গল্পকার : কবির কাঞ্চন
মোমেনা বেগম বালিশে মাথাটা রেখে আনমনে ভাবছেন,
প্রতিবছরের
মতো এবারও শীতকালীন অবকাশ যাপনের ছুটি পেয়ে নানার বাড়িতে মজা করে বেড়াতে
আসছে। এমন মুহূর্তে ওসব কথা তুললে তো ওদের ভাইবোনের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি
হতে পারে। তাতে কী হতে কী হয়ে যায়! বলা যায় না।
কিন্তু বিষয়টা এ মুহূর্তে ওকে না বলেও পারছি না। উফ! খোদা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার আগে আমায় মরণ দিয়ে দাও।
এইসব ভাবতে ভাবতে তার চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়।
এরিমধ্যে সম্পদ দৌড়ে এসে দাদীর হাতদুটো টেনে টেনে বলতে লাগলো,
- দাদী, ওঠো, আমার ফুফু এসেছে। সাথে সাবিহাও। খুব মজা হবে। সারাদিন আমরা একসাথে খেলতে পারবো।
শাড়ীর আঁচল দিয়ে দাদীকে চোখের জল মুছতে দেখে সম্পদ বলল,
- তুমি কাঁদছো কেন, দাদী? তোমাকে কী কেউ কিছু বলেছে?
মোমেনা বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে কৃত্রিম হেসে বললেন,
- না, দাদুভাই। আমাকে কেউ কিছু বলেনি। তোমার ফুফুরা বেড়াতে এসেছে বলে চোখের কোণে আনন্দে জল জমেছে।
চোখ কপালে তুলে সম্পদ বলল,
- আচ্ছা দাদী, তাহলে আনন্দেও মানুষের চোখে জল বের হয়!
- হ্যাঁ, দাদুভাই, বের হয়। আর এটাকে বলে আনন্দ অশ্রু।
মায়ের মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে নয়ন বেগম বলে ওঠলেন,
- কীসের আনন্দ অশ্রু, মা?
- না, এমনিতেই। সম্পদের সাথে মজা করছিলাম। সাবিহা আর জামাই কই?
- সাবিহা ওর বাবার সাথে আসছে। বাড়ির প্রধান ফটকে রিক্সার ভাড়া দিয়ে আসতে একটু দেরি হচ্ছে।
এই কথা বলে নয়ন বেগম সম্পদকে বুকের মাঝে নিয়ে মায়ের পাশে এসে বসলেন।
এরিমধ্যে সাবিহা ও তার বাবা ওবায়দুল শেখ ঘরে এসে পৌঁছেছে।
মেয়ের
জামাইকে কাছে পেয়ে মোমেনা বেগম যেনো জগতের সবকিছু ভুলে গেছেন। নিজের
মেয়েকে রেখে বড় বড় পায়ে সামনের ঘরে এসে জামাইয়ের ভালোমন্দ খোঁজ নিলেন।
বিয়াই-বিয়াইনের খোঁজ নিলেন। ততক্ষণে নয়ন বেগম মায়ের পাশে এসে মন খারাপ করে
মায়ের মুখের দিকে উদাসী চোখে তাকিয়ে আছেন। ওবায়দুল শেখ স্ত্রীর মনের অবস্থা
বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসেন।
মেয়ের জামাইয়ের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে মোমেনা বেগম পিছন ফিরে তাকালেন। নয়ন বেগমকে বেজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,
- কিরে মা, এভাবে কোন কথা না বলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয়।
নয়ন বেগম অভিমানের স্বরে বলল,
- দাঁড়িয়ে থাকবো না তো কি করবো। মেয়ের জামাইকে পেলে তোমার আর কারোর কথা মনে থাকে না। এটা কিন্তু ঠিক না।
মোমেনা বেগম হাসতে হাসতে বললেন,
ওহ্! এই কথা। এখনও তোমার পাগলামো ভাব গেলো না। জামাই অনেক পথ হয়ে এসেছে। তোমার ভাবীকে সাথে নিয়ে আগে জামাইকে খেতে দাও।
- মা, তুমি আবারও----
- আচ্ছা বাবা, আমিই যাচ্ছি। তোরা বসে কথা বল।
এই কথা বলে মোমেনা বেগম ভিতরের দিকে চলে গেলেন।
সাবিহাকে
পেয়ে সম্পদের সেকি আনন্দ! দুজনে একসাথে খেলছে। নয়ন বেগমও মা, ভাই, ভাবিকে
কাছে পেয়ে বেশ খুশি। এভাবে তিনদিন কেটে গেলো। নয়ন বেগমের স্বামীর বাড়ি
যাবার সময় ঘনিয়ে আসে।
মোমেনা বেগম অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন সম্পদের বাবার বিষয়টি মেয়েকে জানাবেন।
পরদিন একান্তে মেয়েকে সবকিছু খুলে বললেন। নয়ন বেগম মায়ের সব কথা শুনে বলল,
- কী বলছো মা! ভাইজান কীভাবে এমন কথা বলতে পারেন?
তোমাদের সম্পদের ভাগ তো উনি আর আমিই পাবো।
ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে উনিই বেশি পাবেন। তাই বলে আমাকে মোটেও দিবেন না। এ কী করে হয়? এ বিষয়ে আজই আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলবো।
- না, ওকে কিছু বলিস না। শেষে ঝামেলা হয়ে যাবে।
- বলবো না কেন? ভাইয়া যেমন তোমার সন্তান। আমিও তো তোমার সন্তান। উনি পেলে আমি কেন পাবো না?
তাছাড়া আমি মেনে নিলেও আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা কি তা মেনে নেবে?
সবচেয়ে বড় কথা- তুমি থাকতে এই ভাগের কথা আসলো কেন?
এরিমধ্যে
সম্পদের বাবাকে ঘরের দিকে আসতে দেখে মোমেনা বেগম মেয়েকে চোখের ইশারা করে
থামিয়ে দিলেন। সম্পদের বাবা তার মা আর বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
- মা, মেয়ের মধ্যে কী কথা চলছে?
নয়ন বেগম তার ভাইকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে পাশের খাটে বসতে বসতে বলল,
- আজই তো চলে যাবো, ভাইয়া। বিভিন্ন বিষয়ে কথা হচ্ছিল।
- কেন? আরো কিছু বেড়িয়ে যা। আমার বাসায় এক সপ্তাহও তো থাকলি না।
- না ভাইয়া, কাল থাকে সাবিহা'র স্কুল খুলছে। তাই চলে যেতে হচ্ছে। ভাইয়া, তোমার সাথে আমার জরুরি একটা বিষয়ে কথা বলার ছিল।
নয়ন বেগমের মতিগতি বুঝতে পেরে তার মা খাট থেকে নেমে ব্যস্ত গলায় বললেন,
- তাহলে তোরা বসে কথা বল। আমি দেখি সম্পদ, সাবিহা কোথায় আছে?
এই কথা বলে তিনি বাইরের দিকে চলে গেলেন।
ওবায়দুল শেখ বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
- আমার সাথে আবার জরুরি বিষয় কী?
- ভাইয়া, আম্মার কাছ থেকে জেনেছি, আমাদের সব সম্পত্তি নাকি আপনি আপনার নামে লিখে নিতে চাইছেন।
- হ্যাঁ, আম্মা তো ঠিকই বলেছেন। এ কথা তো আমিই আম্মাকে বলেছি।
- কিন্তু আপনি যেমন বাবা-মা'র সন্তান তেমনি আমিও। ছেলে বলে আপনি বেশি পাবেন। আমি কম হলেও তো কিছু পাবো।
- না, আমিই সব পাবো। তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে। বাপের বাড়ির কোনকিছুই তুই আর
পাবি না। এখন শ্বশুরবাড়ি ঘিরেই তো তোর সবকিছু। তোকে বিয়ে দিতেও তো অনেক খরচ
হয়েছে।
- ভাইয়া একি কথা বলছেন! ইসলামি শরীয়তের দিক থেকে বাবা-মা'র
সম্পত্তিতে ছেলের পাশাপাশি মেয়েরও হক রয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনেও তা
আছে।
- তুই আমাকে অতো আইন দেখাতে আসিস না। তোর বিয়ের পর থেকে মায়ের
সবকিছু তো আমাকেই দেখতে হচ্ছে। দু'দিন যেতে না যেতেই মা অসুস্থ হয়ে পড়েন।
সেটাও তো আমাকে সামলাতে হয়।
- ভাইয়া, এটাই তো নিয়ম। বাবা-মা দেখে দেখে
আমাদের ছোট থেকে বড় করেছেন। এখন শেষ বয়সে আমাদেরও তো তাদের দেখা দায়িত্ব।
আর শেষ বয়সে বাবা-মা তো ছেলের সাথে থাকেন। দেখুন ভাই, আমাদের তো সম্পত্তি
কম নেই। আমি কিছু না বললেও আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তো চুপ থাকবে না।
- ওসব আমি বুঝতে চাইনা। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই আমি মাকে নিয়ে সব সম্পত্তি আমার নামে লিখে নেবো।
-
ভাইয়া, এমন অন্যায় করবেন না। এ সম্পত্তি কার জন্য গড়বেন? নিশ্চয় আমার
একমাত্র ভাইপো'র জন্য। একজন মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য তেমন
সম্পত্তির প্রয়োজন পড়ে না। তাছাড়া আমাদের সম্পদ-সাবিহা বড় হতে হতে আমাদের
অবস্থানেরও পরিবর্তন হবে নিশ্চয়ই।
- নয়ন, আমাকে তুই জ্ঞান দিতে আসিস না। এই পৃথিবীতে আমি তোর আগে এসেছি। তোর চেয়ে বেশি জানি।
-
ভাইয়া তোমাকে শেষবারের মতো বলছি, আমাদের এই মধুর সম্পর্কে কোন দেয়াল তুলিও
না। মনে রেখো, সম্পত্তির চেয়ে সম্পর্ক অনেক বেশি মূল্যবান।
নয়ন বেগমের এমন কথায় রেগে গিয়ে ওবায়দুল শেখ বললেন,
- তোর তো দেখছি স্পর্ধা কম নয়। আমাকে উপদেশ দিতে আসিস। আমি যা বলেছি তাই হবে।
- তাহলে এই কী তোমার শেষ কথা?
- হ্যাঁ, আগামী সপ্তাহেই আমি সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে লিখে নিচ্ছি।
ভাইয়ের এমন কথায় নয়ন বেগম মন খারাপ করে স্বামীর বাড়ির দিকে চলে যায়।
ওদিকে মা ও স্ত্রীর অনেক অনুরোধেও ওবায়দুল শেখের মন গলেনি।
এভাবে আরো কয়েকদিন কেটে গেলো।
মঙ্গলবার। মাকে নিয়ে শহরের ভূমি অফিসের দিকে বের হতে চাইলে সম্পদও তাদের
সাথে যাবার জন্য বায়না ধরে। অনেক বুঝিয়েও যখন কোন কাজ হয়নি। তখন বাধ্য হয়ে
তাকেও সঙ্গে নিয়ে ভূমি অফিসের দিকে চলে আসেন ওবায়দুল শেখ।
আগে থেকে লোকজন ঠিকঠাক করে রাখায় বেশ ভালোভাবেই সব কাজ সম্পন্ন হয়।
সেই
সকাল থেকে সম্পদটা কিছুই খায়নি। মাও না খেয়ে আছেন। এই ভেবে ওবায়দুল শেখ
ভূমি অফিসে মাকে বসিয়ে রেখে সম্পদকে সাথে নিয়ে ভূমি অফিসের বাইরে চলে আসেন।
ভূমি
অফিসের সামনেই রয়েছে পিচঢালা প্রধান সড়ক। সরকারি ভূমি অফিসের সামনের সড়ক
হওয়ায় লোকজনের সরব উপস্থিতি হয় এখানে। স্থানীয় সড়কগুলোর মধ্যে এটি তাই খুব
ব্যস্ত সড়ক। ওবায়দুল শেখ সম্পদকে এক হাতে শক্ত করে ধরে সাবধানে রাস্তা পার
হলেন। সড়কের পাশেই একটি ঝুপড়ি দোকান থেকে তিনি কলা ও কেক কিনছেন।
সেই
প্রথম থেকে সম্পদ রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একজন ফেরিওয়ালাকে লক্ষ্য করছিল।
হঠাৎ ফেরিওয়ালার হাত থেকে একটি বায়ুপূর্ণ মটু-পাতলু বেলুন উড়ে যেতে দেখে
"মটু-পাতলু!মটু-পাতলু! বলতে বলতে রাস্তার ওপর দিয়ে সোজাসুজি দৌড় দেয়। পিছন
থেকে ওবায়দুল শেখ ছেলেকে ডাকতে ডাকতে বিপরীত দিক থেকে ক্ষীপ্র বেগে ছুটে
আসা একটি মাইক্রোবাস সম্পদকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। সড়কের অপর পাশে
পড়ে থাকে সম্পদের রক্তাক্ত দেহ। প্রচন্ড আঘাতে সে কাঁতরাতে কাঁতরাতে হুশ
হারিয়ে ফেলে। মুহূর্তে ভূমি অফিসসহ আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে
আসে। ওবায়দুল শেখ মাকে সাথে নিয়ে ছেলেকে নিয়ে নিকটবর্তী হাসপাতালের দিকে
চলে আসেন। কর্তব্যরত ডাক্তার সম্পদের দেহ পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মুহূর্তে ওবায়দুল শেখ ও তার মায়ের কান্নায় পুরো হাসপাতাল এলাকায় শোকের
ছায়া নেমে আসে।
এরপর ওবায়দুল শেখ ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।
একমাত্র
ভাইপো'র মৃত্যুর খবর পেয়ে নয়ন বেগম পাগলের মতো বাপের বাড়ির দিকে ছুটে
আসেন। ওবায়দুল শেখের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনসহ পাড়া প্রতিবেশীরা ভীড় করছে। সবার
মনে বিষাদের ছায়া। এতো অল্প বয়সে সম্পদের মৃত্যু হয়েছে। তাও আবার
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ছেলের লাশ দেখেই সম্পদের মা বেহুঁশ হয়েছেন।
মোমেনা বেগম দ্বিতীয়বার হুঁশ হারিয়েছেন।
ওবায়দুল শেখ শোকার্ত চোখে ছেলের
নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কারো সাথে কোন কথা বলছেন না। নয়ন
বেগমও ভাইয়ের পাশে বসে বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন।
নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদের দাফন সম্পন্ন হলো। একান্ত আপনজন ছাড়া পাড়াপ্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনরাও নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেলো।
আজ
সন্ধ্যার আঁধার নামার আগেই ওবায়দুল শেখের ঘরে সুনসান নীরবতা। শোকে কাতর
হয়ে কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। নয়ন বেগম তার ভাইকে সান্ত্বনা দিতে এলে
ওবায়দুল শেখ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,
- বোন, সেদিন তুই যে কথা বলেছিলি আমি তা বুঝতে পারিনি। সেদিন সম্পত্তির লোভে আমি অন্ধ ছিলাম। আজ
আমার সম্পদ চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। যার জন্য আমার এতোকিছু করা, সে-ই যখন নেই, তখন এই সম্পত্তি দিয়ে আর কী হবে!