ছোটকাগজ
লিটল ম্যাগাজিন বা সাহিত্যের ছোট কাগজ কি? এর প্রচার, প্রকাশ বা ব্যপ্তি কিংবা প্রাপ্তিই বা কত বড় এটা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলতঃ ছোটকাগজই বাংলা সাহিত্য সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছে। কোন কবি-সাহিত্যিকদের কোন লেখা বা প্রকাশনা গ্রন্থাকারে সৃষ্টি বা মলাটবন্দী হবার আগে সহজলভ্য হয়ে পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেয় ছোটকাগজ। স্বল্প পরিসরে স্বল্প সময়ে অল্প লেখকদের লেখা নিয়মিত ভাবে প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্য সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছে এ ছোট কাগজ তা আজ সর্বজন স্বীকৃত। এমনকি কালের গতিতে এ ধরনের কাগজকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে সাহিত্যের নানা শাখা, প্রশাখা। গল্প, কবিতা, ছড়া, আলোচনা, সমালোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাক্ষাতকারও ইদানিং বেশ জায়গা করে নিয়েছে।
লিটল কেন ? আকারে ছোট বলে ? প্রচারে ক্ষুদ্র বলে? সব কটাই সত্য। কিন্তু এগুলোই সব কথা নয়; ঐ ‘ছোটো’ বিশেষণটাতে আরো অনেকখানি অর্থ পোরো আছে। বোধ করি বুদ্ধদেব বসুর লিটল ম্যাগাজিন ধারণা এতদপ্রসঙ্গে যুক্ত হতে পারে। আমরা ছোটকাগজ হিসেবে ‘একবিংশ’, ‘নিসর্গ’, ‘ধূলিচিত্র’, ‘ অমিত্রাক্ষর’, ‘লোক’, ‘ শালুক’, ‘চিহ্ন’, ‘পড়শি’, ‘শব্দ’, ‘ভাস্কর’, ‘দোআঁশ’, ‘পুনশ্চ’ জাতীয় কাগজগুলোকে দেখি বস্তুত স্বভাবধর্মে এরা ‘লিটল ম্যাগাজিন’ নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন থেকে যায় ছোট কাগজ আর লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কি ?
এখন ছোটকাগজ সম্পাদকদের কে কাকে ল্যাঙ মেরে কতখানি উপরে উঠতে পারে চলছে তার প্রতিযোগিতা ? কেউ গুণী লেখকদের লেখা দিয়ে, কেউ ঝঁকঝকে প্রচ্ছদ মুদ্রণ করে আবার কেউবা আকৃতিগত কলেবর বৃদ্ধি করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন। বর্তমান সাহিত্যের ছোটকাগজের এমন দশা। তারপরও বাংলা সাহিত্যকে যে ছোটকাগজই অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা অকপটে সকলেই স্বীকার করেন।
এক সময় আমাদের দেশে চন্দ্রবিন্দু, সবুজপত্র, কল্লোল, ‘কালি ও কলম’, ‘প্রগতি’, ‘ ধূপছায়া’, ‘পরিচয়’, ‘পূর্বাশা’, ‘কবিতা’,‘স্বাক্ষর’, ‘সাম্প্রতিক’, ‘ কণ্ঠস্বর’ ছোটকাগজ উল্লেখযোগ্য ছিল। পরবর্তীতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে ‘পূর্বমেঘ’, ‘বিপ্রতীক’, ‘কালান্তর’, ‘উল্কা’, ‘শ্রাবন্তী’, ‘অচিরা’, ‘বহুবচন’, ‘উত্তরণ’, ‘কিছুধ্বনি’, ‘রূপম’, ইত্যাদি ছোটকাগজ যোগ হয় আমাদের সাহিত্য জগতে। ফলে ছোটকাগজের বদৌলতে বাংলা সাহিত্যাঙ্গণ আরও একধাপ এগিয়ে যায়।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সাপ্তাহিক/পাক্ষিক বিশেষ সংখ্যা (ম্যাগাজিন) প্রকাশ করে তাই বলে সেসব ম্যাগাজিন কিন্তু ছোটকাগজ না। আকারগত বিবেচনায় ‘লিটল ম্যাগাজিন’ অবশ্যই ‘ছোটকাগজ’ হতে পারে। কিন্তু চারিত্র বিচারে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ আলাদা। যেকোন দৈনিকের সংকল্প হয় বাণিজ্যিক ভাবনায়; কাটতির হিসেব-নিকেশে। সর্বশ্রেণীর মানুষের সন্তুষ্টি বিবেচনা করতে হয় দৈনিককে। নিজের বলতে তেমন নেই; সবই বাণিজ্যের। সব‘ছোটকাগজ’ই ‘লিটল ম্যাগাজিন’ নয়। সুবিমল মিশ্রর মতে, ‘লিটল ম্যাগাজিন হচ্ছে সাহিত্যের বিশিষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গি, বেপরোয়া, রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা সাহিত্যে যা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে।’ অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা স্বতন্ত্র সংজ্ঞা তৈরি করতে সহায়ক। সবাই যখন ‘লিটল ম্যাগাজিন’ শব্দটি ব্যবহার করতে হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয় ব্যাপারটি কেমন যেন বেঢপ হয়ে ওঠে। আকারে ছোট কিন্তু চরিত্রে অনেকটাই আপোসবাদী কাগজগুলোকেও কি আমরা তবে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বলবো। ফরমায়েশি আর চেনামুখের বৃত্ত থেকে সরে দাঁড়ানোর সদিচ্ছাটাই ছোটকাগজের সম্পাদকদের আরও বেশি করে উপলদ্ধি করতে হবে।
এটা কিন্তু ঠিক যে আকারগত বিবেচনায় ‘লিটল ম্যাগাজিন’ ‘ছোটকাগজ’ হতে পারে কিন্তু স্বভাবগত দিক থেকে তা ভিন্ন। লিটল ম্যাগাজিন বললেই বোঝা গেলো যে জনপ্রিয়তার কলঙ্ক একে কখনো ছোঁবে না, নগদ মূল্যে বড় বাজারে বিকোবে না, কিন্তু হয়তো কোনো-একদিন এর একটি পুরনো সংখ্যার জন্য গুণিসমাজে উৎসুকতা জেগে উঠবে। সেটা সম্ভব হবে এ জন্যই যে, এটি কখনো মন জোগাতে চায়নি, মনকে জাগাতে চেয়েছিলো। চেয়েছিলো নতুন সুরে নতুন কথা বলতে; কোনো এক সন্ধিক্ষণে যখন গতানুগতিকতা থেকে অব্যাহতির পথ দেখা যাচ্ছে না, তখন সাহিত্যের ক্লান্ত শিরায় তরুণ রক্ত বইয়ে দিয়েছিল-নিন্দা, নির্যাতন বা ধনক্ষয়ে প্রতিহত হয়নি। এই সাহস, নিষ্ঠা, গতির একমুখিতা, সময়ের সেবা না-করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টাই লিটল ম্যাগাজিনের মূলধর্ম। ভালো লেখা বেশি জন্মায় না, সত্যিকারের নতুন লেখা বিরল; আর শুধু দুর্লভের সন্ধানী হলে পৃষ্ঠা এবং পাঠক-সংখ্যা স্বভাবতই কমে আসে। অর্থাৎ আমরা যাকে বলি সাহিত্যপত্র, খাঁটি সাহিত্যের পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন তারই আরো ছিপছিপে এবং ব্যঞ্জনাবহ নতুন নাম।’ ইংরেজি-বাংলা অভিধান আমাদের সহজলভ্য। তাতে ‘লিটল’ অর্থ ‘ছোট’ আর ‘ম্যাগাজিন’ অর্থ ‘পত্রিকা’ বা ‘কাগজ’। এমনটি বিবেচনায় বোধ করি ‘লিটল ম্যাগাজিন’ ‘ছোটকাগজ’ হয়েছে। ভুলটা সেখানেই। আমরা নিশ্চয় ‘রিয়েল’ মানে ‘আসল’ আর ‘স্টিক’ মানে ‘লাঠি’ জানা সত্ত্বেও ‘রিয়েলিস্টিকে’র অর্থ ‘আসললাঠি’ বলি না। তেমনি আকার বিবেচনায়ই লিটলের মূল জায়গা মোটেও হতে পারে না। প্রমাণিত সত্য যে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ তার স্বভাবধর্ম নিয়েই ‘লিটল ম্যাগাজিন’। বিভিন্ন ধরণের শিক্ষাালয়ে বা সংগঠনের বিশেষ বিশেষ দিনে এক ধরনের সাময়িকী বা ভাঁচপত্র প্রকাশ করা হয় যার মাধ্যমেও সাহিত্যচর্চা আমাদের চোখে পড়ে । এদেরকে ছোট করে দেখে মোটেও উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
ভাঁজপত্রের মাঝেও লুকিয়ে থাকা অনেক সাহিত্য সম্ভাবনাময় মুখগুলো বেরিয়ে আসে এবং আগামীর লেখক হতে উৎসাহ পায়। ভাঁজপত্রে লিখতে লিখতে এক সময় তার ব্যপ্তি বা পরিসর বৃহৎ হতে থাকে অতঃপর সে খুঁজে নেয় একটি লিটল ম্যাগাজিনÑশিল্পসাহিত্যের ছোটকাগজ, বিচিত্রা কিংবা দৈনিক। প্রথিতযশা কোন কবি-সাহিত্যিকই মনে হয় বাদ যাবে না যারা ভাঁজপত্র বা লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন নাই। বস্তুত প্রায় সকল সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের হাতেখড়িই হচ্ছে ভাঁজপত্র, লিটল ম্যাগাজিন। এ দিক বিবেচনা করে ভাঁজপত্রের অবদান অনস্বীকার্য। অনেকের মতে, ভাঁজপত্র বেশির ভাগ গ্রামগঞ্জের নবীন সাহিত্যপ্রেমীরা অল্প ব্যয়ে স্বল্প পরিসরে অনিয়মিত ভাবে প্রকাশ করে থাকেন যা জাতীয় পর্যায়ে প্রচার বা প্রকাশনায় স্থান পায় না। যদিও ভাঁজপত্রের প্রকাশনা আবার নিয়মিত বা অনিয়মিত বলতে কিছু নেই।মুদ্রণ জগতের অনেক উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের সুবাদে একটি মলাটবন্দি ছোটকাগজ বের করা অনেকটাই সহজ। সেই ক্ষণেও ভাঁজপত্রের প্রয়োজনীয়তা কি? ভাববার বিষয়। একজন লেখকের লেখক হয়ে উঠবার, পাঠকের দৃষ্টিতে পড়বার প্রাথমিক সূত্র-সন্ধানতো ভাঁজপত্রই দেয়। সাহিত্যচাষীদের চোখে সাহিত্যের হাতেখড়িই মূলতঃ শুরু হয় ভাঁজপত্র, দেয়ালিকা বা দেয়ালপত্রিকা, স্কুল ম্যাগাজিন বা বিশেষ কোন ক্রোড়পত্র থেকে। জনৈক কবি-সাহিত্যিক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, একজন লেখক নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যের কাগজে, গ্রন্থে বা বিশেষ সংখ্যায়-ক্রোড়পত্রে নিয়মিত থাকেন এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সাহিত্যে ‘ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি, শস্যের চেয়ে টুপি বেশি’ বহুল প্রচলিত, পরিচিত এবং বিশ্বাস্যও। আমাদের এ্যতো এ্যাতো কাগজের ভীড়ে সাহিত্যের আদর্শিক জায়গাটা কোথায় ? এটাই এ সময়ের সবচে’ বড় প্রশ্ন ?
লিটল ম্যাগাজিন যে কোনো দেশের যে কোনো জাতির সাহিত্যচর্চার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এসব ম্যাগাজিনের মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, তরুণ লেখকদের পরিচিতি, সাহিত্য নিয়ে নানা রকমের আলোচনা-সমালোচনা করা হয়। বাংলা ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে লিটল ম্যাগাজিন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এখনও বিশেষ বিশেষ দিবস কে স্মরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেশ কিছু ছোট কাগজ প্রকাশিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রকাশকদের সংখ্যা। কারণ অনেক প্রকাশকরা আছেন যারা পেশাগত কারণে প্রকাশনা চালিয়ে যাচ্ছেন আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র ব্যবসায়ীক দিক বিবেচনা করে খ্যাত-অখ্যাত কিংবা পাইরেসী কপি প্রিন্ট করে দেদারছে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, অনেক প্রকাশনা সংস্থা নবীন-তরুণ লেখকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে বিজ্ঞাপন প্রচার করে এবং গ্রন্থ প্রকাশের নাম করে হাতিয়ে নেয় হাজার হাজার টাকা। আবার অনেকের স্ক্রীপ্ট নিয়ে নিজেদের কারও নামে বা স্বীকৃত কোন লেখকের নামে চালিয়ে দেয়া হয় অনায়াসে। ফলে এক দিকে যেমন প্রকৃত লেখক তার লেখার স্বত্ব হারালো অপর দিকে নামী কোন লেখক কঁচি/নবীন লেখকের লেখা তার নামে প্রকাশিত হওয়ায় পাঠক সমাজে অবমূল্যায়িত হলো। খ্যাত লেখকের গ্রন্থ বলে কথা, প্রকাশনী সংস্থা নিজের সুবিধা ঠিকই আদায় করতে পেল সহজেই।
এমনও চোখে পড়ে যে সাহিত্য সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই অথচ তিনি বড় মাপের ছোটকাগজ সম্পাদনা করছেন। অনেকে আবার সমাজের কাউকে কাউকে বিশেষ স্বীকৃতি দিতে অন্যের লেখা কপি করে নামমাত্র পরিবর্তন করে তাদের নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এ ঘৃণ্যতম কাজটি সহজে করে দিচ্ছে বিভিন্ন অসাধু ছোটকাগজের সম্পাদকরা। যার লেখা প্রকাশিত হয়েছে অনেক সময় দেখা যায় সেসব লেখকরা নিজেই জানে না। শুধু কি তাই তার নামে যে লেখা প্রকাশিত হয়েছে তাও লেখকের নিজের না। সেসব ব্যক্তিদের সাহিত্যিক-কবি বানানোর ঠিকাদারিত্বে তকমা আঁটাচ্ছে ছোটকাগজের কিছু সম্পাদক। লেখার মানের চেয়ে বাণিজ্যের ব্যাপারটি সেখানে প্রাধান্য পায়। বিভিন্ন অঞ্চল হতে চেনামুখ গুরুত্ব পায়। এটি শুধু আমাদের দেশেই নয় গোটা বিশ্বে একই দশা। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের এ অবস্থা এখন অনেক নগন্য হলেও এক সময় যে বিস্তৃত হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায় ?