কবি : হারুনুর রশিদ
সে ঘ্রাণ নিয়ে ফিরছি
শুকনো জমির বুকে পানি সেচে
হালচাষের যে ঘ্রাণ,
সে ঘ্রাণ নিয়ে ফিরছি।
পুকুরের তলায় জমে থাকা পানিতে
ছোট মাছের ছুটাছুটি দেখতে দেখতে
সে তলায় আধা শুকনো কাদার যে ঘ্রাণ
সে ঘ্রাণ নিয়ে ফিরছি।
ফাল্গুনের প্রথম বৃষ্টিতে
শুকনো মাটির বুক থেকে
যে ঘ্রাণ বেরিয়ে বিমোহিত করে
সে ঘ্রাণ নিয়ে ফিরছি।
ফিরছি বেরসিক এক শহরে
যেথায় মানুষ শুধু মানুষের চোখের দিকে তাকায়
ভীষণ এক বিষন্নতা নিয়ে।
অতৃপ্ত আত্মার দর্শক
অতৃপ্ত আত্মার পরিভ্রমন রেখায় যাত্রা, তৃপ্তির সন্ধানে পৃথিবীর মাটি উলট পালট করে দেয়,
যত ছিল সজ্জিত, যত ছিল শান্ত সেথায় চলে সন্ধান যন্ত্র।
পেতাত্মার মতই দৃশ্যত অদৃশ্য এক মনোষকামনা।
ঠাই হয়নি পূর্ণতার সেই আত্মায়।
আবার পৃথিবীর বুক চিরে,
আরো কোন সুসজ্জিত ভূমির বুকে খন্তির আঘাতে ব্যগ্র।
যে আত্মায় নেই তৃপ্তির অঙ্গ, যে আত্মায় অতৃপ্তির বিশাল রঙ্গভূমি।
সে আত্মায় রঙ্গ হবে, তৃপ্তি নয়।
ঠিক আমার মত
স্বপ্নের মত কেটে যায় দিন
ঘুমাতোর স্মৃতিতে স্থান পায় -
সন্ধ্যা যাত্রার লোকাল ট্রেন, জনাকীর্ণ স্টেশন,
মানুষে ভরপুর কয়েকটি বগি। তারপর স্বল্প দূরত্বের স্টেশনে যাত্রা বিরতি।
অভিজাত আরেক ট্রেনের অপেক্ষায় সময়ক্ষেপণ।
দাড়িয়ে থাকা যাত্রীর গা বেয়ে নেমে আসে ঘাম,
তারই বা কয়েকজন নেমে যায় বিশাল করই বৃক্ষের তলায় ছায়া সন্ধানে, সিক্ত করতে সে দেহ।
লোকাল ট্রেন, সাম্রাজ্যের যত বিড়ম্বনা যত প্রটোকল, সব মেনে চলে এ ট্রেন।
ঠিক আমার মত।।
আমি লজ্জিত
শরতের শিশির সিক্ত ভোর, বদ্ধ বাতায়ন
কাঁথাই মুড়িয়ে ঘুমন্ত, মুখ তুলে দেখেছি তবে,
সেই সকাল-পুষ্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে,
যার পাপড়ির গায়ে ধূলার আঘাত।।
অঝর ধারায় শ্রাবনের দিন, খোলা জানালা
নিসঙ্গ দুটি চোখের দৃষ্টি বৃষ্টিভেজা টিনের চালে,
মৃদুবাতাসে বারবার আছড়ে পড়েছে পুষ্প-জবা
থেতলে গেছে দেহ তার, গায়ে বিধেছে পুরোনো টিনের মরিচা।।
আমি চেয়ে চেয়ে দেখেছি থেতলে যাওয়া দেহ
দেখেছি ক্ষত হয়ে ছিড়ে পড়া রক্তিম পাপড়ি।।
আমার মৃত্যুর পরেও
আমার মৃত্যুতে পৃথিবীর কোন বেদনা নেই
এমনকি তার একটা কণাও এতটুকু ভাববেনা।
গতিশীল পৃথিবীর ভ্রমন রেখায় হবেনা সামান্যতম বিচ্যুতি
দিনরাতের পালাবদলে কালের গর্ভে হারিয়ে যাব।
আমার মৃত্যুর পরে- দিন, রাত, নক্ষত্র ঠিক এমনি রবে
সেদিনও উড়বে ঘুড়ি এই বিশাল আকাশে, খন্ড খন্ড মেঘের সাথে।
উড়বে সব পাখি গাছের ডালে ডালে, আকাশে, শূন্যে, আরো শূন্যে।
উড়তে উড়তে একসময় দৃষ্টিতে অদৃশ্য হবে শঙ্খচিলও।
খেয়াপারের সব মানুষ রবে দাড়িয়ে, ঠিক যেমন আজকের পারাপারে
ব্যস্ত হাটে হাঁটবে সবে, কিনবে সব প্রয়োজনে
ভরদুপুরেও ভরাহাটে মহাজনদের সমাগম, ব্যস্ত সে যে এই হাটে।
সব হবে, আমার মৃত্যুর পরেও, ঠিক যেমন দেখছি এখনো।
ঠিক ঠিক একদিন নিশ্চিহ্ন হব, শরীলের প্রত্যেকটা অঙ্গ আর মাটি -
একাকার হয়ে যাবে, ধূলায় মিশিয়ে হয়তো উড়তে থাকবো সেদিন।
আমায় আর ডাকবেনা কেউ, আমি নিষ্প্রয়োজন।
সেদিনও হিজল গাছের ছায়া রবে, রবে ওরা সবাই শ্রান্ত
আমার মৃত্যুর পরেও সুবর্ণ মেয়েটি হাসবে- যেমনটি প্রাণ খোলে আজ হাসছে।।
ভোরের ট্রেন ও কুয়াশা
এই শীতে কুয়াশা ভেদ করে রেলের বুকে ভর দিয়ে ছুটে চলেছে দুরন্ত ট্রেন। ষ্টেশনের প্লাটফর্মে অপেক্ষমান যাত্রীসাধারণকে দেখলে বোঝা যায় যে শীতের তীব্রতা কতটা দাপুটে। দুরন্ত ছেলেটাও আজ জবুথবু হয়ে বসে রয়েছে। বৃদ্ধের গায়ে মলিন চাদরের ভাজ, চায়ের দোকানে এক কোনায় বসে রয়েছে।
ভোরের ট্রেন সবাইকে গন্তব্যে পৌঁছাবে
আজকের ট্রেনের গতি খুবই মন্থর। প্রচুর কুয়াশা। কুয়াশাভেদ করে পাহাড়সম দেখায় কয়েক গজ দূরের কদম গাছটি। জমিনের বুকে ছড়িয়ে রয়েছে কুয়াশার বিশাল এক সাদা চাদর, মৃদু বাতাসে ধীরে ধীরে উত্তরে সরে যাচ্ছে। বীজতলায় ধানের চারা কুয়াশাসিক্ত, যার ছোট ছোট পাতায় জমিয়ে রেখেছে হীরকের মত শিশির ফোটা। সদ্যচাষের জমিতে ঠাই দাড়িয়ে রয়েছে একজোড়া কানিবক। দলবেঁধে শলিকেরাও এসেছে, স্বচ্ছ জলে ওদের প্রতিবিম্ব। কঙ্কাল দেহ নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে অদূরের শিমুল গাছটি, যার নিস্তেজ ডালে উল্লাস করছে একদল ভোরের কাক। জনজীবনে স্থবিরতা নেমে আসলেও থেমে নেই কৃষক-শ্রমিক। হালচাষে নেমে পরেছে তারা। খেতচাষ, জলসেচ, ধানেরচারা রোপণ এসবই তারা করছেন এই হিম ঠান্ডার মধ্যেই। লাইনের ধারদিয়ে হেটে যাচ্ছে অর্ধউলঙ্গ দুটি শিশু, পিঠ বাঁকিয়ে একে অপরের হাত ধরে, শিশিরভেজা ঘাস মাড়িয়ে ধীরে ধীরে হাটছে তারা। তবে মিনিট পনেরো পরে মনে হল সূর্যের দেখা দিতে পারে, কুয়াশার আবরণের উপরদিয়ে উকি দিচ্ছে লাল সূর্যটা। জানান দিচ্ছে আজ জমে থাকা শিশিরে শত আলোক ছটার বিচ্ছুরণের।
হাওরে এক সন্ধ্যা
দলবাঁধা মেঘের আড়ালে আজি এ শেষ প্রভা
চুম্বন পড়েছে দিগন্তে,
পশ্চিম গগনে সূর্যের দ্যুতি, তরঙ্গ ঝিলমিল,
জলরাশির বুকে ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিশে যায় -
পৃথিবী-সিঁথির সমস্ত সিদুঁর,
রক্তিম মেঘের দেয়া মাল্য।
নিয়েছে ধার পৃষ্টে তার রক্তের বাহার
হাওরের বুকে -
এমনি সান্ধ্য - ক্ষণ!!
তোমারে কেমনে মাড়িয়ে আসবে কালোরাত্রি
কেমনে ভাঙ্গিবে এ সন্ধি
নিশিথিনীতে আজ চক্ষু বন্ধ রেখে
দেখিব নিশির কোলে এ গোধূলী
যতোক্ষণ রবে তোমারি সন্ধি মেঘের সাথে।
কার্তিকের ঝড়
গতকালের ঝড়ে অনেকটা ছিন্নভিন্ন চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে আছে কলাগাছটি। প্রগাঢ় সবুজ পাতায় সাজিয়েছিলেন তার চতুর্দিক। বৃক্ষহীন পথের এই রসালো গাছটি ছিল আশ্রয়ের একমাত্র ছায়াস্থল। এখানে যে ছাগলরা প্রতিনিয়ত ঘাস খায়, তাদের রোদস্ফুলিঙ্গ থেকে রক্ষা করে আসছিল এই গাছটি, যেমনটা ক্লান্ত পথিককেউ দিয়েছিল ছায়াশান্তি। ভগ্নচেহারায় আজ অনেকটা মলিন। দেহ -অঙ্গ থেকে খসে খসে পড়েছে স্ববর্ণ সবুজ। যে টুকু রেেয়ছে সেটুকু চিরল হয়ে ঝুলে রয়েছে যেন খোলে যাওয়া বেণির স্বঢেউয়ে মুড়ানো।
তবে পাশের ভেরেন্ডার শিশু গাছটি অনেকটা হেলে আজিকের ভোরের সূর্যকে স্বাগত জানাচ্ছে -নতুন ভাবে সাজবে বলে।।
রাতের লাল ঠোঁট
আঁধার আলোয় বেশ দৃশ্যান্তর
ভেসে উঠে তার লাল ঠোঁটদ্বয়,
সংকুচিত ঠোঁটের ভাঁজে আর
দু'কোনায় হয়েছে গাঢ়।।
আরাধ্যের ভ্রমণে নিমগ্ন দুকূল
প্রলম্বিত ঢেউয়ে নিবিষ্ট অক্টোপাস,
বাইরের আঁধার মিশে এখানে
শুষে নেয় সব লাল, দায়ী শুধু নর।।
নিঃসঙ্গ সুখ
সঙ্গীহীন চিল, তুমি নিতান্তই উড়ে যাওয়া একাকী
আকাশনীল থেকে আরো নীল, নীল সাগরে চলে যাওয়া এক পাখি।
মস্ত বটবৃক্ষের ডালে বসেছিনু যোগলে- সেদিন
হারিয়ে আজ সব, বিরহগোপনে ডানা মেলে যায় দূরে।।
সঙ্গীহীন নারী, তুমি বিশাল শূন্যতায় শুধু হাহাকার
নিভৃতচারীর পদধ্বনির নিশিভাবনায় এক মানবী।
ছিলে শতরাত্রির গোপনবার্তায়, প্রেমে প্রেমে সন্ধিতে
বিবাগীর সুরে বাজে তন্ময়-বিষাদ সুখ আজি এ লগ্নে।।