আলমিরা
মায়ের শখটার কথা মনে হলে চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে লিটনের। খুব বেশি কিছুনা। মাত্র একটি নতুন আলমিরার শখ ছিলো রাজিয়া বেগমের। পুরোনো মেহগনি কাঠের আলমিরার বিভিন্ন জায়গায় ঘুণে ধরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এ নিয়ে বাবারও চেষ্টার কমতি ছিলোনা। কিন্তু বাবা পারেননি মাকে আর কখনোই একটি নতুন আলমিরা কিনে দিতে। বড় হয়ে মাকে একটা নতুন আলমিরা কিনে দেবে- এমন একটা ভাবনা সবসময়ই মনের মাঝে পোষণ করতো লিটন।
মা যখন পুরোনো আলমিরাটার ভগ্নপ্রায় দরোজা অতি সাবধানে খুলে বিভিন্ন জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতো কিংবা বের করতো তখন তার মুখে কেমন যেন অদ্ভূত এক মমতার ছাপ লক্ষ্য করতো লিটন। আলমিরাটার মাঝের তাকে দুটো ড্রয়ারের একটিতে থাকতো বাবার বেতনের টাকা; যা বিভিন্ন খাতওয়ারী খরচ করার জন্য কয়েকটা ভাগে রাখা হতো। এই সামান্য ক'টা টাকা দিয়েই মাকে চালাতে হতো পুরোটা সংসার। অন্য ড্রয়ারটাতে থাকতো মায়ের কয়েকটি স্বর্ণের গয়না। গয়নাগুলো মা আগলে রাখতেন পরম যত্নে। মাকে ওগুলো কখনো পরতে দেখেনি লিটন। মাঝে মাঝেই ওগুলো বিক্রি করার কথা আলোচনা হতো বাবা ও মায়ের মধ্যে।
একদিন সত্যিই গয়নাগুলো বিক্রি করা হলো। লিটন যখন মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলো তখন চাষের জমিগুলোর সাথে বিক্রি করা হয়েছিলো ঐ গয়নাগুলোও। বাবা-মায়ের ঘরটাতে এখন পাশাপাশি দুটো আলমিরার সহাবস্থান। মেহগনি কাঠের ঘুণে ধরা জীর্ণ সেই আলমিরার গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে হাতিল ফার্নিচারের নতুন একটি আলমিরা। চাকরির টাকা থেকে প্রতিমাসে কিছু কিছু জমিয়ে আলমিরাটা কেনার কয়েকদিন পরই মা চলে যান না ফেরার দেশে। তার দু'বছর পর চলে যান বাবাও। মায়ের কথা মনে পড়লে লিটন মাঝে মাঝেই এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আলমিরা দুটোর সামনে। পুরোনো আলমিরাটাকে কেমন যেন মায়ের মতোই লাগে দেখতে।
দায়
আজ একটু বেশি সময় নিয়েই রাতুলকে পড়াচ্ছে আসাদ। সংসারের খরচ সামলাতে অফিস সময়ের পর দুটো টিউশনি করে সে। এটাই দিনের শেষ টিউশনি। মাসের আজ ৬ তারিখ। এখনও রাতুলের বাবা টিউশন ফি'র টাকাটা দেয়নি। আসাদও মুখ ফুটে চাইতে পারছেনা। তাই সময়টা বেশি নিয়েই অপেক্ষায় আছে টাকাটা পাওয়ার আশায়। কিন্তু দেড় ঘন্টার জায়গায় দুই ঘন্টা কেটে গেলেও কোন লাভ হলোনা। সাধারণত ৭ তারিখের মধ্যেই টাকাটা পেয়ে যায় প্রতিমাসেই। এক বুক নিরাশা নিয়েই রাতুলদের বাসা থেকে বেরিয়ে এলো আসাদ।
প্রতি মাসের ১ম সপ্তাহে বাবার ডায়ালাইসিস করাতে হয় আসাদের। খরচটা খুব বেশি কিছুনা। কিন্তু এই নভেম্বর মাসেই সবগুলো খরচের পালা যেন একসাথে মাথায় চেপে বসে। বাচ্চাদের স্কুলের ডিসেম্বর মাসের বেতন এবং পরীক্ষার ফি'র টাকা অগ্রিম দিতে হয়, আয়করটাও পরিশোধ করতে হয় এই মাসেই। তাতে বাড়তি খরচের পরিমাণটা দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার টাকা। জোগার করা গেছে ১২ হাজার টাকা। আগামীকালই বাবার ডায়ালাইসিসের তারিখ। এদিকে স্কুলের টাকাও পরিশোধ করতে হবে ১০ তারিখের মধ্যেই। তাতে এই ১২ হাজার টাকায় হবেনা। আয়করটা অবশ্য মাসের শেষ তারিখে দিলেও চলবে। কিন্তু টাকার জোগার তো হচ্ছেনা। যে করেই হোক ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।
হনহন করে হাঁটছিলো আসাদ। টিউশনি শেষে এই ২ কিলোমিটার পথ হেঁটেই বাসায় ফেরে সে। ব্যায়ামটাও হয়ে যায় আর রিক্সাভাড়াটাও বেঁচে যায়। হাঁটতে হাঁটতে গলির মোড়ে আসতেই চোখ আটকে গেলো পাশের দেয়ালের ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপনে।
"একজন ধনাঢ্য মুমূর্ষু রোগীর জন্য আগামীকাল রাতের মধ্যে ৫ ব্যাগ AB(-) গ্রুপের রক্ত প্রয়োজন। আগ্রহী রক্তদাতাগণকে সম্মানজনক আর্থিক সহায়তা করা হবে। যোগাযোগ - ০১৯১৫৩৬৯..."
বিজ্ঞাপনটা পড়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে মোবাইল নাম্বারটাতে কল করলো আসাদ। মিনিট চারেক কথা বলেই চোখ দুটো চকচক করে উঠলো তার।
পরদিন বিশেষ কারণ দেখিয়ে বসের কাছ থেকে দুপুরের পর ছুটি নিয়ে নিলো আসাদ। অফিস থেকে বেরিয়ে একটা সিএনজি অটোরিক্সা নিয়ে সোজা পৌঁছে গেলো নির্দিষ্ট হাসপাতালে। ঘন্টাখানিক পর যখন হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলো তখন আসাদের পকেটে বেশ কয়েকটি চকচকে এক হাজার টাকার নোট। চোখেমুখে ক্লান্তি থাকলেও মাথাভরা দুঃশ্চিন্তার পাহাড়টা আপাতত কিছুটা হালকা লাগছে যেন।