সাদা-কালো গল্প -সৈয়দ মাসুদ রাজা
সাদা-কালো গল্প -সৈয়দ মাসুদ রাজা

প্রায় তিন ঘন্টা কম্পিউটারে কাজ করছি। আর ভাল লাগছে না। মাথাটা টনটন করছে। কড়া লিকারের একটা ‘চা’ খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। অনেকের জরুরী কাজ অসমাপ্ত রেখেই কম্পিউটারের শাট-ডাউন বাটন চেপে বেরিয়ে পড়লাম।

গিট্টুর দোকানে চায়ের শেষ চুমুকটা দেয়ার ঠিক সাথে সাথেই ছেলে শোভন এসে হাজির। ওর কথাটা শুনে মনটা ভারী হয়ে গেল। খুব ভাল ইন্টারভিউ দেয়ার পরও ওর চাকরিটা হলো না। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্য একজনকে দেয়া হয়েছে। ছেলেটা বি.এ. পাশ করে হন্যে হয়ে ঘুরছে একটা চাকরির জন্য।

‘আমি কেন যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলাম না’- এই আক্ষেপটুকু করে চলে গেল শোভন। আমি নিথর হয়ে ওর যৌক্তিক আফসোসের কথাগুলো ভাবছি। মূহুর্তেই মনে পড়ে গেল ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।

১৯৭১ সালের মার্চের শেখ দিকে।  বাবার বি.এ.ডি.সি.'তে চাকরির সুবাদে আমরা শার্শা উপজেলার অফিস সংলগ্ন একটা বাসায় ভাড়া ছিলাম। সম্ভবত তখন আমি ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। ছোট বোনটার বয়স ৪-৫ বছর। ৪ সদস্যের ছোট্ট পরিবার। একদিন গভীর রাতে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে।

বিছানায় বসে চোখ কচ্লাতে কচ্লাতে দেখি বাবা খুব অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি করছেন। নীচু গলায় মা'কে বলছে- তাড়াতাড়ি সব গোছগাছ কইরা নাও। পাঞ্জাবী মিলিটারীরা আইসা পড়ছে। আর এক মূহুর্তও এইখানে থাকা ঠিক হইবো না। বলে আমাদের দু’ভাই-বোনকে বিছানা থেকে নীচে নামিয়ে তিনি সংসারের টুকিটাকি জিনিসপত্র বিছানার উপর ফেলে বিছানার চাঁদরটি দিয়ে একটা বড়সড় পোটলা বানিয়ে বললেন- চলো। অন্ধকারে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

চারপাশটা কেমন যেন থমথমে ভাব। বাবার মাথায় পোটলা, মায়ের কোলে ছোট বোন, আমার দুই হাতে দু’টি এ্যালুমিনিয়ামের পাতিল নিয়ে পিছু পিছু হাঁটছি। সদর রাস্তা দিয়ে না গিয়ে বিভিন্ন ক্ষেতের আইল এর উপর দিয়ে। বাবা মাঝে মাঝে মা'কে বলছেন- বাচ্চা যেন না কাঁন্দে। এভাবে প্রায় আধাঘন্টা হাঁটার পর সামনে গিয়ে বুঝতে পারলাম; আমাদের মত আরো অনেক পরিবার আমাদের সামনেই হাঁটছে। সবারই গন্তব্য প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল।

বি.এ.ডি.সি.’তে মেকানিকের চাকরির সুবাদে বাবার এই অঞ্চলটা পুরোপুরিভাবেই চেনা-জানা ছিল। বি.এ.ডি.সি.’র পাওয়ার পাম্পের অনেক ম্যানেজার এবং ড্রাইভার আছে এসব গ্রামাঞ্চলে। যেতে যেতে হঠাৎ সামনে একটা বিকট শব্দ শোনা গেল। বাবা সাথে সাথে পোটলা ফেলে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। আমি ও মা তখনও দিব্যি দাঁড়িয়ে আছি। পরে জানা গেল, সামনের একজনের সাইকেলের চাকা ফেটে শব্দটা হয়েছে। আবার কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা গ্রামের একটা স্কুলে এসে উপস্থিত হলাম। সেখানে দেখি অনেক লোকের সমাগম। সবার মাঝেই আতঙ্ক। বাবা আমাদের একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে স্কুলের ভেতরে গেলেন। প্রায় অনেকক্ষণ, আমি পাতিল মাটিতে রেখে মায়ের কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। প্রচন্ড ভীড়ে হঠাৎ আমি আলাদা হয়ে হারিয়ে যাই। আবছা অন্ধকারে বাবা-মা কাউকে না দেখতে পেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। কিছুটা সময় পার হবার পর মা'কে খুঁজে পাই। এরপর বাবা এসে বললেন- এখানে জায়গা নেই, সব দখল হয়ে গেছে, চল অন্য কোথাও যেতে হবে। বলে আবারও হাঁটা আরম্ভ করলেন। রাত তখন প্রায় শেষ। ভোরের আজান হচ্ছে। আর হাঁটতে পারছি না। ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে একটা বাড়ির বহিঃবাটিতে এসে দাঁড়ালাম।

বাবা কাকে যেন ডাকলেন, নামটি আজ মনে নেই। সেই ভদ্রলোক নামাজ পড়ার জন্য ওজু করতে উঠেছেন। আমাদের দেখে উনি যথারীতি ভেতরে নিয়ে বেশ ভালোই সমাদর করতে লাগলেন। সবাইকে ডেকে বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদের এখানে কিছুদিন থাকতে হবে জেনে লোকটি বেশ খুশি হলেন বলেই মনে হলো। গ্রামটির নাম ‘নিজামপুর’। অপরিচিত পরিবেশ। খেলার সাথী বলতে সে বাড়িতে আমার বয়সী কেউ নেই। অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনের মত সেখানে আমার দিন কাটছিল। বাবার অফিস এখান থেকে অকে দূর হওয়া এবং পথে মিলিটারীদের কাছে পর পর তিনবার ধৃত হয়ে ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন- এখানে আর থাকবেন না।

অফিসের কাছে তুলনা মূলক একটু গ্রামের মধ্যে যেন পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়, এরকম একটা জাযগায় বাসা ভাড়া নেবেন। খেতে বসে মা'র সাথে বাবার এই কথোপকথনে শিশু হিসেবে আমিও একমত হলাম। প্রায় দু’মাস এই বাড়িতে থাকার পর আমরা চলে এলাম ‘শামলাগাছী’ গ্রামে। জায়গা বেশ ভালো। গ্রামটির পাশেই ‘যশোর−কোলকাতা’ রেলপথ। রেল লাইনের সামান্য দূর দিয়ে সমান্তরালে চলে গেছে ‘যশোর−কোলকাতা’ পাকা রাস্তা। আমরা যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি সেটি রেল লাইনের পাশেই।

বাড়িওয়ালার নামটি এখনও মনে আছে- ‘আবুল চেয়ারম্যান’, ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন ‘ভাইস-চেয়ারম্যান’ ছিলেন তিনি। এলাকার সবাই তাকে খুব পছন্দ করতো। এই গ্রামের আলাদা একটা ইউনিটি ছিল। আর এই ইউনিটির প্রধান রূপকার ছিলেন আবুল চেয়ারম্যান। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে গ্রামবাসী তাকে পিস কমিটির চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন। তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার পরই ঘোষণা দিলেন যে, তিনি বেঁচে থাকতে এই গ্রামে পাকবাহিনী ঢুকতে দেবেন না। অপরদিকে রাতের আঁধারে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করতেন। যার কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতেও কোন পক্ষেরই টার্গেটে পরিণত হননি তিনি। সময়টা সম্ভবত আগস্ট এর মাঝামাঝি হবে। রেল লাইনের উপর আমরা ৫/৭ জনের একটা দল গভীর আনন্দে খেলাধুলা করছি। হঠাৎ দেখি পাকবাহিনীর একটা গাড়ি পাকা রাস্তা দিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে লম্বা মতো গোফওয়ালা একজন মিলিটারী নেমে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। কাছাকাছি আসতেই তাকিয়ে দেখি আমার পাশে কেউ নেই। আমি একা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। দৌড় দিতে ইচ্ছে করল না। কারণ আমি ইতোপূর্বে কয়েকদিন দেখেছি, মিলিটারীরা আমার খুব কাছ থেকে ‘কামলা’ শ্রেণির অনেক লোককে জোর করে ধরে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যেতে, আমি ছোট মানুষ বিধায় আমাকে কিছু বলেনি। পরে জানতে পেরেছি- লোকগুলোকে দিয়ে মিলিটারীরা বাঙ্কার খোড়াতো। কাজে ফাঁকি দিলে মারধর করতো, দিন শেষে সামান্য মাইনে দিয়ে তাদেরকে বিদায়ও করতো। লোকটা যতই আমার কাছাকাছি আসছে, আমি ততই একটু একটু ভয় পাচ্ছি।

ভাবছি- আমার আশেপাশে তো কেউ নেই, তাহলে কি লোকটা আমাকেই ধরতে আসছে? লোকটা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে দূর থেকে হাত উুঁচিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। লোকটা একটু বেশী লম্বা। মুখে বেশ মোটা গোফ। ধবধবে ফর্শা। লোকটা সোজা এসে আমাকে ধরে দু’গালে চুমু খেতে লাগলেন। ততক্ষণে আমার হার্টবীট আরো বেড়ে গেছে। তিনি আমাকে স্বাভাবিক করার জন্য নাম জিজ্ঞেস করলেন। ভয়ে ভয়ে বললাম- নজরুল। এরপর আমাকে কোলে তুলে নিলেন। দু’পা এগোতেই দেখি মা গগন বিদারী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ততক্ষণে চারপাশে তাকিয়ে দেখি অদূরে অনেক মানুষ লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে ধৃত হওয়ার দৃশ্য দেখছে। মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সামনে এসে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে তার কোল থেকে আমাকে নামিয়ে মায়ের সাথে কথা বললেন। মা তার সবগুলো অর্থ বুঝতে না পারলেও অন্তত এটুকু বুঝেছে যে, লোকটা তার ছেলের কোন ক্ষতি করবে না।

পৃথিবীতে বোধহয় মা জাতীয় প্রাণীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব ভালো কাজ করে, বিশেষ করে সন্তানের ক্ষেত্রে। সন্তানের মঙ্গল-অমঙ্গল টেলিপ্যাথি স্রষ্টা মা-সন্তানের মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবীতে যার কোন ব্যাখ্যা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। সৈনিকটি মা’কে আশ্বস্ত করে আমাকে নিয়ে চললেন। আমি যেতে যেতে দেখি মা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। গাড়িতে উঠে দেখি প্রায় ১২/১৪ জন সৈনিক। আমাকে তাদের সাথেই বসালো।

গাড়ি ছেড়ে দিতেই দেখি অনেকগুলো উৎসুক দৃষ্টি আমার উপর। তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন কথা বলাবলি করছে আর হাসা হাসি করছে। তাদের এ আচরণে এই প্রথম আমি ভেতরে বসেই কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্না থামাতে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। কেউ গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে থামাতে চেষ্টা করছে। আমাকে যে লোকটা ধরে এনেছে অন্যদের তুলনায় তার বয়স বেশি হবে বলেই মনে হলো। সে বার বারই আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে দু’গালে চুমু খাচ্ছে। আর বারবারই ‘মেরা লাড়কা-মেরা লাড়কা’ বলছে। এক সময় গাড়িটা থামে। সবার সাথে আমাকেও নামায়। কিছু পথ কোলে নিয়ে আবার কিছু পথ হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে আমাকে তাদের ক্যাম্পে ঢুকালো। তার নামটা মনে না থাকায় তাকে ‘লম্বু কাকু’ বলে গল্পে সম্বোধন করি। মাটির নিচে এত সুন্দর করে ঘর হতে পারে তা আমার ধারনা ছিল না। বাঙ্কারের একটা কক্ষে আমাকে বসাল। মাটিতে ত্রিপালের উপর বিছানা পাতা। তার উপর দুইটা কম্বল ভাজ করে রাখা। এক কোণায় মশারিটা জড়ো করা। সামনে একটা টুল। তার উপর একটা এ্যালুমিনিয়ামের জগ। সিথানের দিকে থালা-গ্লাস উপুড় করে রাখা। একটা রুমেই দুইটা বিছানা আড়াআড়িভাবে পাতা। আমাকে বসতে বলে লম্বু কাকু পাশের জনকে ইশারা দিতেই একটু পর আমার সামনে রুটি-মাংসের খাবার এনে দিল।

রুটিটা বেশ পুরু। আমি খাচ্ছি, গভীর আনন্দে আমার খাওয়া দেখছে। তার চোখের চাহনী এবং মুখের তৃপ্তির ছাপ দেখে আমার ভয়টা তখন অনেকাংশেই দূর হয়েছে। খাবার পর লম্বু কাকু আমাকে নিয়ে গেলেন তার রুম থেকে চার-পাঁচটা রুমের পরের একটা রুমে। সেখানে ঢুকেই বসে থাকা লোকটিকে স্যালুট দিল। তার পরনেও খাকি পোশাক। রুমটা বেশ সাজানো গোছানো। মুহর্মুহু স্যার স্যার শব্দে বুঝতে পারলাম; লোকটি হয়তো তাদের বস্। লম্বু কাকু তার সাথে কথা বলছে। বুঝতে পারলাম; আলোচনার বিষয়বস্তু আমি। অফিসারটা কাকুর কথা শুনছে আর মাঝে মাঝে খুব অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। তাদের আলোচনায় লম্বু কাকু কখনো খুব বিনয়ের সাথে আবার কখনো হালকা অভিমানের সুরে কথা বলছেন। তখন বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে মাদরাসায় ‘উর্দ্দূ’ পড়ার সুবাদে সেই সময়ে তাদের কথোপকথনের মর্ম অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। যার অর্থ ছিল- বস্ বলছিলেন ‘সামরিক ব্যারাকে বেসামরিক লোককে আনার নিয়ম নেই, কেন সে একজনকে এখানে নিয়ে এসেছে, হোক না সে বাচ্চা’।

প্রতিউত্তরে লম্বু কাকু বলেছিলেন যে, সে অনেকদিন বাড়ি যায় না, এই যুদ্ধের সময় ছুটিও নেই। বাড়িতে আমার বয়সী তার একটা ছেলে আছে, আমাকে দেখে তার ছেলের কথা মনে হওয়ায় অনেকটা আবেগেই সে এখানে নিয়ে এসেছে। এভাবেই মেজর সাহেবকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল লম্বু কাকু। ব্যস, এরপর থেকেই আমি এই ক্যাম্পে একজন নিয়মিত সদস্য হয়ে গেলাম। লম্বু কাকু আমাকে বিভিন্ন জিনিস ঘুরে ঘুরে দেখান। বিস্তর জায়গা পেয়ে আমি খেলাধুলা করতে থাকি। পড়ন্ত বিকেলে কাকু আমাকে নিয়ে চললেন আমার বাড়ি অভিমুখে। রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে আসছি। বাড়ির কাছে আসতেই দেখি- অনেক লোক দাঁড়ানো। আবুল চেয়ারম্যান তার বহিঃবাটিতে দাঁড়ানো। চেয়ারম্যানের সাথে অনেক লোকজন। দূর থেকেই শুনতে পারছিলাম বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন রকম আক্রমণাত্মক কথা।

কাকু বিষয়টা আঁচ করতে পেরে দূর থেকেই হেসে হেসে আবুল চেয়ারম্যানকে হাত ইশারায় শান্ত থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন। কাকু গিয়ে আবুল চেয়ারম্যানের সাথে হাত মেলালেন এবং তাকে বিস্তারিত খুলে বললেন।

তাকিয়ে দেখি চারপাশে অনেক লোক গোল হয়ে বিষয়টি দেখছে। চলে যাওয়ার সময় কাকু চেয়ারম্যানকে বললেন যে, আমাকে মাঝে-মধ্যে নিজ দায়িত্বে নিয়ে যাবেন এবং পৌছে দেবেন। চিন্তার কোন কারণ নেই এবং চেয়ারম্যান যেন আমার বাবা-মা'কে বিষয়টি খুলে বলেন, এই কথাটি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেদিনের মত বিদায় নিলেন। এরপর থেকে প্রায়ই সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসতাম। কখনো কাকু না আসলেও আমি একাই যাওয়া আসা করতে থাকি। অতি অল্প দিনের মধ্যেই ঐ জায়গাটা আমার একটা প্রিয় জায়গায় পরিণত হলো।

প্রিয় জায়গায় পরিণত হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো সেখাবে অবাধে খেলাধুলা করা এবং রুটি-মাংস ইচ্ছেমত খেতে পাওয়া। আমি বাবার সাথেই ঘুমাই। মাঝে-মধ্যেই গুলির আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে বাবার সাথে কথা বলছি। বাবা আমাকে বিভিন্ন রকম উপদেশ দিচ্ছেন। এর মধ্যে বাইরে থেকে নিচু স্বরে কারা যেন বাবাকে ডাকছে। বাবা দরজা খুলে দিলেন। ৩/৪ জন লোক ঢুকলো। পরনে লুঙ্গি, কোমরে গামছা বাঁধা। এলাকারই ছেলে। তাদের আলোচনায় বুঝতে পারলাম; তারা মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।

বাবা সানন্দে রাজী হয়ে আমাকে বললেন- যাও, ওদের সাথে, তোমাকে ওরা আবার বাসায় দিয়ে যাবে, কোন চিন্তা নেই, যাও। মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি আমাকে বিভিন্ন ঝোপ-জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারে তারা দিব্যি এগিয়ে চলেছে। একটু পর একটা খালের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে সবাই মালকোচা মারল। আমাকে তাদের একজন কাঁধে তুললেন। খালটি পার হতে হতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি রাতে কি খেয়েছি, এখন ভয় পাচ্ছি কি না ইত্যাদি। আমি অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলাম। খালটি পার হয়ে অনতিদূরেই একটা খুপড়ি ঘরের ভেতর ঢুকলো। ঘরে কিছুই নেই। ইতঃস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খড়কুটো। সেখানে আমাকে বসতে বলে একজন বাইরে গেলেন। ঘরে আলো বলতে একটা হারিকেন নিবু নিবুভাবে জ্বালানো। অস্পষ্ট আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাদের চোখেমুখে কেমন জানি অস্থিরতা। এর মধ্যে বাইরে থেকে একজন লোক এসে আমার সামনে বসলো। বুঝতে পারলাম উনি ‘দলনেতা’। উনি বসতে বসতে আমার চিবুকে হাত বুলিয়ে আদর করলেন।

মুঠোভর্তি চকলেট দিয়ে বললেন- আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তোমাকে আমাদের খুব প্রয়োজন। তুমি ছোট হলেও আমাদের কাছে তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন একজন বড় মানুষের সাথে আলাপচারিতা হচ্ছে। উনি আমার কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলেন যে, পাক বাহিনীর ক্যাম্পে আমি কি কি দেখি, রেল লাইন থেকে কোন দিকে কয়টা পদক্ষেপ দিয়ে তারপর বাংকার, ঘরগুলো কেমন, কোন জায়গায় অস্ত্র রাখে, বড় অফিসারটা কোথায় বসে, কতজন লোককে ওরা আটকে রেখেছে, তাদের কোথায় রেখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার খেয়ালে যতটা ছিল তা বললাম। এরপর উনি বললেন- এর পরে ওখানে গিয়ে যেন আরো ভালভাবে বিষয়গুলো খেয়াল করি। রেল লাইন থেকে কোন দিকে কয়টা পদক্ষেপ দিয়ে ক্যাম্পের মূল গেট, মূলগেট থেকে বাংকারে যেতে কয়টা পদক্ষেপ ইত্যাদি মনে মনে হিসাব রাখতে বললেন। প্রায় এক ঘন্টার মত ওখানে ছিলাম। আমাকে বাড়ি পৌছে দিতে আসার সময় রাস্তায় বার বারই স্মরণ করিয়ে দিলেন- আমি যে এখানে এসেছি, তা যেন মনের ভুলেও ক্যাম্পে কারো কাছে না বলি। বাসায় পৌছতে পৌছতে অনেক রাত। লোকটি যাবার সময় বাবার হাত ধরে বললেন- আমাকে তারা প্রায়ই তাদের কাছে নিয়ে যাবেন। বাবা একবাক্যে রাজি হলেন। শুয়ে শুয়ে বাবা আমাকে এই যুদ্ধ, স্বাধীনতা, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন-কষ্ট-ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা বললেন। তাদেরকে আমি যেন আমার সাধ্যমত খবর দিয়ে সাহায্য করি, তাদের কথা যেন পাকবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে না বলি ইত্যাদি বিভিন্ন উপদেশ শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।

মা প্রতিবারই পাকবাহিনীর ক্যাম্পে যাচ্ছি শুনে আঙ্গিনায় এসে সূরা-কালাম পড়ে আমার বুকে ফু দিয়ে বিদায় দেন। মায়ের আশির্বাদের এই ‘ফু’ টুকু নিয়ে সেদিনও যাচ্ছি। আজ ঐ ছোট বয়সেও নিজেকে অনেকটা দায়িত্ববান দায়িত্ববান মনে হচ্ছে। রেল লাইন থেকে ক্যাম্পে যাবার রাস্তায় নেমে মনে মনে পদক্ষেপের হিসাব করছি। উত্তরে কত পা, দক্ষিণে কত, এরপর আবার উত্তরে কত পা ইত্যাদি হিসাবটা মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়লাম। পাকবাহিনীর এই ক্যাম্পটাকে আজ অন্য দিনের থেকে একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে। প্রায় দিনই সেখানে যাই, তবে আজকে যেতে যেতে প্রত্যেকটি বিষয়ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। আমাকে ক্যাম্পে সবাই আদর করে। আমি সেখানে যে কোন সময় যে কোন জায়গায় যেতে পারি। আমার উপস্থিতি সকলকেই আনন্দ দেয়। কেউ আমার গাল ধরে টান দেয়, কেউবা আবার বিভিন্ন রকম ইয়ার্কী করে। আমি মাঝে মাঝে ওদের বিভিন্ন কলাকৌশল অনুকরণ করি, তা দেখে সবাই খুব মজা করে। আমি ভেতরে ঢোকার কিছুক্ষণ পর লম্বু কাকুসহ ১০/১২ জনের একটি দল এলো। কারো হাতে মুরগী, কারো কাছে মাছ। লম্বু কাকু দেখলাম, একটা খাসি টানতে টানতে আনছেন।

আমাকে দেখেই ডাকলেন- বেটা, এধার আও! খাসিটা যারই হোক না কেন, ওটা যে তার মালিকের আদরের ছিল সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়। আমি কাকুকে বললাম, কোথা থেকে আনলেন? কাকু প্রশ্নটা আমলে না নিয়ে একগাল হেসে বললেন- দেখতেহি পছন্দ আ’গায়া, ব্যস্ লে-আয়া। আমি মনে মনে খাশি হারা মালিকের দুঃখ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। ক্যাম্পের পূর্বদিকের একটা অংশে লম্বু কাকু কখনো আমাকে নিয়ে যায়নি। সেখান থেকে মাঝে-মধ্যেই আমি বিভিন্ন রকম অস্পষ্ট আওয়াজ শুনি। দূর থেকেই বিভিন্ন রকম কাতরানোর শব্দ মাঝে-মধ্যে কানে আসে। আজ হঠাৎ মনে হলো- ঐ ঘরগুলোর মধ্যে কি আছে, দেখা দরকার। কিন্তু ঐ দিকটায় যাই কিভাবে তাই ভাবছি। এক পর্যায়ে বুদ্ধি করলাম; ডাংগুল্লি খেলবো। আমি ডাইনিংয়ের চুলার পাড়ে স্তুপ করে রাখা খড়ির মাচা থেকে একটা লাঠি আর ছোট একটি কাঠের গুল্লি নিয়ে ডাংগুলি খেলতে শুরু করলাম। ইচ্ছে করেই ডাং দিয়ে গুল্লিটা ঐদিকে পাঠাই, কিন্তু খুব বেশি দূর গুল্লিটা যায় না। তাই আস্তে আস্তে আমার শক্তি বাড়াতে লাগলাম। এক পর্যায়ে খুব জোরে মারলে গুল্লিটা গিয়ে ঐ ঘরগুলোর কাছাকাছি পড়ে। আমি দৌড়ে সেদিকে যাই। গুল্লিটা কুড়িয়ে আনার সময় হঠাৎ একটা মেয়েলী কন্ঠের আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসে -- নজরুল, এই নজরুল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দের উৎস খুঁজছি, পাচ্ছি না। আবারও ডাকছে। তাকিয়ে দেখি একটা জানালার কাঠের পাল্লা নড়ে উঠলো।

আমার দৃষ্টিটা ঐদিকে পড়তেই মনে হলো- শব্দটা বোধহয় ওখান থেকেই আসছে। এগিয়ে গেলাম। দেখি- বিউটি ফুফু। আমরা যে বাড়িতে থাকি তার পাশেই বিউটি ফুফুদের বাড়ি, দেখতে খুবই সুন্দরী, আমি তাকে ফুফু বলেই ডাকতাম। তারা দুই বোন- বিউটি, পারুল। দু’জনকেই পাকবাহিনীরা এই ক্যাম্পে ধরে এনেছে। দু’জনেই অবিবাহিত। সম্ভবতঃ তারা কলেজে পড়তো। চুলগুলো এলোমেলো, ওড়না জাতীয় একটি কাপড় তাদের বুকের ওপর পেচানো। জানালার একেবারে কাছে গিয়ে দেখি- আরও ১০/১২ জন মেয়ে। একবার দেখে দ্বিতীয়বার আর তাকাতে পারলাম না। ফুফু আমাকে দেখে কেঁদেই ফেললেন। কাঁদো-কাঁদো কন্ঠে বললেন- নজরুল, বাড়িতে গিয়ে তোমার দাদা-দাদিকে বলো, আমরা এখনো বেঁচে আছি, বলে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। বিউটি ফুফুকে বোঝানোর কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, এ ধরনের একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো।

তৎক্ষণাৎ আমি দৌড়ে চলে এলাম লম্বু কাকুর কাছে। কাকুকে গিয়ে বললাম- আমার ফুফুদেরকে আটকে রেখেছেন কেনো? বাড়িতে দাদা-দাদি ওদের জন্য কাঁদছেন। ওদেরকে ছেড়ে দিননা কাকু। বারবারই তার সামনে ঘ্যানঘ্যান করছি। লম্বু কাকু নিশ্চুপ। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আমাকে নিয়ে মেজর সাহেবের রুমের দিকে গেলেন। রুমের সামনে গিয়ে বললেন- তুম মেজর সাবকো বোলাও, হাম বাদমে আতি হো। আমি তৎক্ষণাৎ মেজরের রুমে ঢুকে মেজরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলতে লাগলাম। মেজর আমার কথা ঠিক বুঝতে না পারায় লম্বু কাকুকে ডাকলেন। লম্বু কাকু আমার দুই ফুফুকে আটকে রাখার বিষয়টি মেজরকে বললে, মেজর ঠিক আন্দাজ করতে পারছিলেন না- কোন মেয়ে দু'টো। ওদের কথার মাঝে মনে হচ্ছিল, হয়তো ছাড়বে না।

লম্বু কাকুও ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করছেন। এক পর্যায়ে আমি মেজরের পায়ে পড়ে কাঁন্না শুরু করলাম। মেজর আমাকে থামিয়ে কাকুকে বললেন- ইয়ে লাড়কা যো লাড়কীকি বারে মে ক্যাহতা হ্যায়, কিয়া ম্যায়নে ইস্তেমাল কিয়া? কাকু বললেন- বিলকুল স্যার, আলবৎ হো গিয়া। মেজর চুপচাপ। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেজরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, ‘হ্যা’ সূচক একটা শব্দ শোনার অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ পর মেজর কাকুকে বললেন---- ঠিক হ্যায়, উস দোনোকো ছোড় দো। আমি আনন্দে আত্মহারা। মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালাম মেজরকে, সেই সাথে আল্লাহ পাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া। লম্বু কাকুর দেয়া দু'জোড়া পুরোনো স্যালোয়ার-কামিজ নিয়ে জানালা দিয়ে বিউটি ফুফুকে দিলাম। ওগুলো পরে ওরা বের হলো।

৪/৫ জন পাক সেনা এসে দু’জনের চোখ বেঁধে বললো- চলো। তখন বিকেল ৪/৫ টার মতে হবে। পাক সেনাসহ আমরা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে রেল লাইনে উঠলাম। কিছু দূর আসার পর ওরা ফুফুদের চোখ খুলে দিয়ে আমাকে বললো- যাও বাচ্চো, ইনকো লে যাও। রেললাইন ধরে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় আমরা তিনজন হাঁটছি। ফাঁকে ফাঁকে ফুফুদের মুখের দিকে তাকাই। তাদের অবয়বে সেই সুন্দর ভাবটা নেই। মলিন মুখে ভাবলেশহীনভাবে হাঁটছে। নির্ঘুম রাতের চি‎‎হ্ন তাদের অদ্ভুত সুন্দর চোখগুলোকে ম্লান করে দিয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো বাতাসে উড়ছে। অধিক শোকে তারা অনেকটাই পাথর। যেন দু’টি জীবন্ত লাশের সাথে আমি হেঁটে যাচ্ছি। তাদের সেই নিঃস্ব, রিক্ত, অসহায় মুখোচ্ছবি আমার হৃদয় এখনও বিচলিত করে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছে চলে এসেছি। সামনে তাকিয়ে দেখি- অনেক মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এক পর্যায়ে তারা দৌড়ে এসে আমাদেরকে ঘিরে ধরলো। অনেকেই কোলে নিয়ে আমাকে চুমু খেতে লাগলো। মনে হলো- আমি যেন পুরো পৃথিবী জয় করে এসেছি। সবার মধ্যমনি আমি। আবুল চেয়ারম্যান আমাকে তার কোলে বসিয়ে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।

খবর শুনে মা দৌড়ে আসে। সে এক আনন্দ উৎসব, যা বর্ণনাতীত। বিভিন্ন জনের আশির্বাদে সিক্ত হয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলাম। রাতে খেতে বসে বাবা-মা বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করছে, আমি কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করলাম। মা বলছেন- ওখানে আর যাওয়ার দরকার নেই। মার কথা শুনে বাবা একটা কথা বলেছিলেন, যা আজও মনে আছে- ‘অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ হয়’? একদিন গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা এলো, আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ওদের সাথে নিয়ে চললো। যেতে যেতে আজ অন্য একটা গ্রামের ভেতর নিয়ে গেল। ঘুপড়ির মতো একটা একচালা ঘরের ভেতর ঢুকলাম। কিছুক্ষণ পর কমান্ডার আঙ্কেল একটা সাদা কাগজ ও পেন্সিল এনে আমার সামনে দিল। সাদা কাগজে উনি রেল লাইনের দাগ দিয়ে আমার সামনে দিয়ে বললো- এবার তুমি ক্যাম্পের ম্যাপটা এঁকে দেখানোর চেষ্টা কর তো। কোনদিকে কত কত পদক্ষেপের পর কোন কোন জায়গা। আমি মনে মনে হিসাব করে এঁকে দিলাম।

তারা অত্যন্ত খুশি হয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে আমাকে বাড়ি পৌছে দিলেন। ভোর রাতে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মুহর্মুহু গুলির শব্দ। একটু পর সব নিরব। ভোরের আজানের পরপরই আনন্দ উচ্ছাস। রাস্তায় মিছিল বের হয়েছে। মিছিলের ভেতর আয়নাল পাগলা চিৎকার করে বলছে- নাভারণ ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেছে। তখন স্বাধীনতার মর্মটা আমি বুঝতে না পারলেও আমাদের পক্ষের যোদ্ধারা যে যুদ্ধ জয় করেছে, সেটা ভেবেই খুব ভাল লেগেছিল। সকালে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছি। দূর থেকে দেখি অনেক লোকজন। আরও কিছুটা দূরে ৪/৫টা পাক সেনার মৃত দেহ ঘিরে লোকজন উল্লাস করছে।

কে জানে, হয়তো লম্বু কাকুর মৃত দেহটাও সেখানে পড়ে থাকতে পারে ভেবে আর এগোতে ইচ্ছে করলো না। সম্ভবত নভেম্বরের শেষ দিকে একদিন সকালে বাইরে লোকজনের হাউকাউয়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকিয়ে দেখি ঘরে কেউ নেই। বিছানা থেকে উঠে বাইরে বেরোলাম। দেখি- বিভিন্ন বয়সী অনেক লোকজন বিউটি ফুফুদের বহিঃবাটিতে জটলা পাকানো। রাস্তায় যেতে যেতেই অনেকে আবার আফসোসও করছে।

একটু এগিয়ে গিয়ে শুনি- বিউটি ও পারুল ফুফু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাই। দৌড়ে তাদের বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখি- কলের পাড়ে আম গাছের ডালে দু’টি দেহ পাশাপাশি ঝুলছে। তাদের ঝুলন্ত লাশদুটো দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। বারবারই মনে হচ্ছে- কেন আমি ওদেরকে ছাড়িয়ে আনতে গেলাম? না আনলে হয়তো তারা আজও বেঁচে থাকতো। তখন বুঝতে পারতাম না যে, এ আত্মহত্যাটা সেই বন্দী দশায় বেঁচে থাকার চেয়েও অনেক মধুর ছিল। ভাবতে ভাবতে কখন যে আমার দু'চোখ বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ছে বুঝতেও পারিনি। গিট্টুর ডাকে সম্বিত ফিরে তাকিয়ে দেখি- শোভন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। পরম মমতায় কপোলে গড়িয়ে পড়া অশ্র“ মুছে দিতে দিতে - বাবা তুমি কাঁদছো? আমি ওর প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই চা-এর দোকান থেকে বেরোলাম। আমার হাতে এখনও অনেক কাজ বাকি। -------------------------------------------------------------------------------------------------------------- স্বাধীনতার আজ ৪৪ বছর অতিক্রান্ত। এই দীর্ঘ সময়েও কি একটি পূর্ণাঙ্গ ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয়েছে? মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অবদান কি অস্বীকার করতে পারবে এ দেশ? আমরা ক্ষুদে যোদ্ধারা যারা বেঁচে আছি, আমরা এখন ষাটের কোঠায়। আমাদের সন্তানরা যখন আমাদের কাছে সেদিনের বীরত্বের কথা শুনে প্রশ্ন করে-- আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে পারি না কেন বাবা? আমার কাছে এ প্রশ্নের কোন উত্তর আছে কি?


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান