‘হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে উঠি
জীবন ফুরালো নাকি!
এমনি করে সব্বাই যাবে, যেতে হবে…’
বরিশালে জন্ম হলেও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহার হেসে খেলে শৈশব কেটেছে মংলায় মিঠেখালি গ্রামে। সুন্দরবনের কাছাকাছি থাকলেও সবাই বাঘ হয় না, কিন্তু রুদ্র বাঘের চেয়ে শক্তিমান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সক্রিয়ভাবে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ডাকসুর নির্বাচন করে হেরেছিলেন বন্ধুর কাছে। চূড়ান্ত বাউন্ডুলে এই কবির বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ছিল তার নিজেরও অজানা। তিনি ছিলেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের একজন অংশীদার। আর এই আন্দোলনের খাতিরেই গড়ে ওঠে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তথাকথিত কবি এরশাদ ও তার ভাড়াটে কবিরা নিজেদের বাহাদুরি দেখাতে ঢাকায় যখন আয়োজন
করে এশীয় কবিতা উৎসব, বিপরীতে রুদ্র দাঁড়িয়ে গেলেন ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ নিয়ে।
৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত দেশে এমন কোনো আন্দোলন নেই যাতে রুদ্রুর অংশগ্রহণ ছিলো না। কবিতা, গল্প, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ, গান— যেখানেই শিল্প সাহিত্য সেখানেই রুদ্র। কবিতা আর বিদ্রোহ ছিলো রক্তে। ৭৯ সালে বের হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূলে’। প্রথম বইতেই ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ লিখে সব মনোযোগ পাঠক আর কবিশত্রু কেড়ে নেন। বলেন— ‘আমি কবি নই- শব্দশ্রমিক/শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়।’ দ্বিতীয় বই ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। তারপর একে একে ‘মানুষের মানচিত্র’ (৮৪), ‘ছোবল’ (৮৬), ‘গল্প’ (৮৭), ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’ (৮৮), ‘মৌলিক মুখোশ’ (৯০)। ৭টি কবিতার বই। আর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় নাট্যকাব্য ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’। জীবন নিয়ে রুদ্র যতো হেলাফেলাই করেছেন, কবিতা নিয়ে কখনো করেননি। কবিতায় তিনি সুস্থ ছিলেন, নিষ্ঠ ছিলেন, স্বপ্নময় ছিলেন।
‘ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’র মতো অসম্ভব সুন্দর আর জনপ্রিয় গান লিখেছেন। গানের দল গড়েছেন ‘অন্তর বাজাও’ নামে। শেষ জীবনে ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলেন।কিন্তু মৃত্যু পথ আটকে দিলো। ভীষণ এক খামখেয়ালীর জীবন ছিলো তার। পারিবারিক স্বচ্ছলতা ছিলো, সেপথে যাননি। চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিজেকে বাঁধেননি। কয়েকটা রিক্সা ছিলো— তা থেকে যা আয় হতো তাতেই চলতেন। ঠিকাদারী করেছেন, চিংড়ির খামার করেছেন। পাঞ্জাবী আর জিন্স প্যান্টের যুগলবন্দী তখন বোধহয় তিনি একাই ছিলেন। ঋত্বিকের মতোই ছিলো তার মদ্যপ্রীতি। প্রতিসন্ধ্যায় হাটখোলার নন্দের দোকানে হাজিরা দিতেই হতো। জল বিনা তার যে চলে না। হুইস্কির বাংলাকরণ করেছিলেন ‘সোনালী শিশির’। এই নামে একটা গল্পও লিখেছিলেন।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তসলিমা নাসরিনকে। তখনো তসলিমা নাসরিন নামে খ্যাতি পাননি তিনি। সে বিয়ে টেকেনি। ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যেতে লাগলেন কবি। ক্ষয়ে যেতে লাগলেন। অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা ফলে আলসারে পেয়ে বসেছিল তাকে। পায়ের আঙ্গুলে রোগ বাসা বেঁধেছিল। ডাক্তার বলেছিলো পা বাঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। তিনি পা ছেড়ে সিগারেট নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর তাই স্থান হলো হলি ফ্যামিলির ২৩১ নম্বর কেবিনে। ৯১ সালের ২০ জুন সুস্থ্য হয়ে পশ্চিম রাজাবাজারের বাড়িতে ফিরেও গেলেন। কিন্তু ২১ জুন ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ।
মাটি ও মানুষের প্রতি আমূল দায়বদ্ধ এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাকে দিয়েছে সত্তরের অন্যতম কবি-স্বীকৃতি। অকালপ্রয়াত এই কবি তাঁর কাব্যযাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’— এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি ততধিক স্পর্ধায় তিনি উচ্চারণ করেছেন— ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীকে’। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা। মাত্র ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং ‘ভালো আছি ভালো থেকো’সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।
‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়— বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা আদ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না থাকা জুড়ে ।’
বাবলু ভট্টাচার্য