সায়মার সংগ্রাম- কাজী আমেনা আশরাফ
আজ
সায়মার মেয়ের বিয়ে। সারা বাড়ি অতিথিদের আনাগোনায় সরগরম। সায়মাকে একাই সব
দিক সামাল দিতে হচ্ছে। বাবুর্চি হিসেবে হাস্মতকে পেয়েছে বলে কিছুটা
স্বস্তি। নিজের সাধ্যমতো বিয়ের আয়োজন সায়মা নিজের বাড়িতেই করেছে। কোন কিছুর
কমতি রাখেনি। মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার অনেক দিনের স্বপ্ন। পার্লার থেকে লোক
এসেছে মেয়েকে সাজাতে। কাজের ফাঁকে মেয়েকেও এক নজর দেখে এসেছে। কি যে সুন্দর
লাগছে মেয়েটাকে! কিন্তু কাছে যাবার সাহস হয়নি। পাছে চোখে পানি চলে
আসে এই ভয়ে। জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলে-মেয়েদের
সামনে কখনো চোখের পানি ফেলেনি। অবশ্য শুধু সন্তান কেন, অন্য কারও সামনেই
চোখের পানি ফেলাটা সায়মা পছন্দ করে না। কান্না একান্তই নিজস্ব ব্যাপার এবং
সেটা শুধু জায়নামাজে বসে আল্লাহ্-এর সামনে করা যায়। অন্য আর কারও সামনেই
নয়। বিভিন্ন কাজের মাঝে অতীতের নানা স্মৃতি তাকে অন্যমনস্ক করে ফেলছিল।এরই
মধ্যে বাইরে বর এসেছে, বর এসেছে বলে আওয়াজ ভেসে এলো। বিয়ের বিভিন্ন
আনুষ্ঠানিকতা শেষে এক সময় এলো কন্যা বিদায়ের পালা। সায়মা যথারীতি ভিতরের
আলোড়ন উপেক্ষা করে মৃদু হেসে মেয়েকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত। রিমিও মায়ের
চোখের দিকে তাকিয়ে সব বুঝল। মায়ের এই রূপ তার খুব চেনা। গাড়িতে উঠে মায়ের
হাতের উষ্ণ মৃদু চাপ আর না বলা কথা যেন তাকে নতুন জীবনে চলার সাহস জুগিয়ে
গেল।
রাতে বালিশে মাথা
রেখে সায়মা এপাশ ওপাশ করছিল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বার বার মন আজ
থেকে ছাব্বিশ বছর আগের দিনে ফিরে যাচ্ছিল। খাবার টেবিলে সায়মা ওর বাবা-মাকে
জানিয়েছিল মিনহাজকে বিয়ে করার কথা। কিছু সময় কারও মুখেই কোন কথা ছিল না।
শেষ পর্যন্ত বাবাই নিরবতা ভাঙলেন। 'সম্ভব না'-বলে খাবার ফেলে উঠে গেলেন। মা
শুধু শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। এক অফিসে চাকরির সুবাদে বাবার সাথে
মিনহাজের মামার পরিচয়। নিজের স্বার্থের বাইরে কিছুই ভাবতে চান না। এমন
লোকের সাথে আত্মীয়তার কথা বাবা ভাবতেই পারতেন না। শেষ পর্যন্ত মেয়ের জেদ
মেনে নিতে বাধ্য হন। বিয়ের পর ঢাকার শ্যামলীতে সায়মার সংসার শুরু।
এক
একটি দিন যেন স্বপ্নের মতো মনে হতো। প্রায় প্রতিদিনই মিনহাজ অফিস শেষে
ফেরার পথে ওর জন্য কিছু না কিছু আনতই। হোক সেটা একটা গোলাপ, এক ঠোঙা বাদাম
অথবা একটি বই। ছুটির দিনের বিকালে রিকশা করে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো,সংসদ
ভবনের লেকের পাশে বসে কথার ফুলে যে কত মালা গাঁথা হয়েছে তার হিসেব নেই। এরই
মাঝে সায়মার কোল জুড়ে এলো রিমি। মেয়ের জন্মে মিনহাজ এতটাই খুশি হয়েছিল যে,
অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়েছিল শুধু মেয়ের কাছাকাছি থাকবে বলে। রিমির
জন্মের দু'বছর পর রুমনের জন্ম। এরই মাঝে মিনহাজের প্রমোশন হলো। ওর কাজের
ব্যস্ততা বাড়ল। সায়মাও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল।
ইদানিং
মিনহাজের কথাবার্তায় আগের সেই ভালোবাসার সুর খুঁজে পাচ্ছিল না। সে যেন
কাজে একটু বেশিই ব্যস্ত। প্রায় রাতেই সায়মা ঘুম ভেঙে দেখত মিনহাজ ফোনে কথা
বলছে। জিজ্ঞেস করলে বলতো অফিসের ফোন অথবা এড়িয়ে যেত। চিরচেনা মানুষটা একটু
একটু করে কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছিল। রাতে সায়মার মনে হতো সে একটা পাথরের পাশে
শুয়ে আছে। যার ভেতর কোন আবেগ নেই, উত্তাপ নেই। এক বাড়িতে তবু যেন কত দূরে।
সম্পর্কটা দিন দিন শুধুমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে
পড়ছিল। একদিন আলমারি গোছাতে গিয়ে মিনহাজের কোর্টের পকেটে কিছু চিঠি পেল,
যার প্রতিটি লাইন ওর বিশ্বাসে ঘুন পোকার অস্তিত্বের জানান দিল। সায়মার
পায়ের নিচের মাটি যেন নড়ে উঠেছিল। এত দিনের চাপ ধরা অভিমান যেন কান্না হয়ে
দু'চোখ উপচে উঠেছিল। কতক্ষণ কেঁদেছিল জানে না। নিজেকে স্থির করতে একটু সময়
লেগেছিল, কিন্তু সে তা পেরেছিল। পরের সিদ্ধান্ত নিতে তাকে দু'বার ভাবতে হয়
নি। পরেরদিন সকালে ছয় বছরের রিমি আর চার বছরের রুমনকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে
এসেছিল। তিন বছর আগে হার্ট এ্যাটাকে মায়ের মৃত্যুর আট মাস না যেতেই বাবা
মারা যান। মায়ের হঠাৎ চলে যাওয়াটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। এক
বছরের মাথায় বাবা-মা দু'জনকে হারিয়ে মনে হয়েছিল তার মত দুর্ভাগা আর দু'টো
নেই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সেই ভালো ছিল। অন্তত নিজের এই পরাজিত মুখটা নিয়ে
বাবার সামনে দাঁড়াতে হয়নি।
বাবার গাছের খুব শখ ছিল।
টিনশেড বাড়ির চারপাশ ঘিরে আছে নানা রকম গাছ। যেখানে যা পেয়েছেন, তাই তিনি
লাগিয়েছেন। গাছ যেন তার আর একটি সন্তান। পরম ভালোবাসায় তিনি তাদের যত্ন
নিতেন। এলাকায় সায়মাদের বাড়িটা বাগানবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। এমন কোন ফল গাছ
নেই, যা ওদের বাড়িতে বাবা লাগাননি। আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের দেওয়ার পরও মা
বছরে আট-নয়শ জোড়া নারকেল বিক্রি করতেন। বাড়ির ফল বিক্রির টাকা মা জমিয়ে
রাখতেন। মায়ের কাঠের বাক্সের বিভিন্ন জায়গায় থাকতো ভিন্ন ভিন্ন ফল বিক্রির
টাকা। মায়ের মজার একটি স্বভাব ছিল। কখনও কোন প্রয়োজনে মা তার ফল বিক্রির
টাকা থেকে ধার করতেন। আবার প্রয়োজন মিটে গেলে তিনি সে ধার শোধ করতেন। মা
মারা যাবার পর সায়মা ওই বাক্স থেকে ছাপ্পান্ন হাজার টাকা পেয়েছিল। যেটা ওর
বাবাও জানতেন না। ছেলেবেলা থেকে দাদীর কাছে মায়ের বিভিন্ন গুণের কথা শুনে
শুনে বড় হয়েছে। ও সব সময় মায়ের মত হতে চাইত। আজ বাবা-মাকে খুব মনে পড়ছে।
বার বার দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল।
মিনহাজ যেন মুক্তি
পেয়েছিল। বেশ কিছুদিন পার হলেও সে একবারও ছেলে-মেয়েকে দেখতে আসেনি। সায়মা
সময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। শুরু করেছিল এক নতুন সংগ্রাম। অস্র
হিসেবে ব্যবহার করেছিল, ছেলেবেলায় মায়ের কাছে শেখা নকশীকাঁথার কাজ। নিজেকে
শামুকের মত শক্ত এক খোলসের ভেতর আবদ্ধ করেছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিল সব
প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার। সন্তানদের কখনও তাদের বাবা
সম্পর্কে একটিও মন্দ কথা সে বলেনি। সে চায়নি বাবাকে ওরা অসম্মান করুক।
প্রথম প্রথম বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেও, এক সময় হয়ত ওরা ওদের মায়ের অপারগতা
বুঝতে পেরেছিল। অনেক ঝড় সায়মা মোকাবেলা করেছিল, কিন্তু ভেঙে পরেনি। এক
অদ্ভুত ব্যাপার ও অনুভব করতো। যখনই কোন সমস্যার মুখোমুখি হতো,রাতে ঘুমের
মাঝে বাবা মাকে স্বপ্ন দেখত। এক সময় ঠিকই সমস্যার সমাধান হয়ে যে। এটিকে সে
আল্লাহর রহমত ও বাবা মার দোয়া ভেবে মানসিক শক্তি পেত। রিমি যখন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল,তখন সায়মার মনে হয়েছিল সে সফল। আল্লাহর ইচ্ছায় আজ
সে সত্যিই এক স্বার্থক মা। রিমি এক সরকারি কলেজের প্রভাষক। রুমন ঢাকা
মেডিকেলে ইন্টার্নি করছে।
সায়মার ছোট বেলার বান্ধবী তৃপ্তির অনেক আগে থেকেই
তার নেভাল অফিসার একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে রিমিকে ভীষন পছন্দ। রিমিরও তাতে
কোন আপত্তি না থাকায় এ বিয়ের আয়োজন। বাবা মাকে আজও ভীষনভাবে মনে পড়ছে।
মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠায় সায়মা বাস্তবে ফিরে এলো। দেখল একটি অপরিচিত
নম্বর। অনিচ্ছা স্বত্বেও মোবাইল ধরল সে। হ্যালো কে বলছেন? এর উত্তরে যে
কণ্ঠস্বরটি সে শুনল তাতে তার সারা শরীর ঝনঝন করে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু
ঘাম দেখা দিল। হাত পা কাঁপতে লাগল। এক মূহুর্ত গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের
হচ্ছিল না। চোখ দুটি জ্বালা করতে লাগল। কিন্তু এখনও সে তার সব প্রতিবন্ধকতা
দূর করে রং নম্বর বলে ফোনটি কেটে দিল।
ভাংগা উপজেলা প্রতিনিধি, সাহিত্যবার্তা।