সৈয়দ মুজতবা আলী
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রম্যরচয়িতা ও জীবনবোধের নানামুখি অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ একজন সাহিত্যিক ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী । পিতা তৎকালীন শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জের বিশিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার সৈয়দ সিকান্দার আলী ও মাতা সৈয়দ আয়তুল মান্নান খাতুনের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় । বহুভাষাবিদ এই পন্ডিত বাংলা সাহিত্যে বিবিধ ভাষার শ্লোক ও রূপক ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছেন ।
সৈয়দ মুজতবা আলী জন্মগ্রহণ করেন – সিলেটের করিমগঞ্জে, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯০৪ সালে (পৈত্রিক নিবাস হবিগঞ্জের উত্তরসুর গ্রাম) ।
বিশিষ্ট এই সাহিত্যিক শিক্ষাজীবন – ১৯২৬ সালে শান্তিনিকেতন হতে বিএ ডিগ্রি অর্জনের পর জার্মানির বর্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে ১৯৩২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি এবং মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় হতে মুসলিম ধর্মশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন ।
সৈয়দ মুজতবা আলী কর্মজীবন শুরু করেন কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজের ফরাসি ও ইংরাজি ভাষার প্রভাষক হিসেবে (১৯২৭-২৯ সাল পর্যন্ত) ।
সৈয়দ মুজতবা আলী যে সব ছদ্মনামে লিখতেন – সত্যপীর, ওমর খৈয়ম, টেকচাঁদ, প্রিয়দর্শী প্রভৃতি । তিনি যে শ্রেণির সৃষ্টিকর্মের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন – ভ্রমণ কাহিনী রচনার জন্য ।
কাজী নজরুল ইসলামের পর বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন – সৈয়দ মুজতবা আলী ।
বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ‘রম্য’ লেখক হিসেবে সুপরিচিত – সৈয়দ মুজতবা আলী ।
সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা ছাড়াও অন্য যে সব ভাষাতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন – সংস্কৃতি, ইংরেজি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান, উর্দু, ইতালিয়ান প্রভৃতি ।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিভাগের প্রভষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন – ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ।
সৈয়দ মুজতবা আলী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন – ইসলামের ইতিহাস বিভাগের রিডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।
যেসব পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন – মোহাম্মদী, চতুরঙ্গ, মাতৃভূমি, কালান্তর, আল-ইসলাম, আনন্দবাহার, দেশ, শনিবারের চিঠি, বসুমতী প্রভৃতি ।
সৈয়দ মুজতবা আলীর যে গ্রন্থটি রচনার মধ্যদিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে – দেশে বিদেশে (১৯৪৯) গ্রন্থটির মধ্যদিয়ে ।
‘দেশে বিদেশে’ তাঁর যে শ্রেণির রচনা – ভ্রমণ কাহিনী (যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে গণ্য) ।
সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ ভ্রমণ কাহিনীতে তুলে ধরেছেন – আফগানিস্তানের কাবুল শহরের বর্ণনা ।
আব্দুর রহমান, অধ্যাপক বেনওয়া, আহমদ আলী, খুদাবখশ, বগদানফ, মুইন-উস-সুলতান প্রভৃতি – দেশে বিদেশে গ্রন্থের চরিত্র । ”বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ি ময়লা ।
কিন্তু আমার মনে হয় চর্তুদিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি আর শুভ্রতর আবদুর রহমানের হৃদয়” উক্তিটি – সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে ভ্রমণ কাহিনীর ।
‘একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান বড়লোকের একমাত্র সুন্দরী মেয়ে শবনম বিপরীতে এক বাঙালি যুবকের অসম প্রেমের কাহিনী’ সৈয়দ মুজতবা আলীর যে উপন্যাসের বিষয়বস্তু – শবনম উপন্যাসের । তাঁর ‘শবনম’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় – ১৯৬০ সালে (আনন্দ বাজার প্রত্রিকায়) ।
সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত প্রথম উপন্যাস – অবিশ্বাস্য (১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়) । তাঁর রচিত ছোট গল্পের মধ্যে রয়েছে – রসগোল্লা, তীর্থহীন, পাদটীকা প্রভৃতি ।
তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে – শহর ইয়ার (১৯৫৯) ও তুলনাহীনা ।
কাবুল শহরের কাহিনী নিয়ে রচিত ‘দেশে বিদেশে’ ভ্রমণ কাহিনীটি প্রকাশিত হয় – ১৯৪৮ সালে দেশ প্রত্রিকায় ।
সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত অন্যান্য রম্য রচনা গুলোর মধ্যে রয়েছে – পঞ্চতন্ত্র (১৯৫২), ময়ূরকন্ঠী (১৯৫২), ভবঘুরে ও অন্যান্য, হিটলার প্রভৃতি ।
য়ৈয়দ মুজতবা আলী রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে – বেঁচে থাক সার্দি কাশি, পুনশ্চ, কর্নেল, বিধবা বিবাহ, মা-জননী, স্বয়ংবরা, রাক্ষসী, ক্যাফে-দে- জেনি, জলে-ডাঙায়, বড়বাবু, কত না অশ্রুজল প্রভৃতি ।
”রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়! ইতিালির দেশ র্ধম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়! উক্তিটি কোন গল্পের – সৈয়দ মুজতবা আলীর রসগোল্লা নামক গল্পের ।
সৈয়দ মুজতবা আলীর বিশেষ উক্তি – “জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়ে মহত্তর” “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে প্রিয়ার কালোচোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বই খানা অনন্ত যৌবনা..” “বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না “ প্রভৃতি ।
তাঁর গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে – চাচা কাহিনী (শ্রেষ্ঠ গল্পগ্রন্থ), টুনি মেম, ধূপছায়া প্রভৃতি । সৈয়দ মুজতবা আলী, কাজী নজরুল ইসলামের যে গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন – রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম । ’রসগোল্লা’ নামক গল্পের ঝাণ্ডুদা রসগোল্লা নিয়ে কোথায় ঝামেলায় পড়েছিলেন – ইতালির ভেনিস বন্দরে । সৈয়দ মুজতবা আলী যে সব পুরস্কার লাভ করেন – ১৯৬২ সালে আনন্দ সাহিস্য পুরস্কর, মরণোত্তর একুশে পদক ২০০৫ প্রভৃতি । সরস, মার্জিত ও বুদ্ধিদীপ্ত সাহিত্য ধারার প্রবর্তক সৈয়দ মুজতবা আলী পরলোকগমন করেন – ১১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৪ সালে ।