শৌনক দত্ত
“আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। কথাটা যদি সত্যই হয় তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব কেন। দেশের মধ্যে যতগুলি সুযোগ আছে ইংরেজ তাহা নিজের দিকে টানিবে না, ইংরেজকে আমরা এতবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কী কারণ ঘটিয়াছে।
মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই– আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে– অতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।
হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনোমতেই নিষ্কৃতি নাই। ”রবীন্দ্রনাথের এই লেখা পড়তে পড়তে মৃত্তিকা অস্থির হয়ে ওঠে।কিছুক্ষণ আগেও তার ধারনা ছিলো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার জন্য ইংরেজরাই দায়ী এই উপমহাদেশের নিরপেক্ষ মাটিতে।রবীন্দ্রনাথকে পড়ার পর তার মনে হচ্ছে বৃটিশেরা আমাদের মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে এমন ভাবার কোন সুযোগ বা যুক্তি নেই। বৃটিশেরা দু’শ বছর ভারতবর্ষ শাসন করে জেনে গেছিলো, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের দুর্বল স্থান কোনটি, কোথায় আমাদের লাগে। আমাদের কাতরতা কোনটি নিয়ে বেশি, কী করলে আজীবন আমাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার চর্চা কখনো শেষ হবে না। তারা উপযুক্ত স্পর্শকাতর স্থানটুকু চিহ্নিত করে ব্যবহার করেছে মাত্র। চিঙ্গারি গরমই ছিলো, শুধু আগুনটুকু ঠুকে দিয়েছে তারা।
একটু একটু করে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে মৃত্তিকার জানালার ওপার থেকে ভেসে আসে গোধুলির ফিসফাস।কফির মগ থেকে পোড়া গন্ধ।ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে মৃত্তিকার মনে হয় আজ একটু দাদুর কাছে যাওয়া দরকার।তাকে জানতে হবে।দাদুই পারবে তার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে।
বাইরের কুয়াশা পেরিয়ে মৃত্তিকা যখন ওড়নায় সন্ধ্যা নিয়ে এলো টিভিতে তখন কার গলায় যেন উচ্চারিত হচ্ছে-
একটি সংখ্যালঘু বাড়ি
গোপন অসুখে
ভুগছে।এখানে আর বাতাস নেই
শুধু কানাকানি,আকাশ জুড়ে বিষ
ভয়ের ঈঙ্গিত মিশে আছে
আমার জন্মের পর থেকে আজো
বাতাস নেই..বাতাস নেই..
বন্ধ দরজা জানালায় আতংক...
মৃত্তিকা কথাটা তুলতেই একগাল হাসি ছড়িয়ে তার দাদু বললেন,
অবিভক্ত বঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে দুই সম্প্রদায়কে কাছে আনবার চেষ্টা করা হয়েছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ কিছুটা এগিয়েছিলেন। তার উদ্যোগে দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে চাকরির সুযোগ-সুবিধা অর্ধেক অর্ধেক ভাগাভাগিতে তারা সম্মত হন। এই চুক্তি তৈরি হয় ১৯২৩ সালে, এর দু
’বছর পর চিত্তরঞ্জন পরলোক গমন করেন, এবং বলাই বাহুল্য ওই চুক্তি মোটেই বাস্তবায়িত হয়নি, বরং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, একের পর এক দাঙ্গা ঘটেছে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মূল কারণ দুই মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্ব, যাতে ব্রিটিশের উস্কানি খুব কাজে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা ওপর থেকে নিচে নেমেছে। নিচ থেকে ওপরে ওঠেনি।মৃত্তিকার মনে তখন প্রশ্নের বুদবুদ ছোট থেকে বড় হচ্ছে।দাদু কথার রেশ ধরেই বলতে থাকেন কংগ্রেস নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলত, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটি ছিল হিন্দু-প্রধান প্রতিষ্ঠান। গান্ধী নিজে অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু তিনি ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করতে চাননি, ফলে ধর্মীয় ধ্বনি তুলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজটা মোটেই বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। কংগ্রেসে কট্টর সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন লোকেরা ছিল এবং তারাই শেষ পর্যন্ত মূল শক্তি হয়ে ওঠে, পরে তারা গান্ধীকে পর্যন্ত হত্যা করে। ওদিকে মুসলিম লীগ তো মুসলিমদের প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে উঠেছে, তার নেতা জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, অর্থাৎ ভারতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতি এই মতবাদের ওপর তার রাজনীতিকে দাঁড় করিয়েছিলেন। কংগ্রেস ও লীগ উভয়ের রাজনীতিই হয়ে দাঁড়াল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।
মৃত্তিকার চোখ দরজা পেরিয়ে রেইনট্রির ফাঁকে ঝুলে থাকা চাঁদ আর তার আলোয় আটকে যায়।কথারা তখন হেঁটে হেঁটে ৪৭-এ এসে দাঁড়ায়।দেশভাগ হলো ভারত হয়ে দাঁড়াল হিন্দুপ্রধান এবং পাকিস্তান মুসলিমপ্রধান। দুই রাষ্ট্রে দুই সম্প্রদায়ের প্রাধান্য এমন প্রবল যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে সংখ্যাগুরুর সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হবে, এটা মোটেই সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার পূর্বতন যে ভিত্তি ছিল সেটা আর রইল না। দ্বন্দ্বের শেষ হলো। কিন্তু তবু যে সাম্প্রায়িকতা শেষ হয়ে গেল না তার কারণ কী?মৃত্তিকার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে দিতে দেখে একফালি মেঘ ঘিরে আসছে চাঁদের দিকে।
কারণটা হলো বৈষয়িক লালসা। আরো স্পষ্ট করে বললে সম্পত্তির লোভ। সম্পত্তি বলতে এক্ষেত্রে জমি, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, সুযোগ-সুবিধা সব কিছুই বোঝাবে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা সংখ্যালঘুদের উৎখাত করে তাদের সম্পত্তি দখল করতে তৎপর হয়ে উঠল। আসলে এ হচ্ছে দুর্বলের ওপর প্রবলের অত্যাচার। প্রবল, অর্থাৎ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা, দুর্বলের অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি কেড়ে নিতে থাকল। ব্যাপারটি ছিল লুণ্ঠন, কিন্তু তার ওপর একটা আচ্ছাদন দেওয়া হলো, সেটা ধর্মীয়। ধর্মীয় আচ্ছাদনে দুটো সুবিধা। এক. এতে লুটপাটের ব্যাপারটাকে পবিত্র কর্তব্য বলে সাজানো যায়। দুই. ধর্মের জিগির তুললে মানুষের মধ্যে উন্মাদনাও তৈরি করা সম্ভব হয়।
রাতের নির্জনতা চোখে মেখে মৃত্তিকা হাঁটতে থাকে।বুকের ভেতর কথারা সমাধান খুঁজে ফিরে।তার মনে হয়
নিম্ন বর্গীয় মানুষের মনুষ্যত্বকে হাজার বছর ধরে পদদলিত করে, খ্রীস্টান অর্থোডক্সি ও ক্রীতদাস প্রথার মাধ্যমে, শোষণ বঞ্চনা-দীর্ঘশ্বাস এবং ধর্মীয় ত্রাসের ভিত্তির উপর রোম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে, এক সময় ঐ স্বর্গের মধ্যে ফাটল ধরে । খ্রীস্ট ধর্মের দোহাই দিয়েও
‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের’ স্বর্গরক্ষা সম্ভব হয়নি । ভারতবর্ষে সনাতন হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রীয় বিধান, ব্রাম্মণ রাজন্য ও পুরোহিততন্ত্রের শোষণ, প্রতিপত্তির স্বার্থে, নিম্ন বর্গীয় মানুষকে ও নারীকে অত্যন্ত অমর্যাদা, অবমাননা ও নিষ্পেষণের ফলে ভারতীয় সমাজ স্থবির, নির্জীব ও শক্তিহীন হয়ে গিয়েছিল । এবং সংঘশক্তি ও সংঘচেতনা গড়ে ওঠার বাস্তব শর্ত না থাকায় প্রথমে পারসিক-আফগান-তুর্কী ও পরে ইংরেজ এবং অন্যান্য বিদেশী শক্তির পক্ষে ভারতবর্ষে এসে অতি সহজে এখানকার রাজশক্তিকে পরাভূত করতে পেরেছিল ।রোম সাম্রাজ্যের পতন, ভারতবর্ষের উপবিবেশীকরণ, এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, দেশের সম্পদে ও সমস্যায় দেশের অধিবাসীদের সম্মানজনক, দায়িত্বপূর্ণ ও যথোচিত অধিকারযুক্ত অংশগ্রহণ অধিকার স্বীকৃতি না থাকলে তাদের কাছ থেকে কর্তব্য চেতনা, জাতীয় ঐক্যের চেতনা, বিশ্বাস ও আস্থা প্রত্যাশা করা যায় না । যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার অভিবাসীদের চাকর-বাকরীসহ ধর্মীয় স্বাধীনতা, ভোটের ও নির্বাচনে দাঁড়ানোর তথা রাজনীতি করার অধিকারসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বসবাস করার সম্মানজনক ব্যবস্থা করেছে-এর পেছনে কারণ হিসেবে মূলত তাদের উপরোক্ত ঐতিহাসিক দূরদৃষ্টি ও শিক্ষা কাজ করে থাকতে পারে । সাম্রাজ্যবাদ খারাপ হলেও আধুনিক পূজিবাদী ব্যবস্থার এগুলি ভালো দিক । তাদের দেশের থিংক ট্যাংক জ্ঞানী পণ্ডিতগণ সব দেশের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেন । ইতিহাস পাঠ ও অনুসন্ধান একারণেই এত গুরুত্ববহ ।মৃত্তিকার মন বারবার বলতে থাকে বরং আমরা মেনে নিতে শিখি, জাতিগতভাবে বংশানুক্রমে আমরা সাম্প্রদায়িক মনোভাব ধারণ করি, লালন করি। সমস্যাটা মেনে নেয়া বা চিহ্নিত করা সমাধানের পথ খোঁজার প্রথম ধাপ। অসুখ ধরা পড়লে চিকিৎসার পন্থা ঠিক করা যায় আর আরোগ্য লাভের পথে এগোনো যায়।মন মানে মৃত্তিকা মানে না,তার মনে হয় সমাধান আছেই।কিন্তু প্রতিকার কি?
সময় অনুক্ষণ হাঁটে তার পায়ে ধুলো ওড়ে না।গত কয়েকদিন ধরে মৃত্তিকা এই বই সে লেখায় প্রতিকার খুঁজে বেরিয়েছ।ডাইরির পাতায় টুকে রেখেছে তথ্য,সেগুলো সাজিয়েছে।অনেক জানা হয়ত বাকী তবু সে কফি মগে চুমুক দেয় আর লেখতে থাকে,
স্বাতন্ত্র্যবাদ ও ঐতিহ্য চর্চার নামে আন্তঃগোষ্ঠী, আন্তঃরাষ্ট্র, আন্তঃধর্ম, জাতিতে-জাতিতে এমনকি আন্তঃসম্প্রদায়ে এক প্রকার বন্য সংকীর্ণ ও বদ্ধ আচারনিষ্ঠা এবং অন্ধ ঐতিহ্য-সংস্কার মানুষকে করে তুলেছে যন্ত্রের মতোই চিন্তাহীন-জিজ্ঞাসাহীন; এবং নিজ সংস্কৃতি-অভ্যাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে কারো অমিল নতুনত্ব-অভিনবত্ব দেখলেই তার প্রতি বর্বরের মতো হিংসা-বিদ্বেষ বা আক্রমণের পাশবিক বৃত্তি আজ বিশ্বব্যাপী
‘মনুষ্য’ সমাজের মধ্যে বিরাজমান । খ্রীস্টান-অধ্যুষিত বসনিয়া-হার্সাগোভিনায় ব্যাপক মুসলিম নিধনযজ্ঞ ঘটেছে, তার প্রধান কারণ ছিল ধর্মবিদ্বেষ ও একচেটিয়াভাবে সম্পদ-ব্যবসা-চাকুরী ভোগের আকাঙ্খা ।স্বাতন্ত্র্যবাদের জীবন্ত লৌকিক-মনস্তাত্ত্বিক উদাহরণ কি ? ‘ওই লোক আমার মত নয়, অতএব আমার দলের নয়; সে শয়তান’; ‘ওই ব্যাটা ধর্মদ্রোহী অবিশ্বাসী, বড় বেশী যুক্তির কথা বলে-কাজেই ওই ব্যাটা কাফের, তাকে হত্যা করা আমার পবিত্র-ধর্মীয় অধিকার’ । খেয়ালই করছে না যে কথিত ‘কাফেরের’
রাষ্ট্রীয়-নাগরিক-মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হল কিনা ! এজন্যেই ধর্মের ও
‘রাজনৈতিক লাভ-প্রতিপত্তিলোভী ধর্মীয় নেতাদের’ অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত থাকতে হয় অমুসলিম সম্প্রদায়ের এবং মুক্ত চিন্তার মানুষের সমাধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে, যেমনটি য়ুরোপে-যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে চার্চকে রাষ্ট্র থেকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে । পাকিস্তানের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান থাকলে তথা ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার তরে সমান’-এই নিশ্চয়তা থাকলে কাদিয়ানীরা ১৯৬৬ সনে বর্বর হত্যাযজ্ঞের স্বীকার হতোনা । বাংলাদেশে ’৭৫-এর পর থেকে হিন্দুর সংখ্যা কমে যে প্রায় পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক অথবা ‘জিম্মীর’ মতো মানবিক অধিকারহীন হয়ে বছরের পর বছর নিরাপত্তাহীন ও হামলা-নির্যাতন-বর্বরতার শিকার হতে হলো, তার মূলে কারণ হিসেবে কাজ করেছে ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা গঠনে উপজাতি ও অমুসলিমদের ধর্ম-বর্ণ-নাগরিক অধিকারের নিরাপত্তা ও সমাধিকারের যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল, জিয়াউর রহমান এসে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্থগিত করে মুক্তিযুদ্ধের মৌল স্তম্ভের উপর কুঠারাঘাত করায় । ধূর্ত এরশাদ এসে
‘রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম’-কে সংবিধানে সংযোজন করায় শুধু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া এবং ফয়সালা হয়ে যাওয়া জাতিরাষ্ট্রিক মৌল ভিত্তির(foundation) উপরই আঘাত করা হয়নি, বরং তা ছিল অঙ্গিকারভঙ্গের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদর্শের বিচ্যুতি ও জাতিসত্তার অস্বীকৃতির নামান্তর । যার বর্তমান ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অন্তর্গত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও অমুসলিম বাঙ্গালীদের ‘রক্ষাকবচ আইনগ্রন্থ’ সংবিধানের ফাঁক দিয়ে তাদের জীবন-সম্পদ, সম্ভ্রম এবং মানবাধিকারের নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত ভূলুন্ঠিত হওয়া ।‘সে আমার দেশীয় নয়, অতএব, সে বিজাতী, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী’………ইত্যাদি সমাজে ধর্মে জাতে রাষ্ট্রে মিল না হলেই সন্দেহ করা, শত্রু ভাবা-এই স্বাতন্ত্র্যবুদ্ধিজাত হিংসাই হচ্ছে সাদা কথায় বর্ণবাদ-বিচ্ছিন্নতাবাদ-উগ্র জাতিবাদ, যা ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয় যুগে যুগে দেশে দেশে । যার প্রকাশ দেখা গেছে পাকিস্তানে ‘কাদিয়ানী হত্যাযজ্ঞে’; সাম্প্রদায়িক রুপ গ্রহণ করা ফ্যাসিবাদি দাঙ্গায়; নাৎসিবাদের জার্মানীতে ইহুদী গণহত্যায়; বসনিয়া-হার্সাগোভিনায় মুসলিম গণহত্যায়; আফ্রিকার হুতু ও টুট্সিদের মধ্যে গোত্র বা জাতিগত দাঙ্গায়; সুদানে গৃহযুদ্ধে ইসলামিস্ট মিলিশিয়াদের দ্বারা নির্বিচারে খ্রীস্টান সংখ্যালঘু এবং বর্তমানে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে নির্বিচারে মুসলিম সংখ্যালঘু হত্যা ইত্যাদি । স্বাতন্ত্র্যতা আজ হারিয়েছে তার মৌলিক সংজ্ঞা-বৈচিত্র্যতা-নিজস্বতা-বহুমুখীতা ও বহুর মধ্যে ঐক্য-সমন্বয় । বর্তমানে এটি হচ্ছে গ্রহণবিমুখতা-অনুদারতা, অসহিষ্ণুতা ও কূপমণ্ডুকতার অপর নাম কিংবা প্রতিশব্দ । যেন ধর্মনিরপেক্ষতায় অযৌক্তিক অনাস্থা-অবিশ্বাস, এমনকি প্রয়োজনে বিকৃত মিথ্যাচার(“ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ করা হচ্ছে ধর্মহীনতা”‘ধার্মিক’
দাবীদারদের চিরকালীন অজস্র সত্যবিকৃতির এটি মাত্র একটি দৃষ্টান্ত) এবং সাম্প্রদায়িকতার উঁচু মাত্রা ও পাল্লা দিয়েই ধার্মিকতার ওজন ও গুরুত্ব নির্ধারিত হবে । বিজাতিবৈর কিংবা পার্শ্ববর্তী বহুধর্ম-কৃষ্টিবিশিষ্ট দেশের প্রতি অকারণ ও যুক্তিহীন ঈর্ষা অবজ্ঞা ও অকৃতজ্ঞতাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদী আবেগের নাম । দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে পরশ্রীকাতরতা এবং একটি ব্যর্থ আধা-মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধ-ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় সহযোগিতায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগসাজস করে রাষ্ট্রটিকে ভাঙ্গনের চক্রান্ত করা-দেশী বা লোকজ বাংলায়
‘ল্যাং মারার চেষ্টা’ বা শত্রুতা সাধন । কোথায় তবে বৈশ্বিক চেতনা, আন্তর্জাতিকতা এবং দেশ কাল গোত্র-জাতি-ধর্মের উর্ধ্বে উঠে সর্বজনীন-বৈশ্বিক উদার মানবতাবাদ ! কবিগুরু রবিঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানের আবেদন কি আমাদের হৃদয়ে আর রেখাপাত করে না, উদার-সংস্কৃত-পরিশীলিত হয়ে, আলোকিত হয়ে ‘বিশ্বের মানুষ’, ‘সকল দেশের মানুষ’ হতে আর উদ্বুদ্ধ করে না ! ঃ আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, মনের মাঝে বিশ্বলোকে পাবি সাড়া ।মৃত্তিকা পড়তে থাকে।সমাধানের পাতায় তার মনে হয় লিখে দিতে মানবতার সঠিক বানান,যার প্রতিশব্দ হবে কেবল,কেবল ভালবাসা.............
শ্যামনগর,দমদম
২০.১১.২০১৬
তথ্যসূত্রঃ
১. রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর;
2. ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সুরজিত দাশ গুপ্ত
৩. মৌলবাদের অর্থনীতি, ড. আবুল বারকাত; ৪. মৌলবাদ বিষয়ে শাহ্রিয়ার কবীরের বেশ কিছু
প্রবন্ধ;৫. সংস্কৃতি ভাবনা, আহ্মদ শরীফ; ৬. বঙ্গভঙ্গ ও সমকালীন বঙ্গসমাজ, কমল চৌধুরী;
৭. য়ুরোপের ইতিহাস ঃ দ্রষ্টব্য মধ্যযুগের য়ুরোপে ইনকুইজিশনের অন্ধকার যুগের ইতিহাস-ধর্মীয়
সন্ত্রাস-বর্বরতা ও মৌলবাদের ভয়ঙ্কর রুপ ও তার পরিণাম । ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণের
ক্ষেত্রে ইতিহাসের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার ভূমিকা; ৮. যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসঃ যুক্তরাষ্ট্রে
মৌলবাদের উৎপত্তি ও শক্তিবৃদ্ধির কারণ ।