সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ১৯৮৮ সালের ০১ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের উত্তর উড়ার চর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জেড এম এ মাজেদ পেশায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মা হাসনে আরা আদর্শ গৃহিণী। ছয় ভাই-এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ছোটগল্প লেখক হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, কলাম, শিশুতোষ গল্প ও সাহিত্য সমালোচনা লিখে থাকেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকসহ প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর লাভ করেন।
২০০৭ সালে দৈনিক দেশবাংলার মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর দৈনিক সকালের খবর, বাংলাবাজার পত্রিকা, করতোয়া, সাপ্তাহিক বিশ্লেষণ, দৈনিক সুবর্ণগ্রাম এবং ব্রেকিংনিউজে কাজ করেছেন। নিয়মিত ফিচার লিখেছেন কালের কণ্ঠ, যুগান্তর, সমকাল, যায়যায়দিন, মানবকণ্ঠসহ কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে। বর্তমানে অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে সহ-সম্পাদক পদে কর্মরত। এ ছাড়াও তিনি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ চিন্তাসূত্রের সহযোগী সম্পাদক এবং লিটলম্যাগ রচয়িতার সহকারী সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
ছোটগল্পের জন্য তিনি সুনীল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া কালকিনি প্রেসক্লাব সম্মাননা, কালকিনি কলেজ বাংলা বিভাগ সম্মাননা, এসইএল লেখক সম্মাননা, লেখকবাড়ি পুরস্কার, রকমারি সংবাদ স্টার অ্যাওয়ার্ড, এসবিএসপি-আরপি ফাউন্ডেশন সাহিত্য সম্মাননা প্রাপ্ত হন। পাশাপাশি ছাত্রজীবনে আবৃত্তি এবং অভিনয়ে একাধিক পুরস্কার লাভ করেন।
তার গল্পগ্রন্থ ‘সার্কাসসুন্দরী’, ‘ নিশিসুন্দরী’ ও ‘সুন্দরী সমগ্র’। তার কাব্যগ্রন্থ ‘ মিথিলার জন্য কাব্য’ ও ‘ তুমি চাইলে’। সম্পাদনা করেছেন তরুণ লেখক সাদাত হোসাইনের সাক্ষাৎকার সংকলন ‘আমার আমি’। এ ছাড়া ‘ অগ্নিকাণ্ড সতর্কতা ও নির্বাপণ কৌশল’ তার সচেতনতামূলক গ্রন্থ।
সম্প্রতি তার সাহিত্যচর্চা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন সাহিত্যবার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি শব্দনীল-
১. শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আপনার বিচরণ লক্ষণীয় এবং পেশায় একজন সংবাদকর্মী। নিজের কোন পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন-
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আমি প্রথমত পেশাগত পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারণ পেশাই আমাকে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যচর্চা আমার নেশা। ছেলেবেলা থেকেই চর্চা করে আসছি। ফলে পেশাগত জীবনে যা-ই করি না কেন, ছেলেবেলার সেই নেশাটি ছাড়তে পারি না। শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিচরণ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ এখনো উপন্যাস লিখে শেষ করতে পারিনি। তবে আপনার ধারণা অমূলকও নয়; আগামী বইমেলায় পাঠক হয়তো উপন্যাসটিও পেয়ে যাবেন।
২. কালকিনি থেকে ঢাকার রাজপথ কতটা ভেঙে-গড়ে আজকের সালাহ উদ্দিন মাহমুদকে তৈরি করেছে-
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: মূলত আমাকে তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে কালকিনি। আমার জন্ম ও শিক্ষা কালকিনির মাটিতেই। বলতে পারেন, একরকম পরিণত হয়েই তবে কালকিনি থেকে ঢাকা এসেছি। আমার যা কিছু অর্জন, সবই কালকিনির দান। আমার শিল্প-সাহিত্যচর্চার সূতিকাগার বলতে পারেন কালকিনিকে। কালকিনি থেকেই আমার উচ্চতর ডিগ্রি, সাহিত্যচর্চা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাংবাদিকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। দীর্ঘ সাত বছরে তা ফলবান হয়েছে। ঢাকায় এসে এই অর্ধ যুগে শুধু তার ফসল পাচ্ছি। তবে ঢাকার রাজপথ আমার উপলব্ধিতে পরিবর্তন এনেছে। জীবন বোধ পাল্টে দিয়েছে। দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধকে শানিত করেছে। আমার কোমল হৃদয়কে ইট-পাথরের মতো কঠিন করেছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কৌশল শিখিয়েছে। এমনকি আমার ভবিষ্যৎকে মজবুত গাঁথুনি দিচ্ছে ঢাকা। বাকি জীবনও হয়তো ঢাকার বাতাস গায়ে মেখে কাটিয়ে দিতে হবে।
৩. কবিতাকে বলা হয় কালের ভাষা। শূন্য দশকে এসে এই ভাষা কোনো কারণে জটিল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় কি?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আমার মনে হয়, ভাষা জটিল হচ্ছে না। জটিল হচ্ছে আমাদের ভাবাবেগ। জটিল হচ্ছে আমাদের কল্পনাশক্তি। তবে কবিতায় আমি দার্শনিক তত্ত্বের চেয়ে দৃশ্যপট দেখতে পছন্দ করি বেশি। যেমনটি চর্যাপদে পেয়েছি। পেয়েছি মহাকাব্য, মঙ্গলকাব্য বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তণেও। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও অকপটে দৃশ্যপট ভেসে উঠেছে। তাদের কবিতাকেই মনে হয় একেকটি গল্প। কিন্তু এখন অনেকেই নিজেকে জীবনানন্দের অনুসারী দাবি করেও কবিতার ভাবাবেগ জটিল করে ফেলছেন। কতগুলো পাখি, প্রজাপতি, ঘাস, লতা-পাতা একত্রিত করে জঞ্জালের স্তূপ বানিয়ে ফেলছেন। যে কবিতায় নেই কোনো আবেগ, নেই কোনো কাহিনি। শুধু শব্দের পরে শব্দ বসিয়ে পাগলের প্রলাপ রচনা করা আর কি। তারা আবার বলেন, কবিতার ভাষা সবাই বোঝেন না। তাদের কবিতা না-কি উচ্চমার্গীয়। তারা কালজয়ী হতে চান। অথচ নিজের সময়টাকেই তারা ধরে রাখতে পারেন না। পৌঁছতে পারেন না পাঠকের কাছেও।
৪. ষাট থেকে নব্বই দশকের কবিতা, গল্প, গদ্যে যতটা জীবন্ত বা সঞ্জীবনী শক্তির প্রাচুর্যতা আমরা দেখতে পাই শূন্য দশকে এসে ঠিক অতটা পাচ্ছি বলে মনে হয় কি?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: প্রথমেই বলে নেই, আমি দশকে বিশ্বাসী নই। কাউকেই আমি দশকের বেড়াজালে আটকাতে চাই না। কাল বা যুগ হিসেবে আমরা আধুনিক। বলতে পারেন, অতিমাত্রায় আধুনিক। ষাট থেকে নব্বই দশকে যেসব কারণে শিল্প-সাহিত্যচর্চা হয়েছে; এখন সেভাবে হচ্ছে না। তখন একের পর এক উপলক্ষ সামনে এসে হাজির হয়েছে। শিল্পী-সাহিত্যিকরা সেসব বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। এখন আমরা সেই ফুল-পাখি-নদী-আকাশ নিয়ে পড়ে আছি। নতুন কোনো উপলক্ষ খুঁজে পাচ্ছি না। হয়তো বুকে সাহসও সঞ্চার করতে পারছি না। তাই তো সেই সঞ্জিবনী শক্তি আমাদের মধ্যে নেই। আমরা লিখেই যাচ্ছি; কিন্তু সেই লেখা পাঠকের অন্তরে দাগ কাটছে না। এমনকি কাউকে প্রেম নিবেদন করতে হলেও রবি, নজরুল বা জীবনানন্দের কাছে হাত পাততে হয়। এখনো সেইসব কবিতার আবেদন শেষ হয়ে যায়নি। ফলে নতুন কবিতা বা সমকালীন কবিতা এখনো পাঠককে ছুঁতে পারেনি। হয়তো ভবিষ্যতে এসময়ের কবিতা পাঠককে ছুঁয়ে ফেলবে। তখন পাঠক স্মৃতিকাতর হয়ে শূন্য দশকের কবিতাকে খুঁজে নেবে।
৫. পাঠক কী চায়, সেই ভেবে লেখা উচিত বলে মনে করেন? না-কি প্রাণ কী চায় সেই ভেবে?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: পাঠকের কথা চিন্তা করে লিখলে নিজের লেখক সত্তা সেই লেখায় থাকবে না। তবে কখনো কখনো পাঠক চাহিদার কথাও চিন্তা করতে হয়। তবে লেখকের মন যা চায়, তা-ই লেখা উচিত। লেখায় প্রাণ থাকতে হবে। প্রাণহীন লেখা পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে না। লেখায় অবশ্যই বার্তা থাকবে। লেখকের দর্শন থাকবে। মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা থাকবে। তবেই লেখা মানোত্তীর্ণ হবে। পাঠক তো কত কিছুই চাইবে। একজন লেখকের পক্ষে কি পাঠক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব? না-কি কোনো লেখক পেরেছেন কোনো কালে? এই যে হুমায়ূন আহমেদ এতো জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তিনি কি পাঠকের সব চাহিদা পূরণ করতে পেরেছেন? কিংবা হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, শাহাদুজ্জামানরা পাঠক ধরার জন্য কি লিখেছেন? তাই আমার মনে হয়, আমার মন যা চাইবে, আমি তা-ই লিখবো।
৬. হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন, ‘মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে : কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।’ আপনারও কি তা-ই মনে হয়?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সেটাই তো হওয়ার কথা। আমরা কার জন্য লিখি? মানুষের জন্য। আর কবিতা তো মানুষের কথাই বলে। আবার মানুষই কবিতাকে কণ্ঠস্থ করে রাখে। সুখে-দুঃখে, প্রেমে-বিরহে, প্রতিবাদ-বিপ্লবে কবিতা হয়ে ওঠে মানুষের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৭. অনলাইন সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অভিযোগ আছে ‘মানহীনতা’ নিয়ে। সাহিত্যচর্চার সহজলভ্যতার জন্য এমন অভিযোগ উঠছে বলে আপনার মনে হয় কি?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: অবশ্যই অভিযোগ সত্য। এখন মানহীন লেখার সংখ্যাই বেশি। আমি কাউকে সাহিত্যচর্চায় নিরুৎসাহিত করবো না। তবে বলবো, সব কিছুরই যখন মান বিচার করা হয়, তখন সাহিত্যের মান নিয়েও ভাবা উচিত। অনলাইনে সাহিত্যচর্চা ইতিবাচক দিক। তবে যত্রতত্র সাহিত্যচর্চা মানহীনতার দিকেও নিয়ে যাচ্ছে। আজকাল ফেসবুকেও সাহিত্যচর্চা হয়। সেটি একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। ফেসবুকের সাহিত্যচর্চা অনেকটা নিজের ডায়েরি বা খাতায় লিখে রাখার মতো। এসবের মান নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু অনলাইন নিউজ পোর্টাল বা ওয়েব ম্যাগ যখন মানহীন সাহিত্য প্রকাশ করে; তখন খুব কষ্ট হয়। সাহিত্য এতটা সহজলভ্য বিষয় নয়। শ্রম এবং সাধনার বিষয়। তাই অনলাইনে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড বজায় রাখা উচিত।
৮. আপনি গল্প-কবিতা লিখছেন, সঙ্গে শিশুসাহিত্য মননে তাল মেলাচ্ছেন কী করে?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আমি যেহেতু কথাকার। সে হিসেবে শিশুসাহিত্যের দু’একটি শাখায় কিঞ্চিত পদচারণা আছে। তবে তা খুব বেশি নয়। আমি এ পর্যন্ত আটটি শিশুতোষ গল্প লিখেছি। যা বিভিন্ন পত্রিকা, অনলাইন বা সাহিত্যপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। গল্পগুলো আবার কোনো না কোনো উপলক্ষে লেখা। এর কোনোটা আবার সম্পাদকের অনুরোধেও লিখেছি। এ ছাড়া একটি এনজিওতে কাজ করার সময় কয়েকটি শিশুতোষ মঞ্চ নাটকও লিখেছিলাম। তবে সেগুলো এখনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি। এভাবেই প্রয়োজনে তাল মিলিয়ে যাই।
৯. কখনো কি মনে হয়েছে, কবিতা লিখতে গিয়ে গল্প দুর্বল হচ্ছে বা কবিতা লেখার পরে শিশুসাহিত্যে যে বিষয়টি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে চাচ্ছেন, কিন্তু পারছেন না-
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: না, এমনটি কখনো মনে হয়নি। আমি যখন যে কাজটি করি, তখন কেবল তাতেই মনোনিবেশ করি। কবিতার সময় কবিতা, গল্পের সময় গল্প, শিশুসাহিত্যের সময় শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধের সময় প্রবন্ধ, নাটকের সময় নাটক নিয়েই ভাবি। যখন একটি শাখায় কাজ করি; তখন অন্য শাখায় বিচরণ করতে যাই না। কাজটি শেষ হয়ে গেলে নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করে অন্য কাজে অগ্রসর হই।
১০. সাহিত্যচর্চা কেন করছেন?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: অল্প কথায় এটি একটি জটিল প্রশ্ন। তবে উত্তর কিন্তু সহজ। উত্তর হচ্ছে- ভালো লাগে তাই। আসলে জগতে যা কিছুই আমরা করি, ভালো লাগা থেকেই করি। যে রমণিকে ভালোবাসি, তাকে প্রথমে ভালো লাগে। তারপর ভালোবাসি। এরপর তাকে পাওয়ার জন্য উতলা হই। লেখালেখি বা সাহিত্যচর্চা আসলে একটি নেশার মতো। ছাপার অক্ষরে নিজের নামটি দেখতে পাওয়ার বাসনা থেকেও সাহিত্যচর্চা হয়। কখনো কখনো নির্মল আনন্দও খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক না বলা কথাও বলে দেওয়া যায়। বলতে পারি, সাহিত্যচর্চা আমার কাছে নেশার মতো। আস্তে আস্তে আসক্ত হয়েছি। কিন্তু এখন আর ছাড়তে পারছি না।
১১. এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে-
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনাকেও ধন্যবাদ গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন করার জন্য। পাঠককে ধন্যবাদ ধৈর্য্য নিয়ে এতক্ষণ সঙ্গে থেকে পড়ার জন্য। আয়োজকদের ধন্যবাদ আমাকে বিশেষ সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। সবার জন্য ভালোবাসা ও অশেষ শুভ কামনা রইল।