কেলেঙ্কারির জের ধরে এবার দেওয়া হচ্ছে না সাহিত্যে নোবেল।
তবে একটি সংগঠন দিয়েছে ‘বিকল্প নোবেল’
ফি বছর এই সময়টাতে আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গন থেকে আমাদের দেশের সাহিত্যপাড়া—সবখানে সাহিত্যে এবার নোবেল কে পেলেন তা নিয়ে খুব হইচই চলে। ফিলিপ রথের এ বছর পাওয়া উচিত ছিল, আমোস ওজকে কেন দিল না, হারুকি মুরাকামি কী দোষ করেছিল, আদুনিস বাদ পড়ল কেন, মিলান কুন্ডেরার আরও ১০ বছর আগেই পাওয়া উচিত ছিল, সালমান রুশদী তো পাবেনই—এই সব আলাপ-আলোচনা খুব জমে ওঠে।
এ বছর সেই সম্ভাব্য আলোচনায় কয়েক মাস আগেই জল ঢেলে দিয়েছে সুইডিশ একাডেমি। গত মে মাসেই একাডেমি বলে দিয়েছে, এ বছর এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে না। কারণটাও খুব লজ্জাজনক। যাঁরা পুরস্কারজয়ীদের মনোনীত করেন, সেই জুরিদের একজন কবি কাতারিনা ফ্রসতেনসনের স্বামী প্রখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী জ্যঁ ক্লদ আর্নোর যৌন কেলঙ্কারি এবং দুর্নীতির জের ধরে পুরো জুরিবোর্ডের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে গিয়েছিল। বোর্ডের সভাপতি সারা দানিউস পদত্যাগ করেছিলেন। পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাওয়ার পর একাডেমি বলেছিল, নোবেল কমিটির ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। মানুষের আস্থায় চিড় ধরেছে। বিশ্বাসের সেই ফাটল ঠিক করতে আগে জুরিবোর্ডের সংস্কার করা দরকার। সেটা সংস্কার করার পর আগামী বছর ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের পুরস্কার একসঙ্গে দেওয়া হবে।
সুইডিশ একাডেমি হতাশ করলেও তবে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যানুরাগীদের দারুণ খবর দিয়েছে ‘নিউ একাডেমি’ নামের একটি নতুন সংগঠন। তারা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের আদলে একটি ‘বিকল্প নোবেল’ দিয়েছে। পুরস্কারটির নাম ‘নিউ একাডেমি প্রাইজ ফর লিটারেচার’। এটি অনেকটা জনগণের পক্ষ থেকে দেওয়া পুরস্কার।
এই পুরস্কারকে নোবেলের চেয়ে একেবারে কম কিছু বলে মনে করা হচ্ছে না। নিউ একাডেমি অবশ্য বলেছে এই পুরস্কার এ বছরই প্রথম এ বছরই শেষ। তারা আর এই পুরস্কার দেবে না। এই সংগঠনও এ বছরের পর বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার মানে একটা প্রবল কর্তব্যবোধ থেকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। এটি যিনি পেয়েছেন তাঁর নাম ম্যারিস কোন্ডি। দক্ষিণ ক্যারিবীয় সাগরে ফ্রান্স শাসিত গুয়াদেলুপি নামের একখণ্ড দ্বীপ আছে। কোন্ডি সেই দ্বীপের মানুষ। ৮১ বছর বয়স হলেও এই নারী এখনো বেশ চনমনে। মূলত ঔপন্যাসিক। ফরাসি ভাষায় লেখেন। ২০টির মতো উপন্যাস আছে তাঁর।
কোন্ডির প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বলে নিই, কেন এই ‘বিকল্প নোবেল’।
কেন এই ‘বিকল্প নোবেল’
আলেকজান্দ্রা পাসকালিদু নামের রোমানিয়ান বংশোদ্ভূত এক সুইডিশ নারী সাংবাদিক সুইডিশ একাডেমি–সংশ্লিষ্ট ক্লদ আর্নোর যৌন ও অর্থ কেলেঙ্কারি খবর নিয়ে কয়েক মাস ধরে প্রতিবেদন করছিলেন। একাডেমি যখন ঘোষণা দিল যে তারা এ বছর সাহিত্যে নোবেল দেবে না, তখন বিষয়টি তিনি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। তিনি প্রথমে হতাশ হয়েছেন। সুইডেনের নাগরিক হিসেবে তিনি বিব্রত বোধ করেছেন। পরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গত সপ্তাহে তিনি একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছেন, ‘আমি ভেবে দেখলাম, একজন-দুজনের কুর্কমের জন্য লেখকদের কেন খেসারত দিতে হবে? একজনের চরিত্র স্খলনের জন্য পুরস্কারই বাতিল হয়ে যাবে—এটা কেমন কথা?’
এই ক্ষোভ থেকেই পাসকালিদু এক শ জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বিকল্প নোবেল দেওয়ার কাজ শুরু করলেন। তাঁদের মধ্যে কবি-লেখক, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী—এ রকম লোকজন আছেন। তাঁরা ঠিক করলেন, ‘নিউ একাডেমি প্রাইজ ফর লিটারেচার’ নামে একটি পুরস্কার দেবেন। পুরস্কারের অর্থমূল্য হবে ১০ লাখ ক্রোনার (১ লাখ ১২ হাজার ডলার)। পুরো অর্থ এই এক শ জন এবং অন্যরা চাঁদা হিসেবে দিয়েছেন। ১৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।
‘নিউ একাডেমি প্রাইজ’-এর বিজয়ী নির্বাচন আর নোবেল পুরস্কারের বিজয়ী নির্বাচনের মধ্যে তফাত ছিল। মোট তিনটি ধাপে বিচারকাজ হয়েছে। প্রথম ধাপে ‘নিউ একাডেমি’ থেকে লেখক মনোনয়ন করার জন্য সুইডেনের সব গ্রন্থাগারকে অনুরোধ জানানো হয়। তারা বিশ্বের যেকোনো স্থানের যেকোনো লেখককে মনোনয়ন করার প্রস্তাব করতে পারবে। শর্ত হলো, যে লেখকের নাম প্রস্তাব করা হবে, তাঁর কমপক্ষে দুটি বই থাকতে হবে। এর মধ্যে অন্তত একটি বইকে গত ১০ বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এমন হতে হবে।
সুইডিশ বিভিন্ন গ্রন্থাগার থেকে শতাধিক লেখকের নামের প্রস্তাব আসে। এই তালিকায় ছিলেন তিন কানাডীয় নারী লেখক মার্গারেট অ্যাটউড, অ্যান কারসন ও কিম থুয়ে, ভারতের অরুন্ধতী রায়, জাপানের হারুকি মুরাকামি, কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়ংগোসহ আমেরিকার ১৩ ও সুইডেনের ১২ জন লেখক।
এই লেখকদের বিষয়ে অনলাইনে ভোট হয়। ৩২ হাজারের বেশি ভোট পড়ে। এই ভোট থেকে নির্বাচন করা হয় ৪ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা। এই তালিকায় ছিলেন ফ্রান্সের ম্যারিস কোন্ডি, ব্রিটিশ লেখক নীল গাইমান, ভিয়েতনামে জন্মগ্রহণকারী কানাডিয়ান লেখক কিম থুয়ে এবং জাপানের হারুকি মুরাকামি। অবশ্য সংক্ষিপ্ত তালিকা ঘোষিত হওয়ার পর মুরাকামি নিউ একাডেমিকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। তিনি বলেন, এ বিষয়টির সঙ্গে তিনি নিজেকে জড়াতে চান না। তিনি লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান।
মুরাকামিকে বাদ দিয়ে নিউ একাডেমির জুরিরা বাকি ৩ জনের মধ্য থেকে কোন্ডিকে জয়ী হিসেবে বেছে নেন।
নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার বিরাট পার্থক্য হলো, এই পুরস্কারজয়ী নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নোবেল কমিটি যেভাবে জুরিদের দিয়ে অতি গোপনে বাজটি করে, এখানে তা হয়নি। এখানে জুরিদের পাশাপাশি সাধারণ পাঠকদের অংশগ্রহণও ছিল।
পুরস্কারের উদ্যোক্তা আলেকজান্দ্রা পাসকালিদু একটা মজার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাহিত্য কি শুধু একাডেমিক বোদ্ধাদের সম্পত্তি? গ্রন্থিক আর অধ্যাপকরা ছাড়া সাধারণ মানুষ সাহিত্য বোঝে না? কয়েকজন পণ্ডিত এসে বলে দিলেন অমুক পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য, আর তিনি পেয়ে গেলেন। এমন ব্যবস্থার প্রতিবাদেই আমরা সাধারণ সাহিত্যবোদ্ধাদের মত নিয়েছি।’
তবে তিনি বলেছেন, এটি নোবেল কমিটিকে লজ্জা দেওয়ার জন্য নয়। একেবারে আন্তরিক কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে তাঁরা এই আয়োজন করেছেন। আগামী ৯ ডিসেম্বর পুরস্কারটি তাঁরা ম্যারিস কোন্ডির হাতে তুলে দেবেন।
ম্যারিস কোন্ডি উবাচ
পুরস্কার ঘোষণার পর যখন ম্যারিস কোন্ডির সঙ্গে সংবাদমাধ্যম কথা বলতে গেছে, তখন তিনি ভীষণ উচ্ছ্বসিত। বললেন, ‘কেবল হারিকেন বা ভূমিকম্পের সময়ই এই গুয়াদেলুপির কথা গণমাধ্যমে আসে। আমি দারুণ খুশি যে এ রকম একটা সম্মানজনক খবরের সঙ্গে আমার ভূখণ্ডের নাম উঠে আসবে।’
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সুবাদে জানতে পারছি, দেসিরাদা এবং সেগু—এই দুটি উপন্যাসের জন্য ফ্রান্সে কোন্ডি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর অন্য উপন্যাসগুলোও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উপনিবেশ এবং উত্তর উপনিবেশকালে ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন তাঁর লেখার মূল উপজীব্য। উপনিবেশের শিকার হলে একটি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি কীভাবে ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা বিকৃত হতে থাকে, সে বিষয়টিই তাঁর লেখায় উঠে আসে।
এখন কোন্ডির দিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন বিশ্বের অগণন পাঠক। আর এই দৃষ্টির মধ্য দিয়ে কোন্ডির দেশ গুয়াদেলুপি উঠে আসছে অনন্য উচ্চতায়।