সামাজিক উন্নয়নে সঙ্গীত - সুমন হাফিজ
সামাজিক উন্নয়নে সঙ্গীত - সুমন হাফিজ

আমাদের বিনোদন মাধ্যমগুলির মধ্যে সঙ্গীত সেরা ও শ্রেষ্ঠতম অবস্থানে একথা প্রমানিত ও সর্বজন স্বীকৃত।

অনেকগুলি কারনের মধ্যে প্রধান কারন হলো- সঙ্গীত নেই এমন দেশ পৃথিবীতে নেই এবং সঙ্গীত ভালবাসেনা এমন মানুষের সংখ্যা খুবই নগন্য।

এ পর্যায়ে সঙ্গীতের ব্যাপকতা ও গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ পর্যায়ক্রমে আলোচনা করব। শাস্ত্রমতে সুর, গান (গীত) ও সঙ্গীত কিন্তু এক কথা নয়। এগুলো একটি অপরটির পরিপূরক। সংঙ্গা হিসাবে আমরা জানি- গীত, বাদ্য ও নৃত্য এই তিনটি স্বতন্ত্র কলা (art) বা বিদ্যার একত্র সমাবেশই সঙ্গীত। এই প্রসঙ্গে গুনীজনদের মন্তব্যগুলো হলো, পন্ডিত অহবল রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ “ সঙ্গীত পারিজাত” -এ সঙ্গীত সম্পর্কে বলা হয়- গীত, বাদ্য ও নৃত্য এই তিনটির সম্মিলিত পরিবেশকেই সঙ্গীত বলে। এর মধ্যে প্রধান হলো কণ্ঠ সঙ্গীত। আবার বৃহদ্দেশী গ্রন্থে পাওয়া যায়- “ গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং তথা সঙ্গীতমুচ্যতে ” এখানেও অনুরূপভাবে বলা হয়েছে গীত, বাদ্য ও নৃত্যকে একত্রে সঙ্গীত বলে। ভারতের প্রাচীন পরম্পরানুযায়ী সঙ্গীত শব্দের অর্থ সম্মিলিতভাবে গীত, বাদ্য ও নৃত্য। বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক ও নাট্যকার SHAKESPEAREবলেন,

 “A PERSON WHO HATH NO MUSIC IN HIM NOR IS MOVEDBY THE CONCORD OF SWEET SOUND IS FIT FOR TREASON, STRATAGEMS AND SPOILS ”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “গুনগুন করিয়া যখনই একটা লাইন লিখিলাম, তখনই দেখিলাম, সুর যে যায়গায় কথাটা উড়াইয়া লইয়া গেল, কথা আপনি সেখানে পায়ে হাটিয়া গিয়া পৌঁছাতে পারিতনা। ” অধ্যাপক HUNT বলেন,

 “MUSIC IS THE MEDICINE OF BROKEN HEART ”

” বিজ্ঞানী CARLYLE বলেছেন, 

  “ MUSIC IS THE SPEECH OF THE ANJELS ”

মনিষী SHOPENHEUR বলেছেন,

“ MUSIC IS THE FINEST OF THE FINE ART ”  

উপরের তথ্যগুলি থেকে এ কথাই সত্যি যে, THERE IS NOTHING SWEETER THAN MUSIC অর্থাৎ সঙ্গীতের চেয়ে আর মধুর কিছুই নাই। সঙ্গীত সৃষ্টির ইতিহাস আমাদের করে রেখেছে কুয়াশাছন্ন। এর সঠিক জš§কাল আজও অজানা। মানুষ সৃষ্টির সেই আদিম যুগ থেকেই এর জন্ম।

প্রথমত: মানুষ আকার ইঙ্গিতে ভাবের আদান প্রদান করত। কখনও কখনও তা সুরের মাধ্যমে প্রকাশ পেত। প্রাগৌতিহাসিক যুগ থেকেই আনন্দ, উৎসব, শোক, দু:খ, পূজা ও পার্বনে নানান লোকাচার অনুষ্ঠানাদিতে সঙ্গীতের ব্যপ্তি লক্ষ্যনীয়। সঙ্গীত ইতিহাসের কালচক্রে সিন্ধু সভ্যতা, বৈদিক যুগ, প্রাক বৈদিক যুগ, প্রাক মুসলিম যুগ, সুলতানী আমল পেরিয়ে বর্তমানে আধুনিক যুগে এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গীতের ব্যপ্তি সর্বস্থানে, সর্বস্তরে। ভাষা ও সুরের সংমিশ্রনে সঙ্গীত মানুষকে অলৌকিক জগতের সন্ধান দিতে পারে। সঙ্গীতের মহৎ গুন হলো এটি মনের গ্লানী দূর করে এনে দেয় আশা ও উদ্দীপনা। প্রকৃতপক্ষে, সঙ্গীতের সঙ্গে মনের আতিœক যোগ আছে। মনরঞ্জনের ক্ষেত্রে সঙ্গীত মানুষকে রূপে, রসে ও ছন্দে আবেসপুষ্ট করে তোলে। তবে, সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই যেন সে সমাজের বয়সের সাথে বাড়তে থাকে। সমাজের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তীত হতে থাকে। সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারে ও তার উপর সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়। সঙ্গীত কলার মধ্যে অন্তর্নিহীত আছে পারিপার্শ্বিক অনেক ধরনের কলার প্রতিক্রিয়া, আর সেই প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় চিন্তা, চিন্তা থেকেই হয় দর্শন, দর্শনে থাকে ভাব ও রস।

সঙ্গীতের সৃষ্টিই হলো প্রকৃতিজাত ভাব ও রস থেকে। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে প্রীতি, প্রণয় ও ভালবাসা সাধনের যত উপায় আছে সঙ্গীত তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারন, সঙ্গীত সর্বজনের উপযোগী। সঙ্গীত কর্মীর অবসর বিনোদন, বিলাসীর বিলাসোপকরণ, সাধকের শ্রেষ্ঠ সাধন, ভাবুকের ভাব প্রস্রবণ এবং যোগীর প্রাণায়াম ও বৈরাগীর চলার পথের পাথেও সহ ক্ষুদ্র ও ক্ষণভঙ্গুর মায়ামোহ হতে অবিনশ্বর অনাবিল আনন্দ। যার যতটুকু অধিকার সে ততটুকু আনন্দ ও সুখ লাভ করে থাকে এই সঙ্গীতের মাধ্যমে।

সঙ্গীতের মোহিনী শক্তির তুলনা নাই। জাতী, কাল, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল মানুষই সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়। সুর ও ছন্দে মুগ্ধ হয়না এমন কেউ নেই। শুধু মানুষই নয়, বনের পশুপাখিও সঙ্গীতের প্রভাবমুক্ত নয়। সঙ্গীতের সমাদর তাই সর্বকালে, সর্বদেশে। সঙ্গীতকে আতœায় পৌঁছানোর জন্য সহায়ক হিসাবে প্রয়োজন হয় ভক্তি, সাধনা ও একাগ্রতা। কেননা, যে সঙ্গীত যত গভীরে পৌঁছেছে সে সঙ্গীতেই দেখা গেছে এদের (ভক্তি, সাধনা, একাগ্রতা) আবির্ভাব, যার উপমা স্বরূপ অনেক সঙ্গীতজ্ঞের পদচারনা হয়েছে আমাদের সঙ্গীতের ইতিহাসে। সঙ্গীতে ওস্তাদীর চেয়ে বড় জিনিস হলো দরদ। এটি কোন বাইরের জিনিস নয়, একদম ভেতরের জিনিস। যার জন্ম হচ্ছে ভক্তি, ভাব-রস ও সাধনা থেকে যা স্বাভাবিকভাবেই অদৃশ্যমান প্রকৃতি থেকে সাধকরা আরহণ করেন। আর সঙ্গীত রসিকগণ সাধকদের কাছ থেকে তা চয়ন করেন। যে কোন শিক্ষাই মানুষকে প্রণালীবদ্ধ করে। এর মধ্যে সঙ্গীত শিক্ষার বিশেষত্ব আছে।

সঙ্গীতের শিক্ষা মানে তাল-লয়ের মাধ্যমে সঙ্গীত শিক্ষা। বিচিত্র এই বিচ্ছিন্ন জগতে একটি ঐক্যবোধ খোঁজা বা সুরের দিশা পাওয়া। এ জীবনের জীবনত্ব রূপে-রসে-গন্ধে ফুটে ওঠার প্রধান চাবিকাঠি। এই রূপ, রস ও ভঙ্গির ভিতর তালের সাহায্যে সুরের জগতের সন্ধানই সঙ্গীতের উপজিব্য। আমাদের প্রয়োজনীয় কাজ কর্ম, স্বার্থের দ্বন্দ, সংঘাত ইত্যাদির মধ্যে অনুক্ষণ নিমজ্জনে জীবনের যে কল্যাণী রূপ ফুটে ওঠেনা, সেই অসম্পূর্ণ জীবনকে সম্পূর্ণ করতেই সঙ্গীত শিক্ষার প্রয়োজন। সঙ্গীত সমাজের বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে আছে। এটি সমাজের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত। মানুষের সুখে ও দু:খে সঙ্গীত। আবেগ প্রকাশের সহজ মাধ্যম সঙ্গীত। সঙ্গীত শক্তিরও উৎস। “গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে, গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা ”। সমাজে বিত্ত শ্রেণীর মানুষ থেকে শুরু করে নিচু শ্রেণীর মানুষ পর্যন্ত সঙ্গীতের পিপাসায় প্লাবিত। প্রকৃতির হাতে চির অসহায় মানুষেরই সৃষ্ট এই একটি কলা (সঙ্গীত)। আকাশ যখন নিষ্করুন তখন সঙ্গীত সহযোগে মাদল বাজিয়ে নৃত্য করেছে মানুষ। দূর্ভিক্ষ, মহামারী এবং প্রাকৃতিক শক্তির অর্চনার সহায় এই সঙ্গীত। সভ্যতার উষাকাল হতে উৎসবে, লোকাচারে ও সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে সঙ্গীতেরও পরিবর্তন ঘটেছে। সভ্যতা চিনবার সহজ উপায় হল সঙ্গীত। সামাজিক উৎসবেও এর পরিবর্তন হয়েছে- বিজয়োৎসবের সঙ্গীত, বিবাহের সঙ্গীত, নবান্নের সঙ্গীত ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপের প্রয়োজনে নতুন সুর ও আকৃতির আগমন ঘটায়। পরাধীনতার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে, তৎকালনি সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে সকল উদ্দীপনামূলক গান রচনা করেন তার অনুপ্রেরণায় মানুষ জাগ্রত হয় দিগুন উদ্দীপনায়।

“ কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লপাট ”। সঙ্গীত মানুষকে স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এক বিরাট ভূমিকা রাখে। মন মাতানো দেশাত্ববোধক গান শুনে যত সহজে হৃদয়ে দেশপ্রেম পুলকিত হয় অন্য কোন উপায়ে তা সম্ভব নয়। “ হায়রে আমার মন মাতান দেশ, হায়রে আমার সোনা ফলা মাটি রূপ দেখে তোর কেন আমার পরান ভরেনা ”। সঙ্গীত মানুষের মনের জন্য ঔষধ হিসাবে কাজ করে ও উন্নতি ঘটায়। সঙ্গীতানুরাগী মানুষ কখনও অসৎ কাজগুলোতে যেতে পারেনা। বরং অসৎদের সৎ পথে নিয়ে আসে সঙ্গীত। সঙ্গীত মানব আত্মার খোরাক। মানুষের জীবন সুখ ও দু:খে নির্মিত। এমতাবস্থায় মানুষ কখনও কখনও নি:সঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন এই সঙ্গীতই তার আতœাকে প্রকৃত শান্তি দেয়। আরও কিছু সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সঙ্গীতের অবদান : যেমন- (০১) সুস্থ জীবন গঠনে সহায়তা প্রদান (০২) শ্রদ্ধা ভক্তি বৃদ্ধি করা (০৩) আতœকর্মসংস্থান অর্থাৎ বেকারত্ব দূর (০৪) ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা (০৫) উৎসবে সম্মেলনে সঙ্গীত (০৬) সন্ত্রাস দমনে সঙ্গীত (০৭) সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণ (০৮) খ্যাতি অর্জন (আন্তর্জাতিক সহ) (০৯) বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন (১০) শক্তির উৎস (১১) দু:সময়ের সঙ্গী, ইত্যাদি। আলোচনায় আমরা দেখতে পেলাম, অনেক ধরনের সামাজিক উন্নয়নের ধারায় সঙ্গীতের অবদান তুলনাহীন। অব্যক্ত ভাবের একমাত্র অনুভূতির প্রকাশ মাধ্যম। যতদিন পৃথিবীতে সুশিল সমাজের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন সঙ্গীতের স্থিতিকাল থাকবে। সুতরাং, মানব জীবনের শুরুতে সঙ্গীত ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

সুমন হাফিজ

বিভাগীয় প্রধান (সঙ্গীত বিভাগ) শান্ত-মারিয়াম একাডেমী অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজী,

উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান