সাগরলীনা - সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত
(গল্পকার- সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত)
সন্ধ্যে ন’টা চল্লিশ। এই মুহূর্তটা থেকেই যেন সারাদিনের ক্লান্তি ও বিশ্রাম
শেষে সন্ধ্যেটা পূর্ণ-যৌবনা হয়ে ওঠে, মাছের গন্ধে চারদিক ভুরভুর করছে।
নানা সামুদ্রিক ভাজামাছের সম্ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু বিক্রেতা। কাছে এলে,
দেখা যাবে সেই মহিলা ভাজামাছ বিক্রেতাদের চড়া সাজ আর নাকে আসবে কড়া
পারফিউমের মাদক গন্ধ। তাদের বয়েস পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে। কটিদেশ বেশ স্ফীত আর
স্তন-যুগল শিথিল হয়ে খানিক নিম্নমুখী। ওয়াকিং স্ট্রিটের কুয়াংহান
বিয়ার-পাবে বিয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বসেছে ওয়ান আর তার সঙ্গীরা। সঙ্গী
বলতে রোজ রাতে পাশাপাশি বসা বা চলতে ফিরতে দেখা হওয়া, আর কাজের খাতিরে
খানিক নিজেদের মধ্যে ঢলাঢলি করা আর কি। এমনিতে চরম রেষারেষি। এসে থেকেই
ওয়ান নুক’কে খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। আটটার বেশি দেরি কেউই করে না, তাই
নিশ্চয়ই নুক এসে গেছে। তাহলে কি আসতে না সতেই কাস্টমার পেয়ে গেছে? ওয়ানের
নাকের পাটা ফুলে উঠতে শুরু করে। বিয়ারের মগে মুখ দিয়ে বেশ শব্দ করেই
খানিকটা বিয়ার গলায় টেনে নেয় ওয়ান। পাশে বসা মুমু চমকে তাকায়, ‘ব্যাদ
ম্যানা...র’ বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওয়ান-এরও গলায় ঝাঁঝ লেগেছে। নিজেদের
পয়সায় এরা সবচাইতে সস্তার বিয়ার খায়। স্বাদটা যেন ঘোড়ার পেচ্ছাপ! বিড়বিড়
করে একটা অশ্লীল গালি দেয় ওয়ান। হাতের ঝলমলে উগ্র গোলাপিরঙা ব্যাগটা খুলে
ছোট আয়না বের করে আরেকবার মুখে কমপ্যাক্টের পাফটা বুলোয় আর লিপস্টিক’টা
ঠোঁটে লাগিয়ে রঙ গাঢ় করে নেয় ওয়ান। সিঁড়ি দিয়ে সামনের রাস্তায় নেমে আসে,
ছোট্ট স্লিভলেস টপ’টার ডানদিকের কাঁধের কাছটা একটু নামিয়ে দিয়ে বিচের সামনে
পার্কের দিকে হাঁটতে থাকে। বেঞ্চ আছে ছাড়া-ছাড়াই। মেয়েদের মধ্যে কেউ একা,
কেউ বা কারো সাথে হাসাহাসি করছে। উরু থেকে পায়ের পাতা উন্মুক্ত। ঝকঝকে ফরসা
পায়ে হাই-হিল স্যান্ডেল সবার। অনেকেই ধৈর্য ধরে রাখতে পরের পর সিগারেট
খাচ্ছে। যদিও ডিসেম্বর মাস, ট্যুরিস্টের কমতি নেই। সারা বছরই কমবেশি বিদেশি
টুরিস্ট আসে এখানে। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে মার্চ বৃষ্টিশূন্য থাকে
সাগর-ঘেঁষা এই শহরটি। তাই এই সময়টা তার সমস্ত সৌন্দর্য আর যৌবনের ডালি
এগিয়ে নিয়ে পাটায়া তার মলিন ছাপ-ছোপ যা আছে, সেসব সযত্নে লুকিয়ে রাখে।
আরেকটু এগিয়েই ওয়ান দেখল, সামনের থেকে নুক-এর কাঁধে হাত রেখে আমেরিকান একটি
লোক এগিয়ে আসছে। ওয়ান-এর সাথে মুখোমুখি হতেই নুক একটা চোখ মেরে এগিয়ে গেল।
ওয়ান-এর মনে হল, লোকটি খুবই মালদার। যদিও ওয়াকিং স্ট্রিটে আসা সবারই পোশাক
বলতে শর্টস আর হাতকাটা গেঞ্জি। তাই পোশাক দেখে কিছুই বোঝার উপায় থাকে না।
কিন্তু ওয়ান চেহারা দেখেই বোঝে, কার পকেটের কেমন জোর। নুক’ও বুঝেছে যে ওয়ান
ওকে হিংসে করতে শুরু করেছে। হিংসে করবে নাই বা কেন? এই যে আজ ওয়ান সাড়ে
ছটা থেকে বসে, আর নুক-নাইট স্কুল থেকে ফিরেই খদ্দের পেয়ে গেল!
ওয়াকিং স্ট্রিট থেকে নুক’রা রাস্তার দিকে এসে একটা ট্যাক্সি নেয়। ব্রডি’কে
নুকের বেশ পছন্দই হয়েছে। একটা বড়সড় কিছু নাম বলেছিলেন এই আমেরিকান-যুবক।
নুকের ডাকনাম ব্রডি’টা বেশ পছন্দ হয়েছে। যদিও সে ডাকছে ‘ব্রদি’ বলে।
ছেলেটিও হেসে মেনে নিয়েছেন নিজের নতুন নাম। নুক-এর দেখাদেখি ব্রডি’ও বেশ
স্বচ্ছন্দভাবেই হাঁটছে, যেন রাস্তা বেশ চেনা। জিগ্যেস করে নুক জানে যে
ব্রডি’র সপ্তাহ পেরিয়েছে এখানে। উঠেছে বিচরোডের এক হোটেলে। বসায়া বিচ হোটেল
রিসর্টে উঠেছে ব্রডি। নুক বোঝে ব্রডি’র এখন হোটেলে যাবার কোনো ইচ্ছেই নেই।
সিক্সটিনাইন’য়ারস বার পটায়া’তে ওরা এসে বসে। যথেষ্টই ভিড় বিয়ার-বারটিতে
এখন। দু’একজন মুখচেনা মেয়ে চোখে পড়ে নুক-এর, কিন্তু আলাপ নেই। আসলে এই কাজে
নুকের বেশিদিন হয়নি। আগে থাই-মাসাজ পার্লারের সামনে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে
দাঁড়িয়ে কাস্টমার ডাকতো অন্য মেয়েদের সাথে দাঁড়িয়ে নুক। প্ল্যাকার্ডে লেখা
থাকত নানা এরোটিক মালিশের নাম আর তাদের চার্জ। ওদের পোশাক ছিল লাল-সাদা
কম্বিনেশনের ছোট্ট ফ্রক। ওয়ান মাস ছয়েক হলো নুক’কে ওয়াকিং স্ট্রিটে নিয়ে
এসেছে। নুক এ’বছরই ষোলোয় পা দিয়েছে। ওয়ানের থেকে চোদ্দ বছরের ছোট। ওয়ানের
চেহারা বড়সড়, নুকের চেয়ে একেবারেই আলাদা।
‘তুমি কি এখানকারই মেয়ে নাকি অন্য কোথাও থেকে মাইগ্রেটেড? থাই তো বটেই, তাই
না?’ ব্রডি’র কথায় নুক খানিক অবাক হয়। হেসে জবাব দেয়, তুমি আমার ঠিকুজির
খবর নিয়ে কি করবে? ব্রডি বলে সে নুকের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। পটায়াতে সে
এখন কিছুদিন থাকবে। জানবে এই শহরটাকে। নুক-এর মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে এইসব
ঝামেলায় পড়তে চায় না। সে সবে নতুন পয়সার মুখ দেখতে শুরু করেছে। দু’তিন
ঘন্টা কাজ করবে, পয়সা উপার্জন করবে, কখনো বাইরে খাওয়া-দাওয়া করে, কখনো বা
হোটেলের রুমে বসেই খাওয়া সেরে ডিউটি সেরে পাঁচশো থেকে দেড় হাজার বাহ্ট
ভ্যানিটি-ব্যাগে পুরে সে ফিরে যেতে চায়। খানিক চৌকস করে বিদেশী কাস্টমারদের
কাছে নিজেকে এগিয়ে দিতে চায় নুক। প্রতিতি উপার্জনের আবার তিন – চারভাগ হয়।
নুক অবশ্য নিজে কাউকে কিছু দেয় না, নিজের ভাগটা রেখে ওয়ান’কে দিয়ে দেয়
বাকিটা। দালালকে তার হিসসা দেওয়ার পর ওয়ান এখানকার খরচের জন্য সামান্য টাকা
রেখে বাকিটা গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। অবশ্য বেশিরভাগ সময় নুক-এর
দাদাই মাসের শেষ দিনটিতে টাকা নিতে চলে আসে। কখনো মাসের মাঝখানেও এসে হাজির
হয়। আর তখনই হয় মজা, নুক-এর তো মজাই লাগে। যে রাতে কাজের থেকে ফিরে নুক আর
ওয়ান নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দেখে যে বড় ভাই শীজাং দরজার বাইরে ওদের
জন্য অপেক্ষা করছে,--
‘এখানে মরতে কেন এসেছো?’ গজগজ করতে করতে দরজার তালা খোলে ওয়ান। শীজাং জবাব
দেয় না, অসহায় মুখ করে থাকে। কিন্তু নুক জানে তাদের বড় দাদা আসলে একটা
মিটমিটে শয়তান। বছরের বেশিরভাগ সময়টাতেই সে কিছু করে না শুধু বোনেদের
রোজগারে খায়।
‘মা পাঠিয়েছে। আমি আসতে চাইনি। বাবার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে।’ শীজাং আমতা আমতা
করে। এরপর ওয়ান গালাগাল শুরু করে শীজাং মিথ্যে বলছে বলে। ওয়ান মা’কে মাসের
প্রথমেই সংসার খরচের টাকা পাঠিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ফুরোবার কথা নয়, শীজাং
এসেছে নিজের নেশার আর জুয়ার খরচের জন্য। তবে মা জানে ঠিকই। মা সংসারের টাকা
থেকে দেয়নি ছেলেকে, তাই শীজাং নিজেই গ্রাম থেকে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।
*******
‘জানো নুক, যার রক্ত আমার শরীরে বইছে সেই ভদ্রলোকও নিজের জীবনের বেশির ভাগ
সময়টাই তোমাদের এই শহরে কাটিয়েছেন।’ খুব মনোযোগ সহকারে নুক বীফ-কেবাবে কামড়
দিয়ে ব্রডি’র দিকে তাকায়। প্রথমে নুক ঠিক করেছিল এসব বকর-বকরে সে না থেকে
ব্রডি’কে ওয়ানের দিকে ঠেলে দেবে। কিন্তু গতকালই ব্রডি নুক’কে একটা দামি লাল
ফ্রক কিনে দিয়েছে। কোমরের কাছে সরু রূপালি ধাতব-বন্ধনী একটা। তার সাথে
ম্যাচ করা রূপালি ব্যাগ আর স্টিলেটো জুতো। কথাবার্তায় ব্রডি বুঝিয়ে দিচ্ছে
যে সে খরচ করার ক্ষমতা রাখে আর করবেও খরচ। তাই নুক ঠিক করতে পারছে না
ব্রডি’র সাথে কি করা উচিত। নুক প্রশ্ন করে –
‘তোমার শরীরে রক্ত বইছে বলতে?’
‘যে পুরুষটি আমার মাকে গর্ভবতী করেছিলেন তার কথা বলছি।’
‘ওহ তোমার বাবা।’ নুক আবার খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ‘ভদ্রলোক আমেরিকান
সেনা-বিভাগে কাজ করতেন। চরিত্রহীন লম্পট ধরনের।’ নুক এখনো বিয়ারের ঝাঁঝে
অভ্যস্ত হতে পারেনি। ব্রডি’র সাথে রোজ পুরো সন্ধ্যেটা কাটানোর জন্য নুক
মাঝেমাঝেই ফলের রস খায়। শেষে কোনো রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেয়ে দশ বাহ্ট
দিয়ে টুকটুকে চড়ে নিজের ডেরায় ফিরে আসে। অবশ্য ব্রডি ট্যাক্সির ভাড়ার জন্য
আলাদা একশ বাহ্ট রোজই দেয়।
‘আছা ওয়ান তুমি কি এখানে জিমি ডেন্টন বলে কারো নাম শুনেছো?’
আজ ওয়ান ফেরার পর পরই নুক জিজ্ঞেস করে তাকে। হাতের ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে পায়ের জুতো জোড়া খুলে ওয়ান বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ে।
‘জিমি মানে কোনো আমেরিকান শুয়োরের বাচ্চা হবে তাই তো? আর কোনো নাম খুঁজে পেলি না তুই হতচ্ছাড়ি?’
ওহ নুক-এর খেয়াল ছিল না যে ওয়ান আমেরিকানদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না।
ওয়ান-এর চেহারা নুক-এর চেয়ে একেবারেই আলাদা। এদিককার সবার থেকেই আলাদা।
নাক, চোখমুখ এমন কি শরীরেও ওয়ান আলাদা। বরং পশ্চিমের দেশগুলো থেকে যারা আসে
এখানে তাদের সাথে ওয়ান-এর চেহারার বেশ মিল। নুক মোবাইল থেকে চোখ তুলে
পাশের সিঙ্গল খাটের দিকে আড়চোখে তাকায়। ওয়ানের মুখটা লাল হয়ে আছে, ধকধক করে
জ্বলছে চোখ দুটো।
*******
স্কুলে যেতে ইচ্ছে করতো না ওয়ান-এর। সবাই ওকে দেখে খেপাত ‘মিস-আমেরিকা’
বলে। এমন কি ক্লাসে মাস্টারমশাইও মিটিমিটি হাসতেন ওই কথে শুনে। মা-বাবার
মধ্যেও যে ওকে নিয়ে ঝগড়া হতো, তা বুঝত ছোট্ট ওয়ান। দু’বছরের বড় শীজাং
ওয়ান’কে সুযোগ পেলেই মারত। আর বাবা তো কথাই বলতো না ওয়ান-এর সঙ্গে। যেদিন
বেশি মাছ উঠতো না জালে সেদিন বাবার মেজাজ থাকত সপ্তমে। দেশি মদে চুর হয়ে
এসে মাকে মারত, অবশ্য মা’ও চিৎকার করে পাড়া মাথায় করত। বাবা তাদের মাকে বলত
যেখান থেকে হোক পয়সা কামিয়ে আনতে। যেমন আগে আনত।
‘সোলজাররা আর কোথায়! যে আসবে ফূর্তি করতে?’ ওয়ানের মা খেঁচিয়ে বলত।
‘কেন খানকির ছেলেরা কি সব নপুংসক হয়ে গেছে না কি?’
নেশার ঘোরে ওয়ানের বাবার
খেয়াল থাকত না যে সালটা ১৯৭৭। দু’বছর আগেই যুদ্ধ শেষ হয়েছে ভিয়েতনামে।
যখনই কাজে মন্দা যেত, ওয়ানের বাবার আমেরিকান সেনাদের হুল্লোড় আর টাকা
ওড়ানোর কথা মনে পড়ত।
দুপুর নাগাদ আসত ওরা। আর্নল্ড, ম্যাক, জোসেফ আরো ক’জন ছিল নাম মনে নেই।
অনেক ভালো ভালো মদ আনত ওরা, আর আনত পকেট ভর্তি বাহ্ট। খানিক পরে বাড়ির
ছেলেগুলো চলে যেত মাছ ধরতে সাগরে, আর মেয়ে-বউরা সেনাদের খাতির করত
থাই-মালিশ ইত্যাদি দিয়ে। ‘তা নিজেদের এই পাপটাকেও নিয়ে গেল না কেন?’
ওয়ান-এর দিকে আঙুল দেখিয়ে তার বাবা বলে। আগে কিছুই বোঝেনি ওয়ান-এর মা ।
ওয়ান জন্মাবার পর ধীরে ধীরে সবার সাথে সেও দেখে যে ওয়ান-এর চেহারায় বিদেশী
ছাপ পরিস্ফুট হয়ে উঠছে।
******
ব্রডি লিফটে নেমে রিসেপশনে হোটেলের ঘরের চাবিটা জমা দেয় ঘর পরিষ্কারের
জন্য। রিসেপশনে বসা মেয়েটি সকালের শুভেচ্ছা জানিয়ে হাসে। মেয়েটির গালে
লালের ছোপ থাকলেও এই প্রথম সে এখানে এই বয়েসি কোনো মেয়েকে দেখল যে তেমন
সাজগোজ করেনি। হতে পারে রাত থেকে ডিউটি করে সকালে সে চলে যাবে, তাই মুখের
সাজ ফিকে হয়ে গেছে। বাগান পেরিয়ে সুইমিং-পুল তারপর বাঁদিকে ডাইনিং হল।
ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট চলছে। কালকেও এ’সময়ে একটি চাইনিজদের বড় দল হুল্লোড়
করে জলখাবার খাচ্ছিল। ব্রডি টোস্টারে একটা ব্রাউন ব্রেড ঢুকিয়ে প্লেটে
তরমুজ, আনারস আর পেঁপের টুকরো নিয়ে কোণার দিকে একটা টেবিলে রেখে, তাড়াতারি
ব্রেডটা বের করে এনে আরেকটা প্লেট নিয়ে একটু মার্মালেড লাগিয়ে টেবিলে ফিরে
এলো। তারপর কফি বানিয়ে এনে চুমুক দিল। আজ খানিক বেশিই খেলো ব্রডি। জমটিয়েনে
আমেরিকান কনস্যুলেটে কে জানে কত সময় লাগবে।
‘জিমি ডেন্টন?’
সামনে বসা অফিসার কম্পিউটারে ডেটা-ফাইল সার্চ করে জবাব দেয়, ‘ না, এই নামে
গত দু’বছরের মধ্যে কাউকে দেখছি না’ ব্রডি বলে, ‘ না- না পনের ষোলো বছর আগের
কথা।’ এত পুরনো শুনে অফিসার কম্পিউটার থেকে পুরোপুরি মুখ সরিয়ে মৃদু
হাসলেন। তারপর বললেন, ‘এত পুরনো কাউকে এভাবে তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। জিমি
ডেন্টন..., তা ইনি এখানে কি ভাবে থাকতে পারেন বলে আপনি ভাবছেন?’
ব্রডির মুখ খানিক শক্ত হয়। শেভ করা পরিষ্কার মুখে ওপরের ঠোট আর নাকের নিচে
গোঁফের ডান হাতের তর্জনি দিয়ে একটু চুলকিয়ে সে উত্তর দেয় – ‘ ২০০০ সালের পর
কোনো এক সময়ে তিনি হয়ত এ দেশে এসেছিলেন। তারপর বারো তেরো বছর পর তিনি
আর্থিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে নিজের দেশে তাঁর বন্ধুকে জানান সাহায্যের
জন্যে। এর বেশি আর কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
এরপর সে অফিসার বলেন, তিনি এভাবে সাহায্য করতে সম্পূর্ণ অপারগ। ব্রডি’র না
কি উচিত ছিল টুরিস্ট-পুলিস এবং হোমলেস-সেন্টারে খোঁজ নেওয়া। বডি আজ একটু
আগেই ওয়াকিং স্ট্রিটে এসেছে। কনস্যুলেট থেকে আর কোথাও যায়নি ব্রডি, হোটলে
ফিরতেও ইচ্ছে হলো না আর। ওয়াকিং স্ট্রিট এখন জৌলুষহীন হয়ে রাতের প্রতীক্ষায়
শেষ বিশ্রামটুকু সেরে নিচ্ছে। আর ক’ঘন্টা পরেই রঙে রূপে সজ্জিত হয়ে নিজেকে
ধরে রাখতে হবে সেই রাত তিনটে অবধি। বিচের ধারে এসে একটা বেঞ্চে বসে ব্রডি।
নুক-এর আসতে অনেক দেরি। সামনে সমুদ্র বড় সুন্দর। নীল আর শান্ত। ছোট ছোট
ঢেউ আসছে, বোল্ডারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে যেন হেসে লুটিয়ে পড়ছে। নিজের
ফ্লিপফ্লপ জুতো খুলে সাদা ঝরঝরে বালুকণায় পা রাখে ব্রডি। রোদ পড়ে আসছে তবু
বালুকণার সামান্য তাপ ব্রডি’র পায়ে এসে লাগে। আরাম লাগে পায়ে। নুক রোজই বলে
থাই-মাসাজ নিতে। তাঁর জানাশুনো পার্লারের নামও বলে দিয়েছে, কিন্তু ব্রডি
একবারও যায়নি সেখানে। সে চায় না কোনোভাবেই এদিককার কোনো কুহেলিকায়
মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তে। ব্রডি এই ব্যাপারে সন্ত্রস্ত থেকেছে সারাটা জীবন।
তারপর এখানে এসে যেন আরও সচেতন। কোনোভাবেই সে যেন সে সমস্ত কু-প্রবৃত্তির
প্রতি আকৃষ্ট না হয়, যে সব তার জন্মদাতার ছিল। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ব্রডি
ভাবে, সে কেন এখানে সময় নষ্ট করছে! জিমি ডেন্টন বলে এক দুশ্চরিত্র লোকের
খোঁজ সে কেন করছে, যে লোকটির জন্য তার পুরো শৈশব অনাথ আশ্রমে মুখ গুঁজে
কেটেছে। যখন তখন তাকে খেতে হয়েছে হোমের বড় ছেলেদের কিল ঘুষি আর কুঁকড়ে
থাকতে হয়েছে সুপারের যৌন-লাঞ্ছনার আতঙ্কে।
সাগরের ওপারে সূর্যাস্ত হয়েছে কিছুক্ষণ হলো, এপার আলোর মালায় সুসজ্জিত।
ব্রডি পা চালায় বিয়ার পাবের দিকে নুক-এর উদ্দেশ্যে। নুক-এর বদলে একজন লম্বা
খানিক ভারি চেহারার মহিলাকে নিজের টেবিলের কাছে আসতে দেখে ব্রডি।
‘আজ নুক আসতে পারছে না।’ গম্ভীর স্বরে কথাটি বলেই ফিরে যেতে চায় মহিলা।
‘আপনি কি ওর দিদি ওয়ান? বসুন একটু বিয়ার পান করা যাক।’ অত্যন্ত বিনয়ের
সঙ্গে কিন্তু এক নিঃশ্বাসে বলে ব্রডি। নুক-এর মুখে সে শুনেছে যে পশ্চিমের
লোকেদের ওয়ান পছন্দ করে না। খুব কাঠকাঠ স্বরে ওয়ান জানায়, সে এখন ব্রডি’র
সাথে বসতে অপারগ কারণ তাকে কাস্টমার ধরতে হবে। ব্রডি যখন তাকে আজ সন্ধ্যার
চার্জ অফার করে তখন ওয়ান প্রায় মারমুখী হয়ে ওঠে।
‘আপনারা কি ভাবেন বলুন তো! আমি নিজের বোনের কাস্টমার ছিনিয়ে নেবো? তাছাড়া
আপনি না কি কোন অ্যামেরিকান লম্পটকে খুঁজতে এসেছেন এখানে, নুক রোজ হাসাহাসি
করে। শুনুন, ওইসব নখড়াবাজিতে আমি থাকি না।’
তবু ওয়ান বসে ব্রডি’র সাথে। শোনে ব্রডি’র বাবার কথা। শুনতে শুনতে ওয়ানের
চোখ ধারালো হয়ে ওঠে। জিমি ডেন্টন। আমেরিকান সেনা-বাহিনীর একজন সেনা।
এসেছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে। যুদ্ধ চলাকালেই থাইল্যান্ডের প্রতি তিনি আকৃষ্ট
হন এবং পরে দেশে ফিরে গিয়েও ছুটি কাটাতে প্রায়েই এখানে চলে আসতে থাকেন।
সুরাসক্তি ও মহিলাপ্রীতি এতটাই মারাত্মক হয়ে ওঠে যে অবসরের পর তিনি
পাকাপাকিই এদেশে চলে এসে পাটায়াতেই থাকতে শুর করেন। এসব অনেক আগের কথা। বছর
চারেক আগে তিনি ওদেশে নিজের এক বন্ধুকে জানান যে তিনি প্রচন্ড আর্থিক
অনটনে আছেন। সংক্ষেপে এই গল্পটুকু বলে ব্রডি তাকায় ওয়ান-এর দিকে।
‘আর তোমার মা?’ শ্বাস চেপে ওয়ান জিজ্ঞেস করে।
না, ব্রডি’র মা নিজের জীবন নষ্ট করেননি। প্রথমদিকে চেষ্টা করেছিলেন
স্বামীকে ফেরাতে। যুদ্ধ শেষ হবার আগে নিজে থাইল্যান্ডে এসে স্বামীর সঙ্গে
যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হননি। বিয়ে ভেঙে ছেলেকে হোমে রেখে চলে
গেছেন। ওয়ানের হাতে সিগারেটের ছাই লম্বা হয়ে এসেছে খেয়াল হতেই যেন নাড়া
দিয়ে ওঠে শরীরে আর তারপরই খুব একচোট হেসে ওঠে। ব্রডি ওর দিকে তাকিয়ে থাকে,
বলে না কিছু। নুক-এর মুখে শুনেছে যে ওয়ান খামখেয়ালি।
‘তুমি তো দেখছি আমার চেয়েও শোচনীয় শৈশব কাটিয়েছো।’ ওয়ান জানায় যে সে অতশত
বোঝেনি প্রথমে। তবে চেহারায় যে সে এদিককার মানুষের চেয়ে আলাদা সেটা হাড়ে
হাড়ে টের পেতো সেই ছোট্ট বেলা থেকেই।
‘তোমার বাবার মতই কোনো সেক্স-হ্যাগার্ডের পাপের ফসল আমি।’
তবে ‘ফরংগ’দের সেই তখন থেকেই যে ঘেন্না করতো, এমন নয়। ব্রডি’র জিজ্ঞাসাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে ওয়ান বোঝে যে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
‘আমেরিকা থেকে যারা আসে তাদের আমরা এখানে ফরংগ বলি। এরা কেউ আমাকে পছন্দ
করে না, নিজের বোন মনে করে বোধ হয়।’ বলেই অশ্লীল চোখ করে এক চোট হাসে ওয়ান।
পাশের টেবিলে ওয়ান-এর দু’তিনজন পরিচিত মেয়ে এসে বসে। কিসব বলে ওয়ান কে।
ব্রডি বোঝে না।
‘ওরা আমার সাথে ফরংগ দেখে অবাক হচ্ছে। আমি শুধু এশিয়ান কাস্টমারই পাই কি না।’
*******
নুক-এর দিকে একটা ফলে টুকরি আর ক্যান্ডির প্যাকেট ছুঁড়ে দিয়ে ওয়ান বলে – ‘
নে তোর বয়ফ্রেন্ড পাঠিয়েছে।’ নুক বন্ধুর মারফর খবর পেয়েছে যে ওয়ান আজ
সন্ধ্যে থেকে ব্রডি’র সাথে ছিল। ওয়ান-এর ওপর নুক-এর কেন জানি না রাগ হয় না
কখনও। ওয়ান সবসময় নুক’কে আগলে রাখে। ক্যান্ডি দিয়েও বললো, ‘ চেহারা খারাপ
করিস না যেন ক্যান্ডি খেয়ে খেয়ে। তাহলে পঁয়তাল্লিশ বছরের অনেক আগে থাকতেই
ওয়াকিং স্ট্রিটে ঠেলা করে মাছভাজা বিক্রি করতে হবে।’ নুক বোঝে আজ ওয়ান-এর
মেজাজ বেশ ফুরফুরে। ব্রডি’র সাথে ঝামেলা হয়নি।
‘ব্রডি বেশ ভালো ছেলে, কি বলো ওয়ান?’ ক্যান্ডির একটা প্যাকেট খুলতে খুলতে নুক প্রশ্ন করে।
‘নুক, কাল থেকে আমার ব্রডি’র সাথে কিছুদিন কাজ আছে। আশাকরি তুমি আমায় ভুল
বুঝবে না। এমন ডালিম-রঙা গাল নিয়ে তোমার আশাকরি কাস্টমার পেতে মনে হয় না
কোনো অসুবিধে হবে।’
নুক একটু ঠাট্টা করতে যায় – কি ব্যাপার ? ফরংগ’র সাথে ফরংগ মিলে গেল না কি?
কিন্তু করে না। নুক বোঝে ওয়ান নিশ্চয় ব্রডি’কে ওর বাবাকে খুঁজতে সাহায্য
করবে। নুক এ’কদিনে বুঝেছে যে ব্রডি অন্যরকম পুরুষ। নারীবিদ্বেষী নয়,
মহিলাদের সাথে ফূর্তি করার কোনোরকমের ইচ্ছেও ওর নেই। জীবন নিয়ে নুক কিছু
ভাবে না, কি ভাববে বুঝতেও পারে না। মা-বাবার কাছে সে তেমন থাকেনি, প্রথম
থেকেই ওয়ান নুককে নিজের কাছে রেখেছে। হয়ত মা নিজেই এই ব্যবস্থা করেছে, জানে
না নুক। ওয়ান সবসময় নুক’কে পড়ার ব্যাপারে জোর দেয়, বলে কলেজে পাশ করার পর
নুক নিশ্চয়ই ভালো চাকরি পাবে। পর্যটন-বিভাগে চাকরি পাওয়া যায়। নুক দেখতে
সুন্দর, হোটেলের রিসেপশনেও চাকরি পেতে পারে। নুক দেখে ওয়ান হঠাৎ ওর দিকে
তাকিয়ে হাসছে।
‘ তোমার গালে নাকে চকলেট লেগে গেছে। এখন যদি তোমার কোন বন্ধু তোমায় দেখে-’
বলে আবার ওয়ান হাসতে থাকে। মায়া ভরে তাকিয়ে থাকে ছোট বোনের দিকে। ওয়ান-এর
যদি উপায় থাকত, তাহলে নুক’কে দিয়ে কাজ করাতো না। কিন্তু ওদের মতো পরিবারে
কোনো মেয়েই বসে থাকে না। পরিবারের ভীষণ চাপ আসে, টাকা কামানোর তাগিদ আসে
মা-বাবার কাছ থেকেই।
পরের দিন বেলা এগারোটা। ব্রডি’র ট্যাক্সি যখন ওয়ানকে নিতে ওদের পাড়ার মোড়ে
এলো তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ব্রডি’কে বেশি অপেক্ষা করতে হলো না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওয়ান মাথায় একটা ছাতা ধরে পৌঁছে যায়। আজ ওয়ান-এর
পোশাক একেবারে আলাদা। লম্বা পা ঢাকা খয়েরি রঙা চেক স্কার্ট আর সাদা ফুলহাতা
শার্ট।
শ্রীমতি সুনন্তা কেওয়ামুয়াংপেৎ। ইসরাচোন ফাউন্ডেশন। খানিক আগে ব্রডি’রা
এসেছে। এখানকার খোঁজ তাদের দিয়েছিল টুরিস্ট-পুলিশের এক অফিসার। ব্রডি আর
ওয়ান’কে দেখে হয়ত খানিক সহানুভূতি হয়ে থাকবে তাঁর। আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য
গড়ে উঠেছে এই ফাউন্ডেশন। থাইল্যান্ডের বাসিন্দা ছাড়াও এখানে বেশ কিছ
বিদেশিকেও সাহায্য করা হয়। বিদেশিদের সকলেই পুরুষ এবং অ্যালকোহল-সমস্যার
কবলিত। এদেশে এসে প্রথম দু’এক বছর এরা প্রচুর টাকা ওড়ায়, ফূর্তি করে।
অত্যন্ত নারীলোলুপ আর নেশাপ্রিয় এরা। দেশে ফিরতে আর চায় না। ভিসার’র মেয়াদ
ফুরিয়ে যায়, তাও তোয়াক্কা করে না। তারপর কারো ব্যবসা লাটে ওঠে তো কারও বা
কোনও কারণে দেশ থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে এদের থাকা-খাওয়ার
সংস্থানটুকুও আর থাকে না।
ওয়ান ব্রডি’র দিকে তাকিয়ে দেখে। সুনন্তা’র কথা শুনতে শুনতে ওর মুখটা
প্রাণহীন, কালো হয়ে উঠছে। যদিও ব্রডি’র বাবার খোঁজ কেউই এখনও দিতে পারছে
না।
‘আপনাদের দেশ তো এদের জন্য কোনো সাহায্যের হাত বাড়ায় না। প্রতি সপ্তাহেই
ভিখিরির মত এরা নিজেদের এমব্যাসিগুলোতে মিনতি জানায়, শেষে একদিন যাওয়া ছেড়ে
দেয়। পাবগুলোর ফেলে দেওয়া খাবার পর্যন্ত এরা কেউ কেউ মুখে তুলতে বাধ্য হয়
কখনও। ছবি আছে বাবার?’
ব্রডি চমকে তাকায় সুনন্তা’র দিকে। তারপর কাঁধের ব্যাগ খুলে একটা ছবি বার
করে টেবিলে রাখে। সেনার উর্দি পরা এক কমবয়েসি অ্যামেরিকান পুরুষ। ঠিক সামনে
বসা ব্রডি’র চেহারার সাথে বেশ মিল। সুনন্তা মৃদু হেসে বলেন, ‘ আমাদের কাছে
সব বড় বড় দাড়িগোঁফ নিয়ে ন্যালাখ্যাপা গোছের লোকেরা আসে, মানে আমরা যাদের
সাহায্য করি। রুটি খাবার পয়সাই ওদের নেই তো দাড়িগোঁফ কাটানোর পয়সা কোথা
থেকে পাবে! তাছাড়া সকলেই ত বুড়ো। এই ছবির সাথে কারো মিল নেই।’
ফেরার পথে ওয়ান ব্রডি’র কাছে জানতে চায় যে তার মন খারাপ কি না। ব্রডি ঘাড়
নেড়ে জানায় ‘না’। ওয়ান’কে সে জানায় যে, খানিক মানবিকতা বোধেই সে এদেশ এসেছে
বাবার খোঁজে। বাবার শোকে নয়। বাবার পুরনো এক বন্ধু ব্রডি’কে জানান যে,
ডেন্টন ইদানিং খুব আর্থিক কষ্টে আছে। ব্রডি ভেবেছিল যে যদি সে কোনোভাবে
তাঁর খোঁজ পায় তাহলে বাকি জীবনটায় খাওয়া-থাকার একটা সংস্থান করে যাবে। তা
আর হলো না।
******
টুকটুকের ভাড়া মিটিয়ে ওয়ান নিজেদের পাড়ার দিকে এগোতে থাকে। কোণের সাদা ছোট
বাড়িটার সামনে লোকটা ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি রাতেই ওয়ান যখন ফেরে তখন ও
দাঁড়িয়ে থাকে। রোজই ওয়ান গটগট করে সামনে দিয়ে এগিয়ে যায় নুক-এর সাথে। আজ
ওয়ান একা। ওয়ান ঘড়ি দেখে, রাত একটা বেজে কুড়ি মিনিট। পুরুষদের নিয়েই
ওয়ান-এর কারবার তবু যেন আড়চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বোধ করে সে।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। লোকটা চীনা। ট্রান্সপোর্টের
ব্যবসা। ওয়ান’কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রথম বউ ছেড়ে চলে গেছে। ওয়ান ঘরে
এসে ব্যাগ ছুঁড়ে দেয় বিছানায়, আর নিজেকেও। নুক আর ওর এক স্কুলের বন্ধুকে
নিয়ে ব্রডি গেছে দু’দিনের জন্য ব্যাংকক বেড়াতে। ঘরে ঢুকেই কেমন ফাঁকা ফাঁকা
লাগছে। সেই ছোটবেলা থেকে নুক থাকে ওয়ানের কাছে। ওয়ান জানে, সে কোনদিনই
নিজে সংসার করতে পারবে না। যদিও ওদের মধ্যে অনেকেই বিয়ে করে নেয় পরে। তবে
নুক’কে একটা অন্য জীবন দেবার চেষ্টা করবে ওয়ান। বড্ড ছেলেমানুষ ও এখনও।
ব্রডি ওয়ান’কেও যেতে বলেছিল, ওয়ান যায়নি। কাজের ক্ষতি হবে। ব্রডি একা
নুক’কে নিয়ে যেতে চায়নি, তাই আরেকটি মেয়ে গেছে ওদের সাথে।
অদ্ভুত এই ব্রডি। ওয়ান এমন পুরুষ কখনও দেখেনি। নুক’কে একেবারেই বাচ্চা
ভাবে। তবে ওয়ান’কে বন্ধু মনে করে। বলেছে, ‘তুমি পশ্চিমীদের মতই দেখতে! তুমি
কি যেতে চাও ও দেশে? আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’ ব্রডি জানে না
পশ্চিমের লোকেরা কিছুতেই ওয়ান’কে পছন্দ করে না।
‘ আমাকে বেছে নেয় ভিয়েতনামি, চীনা, ইন্দোনেশিয়ানরা। ইয়োরোপিয়ান বা আমেরিকানরা নয়।’
ব্রডি বাধা দিয়ে বলে ‘ তুমি আমেরিকা গিয়ে একাজই যে করবে এটা কেন ভাবছ ওয়ান?’
ঘুম আসছে না ওয়ান-এর। কাল একবার ইসরাচোন ফাউন্ডেশনে যেতে হবে। একটা চেক রেখে গেছে ব্রডি ফাউন্ডেশনের অসহায় বাসিন্দাদের জন্যে।
‘ঈশ্বর তোমার মনে শান্তি দিক ব্রডি।’ এই প্রথম একজন আমেরিকানের জন্যে কষ্ট অনুভব করে ওয়ান।