সাক্ষাৎকার : হাসান আজিজুল হক আমাদের কথা সাহিত্যে কিংবদন্তিতুল্য ধীমান পুরুষ
ছবি : হাসান আজিজুল হক
এখন নির্দয় শীতকাল।
ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে বড় একটা কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়।
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ এর ঠিক অবিকল এই দৃশ্য ফুটে আছে জানালায়, গ্রীলের বাইরে। আকাশ থেকে অন্তর্হিত চাঁদ। জানুয়ারীর শীত
সকালের হিমেল হাওয়ায় কাঁপছে মানুষ ও প্রকৃতি।
বাড়ির নাম ‘উজান’। খাবার টেবল লাগোয়া জানালা, তারপর দেয়াল আর সেই দেয়ালের
বাইরে আদিগন্ত বিস্তৃত যেন শিল্পী কিবরিয়ার ছবির জ্যামিতিক উদ্যানের
বিচিত্র পটভুমি। বাতাসে কলাগাছের পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। এই
দৃশ্যে চমকে ওঠে চোখ।
দেয়ালে তাঁর মায়ের ছবির সামনে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াই। চতুষ্কোন
ফ্রেমের ভিতর থেকে তিনি অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন পৃথিবীর দিকে। মনে
পড়ে, আজ থেকে ৩৪ বছর আগে তাঁকে দেখার জন্যে আমরা, আবুল হাসনাত ( তিনি তখন
সংবাদ-এর সাহিত্য সম্পাদক) ও আমি ফুলতলা গিয়েছিলাম হাসান ভাইয়ের সঙ্গে।
স্মৃতি ও ছবিতে মানুষটি যেন জীবন্ত হয়ে আছেন আজো।
রাজশাহী এসেছি দিন দু’য়েকের জন্যে। উদ্দেশ্য, বাংলা সাহিত্যের অসাধারন
পুরুষ হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে দ্যাখা করা। এর আগে কখনো আসিনি, সব কিছু
অপরিচিত। বেশ সাজানো গোছানো শহর। ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা (দর্শন বিভাগ) করেছেন তিনি। রাজধানীর
দূষিত পরিবেশের বাইরে, অনেকটা কোলাহলমুক্ত এই বিভাগীয় শহরকেই বেছে নিয়েছেন
অবসর জীবনের বাসস্থান হিসেবে। স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের নিয়ে থাকেন-- আর আছে
এক নাতি, অনিন্দ্য-- দেড় বছরের, মুখে কথা ফোটেনি, সারাবাড়ি ঘুরঘুর করে
বেড়ায়। মা মালা আর দাদীর (মন্জু ভাবী) চে’ ওর আকর্ষন দাদুর দিকে। কিছুক্ষন
পরপরই দাদুর কাছে যাবার বায়না। আমরা বসেছিলাম ষ্টাডি রুমে। বারবার নক করছিল
অনিন্দ্য।
বলা নিস্প্রয়োজন, হাসান আজিজুল হক আমাদের কথা সাহিত্যে কিংবদন্তিতুল্য
ধীমান পুরুষ। তাঁর হাতে আমাদের গদ্য সাহিত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। গদ্যের
জন্যে যাঁরা ভাষা নির্মাণ করেছেন তিনি তাঁদের পুরোধা। শকুন, আত্মজা ও একটি
করবী গাছ, মারী, আমৃত্যু আজীবন, তৃষ্ণা, উত্তর বসন্তে, পরবাসী, শোণিত সেতু,
জীবন ঘষে আগুন, জননী, ঘর ঘেরস্থি, খনন-এর মতো অসংখ্য গল্পে এই সত্য
উদ্ভাসিত।
প্রাবন্ধিক, গবেষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, হাসান আজিজুল হক
যে-কোনো মানদন্ডে একজন বড় গল্পকার। ...তাঁর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। সে-দৃষ্টি
শাণিত হয়েছিল তাঁর বামপন্থী বোধের দ্বারা। জীবন কেমন তা দেখছিলেন তিনি;
কেমন হওয়া উচিত ছিল, তা উপলব্ধি করছিলেন। এর থেকে তৈরি হচ্ছিল স্বপ্ন,
জন্মেছিল ক্রোধ, জাগছিল পরিহাস-প্রবনতা।...নিজের পরিবেশ ও পরিমন্ডল, ইতিহাস
ও ঐতিহ্যে তাঁর প্রচন্ড আস্থা। ...কিন্তু তিনি সংকীর্ণ স্বাদেশিক নন, ওই
বামপন্থাই তাঁকে আন্তর্জাতিক করেছে। তারপরও জানেন, চোখ রাখবেন দূরে, পা
দুটো শক্ত হয়ে চেপে রাখবে নিজের মাটি।...বড় লেখক সব সময়ে বড় মানুষ হন না,
কখনো কখনো হন। এ দৃষ্টান্ত আমরা তাঁর মধ্যে পাই।
তাঁর অনেক লেখায় আমরা দেখি মার্কসবাদী দার্শনীক প্রত্যয়। তা স্বত্তেও
নিজেকে মার্কসবাদী লেখক হিসেবে দাবী করা থেকে বিরত থেকেছেন তিনি। স্থিতধি
মার্কসবাদ অনুরাগী হাসান আজিজুল হক তাঁর বিশ্বাসের সঙ্গে আপোষ করেননি
কখনো।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্ষেত্রে একমাত্র মার্কসবাদকেই বিবেচনা করেছেন উজ্জ্বল
উদ্ধার হিসেবে। তবে বাংলাদেশে বহুধাবিভক্ত বামপন্থী দলগুলোর কার্যকলাপ হতাশ
করেছে তাঁকে। আর এই হতাশা তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ‘...আমি মনে করি,
মার্কসবাদ নিয়ে এদেশে স্তুতি অথবা নিন্দা এই দুটি অনর্গল আউড়ে যাওয়া প্রায়
একমাত্র কাজ যা আমরা করতে পেরেছি। এতে মার্কসবাদ বোঝার ক্ষেত্রে ক্ষতি
হয়েছে, কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আরো ক্ষতি হয়েছে। দীক্ষিতদের জন্য মার্কসবাদ
শাস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, অদীক্ষিতদের জন্য অস্পৃশ্য ব্যাপার। মূল্যায়ন করার
কাজ অবশ্যই করা উচিত-- যেহেতু মার্কসীয় দর্শন মৃত নয়, কেবলমাত্র দর্শনও নয়।
[ মার্কসীয় দর্শন / হাসান আজিজুল হক/১৯৯৪]
- ইকবাল হাসান
২.
আমরা বসেছিলাম দোতলার ষ্টাডিরুমে। মুখোমুখি।
ইকবাল হাসান-
দেশভাগ-- যেন একটা ক্ষত-- আপনার লেখায় নানাভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে। এই ক্ষত এতোটা তীব্র কেন?
হাসান আজিজুল হক--
হাসান আজিজুল হক বল্লেন, এই ক্ষতটা তীব্র বলছো! আমি বলছি, কখনোই আর নিরাময়
হবার নয়। মানুষের স্বত্তার ভিতর বিষক্রিয়ার মতো এই ক্ষত কাজ করছে আমার
ভিতরে। আমিতো দেশত্যাগ করিনি। তখন এমন একটা বয়স-- যে মানুষদের সঙ্গে আছি
তারা ধোপদূরস্ত পোষাক পরা সুশিক্ষিত রুচিবান মানুষতো নয়। শুধুই মাটিলগ্ন
মানুষ, যাদের দেহের রঙও মাটির মতোন-- খাঁটি অর্থে বাংলার চাষীদের মধ্যেই
আমি বড় হয়েছি। প্রসঙ্গত একটি কথা বলা প্রয়োজন, আদিম অবস্থায় মানুষ ছিল পশু।
অক্ষর চেনে না জানে না-- এমন অবস্থা গেছে দীর্ঘদিন। অথচ মানুষের পরিপূর্ন
বিকাশ হয়েই গেছে ততদিনে। হোমার তো অক্ষর জানতেন না। আমরা অক্ষর লালিত
মানুষের সভ্যতা-- যা আমাদের জ্ঞানের তিনভাগ দখল করেছিল, এখনো আছে আর এই
অবস্থায় আগে যখন মুদ্রিত অক্ষরের কোনো চল ছিল না-- তখনও বড় বড় সভ্যতার
সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে একটা ধারনা হয়-- অই ঐতিহ্য বহন করছে অই মাটির
মানুষেরা। যারা অক্ষর না চিনলেও আলো মাটি, আকাশ নক্ষত্র, নদী জল চেনে--
মৌলিকভাবে নীতি বিরুদ্ধতা ঠিকই চেনে-- কপালক্রমে এই রকম একটা সমাজে আমার বড়
হওয়া। বস্তুত এরাই হচ্ছেন আদিম কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষেরই একালের
প্রতিনিধি।
শুনতে অবাক লাগবে, আমাদের গ্রামে, বলতে গেলে পুরো অ লে বিশেষ করে মুসলিম
সম্প্রদায়ের মধ্যে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ খুবই কম ছিল। সাধারনভাবে বলতে
গেলে জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশকে অধিকার করে ছিল নিরক্ষরতা। কিন্তু মনেতো
হয় না, এই মানুষগুলো অসভ্য ছিল, বর্বর ছিল, অজ্ঞান এবং অনভিজ্ঞ ছিল। বরং
উল্টোটাই মনে হয়। এই বিপুল জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বরং এই আলোকিত সময়েই প্রায়
অন্তর্হিত হয়েছে। কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারলাম কিনা জানি না। জানি, আমার এই
কথার বিপক্ষে সরবে প্রতিবাদ করার মানুষই বরং বেশি দেখা যাবে।
আমার কপাল ভালো, মূল কথাটা বোধহয় সম্ভাব্য যাবতীয় প্রতিবাদের মুখেও অনেকের
কাছে পৌঁছে যাবে। এই রকম একটা সমাজের মানুষ বলে-- সে মানুষ দেশ বলতে যা
বুঝবে, রাষ্ট্র বলতে যা বুঝবে, সম্প্রদায় বলতে যা বুঝবে, ধর্ম বলতে যা
বুঝবে-- তা হয়তো সমস্ত তত্ত্ব, কূট রাজনীতি, বড় বড় হিসাব কিছুতেই হৃদয়াঙ্গম
করতে পারবে না। এই অর্থে দেশ ভাগ আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি। অতএব গ্রহণ
করার প্রশ্নই ওঠে না। সত্যি বলতে কি, দেশভাগ কাকে বলে, কেন ঘটে তাও আমার
ঠিক জানা ছিল না।
দেশভাগ হয় ১৯৪৭ সালে, তার ৭ বছর পর ৫৪ তে আমি এখনকার বাংলাদেশে আসি।
খুলনায়। কারণ খুবই আপতিক। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর কোথাও না কোথাওতো ভর্তি
হতে হবে-- সেটা বর্ধমান কিংবা মাদ্রাজেও হতে পারতো। আমার বেলায় হয়েছিল
পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায়। বাড়ি থেকে খুব যে একটা দূরে তাও নয়। বৃহদায়তন
উপমহাদেশ মাথায় রাখলে সত্যি খুব একটা দূরে আমার দেশান্তর ঘটেনি।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, অন্তত ৭ বছর দেশভাগের কিছুই বুঝিনি আমি। ক্ষত-টতের
কিছুই না। আত্মিয়-স্বজন যারা তখন পূর্ব পাকিস্তানের নানা জায়গায় ছিলেন তারা
তো বেশ স্বাচ্ছন্দেই যাতায়াত করছিলেন-- তাহলে আর আমি এতো আহত বোধ করবো
কেন? কোনো কারণ তো নেই।
ইকবাল হাসান--
আর দাঙ্গার কথা?
হাসান আজিজুল হক--
হ্যা, দাঙ্গার কথা, কোলকাতার দাঙ্গার কথা, নোয়াখালী বিহারে সাম্প্রদায়িক
হত্যার কাহিনী খুব ছোটবেলায় অল্পবিস্তর শুনেছি বটে-- আশে পাশের অন্চলে দু
একটি ছোটখাট দাঙ্গা খুন-- তাও দেখেছি। কিন্তু এর চে’ মনের উপর প্রভাব
ফেলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ৫০ এর মন্নান্তর। এসবই দেশভাগের তুলনায়
মনকে অনেক বেশী গ্রাস করেছিল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে-- যে ক্ষতের কথা দিয়ে আমরা
শুরু করেছিলাম সেটার সূত্রপাত সব হারানোর সূত্রপাতের সঙ্গেই যুক্ত।
ইকবাল হাসান--
প্রাপ্তির পাশাপাশি হারানোর বেদনা আপনার ক্ষতকে তীব্রতর করে তুলেছে। নয় কি?
হাসান আজিজুল হক--
আমি একবারে সব হারাইনি। একটু একটু করে হারিয়েছি। যেমন, কৈশোর থেকে যুবকত্বে
পৌছেছি, উদভ্রান্ত তারুণ্যে পৃথিবী চষে ফেলতে চেয়েছি, পৌঢ়ত্বের ভয়ানক গভীর
অন্তশীলার জীবন ¯্রােতের মধ্যে ঢুকে পড়েছি এবং তারপর এই বার্ধক্যে এসে অতি
তিক্ত লবন জলে এখন পরিপূর্ণ নিমজ্জনে আছি। সামান্য সুক্ষ্ম একটা বিদায়ন
রেখা দিয়ে শুরু-- তারপর বাড়তে বাড়তে বাড়তে-- তুমি যে তীব্র ক্ষতের কথাটা
তুল্লে ইকবাল, সেই তীব্র ভয়ানক ক্ষত সমস্ত সময়টা পিছনে ঘটে যাওয়া
সর্বনাশগুলো জানতে পেরেছি, আর সামনের অবধারিত সর্বনাশগুলোকেও দেখতে
পেরেছি।
লক্ষ কোটি মানুষ দেশান্তরীত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি ঘটেছে।
সর্বস্ব গিয়েছে। অর্থ সম্পদ, সহায় সম্পদ চিরকালের জন্য বিনষ্ট হয়েছে, নিজের
আকাশ মাটি জমি থেকে উৎখাত হয়েছে, এক একটা সম্প্রদায় ভয়ানক সংকটের সন্মুখীন
হয়েছে-- মূল কারণটি আজো খুঁজে পাইনি। মানুষের মর্যাদা গিয়েছে, ইজ্জত
গিয়েছে, মানুষ হিসেবে নিম্নতম স্বীকৃতি জোটেনি। এই বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের
জন্য আমার মনে হয়-- আমার ক্ষত নিরাময়হীন।
ইকবাল হাসান--
তাহলে কি আমরা বলবো, কিছুই অর্জিত হয়নি?
হাসান আজিজুল হক--
একতরফা কথা বলা যে কিছুতেই ঠিক নয় তাও জানি। হ্যা, অর্জন হয়েছে-- কিছুই
অর্জিত হয়নি তা তো বলা যাবে না। ৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্থান থেকে ২০১২ সালের
বাংলাদেশ পর্যন্ত উচ্চশিরে ভয়শূন্য মনে এই পৃথিবীতে বিপুল অর্জন বলতে যা
বোঝায় তারও অনেক কিছুর মালিক আমরা। তা কি আমার কল্পনাকে, ভাবনাকে, কাজকে,
চিন্তাকে গভীর সন্তোষের মধ্যে নিয়ে যায়নি? কাজেই দুটো ইতিহাসই এক সঙ্গে
চলে-- ক্রমাগত হারানো এবং ক্রমাগত পাওয়া। প্রাণ খোয়ানো আর প্রাণ ফিরে
পাওয়া-- অবিনাশী স্বত্ত্বা অর্জন করা।
তবুও ক্ষত, তবুও মহা সর্বনাশের অভিজ্ঞতা তো হতেই থাকে।
৩.
ইকবাল হাসান--
আপনি আপনার গল্পে প্রান্তিক মানুষের কথা বলেছেন। দাঙ্গা, ক্ষরা, ক্ষয় ও
ক্ষতের কথা বলেছেন। আপনার গল্পে উঠে এসেছে নিবিত্ত আর নিম্নবিত্তের
মানুষেরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নাগরিক এলিট শ্রেনীর
কথা...
হাসান আজিজুল হক--
আমার লেখায় নেই তাই বলতে চাইছো তো? আমি পরিবারের দিক থেকে, পেশার দিক থেকে,
জীবিকা উপার্জনের জায়গা থেকে এবং নিম্নতম বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দের দিক থেকে
এলিট শ্রেনীর কেউ না হলেও অবশ্যই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ। এটাই আমার ও
আমার পরিবারের অবস্থান। এটাই আমার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় গড়ে তুলেছে।
অর্থাৎ বাইরের থেকে যে আমাকে দেখতে পাওয়া যায় তার সবটাই হচ্ছে এগুলি।
তারপরও আমি কী করে বোঝাবো জানি না, আমি এলিট শ্রেনীতে নিজেকে একজন সদস্য
হিসেবে সম্পূর্ন প্রত্যাখান করি। কেউ সেটা মানবে না জানি, কারণ সবাই বাইরের
রূপটিই দেখতে পায়। মূল অস্তিত্ব ও চেতনা বাইরে থেকে দেখা যায় না। লোকে
অবশ্য ঠাট্টা করে বলতে পারে-- সুবিধা নেবে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর আর ভালোবাসা
দেখাবে প্রান্তিক মানুষের প্রতি-- এ এক ধরনের ভন্ডামী ছাড়া আর কি! এরকম
ভাবলে আমার অবশ্য বলার কিছুই নেই। এখন কেমন করে বোঝাই, আমি এলিট শ্রেনীর
মধ্যে নেই। বাংলাদেশের অই শ্রেনীকে আমি ‘রিফিউট’ করি। পাশাপাশি মধ্যবিত্তের
তেলতেলে সুবিধাবাদিতাকেও ঘৃণা করি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সমগ্র
জনগোষ্টির মধ্যে এই দুই শ্রেনী তুলনমুলকভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। পশ্চিমের
স্বাধীন বুর্জুয়া সভ্যতা সংস্কৃতির মধ্যে না গিয়ে তাকে পুরোপুরি ডিঙ্গিয়ে
এসে উপনিবেশ এবং তাবেদার সামন্ত শ্রেনীভুক্ত হয়ে আজ এই এলিট ও মধ্যবিত্ত
শ্রেনী, এক রকম ভালো অর্থে বলছি, শুয়োরের মতো। শুয়োর দেখে কেউ একজন নাকি
জিজ্ঞেস করেছিল-- একি ইঁদুর বড় হয়ে হয়ে হয়েছে নাকি হাতি ছোট হয়ে হয়ে হয়েছে?
কাজেই আমার দৃঢ় বোধ জন্মেছে যে, ওখানে থাকা মানে ছোট হয়ে থাকা, ডোবার
মধ্যে থাকা। আর সাধারনভাবে সব বিবেচনার উপরে গিয়ে মানুষের মধ্যে থাকাটা
অনেক বড় হয়ে থাকা। সমুদ্রের মধ্যে থাকা। এক কথায় সারা পৃথিবীর মানুষের
মধ্যে থাকা।
সেজন্যে আমি প্রান্তিক মানুষের জন্যে লিখি।
ইকবাল হাসান--
আপনি উপমহাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক বিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন, পতাকার
পরিবর্তন দেখেছন বেশ ক’বার-- এই বিবর্তনের মূল্যায়ন করেন কিভাবে?
হাসান আজিজুল হক--
উপনিবেশিক ভারতবর্ষে (বৃটিশ শাষিত) কেটেছে আট বছর, পাঁচ বছর গেছে অবোধ
অবস্থায়। তিন বছর কেটেছে চেতনার উন্মেষকালে। এখন বলতে গেলে অইটুকুই সম্বল।
জীবনের প্রথম পাঁচ বছর গেছে এক ভয়ংকর সময়ের মধ্যে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে।
ভারতবাসীদের জন্য ক্রদ্ধ একটা সময়। প্রায় তখন আমার জন্ম। অজস্র যুদ্ধ
বিমান, জাপানী আতংক, বার্মার পতন, কোলকাতায় জাপানীদের বোমাবর্ষন-- আমার মনে
এসবের কিছুই রেখাপাত করেনি। শুধু মনে পড়ে, মহিষের গাড়িতে মামা বাড়ি যাবার
সময় এক ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে পেছনের রাস্তার দিকে চেয়ে থাকতাম।
মনে পড়ে, গোড়া সৈন্যরা কখনো গ্রামে ঢুকে পুকুর ঘাটে স্নানরত যুবতীদের দেখে
শীস দিত। দাম না দিয়ে কখনো মেয়ে মানুষ কিংবা মুরগির ডিম নিয়ে চলে যেত ওরা।
এই আছে অই সময়ের স্মৃতিতে। আর আছে-- চাল নেই, ডাল কেরোসিন না-থাকার স্মৃতি।
সঙ্গে দূর্ভিক্ষ। আর একটু বড় হয়েই শুনতে পেলাম দাঙ্গার কথা। তার মানে,
বৃটিশ আমলের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। সব ভেঙ্গেচুরে পড়ছে। টুকরো টুকরো হয়ে
যাচ্ছে গ্রামের যৌথ
পরিবার। মানুষ পাড়ি দিচ্ছে শহরের দিকে। মেয়েরা চলাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছে
নগ্ন হয়ে। রেশনের দোকানে একটা মোটা শাড়ি কিংবা একটুকরো মার্কিনী কাপড় পাবার
জন্যে হাহাকার দেখেছি। এরপরই দেশভাগ।
তবু কেন যেন মনে হয়, অই আট বছর মানুষের জীবন কাটতো শান্ত একটা নিস্তরঙ্গ
স্রোতের মধ্য দিয়ে। এরপর পাকিস্তানের ২৩ বছর অতিশয় ক্ষুব্ধ অসন্তুষ্ট
মানুষের মর্যাদাহানিকর এক অপমানিত জীবন কাটিয়েছি। সম্ভবত ‘মাথা নোয়াবো না’
এই রকম একটা সংকল্প মনের ভিতর দৃঢ় থাকার ফলে চারদিকের সমস্ত প্রতিবাদকে
সমস্ত স্বত্ত্বা দিয়ে সমর্থন করতাম। এবং রাজনৈতিক বামপন্থাই আমার জন্য শেষ
পর্যন্ত ধ্রুব হয়ে উঠলো। ২৩ বছর নৃশংস, নীতি-ধর্মহীন, বিবেচনাহীন ক্ষমতা
প্রয়োগ করে একটা রাষ্ট্র যে চালানো যেতে পারে তা বৃটিশ শাষকরা যতটা আমাদের
দেখাতে পেরেছে-- পাকিস্তানী শাসকরা দেখিয়েছে তার শতগুন।
এরপরের বাকী ৪০ বছর যে বাংলাদেশে কেটে গেল তার একটা বিবরন দেয়া এতই পরস্পর
বিরোধী হয়ে যাবে যে, কেবলই বক্তব্যগুলো পরস্পরকে কাটাকুটি করতে থাকবে।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যেমন আকাশতুল্য অর্জন, তেমনি বাংলাদেশ
রাষ্ট্রটির ক্রমাগত পাতাল প্রবেশ একই সঙ্গে ঘটেছে। সেই আলোচনার জন্য এই
সাক্ষাৎকারটি যথেষ্ট নয়।
৪.
ইকবাল হাসান--
আপনি একদিকে আকাশতুল্য অর্জনের কথা বলছেন আবার অন্যদিকে হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন! মূল সমস্যাটা তাহলে কোথায়?
হাসান আজিজুল হক--
আমাদের দূর্ভাগ্য কি জানো, শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই
জনস্বার্থের পথ ধরে এগোয়নি। এক নেত্রীর স্বৈরাচারী শাসন, দুই নেত্রীর ঈর্ষা
ও হিংসার সম্পর্ক, দশ নেত্রীর কোন্দল মুখ্য হয়ে ওঠে। ঢাকের শব্দে মন্ত্র
চাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশে হয়েছে তাই। দুই নেত্রীর কথা যখন তুললে-- বলতে ভালো
লাগে না, তারপরও বলছি-- দু’জনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, হিংসাহিংসি, কার
ভাগে কতোটা পড়লো, কার সঙ্গি সাথী পাইক প্যাদা বেশী, কার কতোটা দখলে এলো
এগুলোই মূল বিষয়। এই মহারোলের আড়ালে চাপা পড়ে যায় যাদের নিয়ে রাষ্ট্র
তারাই। ফলে রাষ্ট্র নিজেই হিং¯্র দানব হয়ে যায়।
যে যখন ক্ষমতায় থাকে সেই তখন ক্ষমতায় থাকা এবং চিরকাল থাকার জন্যে
রাষ্ট্রের সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে নেয়। সেই সাজানোটা ক্ষনস্থায়ী। দলের শাসন
বদলালেই সব সাজানো ভন্ডুল হয়ে যায়। মাজখান থেকে মারা পড়ে জনগন। এরকম অবস্থা
দেশে থাকলে আমাদের পরিচিত রাষ্ট্রের চেনা রূপ কোনটাই কাজ করে না। গনতন্ত্র
অর্থহীন হয়, প্রজাতন্ত্র অর্থহীন হয়, সামাজিক সুবিচারের প্রতিশ্রূতি মাঠে
মারা যায়। ধর্মনিরপেক্ষতাসহ যত স্তম্ভ খাড়া করা হোক না কেন-- সবই ধ্বসে
পড়ে। এইসব পরিচিত রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো তখন আর কোনো অর্থই বহন করে না।
ইকবাল হাসান--
তাহলে তো, এক অর্থে বলা যায়-- আমরা গনতন্ত্রহীন একটা দেশে বাস করছি, নয় কি?
হাসান আজিজুল হক--
গনতন্ত্র চালু আছে-- হ্যা, বাংলাদেশেতো চালু আছেই। কিন্তু সত্যিকারের
গনতন্ত্র কি দেশে আছে? আমিতো মনে করি না। নাম যাই দেয়া হোক না কেন--
পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রই স্বতন্ত্র পথে চলে। গনতান্ত্রিক দশটি দেশও
একরকমভাবে চলে না। আমাদের এই শতরঙে ভরা বাংলাদেশে কোনো নামে কোনটাই একরকম
চলেনি। প্রতিনিয়ত ভুলুন্ঠিত হয়েছে দেশের সংবিধান। কোনো স্তম্ভই আর অবিকল
নেই। কোনো স্তম্ভ খাড়া রাখতে তার গায়ে ‘ঠেকনো’ লাগাতে হয়েছে।
চল্লিশ বছরে সমাজতন্ত্রের কথা, খাটি স্বৈরতন্ত্র, ছদ্মবেশি স্বৈরতন্ত্র এবং
গনপ্রতিনিধিমুলক গনতন্ত্র জ্বলছে আর নিভছে। ঠিক এই হয়েছে আজকের বাংলাদেশের
পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতির কোনো না কোনো সেবা করে যাচ্ছে রাষ্ট্র ও
রাজনীতি। অল্পস্বল্প আদর্শের মৌলিক পার্থক্য হয়তো আছে। কিছু আদর্শ পায়ের
তলায় ঠেঁসে ধরেছে ইসলামপন্থী, জঙ্গি ও তথাকথিত জাতীয়তাবাদী অংশ। আবার এইসব
আদর্শের নামকাওয়াস্তে স্বীকৃতি দিয়ে তফাৎ তৈরি করাটাও হচ্ছে। এমন
পরিস্থিতিতে দেশের সর্বসাধারনের কল্যান বৃদ্ধি, সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবার কোনো
উপায় থাকছে না।
ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে আমাদের দেশের রাজনীতি। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড়
দিতে চাইছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতার শীকার হচ্ছে সাধারন মানুষ। এর থেকে
উদ্ধার পাবার কোনো পথ আছে কি ?
প্রথমত, অস্থিরতার কারণ অগননীয়। বিশ্ব যখন সামগ্রীকভাবে অস্থির থাকে-- সে
অস্থিরতার ঢেউ স্থির সমাজেও এসে লাগে। আজকের বিশ্ব-ব্যবস্থায় আমরা দেখি
প্রচন্ড অস্থিরতা, অসন্তোষ, হতাশা, বর্বর হিংসা এবং পরস্পরকে ধোকা দেয়া--
সবই একসঙ্গে চলছে। তার থেকে আমরা নিজেদের বিযুক্ত রাখতে পারছি না। এটাতো
বাইরের পরিস্থিতি। ভেতরে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ইতিহাস সৃষ্টির পর থেকেই
একদিনের জন্যেও সুস্থিরতার মুখ দেখেনি। এখন সমাজ অস্থির বলাই যথেষ্ট নয়--
নানা সংকটে কন্টকাকীর্ন। এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবার লোক আগের তুলনায় এই
মুহূর্তে অনেক বেড়ে গেছে। রক্তপিপাসু জোকের খাবার জন্য রক্তের পরিমান কম।
তাদের আরো অনেক রক্ত চাই। আর সেই প্রক্রিয়াটাই যেন অতি দ্রুত অবধারিত পতনের
দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। যে পাকে পড়েছি আমরা সেখান থেকে পুরো রাষ্ট্রকে
তুলতে না পারলে-- এই অংশ অই অংশ টেনেটুনে উপরে তোলার চেষ্টায় খুব একটা লাভ
হবে না।
ক্রশফায়ার, অপহরন, গুম, গুপ্তহত্যা একধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। বিভিন্ন
সরকারের আমলে আমরা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো ভয়ংকর, ভীতিকর
পরিস্থিতি দেখে আসছি। আপনি বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
তুমি ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ বলে যা বোঝাতে চাইলে-- যেগুলোর কথা বললে, সেগুলো
সমস্ত সীমানা অতিক্রম করে গেছে। সম্ভবপর সর্বোচ্চ চিকিৎসাও আর সহজে কাজ
করবে বলে মনে হচ্ছে না। ক্রশফায়ারিং প্রতিষ্ঠিত হতে হতে এনকাউন্টার নাম
নিয়ে এখন মানুষকে অপহরন, গুম ও গুপ্তহত্যার পর্যায়ে চলে গেছে। রাষ্ট্র কী
যে ভয়ানক, ভয়ংকর-- বসবাসকারী নাগরিকরা তা কল্পনাও করতে পারছেন না। আমিও
পারি না। তোমাকে স্পষ্ট করে বলি, এইসব আইন বিরোধী, মানবতা বিরোধী, চরম
নিবর্তনমুলক প্রক্রিয়া চালু থাকা পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি মানুষেরই বেঁচে
থাকার মৌলিক স্বাধীনতার বাস্তবতা নেই।
ক্ষমতার রাজনীতির দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ন বিবেক বিরূদ্ধভাবে-- যাকে বলা যায়
অভিসন্ধিমুলক-- এমন আচরন হয়েই যাচ্ছে। তবে আমি মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের
মধ্যে মানবতাবিরোধী কাজের সঙ্গে লিপ্ত ছিল বলে যাদের জানি তাদের সংখ্যা
অনেক বেশী। এবং তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এদের বিচারের আওতায়
আনার সম্ভবনা ক্রমশ ক্ষীন হয়ে যাচ্ছে।
ধর্মীয় গোড়ামী ও কুসংস্কার আমাদের দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের
অন্তরায়। আপনি কি মনে করেন যে, এর পিছনে রয়েছে আমাদের রাজনীতিবিধদের
প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়?
ধর্মীয় গোড়ামী ও কুসংস্কার সব কিছুরই অন্তরায়। সবচে’ কঠিন এবং সবচে’
পশ্চাদমুখী গোড়ামী হচ্ছে ধর্মীয় গোড়ামী। এটা মানুষের বৃদ্ধিও বন্ধ করে দেয়।
সমাজ সভ্যতার গতিকে স্থবির করে দেয়। প্রশ্নই ওঠে না কোনো ধরনের উন্নয়ন। আর
যদি তা রাজনীতিকে আক্রমন করে তাহলে সেই রাষ্ট্র অন্ধকারের অতলে তলিয়ে
যাবে-- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
৫.
ইকবাল হাসান--
এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কেউ কেউ বলে থাকেন, আপনি এখনো শৈশব কৈশোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি...
হাসান আজিজুল হক--
এক অর্থে না পারিনি তো। কে পারে? এই যেমন ধরো, তুমি এলে রাজশাহী। তো
সকালবেলা নাস্তার টেবলে একটু দীর্ঘ সময় গল্প করবো কিশোর বেলার মতো-- তা আর
হচ্ছে কৈ! ঘড়িকে বলি, সকালের দিকে অতো দ্রূত, নয় আস্তে আস্তে চল। ঘড়ি শোনে
না।
এখন আমাকে দেখে, আমার সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থান বিচার করে যদি কারো ঠিক এমন ধারনা হয়-- আমি তার সঙ্গে তর্কে যাবো না।
রাজশাহীতে বাড়ি করবার সময় আমাকে খুব ভালোবাসেন এমন একজন আর্কিটেক্ট কে
বলেছিলাম, নেহাত দেয়াল না দিলে তো ঘর হয় না। কাজেই দেয়াল আপনি দেন-- আপত্তি
করবো না, তবে যতো কম পারেন।
ঠিক এভাবেই আমি পৃথিবীকে দেখি।
বি:দ্র: - ওয়েব ম্যাগাজিন ' গল্পপাঠ ' এর সৌজন্যে