১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু
সেদিনই সমগ্র বাংলাদেশ, পাকবাহিনীমুক্ত হয় নি। খুলনা মুক্ত হয় ১৭ তারিখ
বিকেল নাগাদ। সে খবর আমি কলকাতা বসে পাই, রাত ৮ নাগাদ;
সঙ্গে-সঙ্গে
ঠিক করে ফেলি, কালই একবার বাড়ি ঘুরে আসি! কতকাল আর বিদেশবিভুঁইয়ে! রাত
থাকতে শ্যামবাজার থেকে বাস, বসিরহাট হয়ে সীমান্ত চৌকি ভোমরায় পৌঁছতে বেলা
১০। দেখি, দুই পারই জনমানবশূন্য, অফিসপত্তরে তালা। ভাবছি, কী করি! হঠাৎ,
যমদূত প্রায়, একজন রিক্শাওয়ালা ভাঙারিক্শা টানতে টানতে সামনে হাজির, কোথায়
যাবেন! বললাম, সাতক্ষীরা! এই জায়গার
কাছাকাছি, আমার মামাবাড়ি; বহুবার এসেছি, বেশ চেনা! যাবেন তো, কিন্তু পথঘাট
তো ল্যান্ডমাইনে ভরা, গতকালও কয়েকটা গোরু উড়ে গেছে।
সেই রিক্শা চেপে টুংটাং করতে করতে প্রাণ হাতে নিয়ে সাতক্ষীরা; বেলা তখন১।
দেখলাম, সবাই মোটামুটি টিকে আছে, আওয়ামিপন্থী বড়ো মামা, আত্মগোপনের। ভাই মন্টুকে আমার উদ্দেশ্য বলতেই, সে বলল, আজ নয় ভাই, পথ এখনো রাজাকারমুক্ত নয়। আগামীকাল দুপুরে খেয়েই রওয়না হব মটর সাইকেলে, ঘুরপথে, চুকনগর দিয়ে
দুই ভাই, সে। ভাবেই চললাম, পথের ঝঞজাট, নাই বলি; শুধু একবার পশুরের খেয়াঘাট পার হতে বলেছিলাম, ভাই রে, দজ্ক্ষিণ আমেরিকা আবিষ্কারও তুলনায় সহজ ছিল; তখন, বেশ রাত। বাগেরহাটে নিজ গ্রামের নিজ আঙিনায় মটরসাইকেল ঢোকাতে মধ্যরাত পার। মটরের শব্দে সবাই জেগে গেছে, বাতাসে সামান্য আতঙ্ক। যত জোরে সম্ভব চিৎকার করে উঠলাম, মা মা মা
চেনাকণ্ঠে, হুড়মুড় করে দরজা জানালা খুলে গেল; সামনে মূর্তিমতি মা, হাতে হ্যারিকেন, ঘিরে আছে ভাইবোন; তারা হাসবে না কাঁদবে, বুঝে উঠতে পারছিল না। কে যেন বলল, দাদি ডাকে। আমার দাদি, সবাই বলে, আমিই তার চোখের মণি, দীর্ঘকাল পক্ষাঘাতগ্রস্থ, বিছানায় বন্দি। সত্যিকার অপরাধীর মত দ্রুত হাত জোড় করে হাজির হলাম, দাদির মুখোমুখি, টেমির আলোয়, যেন কত জনমের পর। কিন্তু, দাদির তেমন নড়াচড়া নেই, উৎসাহও নেই। অবাকই হচ্ছিলাম,হঠাৎ দেখি, দাদির চোখভাঙা জল, তুই তো এলি, শেখের বেটা কই, তাকে আনতে পারলি না! আমি বিমূঢ়, হতবাক! দদাদির বেদনার বানে আমি খড়কুটো! মা, দুই হাতে দাদিকে জাপটে ধরে, এত উতলা হয়েন না মা, তিনি আসবেন। রান্নাঘরের পথে মা বলতে লাগল, গত ন মাস ধরে তোর দাদির এ্ই হাল, কী করে সামলাই
সারারাত, জেগেই রইলাম। শুধু ভাবছিলাম, দেখা হল, এক মহাকাব্যিক কাহিনি, জনম সার্থক মাগো, মরণও
সকাল, শহরে যাব, মা ডাকলেন, দেখে যা। উঠতে পারেন না, জায়নামাজে কাত হয়ে, তসবিহ হাতে ,কেঁদেই চলেছেন , আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দাও
কখন যে আমিও ভিজে গেছি , শেখের ছাওয়াল ফিরবেই, তাকে ফিরতেই হবে, না হলে বৃদ্ধাকে বাঁচাবে কে! হ্যাঁ একমাত্র তিনি, একই দেহে কারো পিতা কারো সন্তান,যিনি