আমি অপেক্ষা ক'রছি
আমি তাঁকে দেখার জন্য ১৯২০ সালে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম
প্রাণময় উজ্জ্বল দিনটি ছিলো মার্চ মাসের ১৭ তারিখ
মধুমতীর খুব তাড়া ছিলো ব'লে জোর ছুটছিলো
আর আকাশ দেখছিলো চৈত্রের দুর্দান্ত সাহসে দোল খাওয়া পাটের ডগা
নৌকায় ও হাঁটাপথে জেলা ফরিদপুর থেকে মহকুমা গোপালগঞ্জ যেতে-যেতে
আমাকে বৃটিশ ভারতের মানচিত্র শেখাচ্ছিলো
ঘরের চালের পচাখড় ও মাটির ভাঙা কলস
আমি তাঁকে দেখার জন্য
শেখ লুৎফর রহমানের বসতবাড়িতে প্রবেশ ক'রেছিলাম
আমি তাঁর প্রথম ক্রন্দনধ্বনি শোনার জন্য উদগ্রীব ছিলাম
তাঁর আগমনবার্তা অনুভব ক'রেছিলাম এ মাটির শিরা-উপশিরায়
জলবায়ু ও প্রকৃতির মগ্নমায়া ছুঁয়ে দেখেছিলাম
বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে এক নাম
শেখ মুজিবুর রহমান
আমি তাঁকে দেখার জন্য বেকার হোস্টেলের সম্মুখে অপেক্ষা ক'রেছিলাম
প্রতীক্ষা ক'রেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমপাতার আলোছায়ায়
মিছিলে ছিলাম মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তায়
জেলখানার দরোজায় দাঁড়িয়ে থেকেছি বছরের পর বছর
রোজ গার্ডেন থেকে গভর্নর ভবন অব্দি প্রতিটি ল্যাম্পোস্ট স্পর্শ ক'রেছি
দিনের সূর্য রাতের তারা সাক্ষী রেখে হেঁটেছি
পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত
গতিবিধি লক্ষ্য রেখেছি ময়দান ও মাইক্রোফোনের
তাঁকে দেখার জন্য একে-একে দফাগুলো
পাঞ্জাবির বুকপকেট থেকে বের ক'রে মেলে ধ'রেছি
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে বানিয়েছি মশাল মিছিলের শিখা
ঊনসত্তরে রেসকোর্সে একজন বঙ্গবন্ধু রক্তের শপথ উচ্চারণ ক'রলে
তাঁকে দেখার জন্য আমি মাথা উঁচু ক'রলাম
আমি তাঁকে দেখার জন্য মহাকাশের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম
আমি তাঁকে দেখার জন্য সৌরমণ্ডলে দাঁড়িয়েছিলাম
আমি তাঁকে দেখার জন্য পৃথিবীতে দাঁড়িয়েছিলাম
আমি তাঁকে দেখার জন্য বাংলাদেশে দাঁড়িয়েছিলাম
আমি তাঁকে দেখার জন্য ঢাকা শহরে দাঁড়িয়েছিলাম
আমি তাঁকে দেখার জন্য ধানমন্ডি দাঁড়িয়েছিলাম
আমি তাঁকে দেখার জন্য ৩২ নম্বরে দাঁড়িয়ে আছি
একজন মানুষ দেখার জন্য
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঊষালগ্নে
রক্তের গম্বুজের সম্মুখে
আমি অপেক্ষা ক'রছি
হাবীবুল্লাহ সিরাজী ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলায় জন্ম নেন। তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে কবিতাগ্রন্থ: দাও বৃক্ষ দাও দিন, মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি, হাওয়া কলে জোড়াগাড়ি, নোনা জলে বুনো সংসার, স্বপ্নহীনতার পক্ষে, আমার একজনই বন্ধু, পোশাক বদলের পালা, প্রেমের কবিতা, কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা, সিংহদরজা, বেদনার চল্লিশ আঙুল, ম্লান, ম্রিয়মাণ নয়; বিপ্লব বসত করে ঘরে, ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ন, জয় বাংলা বলো রে ভাই, সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না, সুগন্ধ ময়ূর লো, নির্বাচিত কবিতা, মুখোমুখি : তুচ্ছ; স্বনির্বাচিত প্রেমের কবিতা, হ্রী, কতো আছে জলছত্র, কতোদূর চেরাপুঞ্জি, কাদামাখা পা, ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই, একা ও করুণা, যমজ প্রণালী, আমার জ্যামিতি, পশ্চিমের গুপ্তচর, কবিতাসমগ্র। উপন্যাস: কৃষ্ণপক্ষে অগ্নিকাণ্ড, পরাজয়। অনুবাদ: মৌলানার মন : রুমীর কবিতা। আত্মজৈবনিক: আমার কুমার। গদ্যগ্রন্থ: দ্বিতীয় পাঠ, মিশ্রমিল, গদ্যের গন্ধগোকুল। শিশুসাহিত্য : ইল্লিবিল্লি, নাইপাই, রাজা হটপট, ফুঁ, ফুড়ুৎ, মেঘভ্রমণ, ছয় লাইনের ভূত, ছড়াপদ্য।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী ২০১৬ সালে একুশে পদক, ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৭ বিষ্ণু দে পুরস্কার, ২০১০ সালে রূপসী বাংলা পুরস্কার, সালে ২০১০ কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার পান। এছাড়া দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।