রেন দেরীতে আসলে দূরের লোকেরা এখানেই থাকতো।
অতঃপর, দু’একদিন বাদেই যোগদান করতে ঢাকায় গিয়েছিল আজাদ। এরপর আর ওর সাথে কোন যোগাযোগ হয় নি। কোন চিঠিও আসে নি। কিছুটা উদ্বেগ কাজ করলেও সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে সান্ত্বনা খুঁজছিলাম। তাছাড়া সেই সময়ের সম্পর্কগুলো ছিলো এমনই। ধরো, এক বছর কারো সাথে দেখা নেই কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা হলেই এক বছরে জমে থাকা সমস্ত গল্পগুলি এক বিকেলেই শেষ হয়ে যেত। অথবা দূরের কোনো শহরে কোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে হয়ত সারারাত মেসের মধ্যে গল্পে গল্পে কেটে যেত।
এরই মাঝে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। বিয়ের কারণে যদি জীবনের ব্যাকরণ বদলে যায় এই ভেবে বেশ দেরী করেছিলাম আমি। প্রাথমিক কর্ম সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি। পরিবারসহ আমায় সহযোগীতা করেছিল আমার বন্ধুরাও। সেদিন ছিল আমার গায়ে হলুদ। এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত কোনো প্রস্তুতি ছিল না আমার। কিন্তু আমার ছোট বোন এবং শিক্ষার্থীরা কীভাবে যে এত মনোজ্ঞ আয়োজন করেছিল ভাবতেই পারি নি। গাঁদা ফুলের পাঁপড়ি দিয়ে লেখা‘গায়ে হলুদ’ শব্দটি আজও মননে দোলা দেয়। একজন শিক্ষকের প্রতি যে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা এতটা গভীর হতে পারে সেদিনই প্রথম আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমার বন্ধুরাও অবাক হয়েছিল স্যারের প্রতি শিক্ষার্থীদের এমন শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা দেখে। হলুদের আয়োজন শেষে মাথা নিঁচু করে ঘরের মধ্যে কি যেন খুঁজছিলাম আমি। মাথা উঁচু করতেই দরজায় নতুন শার্ট, প্যান্ট আর জুতো পরা আজাদকে দেখতে পেলাম। আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও। মুখে নির্বাক উচ্ছল হাসি। কাঁধে একটি কালো রঙের অফিস ব্যাগ। ওকে দেখে হৃদয় সিক্ত হয়ে এলো আমার, শিশিরের সাথে পায়ের স্পর্শে যেমন হয় ঠিক তেমনই। ইশারায় ভেতরে আসতে বলামাত্রই জুতো খুলতে শুরু করলো ও। জুতো জোড়া বাইরে রেখেই আমার পাশে এসে বসলো।
‘স্যার’ বলতেই ওকে একটা ধমক দিলাম আমি। ধমকটি দ্রুত গলধঃকরণ করেই এবার দীর্ঘস্বরে ভাই বলে ডাকলো ও।
‘বল এবার, তোর খবর কি?’ আমি ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম।
‘ভাইজান, আমার প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল প্রথম মাসের বেতন তুলেই আপনার সাথে দেখা করবো, কিন্তু আমার দুভার্গ্য, সেটি পারি নি। আপনি মনে হয় আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। বিশ্বাস করুন, আমার কোনো উপায়ই ছিলো না।’ও মাথা কিছুটা নিচু করে সংকোচের সাথে বলে গেল।
‘ধুর ধুর বোকা, এটা কোনো কথা হলো। কুলিয়ে উঠতে পারিস নি তাই আসিস নি। হয়ে গেল, এত লম্বা কৈফিয়ত দেয়ার কি আছে।’ বলামাত্রই ও একটি সাদা খাম আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘ ভাইজান, আমার প্রথম মাসের বেতন, আপনাকে নিতেই হবে।’
ওর এমন আহ্বানে একেবারেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে সম্মত হলাম না। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক যে অর্থের নয় সেটিওকে বোঝাতে থাকলাম অনবরত। কিন্তু কোনোভাবেই দমলো না ও। অনুরোধের মাত্রাটি সর্বোচ্চ সীমায় এসে পৌঁছলো। আমার সিদ্ধান্তে আমি অনড় থাকায় লক্ষ করলাম ওর দু’চোখের কোণে শিশির বিন্দুর মতো পানির ফোঁটা আবির্ভূত হচ্ছে। এখনই হয়তা ঝরতে শুরু করবে। এমন একটি বিষাদঘন প্রেক্ষিতে গোটা আবহটিই ভারী হয়ে উঠলো। আমার নীরবতায় এবার চোখের পানি ঝরতে শুরু করলো ওর। কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো।কান্নার শব্দ শুনে এবার ঘরে প্রবেশ করলেন আমার মা। আসলো সোমা, কণা, দিতিসহ সবাই। আমার কাছে বিস্তারিত জানার পর আজাদের পক্ষ নিলো মাসহ সোমারা। মায়ের পীড়াপীড়ি আর শিক্ষার্থীদের অনুরোধে বুকের ভেতরটা বরফের মতো হিম হয়ে এলো আমার। অনেক কষ্টে আবেগকে সম্বরণ করলাম আমি। তাকালাম আজাদের মুখের দিকে। অশ্রুবিজড়িত ওর চোখদুটিতে রাখলাম আমার চোখ। ওর একদম কাছে এসে ওর পীঠে আমার ডান হাতটি রেখে বললাম, ‘ আরে পাগল, এই যে তোর চোখের জল এটিই তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার, এর থেকে বড় প্রাপ্তি একজন শিক্ষকের জীবনে আর কি হতে পারে, বল?’
এরপর আর একটি কথাও বলতে পারলেন না সারোয়ার স্যার। বলা সম্ভব হলো না তার পক্ষে। পুরো নিস্তব্ধ হয়ে গেছে আনন্দপাঠ পাঠাগারের পরিবেশ। ঘনঘোর রাত্রির নীরবতা যেন আকড়ে ধরেছে সবাইকে। কেউ কেউ চোখের জল মুছছে। কেউ কেউ বোবার মতো নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।
‘স্যার, স্যার, খামটা কি নিয়েছিলেন?’ কে যেন বলে উঠায় আবারও স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন সারোয়ার স্যার। দৃঢ় চিত্তে বললেন, হ্যাঁ, নিয়েছিলাম। পুরো অর্থ দিয়েই একটি আলমারি ও কিছু গ্রন্থ কিনেছিলাম। পরবর্তীতে আমার অত্যন্ত তিন প্রিয় শিক্ষার্থী সোমা, কণাও দিতি চাকরি পেয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ উপহার দিয়েছিল। এবং সাহস করে শুরু করেছিলাম আমি আনন্দপাঠ পাঠাগারের যাত্রা। একটি কথা সবসময় মনে রাখবে, একজন প্রকৃত শিক্ষার্থী আজীবন একজন শিক্ষকের কাছে শ্রদ্ধায় অবনত থাকে। আর একজন প্রকৃত শিক্ষক তার কর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যাতে আজীবন মাথা নিচু করতে পারে সে চেষ্টাই করে। দায়িত্ব ফাঁকি দিয়ে অর্থ উপার্জনের মোহে নিমগ্ন হয়ে থাকেন না। বস্তুত, এভাবেই একটি জাতি অবচেতনাতেই শিক্ষকদের শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে। ফলতঃ সেই জাতিটি সুস্থ জাতি হিসেবে বিকশিত হতে পারে। মনোযোগ দিয়ে আমার গল্প শোনার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং প্রত্যাশা করছি- অর্থ নয় বরং জ্ঞানভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মাঝে; মহৎ কাজের মধ্যে লীন হয়ে প্রতিটি প্রাণ খুঁজে পাক তার অমূল্য অনুভূতিটি।
গল্পকারঃ শিক্ষক, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ।